“প্রিয় দিও বিরহ”
৩৩.
দীর্ঘ এক মাস হলো মেহতিশা তাঁর বাবার বাড়িতে আছে। নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে এতোটা সময় ৷ দরকার ছাড়া রুম থেকেও বের হয়নি। মোবাইলের সিমও বদলে ফেলেছে। দর্পণ এসে অনেক চেষ্টা করেও পারেনি দুটো কথা বলে তাঁকে নিয়ে যেতে রাতে প্রচুর মাথা ব্যাথা ছিলো। একটু আগেই কুসুম মাথায় তেল দিয়ে ম্যাসেজ করে দিয়েছে। এখন হালকা ছায়ার রোদে বসে রোদ পোহাচ্ছে সে। দৃষ্টি তখনও দূরসীমানায়। ক’টা ছেলেমেয়ে গাছের নিচে বসে বেলি ফুলের মালা গাঁথছে। মনটা ওখানেই ছুটে গেছে। মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে করে সকল বাঁধা পেরিয়ে ওই সরল শৈশবে ফিরে যেতে। ব্যাপারটা ভাবতেও কেমন কেমন একটা শিহরণ অনুভব হয়। গর্ভাবস্থায় নাকি ত্বক উজ্জ্বল হয়, চুলের গ্রোথও বাড়ে। মেহতিশার গায়ের রং তো আগে থেকেই উজ্জ্বল। তবে,সত্যিই চুল আগের তুলনায় বেড়েছে। তেল মাখা চুলগুলো তাল মিলিয়ে উড়ছে ছন্দে। বারান্দার দরজায় অযাচিত শব্দে পেছনে ফিরলো সে। নিশ্চয়ই কুসুম যাওয়ার সময় দরজা খুলে চলে গিয়েছে। কে এসেছে দেখার জন্য মাথা উঁচু করে দেখলো দরজায় সৌজন্যে দাঁড়িয়ে আছে। মুচকি হেঁসে হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে আসতে বলল মেহতিশা। সৌজন্যে কী যেনো ভেবে একটু ইতস্ততবোধ করলো।
তবুও, টিমটিমে পায়ে এগিয়ে এসে পাশের মোড়ায় বসলো। মেহতিশা ওর অস্বস্তি বুঝে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘কীরে সৌজন্যে চাচা বলল তুমি নাকি ভিসার জন্য এপ্লাই করেছিস। কোন দেশে যাবি আবার?’
সৌজন্যে মুখটা নিচু রেখেই বলল,
‘জাপান। ‘
‘বেশ তো। ওখানে গিয়ে ভালো ডক্টর হয়ে ফিরে আয়। দেশের জন্য কিছু কর। কত মানুষের ইচ্ছে থাকে, কিন্তু সুযোগ হয়না। ‘
সৌজন্যে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি কিন্তু পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারতে ৷ ‘
মেহতিশা হাসলো। কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,
‘হয়নারে, বিয়ের পর কেমন একটা মানসিক পরিবর্তন চলে আসে। চাইলেও আসে না চাইলেও আসে। তখন আর বইয়ে মুখ ডুবিয়ে লেখার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। সংসারে কী করলে ভালো হবে,কোন জিনিসটা দরকার, কোনো লেকিংস আছে কিনা এসবই তখন কেন্দ্রবিন্দু হয়। নতুন মানুষদের মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া সবটাই একটা পরিবর্তন৷ খুব বেশি মেধাবী বা বইপড়ুয়া না হলে পড়াশোনাটা হয়না। আগ্রহটা লাগে। ‘
‘তোমার অনুশোচনা হয়না?’
‘কীসের জন্য ? ‘
‘এই যে দর্পণ ভাইয়াকে বিয়ে করতে তো চাওনি তুমি। এখন কী আলাদা হয়ে যাবে? ‘
‘তোর এমন কেনো মনে হলো?’
‘মনে না হওয়ার কী আছে! কতদিন হলো এইখানে আছো। দর্পণ ভাইয়া রোজ আসে, সকালে তোমার দরজার পাশে কান পেতে বসে থাকে। তুমি দরজা খোলো না, এক ঘন্টা পর সে চলে যায়। তুমি জেনেও না জানার ভান করে থাকো। এটা কী সত্যি যে অনন্য শায়েরকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করবে? ‘
মেহতিশা নিঃশব্দে হাসতে থাকলো। গাল লাল হয়ে গেছে।
‘তোকে কে বলল এসব কথা?’
‘হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে এলো। ‘
‘একটা কথা কী জানিস, সংসার হচ্ছে একটা মায়ার বাঁধন।
চাইলেও না এই রশি খুলে ফেলা যায়না। কেমন একটা পাগল পাগল লাগে। দেখিস না, কত বছরের প্রেমকে ছেড়ে মানুষ বিয়ে করে দিব্যি সংসার করে বাচ্চার বাপ মা হয়ে যায়। সবই মায়া,অভ্যাস। একটা সময় গিয়ে ভালোবাসাটাও টের পাওয়া যায়। কোথাও না কোথাও ভালোবাসাটা ঘাপটি মেরে থাকে। এই যে ঐ পাগল লোকটা রোজ আসে। কত রকমের কথা বলে! কখনো বলে আমি তার সাথে গেলে সে আমাকে কক্ষনো বকবে না, কোনো আনহেলদি খাবার খেতেও বারণ করবেনা, মেয়ে হলে নাম রাখবে আয়না। ছেলে হলে জল। কী অদ্ভুত অদ্ভুত কথা যে বলে!কখনো হেঁসে ফেলি আমি রুমে বসে। কিন্তু দরজাটা খুলি না, কেনো জানিস? তাঁর শাস্তির প্রয়োজন আছে। খুব দূরে না গিয়েও কখনো কখনো শাস্তি দেয়া যায়৷ আমি চাইলেই পারতাম তাঁকে সত্যি সত্যি ডিভোর্স দিয়ে দূরে চলে যেতে। কিন্তু এটা কী সমাধান হতো? হয়তো কেউ সাময়িক ভাবে আমার সন্তানকে নিজের পরিচয় দিতো। কিন্তু কখনো না কখনো তো আক্ষেপ হবেই। আর ঐ পাগল লোকটার মতোই বা পাবো কোথায়?ঐ লোকটা একটা পিসই আছে। কখন কী করে নিজেও জানেনা। রাগলে তুলকালাম করে রাগে৷ ভালো হলে গলে পানি হয়ে যায়। ভালোবাসলেও পৃথিবী উজার করে ভালোবাসে। আর বাকি রইলো,অনন্য শায়েরের কথা তো? হ্যা আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। কিন্তু, সব চাওয়াই কী পূর্ণতা পায়? ক’টা প্রেম এক হয়! আমি হয়তো তাঁকে তাঁর ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারবোনা। কিন্তু তাঁর ভালো থাকার দায়িত্ব তো নিতেই পারি। সে কথা দিয়েছে, নতুন করে সবকিছু শুরু করবে সে। পুরনো ক্ষত সবসময় মানুষকে খোঁচাতে পারেনা। মরার শোক ভাত মিটিয়ে দেয়। কেউ মা’রা গেলে যেমন তাঁকে ব্যতিত আমরা অন্য কাউকে ভাবতে পারিনা, কিন্তু ঠিকই প্রকৃতি তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করে দেয়। আমার শূন্যস্থান পূরণ করতেও পৃথিবীর কোনো প্রান্তে হয়তো কেউ আছে।’
সৌজন্যে প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘সবার জীবনেই আসে তিশা?’
‘হুম আসে। ‘
‘তোমার শূন্যস্থান তো আমার জীবনেও আমি টের পাই। সেই শূন্যস্থান পূরণ হয়না কেনো?’
ঘোরে ঘোরে পুরো কথাটা বলে নিজেই চুপসে গেলো সৌজন্যে। মেহতিশা সেটাকে আমলে না নিয়ে বলল,
‘সুযোগ দে, নিজেকে সব ভুলে সামনে নিয়ে যা। শূন্যস্থান কখনো কখনো সাফল্যতাও দূর করতে পারে। জীবনে প্র্যাকটিকাল থাকা খুব প্রয়োজন। প্রতিটা জিনিসেরই পজিটিভ নেগেটিভ দুটো পিঠ আছে। পজিটিভ চিন্তা করতে হবে। আর নেগেটিভ কিছু আমাদের সঙ্গে হলেও সেই মানসিক প্রেপারেশন রাখতে হবে। যেখানে যাচ্ছিস, এবং যে লক্ষ্যে সেটায় পুরো মনোযোগ দে। ‘
সৌজন্যে মৃদু হাসলো। তেমন আর কিছুই বললোনা। হাস্যজ্জ্বল মুখে একটা ছোট বক্স এগিয়ে দিলো। মেহতিশা ভ্রু কুচকে বলল,
‘এটা কী?’
‘গিফট। আমি তো আজ রাতই চলে যাবো। তুমি তো ঘরেই থাকো বের হওনা। তাই ভাবলাম আমিই দেখা করে যাই। ‘
‘এটা দরকার ছিলোনা সিজু!’
‘দরকার আছে, নতুন মেহমানকে তো আর আমি দেখবো না। তাই অগ্রিম গিফট। এছাড়া তুমিও তো কতদিন পর আমার সিজু ডাকলে! ‘
কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ােলো সৌজন্যে। মেহতিশা বলল,
‘তুইও তো কতদিন হলো আমাকে তিশাদিদি ডাকিস না!’
‘যা পারবোনা তা বলো কেনো?’
‘পারবিনা কেনো?’
‘জানিনা। ভালো থেকো। ভুল টুল হলে ক্ষমা করে দিও, খুব জ্বালিয়েছি তো তোমাকে। ‘
মেহতিশা নির্মল চোখে তাকিয়ে থাকলো। সৌজন্যের দিকে নরম কন্ঠ দিয়ে বলল,
‘এক দুইটা ভুলেরও দরকার আছে জীবনে। কোনো বড় সাফল্যের সময় অতীতের ভুলগুলো ভেবে হেঁসে ফেলাটাও তো মজার। ‘
–
সেই রাতেই বাংলাদেশ থেকে জাপানে একটা নতুন স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমালো সৌজন্যে। মেহতিশা একটা শান্তির শ্বাস ফেললো। অতীত ধরে বর্তমান নষ্ট করতে নেই। কথাটা শেষমেশ বোঝাতে সক্ষম হলো সে। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মোবাইলে টুং করে মেসেজ আসলো। চেক করে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে,
‘আমি ওই বাড়ি আসি বউজান?’
মেহতিশা রাগী ইমোজি দিয়ে বলল,
‘না।’
‘প্লিজ!তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। ‘
চলবে-
লেখনীতে-নাঈমা হোসেন রোদসী।