#আছি_তোমার_পাশে
পর্ব ১২
লেখা- #Anjum_Tuli
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ]
.
.
মানুষের জীবনে কখন কি ঘটে যায় তা আসলে কেউ বলতে পারে না। কখনো কখনো এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় যা মাঝে মাঝে জীবন লন্ডভন্ড করে দেয়।
বেচে থাকার লড়াইয়ে কেউ বা ক্লান্ত হয়ে যায়। কেউ চাহিদার সাগরে ভাসতে থাকে। যা চাই তা এখুনি চাই। কেউ বা চাহিদা পূরণে নিজের জীবনের শেষ সম্বল টুকু বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত। সংসার নামক খেলায় কেউ বা জয়ী কেউ বা অসহায়। কারো জীবন সুখ ক্ষনস্থায়ী তো কারো জীবনে সুখের দেখাই মিলে না। জীবনটা সত্যি অদ্ভুত।
তুতুলের ডাকে আমি তাকাই। রায়ানের কোলে বসে লাফালাফি করছে। বেচারা কাজটাও ঠিক মত করতে পারছে না। আমি ইচ্ছে করেই তুতুলকে ডেকে আমার কাছে নিয়ে আসছি না। আমি চাই রায়ান নিজের মুখে আমাকে বলুক। কিন্তু না বান্দার ধৈর্যের মাত্রা অত্যাধিক। কিছুতেই আমাকে বলছে না। আমিও কম কিসে। আনবো না তুতুলকে। দেখি ঠিক কতক্ষন নিজের কাছে রাখতে পারে।
রায়ানের সাথে আমার সম্পর্কটা এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রথম দেখায় গম্ভীর মনে হওয়া এই লোকটা আসলে চমৎকার। সে চমৎকার একজন প্রেমিক, দায়িত্ববান ছেলে, আর বেস্ট বাবা। রায়ান আমার সব রকমের প্রয়োজন মেটায়। বলার আগেই আমার দরকারী সব কিছু হাতের কাছে পেয়ে যাই। রায়ানের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। আমি তাকে স্বামী রুপে আমার কাছে পাওয়ার আগে তাকে প্রেমিক হিসেবে পেতে চাই। তার সাথে আমি জ্যোৎস্না বিলাশ করতে চাই। আমার না বলা কথাগুলো বলতে চাই। আদৌ তা কখনো সম্ভব কি না আমি তা জানি না। আমার কাছ থেকে ভালোবাসার কথা শুনে আমি জানি না রায়ানের রিয়েকশন কেমন হবে। আমি চাই না রায়ানের মন থেকে রোদুসি মুছে যাক। আমি কেবল নতুন করে রায়ানের মনে রোদু নামক আরেকটি ফুল ফটাতে চাই। যে সবসময় তার পাশে থাকবে। রায়ানের দুঃখ বিলাশে হাতে হাত রেখে বলবে ‘ এত চিন্তা কিসের বলোতো, আছি তোমার পাশে। আর থাকবো আজীবন।‘
রায়ান আমাকে কথা দিয়েছে সে একজন ভালো স্বামী হয়ে দেখাবে। সেদিন রাতে আমাকে তার অতীত বলতে পেরে রায়ান ঠিক কতটা শান্তি পেয়েছে তা রায়ানের চোখে মুখেই প্রকাশ পেয়েছে। রায়ান সময় চেয়েছে। সম্পর্কটা সুন্দর ভাবে শুরু করার জন্য। আমি দিয়েছি। আমিও চাই আমাদের সুন্দর সম্পর্কে পুরোনো অতীতের কোনো ছায়া না পরুক।
তুতুলের দুষ্টুমিতে বিরক্ত হয়ে রায়ান বলে ফেললো, ‘রোদু তুতুলকে নাও তো। ইম্পোর্টেন্ট কাজ করছি।‘
আমি হেসে দিলাম। আমার প্রচন্ড দম ফাটানো হাসি আসলো। রায়ান ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেলো। কারণ সে তো কোনো কৌতুক বলে নি। সামান্য তুতুলকে কোলে নিতে বলেছে।
তুতুলও আমার দেখা দেখি খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলো। আর বলতে লাগলো, ‘মাম্মা যাব না, যাবো না’
রায়ান বিরক্ত হয়ে বললো, ‘এসব কি হচ্ছে রোদু?’
আমি ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে বুঝালাপ চুপ। সে বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে তুতুলকে নিচে নামিয়ে হনহনিয়ে হেটে চলে গেলো। আশ্চর্য এবারেও আমার হাসি পেলো। খুব হাসি। উফ কতদিন পর এভাবে প্রাণ খুলে হাসলাম। ধন্যবাদ মিঃ রায়ান।
রায়ান উঠে যাওয়ার সাথে সাথে তুতুলও পেছন পেছন ছুটলো। একদম বাপের ন্যাওটা। সব সময় বাবার কাছাকাছি থাকা চাই। হুট করেই আমার মনে অদ্ভুত এক ইচ্ছা জাগলো। আচ্ছা রোদুসি দেখতে কেমন ছিলো? রায়ানের ফোনটা হাতে নিলাম। নিশ্চই এতে রোদুসির ছবি পাবো? বাট ফোন লক।
এই মুহুর্তেই রায়ান তুতুলকে কোলে নিয়ে এসে ধুপ করে আমার কোলে তাকে বসিয়ে দিয়ে বললো,
‘যাও মা মেয়ে মিলে আমার জন্য রান্না বান্না করো গিয়ে।‘
হুহ আমার বয়েই গেছে তার জন্য রান্না করবো। আমি মুখ ভেংচি কেটে তুতুলকে বললাম, ‘তুমার পাপাকে বলে দাও শুনা, মাম্মা রান্না করবে না’
তুতুলও আঙ্গুল নাচিয়ে নাচিয়ে বললো, ‘মাম্মা নান্না কব্বে না’
রায়ান হেসে বলে উঠলো, ‘তাহলে কে করবে সোনা?’
তুতুল দাড়িয়ে গেলো। দুহাতে মুখ চেপে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো, ‘আমি কব্বো’
বলেই দৌড় দিলো। সত্যি সত্যি রান্না ঘরে চলে গেলো না তো? ভয়ে আমিও পিছু পিছু গেলাম। না সে তার খেলনা রান্না বাটি নিয়ে এসে বেডে রায়ানের পাশে বসলো। আমি মুচকি হেসে কিছু ফ্রুটস কেটে এনে রায়ানকে আস্তে করে বললাম,
‘একটা আবদার করবো রাখবেন?’
রায়ান সিরিয়াস হয়ে তাকালো। বললো, ‘হ্যাঁ বলো’
আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম, ‘আমাকে রোদুসির একটা ছবি দেখাবেন?’
রায়ানের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। বললো, ‘শুধু শুধু কষ্ট পাবে।‘
আমি বললাম, ‘উহু। একদম না। আমি তুতুলের মা’কে দেখতে চাই।‘
রায়ান আস্তে করে বললো, ‘দেখাবো’
__________________________
আমি ভার্সিটিতে যাওয়া আসা শুরু করলাম । রায়নও অফিসে যায় সকালে রাতে আসে। তুতুলের দেখা শুনার জন্য টুনির মা থাকেন সব সময়। আমি একদিন বাড়িতে এসে দেখি তুতুল পরে গিয়ে চিৎকার করে কাদছে। কাছে গিয়ে দেখি পা ছিলে গেছে। সোফায় আম্মা বসা। অথচ আম্মা উঠে এসে তুতুলকে না ধরছে না শান্তনা দিচ্ছে না আদর।
আমার প্রচন্ড রকমের রাগ উঠে যায়। একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে আম্মা এমন কেনো করে বুঝি না। আমি একটু রাগ দেখিয়েই আম্মাকে বলি, ‘একটা বাচ্চা মেয়ে পরে ব্যাথা পেয়েছে। আর আপনি বসে আছেন। বাচ্চাটার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তো মানবতার খাতিরে এগিয়ে আসা যায়। আপনার ভেতর কি মায়া দয়া কাজ করে না? নিজের রক্তকে কিভাবে এত কষ্ট দেন আম্মা?
আম্মা আমার কথায় তেঁতে উঠেন। আমাকে শাসিয়ে বলেন, ‘দেখো বউমা সত্যটা যত তারাতাড়ি গ্রহণ করবে ততই ভালো। তুতুল তোমার কেউ না।‘
আমি তাচ্ছিল্য হাসলাম। বললাম,’ ঠিক বলেছেন আম্মা। তুতুল আমার কেউ না। কিন্তু সে আপনার ছেলের করা অন্যায়ের ফসল। আর এর দায়িত্ব আপনার। সো সে হিসেবে সে এই বংশের মেয়ে’
আম্মা রেগে গেলেম। আমাকে আঙ্গুল উচিয়ে বললেন, ‘খুব মুখে খই ফুটেছে তাই না? তোমার মত অপয়া মেয়েকে সব জেনে শুনে ঘরে তুলে এনেছি এই দিন দেখতে?’
রাগে কষ্টে অপমানে আমার মুখ থম্থমে হয়ে গেলো। আমি বলে ফেললাম, ‘অপয়া তা তো জেনে শুনেই এনেছেন আম্মা। তাহলে ?
আর তাছাড়া আপনার পরিবারও ধোয়া তুলসি পাতা নয়। এক ছেলে জেলে তো আরেক ছেলে প্রেমিকার সন্তান নিয়ে আছে’
না চাইতেও আমার মুখ দিয়ে কথাটা বেড়িয়ে গেলো। কি হয়ে গেলো আমি বুঝলাম না। যে তুতুলের জন্য আম্মার সাথে লড়লাম। সেই তুতুলকে নিয়েই আম্মাকে এমন কথা কি করে বললাম। তুতুলকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলাম। আম্মার দিকে আর তাকালাম না। আমার বাচ্চাটাকে নিয়ে ড্রেসিং করিয়ে ঘুম পাড়ালাম। বুকের সাথে চেপে রেখে বললাম, ‘তুই আমার মেয়ে। শুধু আমার। আর কখনো মাম্মা এমন কথা বলবে না শুনা। মাম্মাকে মাফ করে দে।‘
রায়ান ফিরে আসলে দেখলো ঘরের পরিবেশ নিরব। সে যখনই বাসায় আসে এক পলক আম্মাকে দেখে তার পর রুমে আসে। আজ আমার বুক ধুকবুক করতে লাগলো। রায়ান নিশ্চই কষ্ট পাবে। আর আম্মা ! উনিও নিশ্চই কষ্ট পেয়েছেন। মনে মনে স্থির করে নিলাম। রায়ান আসতেই রায়ান সহ আম্মাকে সরি বলে ফেলবো।
রায়ান নিরবে রুমে এসে বললো, ‘রোদু আছো?’
আমি জবাব দিলাম,’ হু’
আমার এমন আস্তে বলা কথায় রায়ানও ফিসফিসিয়ে বললো, ‘এভাবে লাইট অফ কেনো? আর এ অসময়ে তুতুল ঘুমাচ্ছে যে?’
আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘না মানে তুতুল হালকা ব্যাথা পেয়েছে পরে গিয়ে’ কথাটা যথেষ্ট ভয়ে ভয়ে বললাম।
রায়ান স্বাভাবিক। সে বলল, ‘মেয়েটা দিন দিন বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে কি করি বলো তো। টুনির মা বলেছে খেলতে গিয়ে পরে গেছে। তুমি ঠিক সময়ে না আসলে আরো কান্না কাটি করতো’
বুঝলাম টুনির মাই বলেছে রায়ানকে সব। আচ্ছা আম্মা কি কিছুই বলে নি? টুনির মাকে আমি অনেক বকাঝকা করেছি। বেচারিরও কোনো দোষ নেই। একা হাতে কত সামলাবে। রান্না রান্না সহ তুতুলের দেখাশোনা প্রায় সব টাই করে। আমি রায়ানকে বললাম, ‘আম্মার সাথে কথা হয়নি আপনার?’
রায়ান গম্ভীর মুখে বলল, ‘হু হয়েছে।‘
তারপর বললো, ‘আচ্ছা রোদুসি সায়ান ভাইকে যদি কখনো না জানাই তুতুলের কথা তাহলে কি খুব অন্যায় হবে?’
আমি তাকালাম রায়ানের দিকে। অসহায় ভাবে সে কথাটা বলেছে। কিন্তু কেনো? আর বললেই বা কি হবে? সে কিসের ভয় পাচ্ছে এত?
চলবে কি?
[আগামী দু-দিন গল্প দিবো না। পরের পর্ব দু-দিন পরে পাবেন।]