হৃদয়ের কোণে পর্ব ১৯

0
719

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ১৯)
#নাহার
·
·
·
সকাল সকাল ঘুমের ডিস্টার্ব হওয়াতে নিরা রেগে আগুন হয়ে আছে। ঘুম থেকে জাগিয়ে কফি বানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হতে গিয়ে সেখানে ঘটলো বিপত্তি। রাফিন নিরাকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়েছে। নিরা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে আবার একদৌড়ে বের হয়ে আসে। হাত পা কাপছে। রাফিনের শার্ট খামছে ধরেছে। নিরার এমন অবস্থা দেখে রাফিন কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। নিরাকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে ভেতরে? নিরা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
— তেলাপোকা।

— কি?

— ওয়াশরুমে তেলাপোকা ডাক্তার। আমি যাবো না।

রাফিন প্রথমে বেকুবের মতো চেয়ে ছিলো নিরার দিকে। পরক্ষণেই ঘর কাপিয়ে হেসে দিলো। নিরা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। রাফিন নিরাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
— নিরা লাইক সিরিয়াসলি তুমি একটা তেলাপোকা দেখে এভাবে ভয় পেয়েছো?

— হ্যাঁ।

— তাই বলে এভাবে ভূত দেখার মতো ভয় পেয়েছো? তেলাপোকা কি খেয়ে ফেলবে?

— ওইটা উড়ছে। আমার গায়ে পড়লে তখন কি হতো?

— হুম! বাচ্চাদের সাথে প্রেম করলে যা হয় আরকি। ওয়েট আমি যাই তাড়িয়ে দিয়ে আসি।

রাফিন কলার খাড়া করে বুক ফুলিয়ে ওয়াশরুমের ভেতরে গেলো। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে আসলো। নিরা রাফিনকে বললো,
— তাড়িয়ে দিয়েছেন?

রাফিন কথা বলছে না শুধু মুচকি মুচকি হাসছে। নিরা আবার বললো,
— কি হলো ডাক্তার বলুন না তেলাপোকা চলে গেছে?

রাফিন পেছন থেকে হাত উঠিয়ে নিরার সামনে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নিরা চিৎকার দিয়ে বেডের উপর উঠে লাফাতে শুরু করলো। রাফিন এদিকে হেসে কুটিকুটি। রাফিন তেলাপোকাটাকে হাতে করে নিয়ে এসেছে। নিরার সামনে গিয়ে বললো,
— এখন দশ মিনিটের মধ্যে যদি আমি কফি না পাই তাহলে এই তেলাপোকা তোমার গায়ে ছেড়ে দিবো। হাহা।

— আচ্ছা এনে দিবো তো। প্লিজ ওইটাকে ফেলে দেন। ডাক্তার প্লিজ।

নিরা কান্নাকাটি করে শেষ। রাফিন হেলেদুলে নিজের রুমে চলে গেছে। নিরা বোকার মতো দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নাকের পানি চোখের পানি এক করে কি এক মরা কান্না কেঁদেছে। তারপর ফ্রেস হয়ে কিচেনে গেলো কফি বানাতে। সুন্দর করে কফি বানিয়ে রাফিনের জন্য নিয়ে আসতে লাগলো। রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় একটা শয়তানি বুদ্ধি মাথায় এলো। আবার রান্না ঘরে ঢুকে তার কাজ করে কফি নিয়ে রাফিনের রুমে গেলো। কফির মগটা রাফিনের সামনে ধরে বললো,
— এই ডাক্তার আপনার কফি।

— বাহ ভেরি গুড।

রাফিন কফিটা নিয়ে বইয়ের দিকে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। কফিটা ঠান্ডা হওয়ার পর একটানে পুরা কফি খেয়ে নিরার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ছলছল করছে৷ নিরা মুখ টিপে হাসছে। রাফিন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পুরো নাক মুখ কান লাল হয়ে গেছে। মুহুর্তেই রাফিনের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। কাশতে কাশতে খুব বাজে অবস্থা। নিরা রাফিনের কফিতে মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে দিয়েছিলো। রাফিন গলা ধরে ধপ করে বেডে বসে যায়। নিরা এটা দেখে হাসি বন্ধ হয়ে যায়। দৌড়ে রাফিনের কাছে গিয়ে বসে। রাফিন ঝালে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না।

নিরা কান্না করে বললো,
— সরি ডাক্তার। আমি জানতাম না আপনার যে এই অবস্থা হবে। আমি বুঝতে পারিনি।

রাফিন কিছু বলছে না। চোখ থেকে শুধু পানি পড়ছে। চোখ মুখ লাল। নিরা উপায় না পেয়ে দৌড়ে কিচেনে যায়। বাটিতে করে এক বাটি দই নিয়ে তাড়াতাড়ি আসে রাফিনের কাছে। খুব ঝাল লাগলে দই খেলে ঝাল নিবারন হয়। নিরা এটা ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছিলো।

রাফিনের সামনে বসে কয়েক চামচ দই রাফিনের মুখে দেয়। এখন রাফিনে কিছুটা শান্ত হয়েছে। বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। একটু আগেই হেসে কুটিকুটি হওয়া মানুষটা এখন একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে এটা নিরা মানতে পারছে না। নিরা রাফিনকে ধরে কান্না করতে করতে বললো,
— আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে। প্লিজ আমাকে মাফ করে দেন। আর কখনো এমন করবো না। সরি ডাক্তার। প্লিজ মাফ করুন আমাকে।

রাফিন কিছু বলছে না। নিরার কান্না দেখছে। নিরা আবার বললো,
— ঝাল কমেনি? দই খাইয়ে দিবো আবার? প্লিজ কিছু বলুন।

নিরা কেঁদেই যাচ্ছে আর রাফিন বসে বসে কান্না মাখা সেই প্রিয় মুখটা দেখছে নিরার। নিরা আরেকটু সামনে এগিয়ে রাফিনের গালে হাত রেখে বললো,
— প্লিজ ডাক্তার কিছু বলুন। এভাবে চুপ করে থাকবেন না। আপনি আমাকে শাস্তি দিন। বকা দিন। তাও চুপ করে থাকবেন না।

রাফিন একটু এগিয়ে নিরার চোখের পানি মুছে দেয়। নিরার দুইহাত আলতো করে ধরে বললো,
— মায়াবতী! কান্না করলে কতটা সুন্দর লাগে জানো তুমি?

নিরা কান্না থামিয়ে চুপ হয়ে যায়। রাফিনের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছে। রাফিন আবার বললো,
— কান্না করার পর তোমার মুখের যেই একটা আভা আসে সেটা আমাকে খুব পাগল করে নিরু। আমাকে ঝাল খাইয়ে দেয়ার পর যদি তুমি আমার থেকে বেশি কষ্ট পাও, উত্তেজিত হয়ে যাও তাহলে আমি প্রতিদিন এভাবে ঝাল খাবো আর তুমি আমাকে পরম যত্নে দই খাওয়াবে।

নিরা এবার লজ্জা পেলো। মুচকি হেসে মাথা নিচু করে নিলো। উঠে চলে যেতে চাইলে রাফিন হাত ধরে টেনে আবার বসিয়ে দিলো নিজের সামনে। আবার বললো,
— এভাবে পালাবে না। পালাতে দিবো না তোমাকে। আর যেখানেই পালাও তুমি ঘুরেফিরে আমার কাছেই আসতে হবে। আচ্ছা তুমি কি জানো তোমার মুখে কতটা মায়া জড়ানো? কতবার তোমার প্রেমে পড়ি আমি। বুঝো তুমি? এই মায়াবতী জানো তুমি?

নিরা আর বসে থাকতো পারলো না। কোনোরকম ছুটে এলো। নিজের রুমে আর যায়নি। সোজা নিচে নেমে এলো। সে এখন আর রাফিনের সামনে পড়তে চায়না। এখন রাফিনের চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। লজ্জায় মরেই যাবে। রাফিন মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
— আমি তাকে কি সোজা করবো আমাকেই তারের মতো সোজা বানিয়ে দিলো। আল্লাহ। এই পিচ্চির মাথায় এতো কিছু আসে কিভাবে? থাক কি আর করার এই পিচ্চিটাই আমার বউ হবে। বউ। আহ কি মিষ্টি শব্দ।

রাফিন রেডি হয়ে হসপিটাল চলে গেলো। রাফিন চলে যাওয়ার দিকে নিরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে অনেকবার।

——————————————————————————–
সন্ধ্যায় নিরা রাফিনের রুমে এসে রাফিনকে বললো,
— ডাক্তার আপনার লেপটপে একটা মুভি দেখি?

— হ্যাঁ দেখো।

— ওকে।

নিরা রাফিনের লেপটপ নিয়ে খুজছে কোন মুভিটা দেখবে। অবশেষে পেয়ে গেলো। মুভিটা চালু করেছে দেখার জন্য। রাফিন জিজ্ঞেস করলো,
— নিরু কি মুভি দেখছো?

— Fifty shadows of…

বাকিটা বলার আগেই রাফিন দৌড়ে এলো। রাফিনকে এভাবে আসতে দেখে নিরা বেডের উপর উঠে দাঁড়িয়ে গেলো লেপটপ নিয়ে। রাফিন বললো,
— নিরা তুমি ওই মুভিটা দেখবে না।

— কেনো? আমিতো দেখবো।

— তুমি এখনো বাচ্চা। এটা বড়দের মুভি।

নিরা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে রাফিনকে বললো,
— আমি এখন অনার্সে পড়ি আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। তাই এই মুভিটা আমি দেখবো।

নিরা একবার বেডে আবার বেড থেকে নিচে নেমে দৌড়াচ্ছে। রাফিনও নিরাকে ধরার জন্য নিরার পেছনে ছুটছে। রাফিন বললো,
— নিরা তুমি অন্য মুভি দেখো। আমার লেপটপে ডোরেমন আছে, টম এন্ড জেরি আছে ওগুলা দেখো।

— নাহ আমি এই মুভিটাই দেখবো।

— নিরা ওইটা দিয়ে দাও। এরপর তুমি যা বলবে যেটা চাইবে সেটা দিবো।

— সত্যি?

— হ্যাঁ। লেপটপ দাও।

— তাহলে আমাকে ভাসমান সেতু, হনুমান গ্রাম এবং গদখালী ফুলের রাজধানীতে নিয়ে যেতে হবে। রাজি?

— ঠিকাছে নিয়ে যাবো।

রাফিন ছো মেরে লেপটপটা নিয়ে নেয়। রাফিন লেপটপ বন্ধ করতে করতে বললো,
— খুব অবাধ্য হয়ে গেছো তুমি। একদম কথা শুনো না।

নিরা রাফিনের বেডের উপর পা ভাজ করে ধ্যান করার মতো বসে। রাফিন নিরাকে একবার দেখে আবার কাজে মন দিয়ে বলে,
— এভাবে বসে কি ভাবছো তুমি?

— কোনদিন নিয়ে যাবেন? কালকে?

— না৷ কালকে আমার কাজ আছে। শুক্রবারে নিয়ে যাবো।

— সত্যি?

— হ্যাঁ।

নিরা খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো। নিরাকে রাফিন আবার জিজ্ঞেস করলো,
— এভাবে বসে তুমি ভাবছো টা কি?

— শাড়ি পড়ে যাই?

— এই শীতে শাড়ি পড়বে?

— শার্ট প্যান্ট পড়ি তাহলে?

রাফিন ভ্রু কুচকে নিরার দিকে তাকালো। নিরা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। রাফিনের উত্তর না পেয়ে নিরা বললো,
— আপনার উত্তর নেই। তার মানে আপনিও রাজি? ঠিকাছে শার্ট প্যান্টই পড়বো।

রাফিন শব্দ ছাড়াই উঠে আসে নিরার কাছে। রাফিনের সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ খুলে তাকায়। রাফিনকে নিরার এতো কাছাকাছি দেখে নিরা একটা ঢোক গিলে বললো,
— সরি বোরকাই পড়বো ঠিকাছে? একদম ঠান্ডা লাগবে না।

চোখ নামিয়ে নেয়। রাফিন রেগে তাকিয়ে আছে। রাফিনের দিকে আবার তাকিয়ে বললো,
— এভাবে তাকানোর কি আছে? সরিতো। শার্ট-প্যান্ট পড়বো না। ওইটা দুষ্টামি করে বলেছি। হিহি।

নিরা উঠে দরজার সামনে চলে আসে। রাফিনের মতিগতি ঠিক মনে হচ্ছে না নিরার কাছে। তাই এখন সে পালাতে পারলেই বাঁচে। রাফিন বলে উঠলো,
— নীল সেলোয়ার-কামিজ পড়বে। আর শীতের চাদর নিবে। চুল খোলা রাখবে। হাতে কয়েকটা কাচের চূড়ি পড়বে। টিপ পড়বে না। আমার ভালো লাগে না।

নিরা ঘুরে তাকায় রাফিনের দিকে। রাফিন ছোট করে হাসি দিলো। নিরাও হেসে নিজের রুমে চলে এলো। ঘুরতে যাবে সেগুলো নিয়ে হাজার স্বন বুনছে নিরা। তার প্রিয় মানুষটার সাথে যাবে ভাবতেই এক খুশির বন্যা বইছে মনে।
·
·
·
চলবে………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here