হৃদয়ের ওপারে তুমি ❤ পর্ব-২

0
3298

#হৃদয়ের_ওপারে_তুমি
#গল্প_ভাবনায়_ফারজানা_ইয়াসমিন_রিমি (আপু)
#লেখিকা_রিয়া_খান
#পর্ব_২

গরু কেনা হয়েছে পাঁচটা তিনটে গরু কুরবানির ও দুটো গরু ফুলের মেজো ভাই আশিকের বিয়ের জন্য। মঙ্গলবার ঈদ,বৃহস্প্রতিবার আশিকের গায়ে হলুদ আর শুক্রবার বিয়ে।

সন্ধ্যায় ভাইয়েরা গরু নিয়ে ফিরতে ফিরতে এতোক্ষণে ফুল অভিমান চেপে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে।

ভাইয়েরা যখন জানতে পারলো তাদের অনুপস্থিতিতে এরকম কাহিনী ঘটে গেছে
ফুলের বড় ভাই আয়মান রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
-কার এতো বড় সাহস হলো আমাদের বোনের বিচার বসানোর?কত বড় বিচারক সে? এতো বড় কলিজা হয় কি করে আমাদের না জানিয়ে আমাদের বোনের বিচার সভা বসায়!

আয়মানের সাথে ফুলের চাচাতো ভাই নিজামও তাল মিলিয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো,

-কি এমন অপরাধ করেছে যার জন্য আমাদের বোনের বিচার বসায়?মানুষ খুন করেছে পুতুল ?

নিজামের স্ত্রী সুমাইয়া ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে কাঁপা গলায় উত্তর দিলো ,
-সালমা বানুর বাড়িতে চুরি করেছিলো!
-হীরে রত্ন চুরি করেছে আমাদের বোন?কয় ভরি গহনা চুরি করেছে?
পাশে থেকে আয়মানের স্ত্রী কবিতা উত্তর দিলো,
-না মা মানে পেয়ারা চুরি করতে গিয়েছিলো বন্ধুদের নিয়ে। সেখানে সালমা বানুর হাতে ধরা পরে।

-কিহ! সামান্য পেয়ারার জন্য অই সালমা বানুর মুখের কথায় আমাদের পুতুল বোনের বিচার বসিয়েছে?অই মহিলার সাহস কি করে হলো এই বাড়িতে আমাদের বোনের নামে বিচার নিয়ে আসার?আর বাড়ির মুরব্বীরা কি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে মুরব্বী হয়েছে! একটা তুচ্ছ কারণে আমাদের বোনকে এভাবে অপমান করেছে!পুতুল ছোটো বলে কি ওর কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই?

বড় মামাতো ভাই পারভেজ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজাম ও আয়মানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ভাই ওই মহিলা যেমন সামান্য তুচ্ছ কারণে আমাদের বোনের বিচার করিয়েছে এখন সবাই চলো আমরা গিয়ে অই মহিলার বিচার করবো।যদি শিক্ষা না দিতে পেরেছি আজকে তো আমরা পুতুলের ভাই ই না।
-ঠিক বলেছিস।চল আগে অই মহিলাকে সাইজ করে এসে তারপর বাড়ি এসে গোসল দেবো।পুতুল বোনের পায়ে ধরে যদি ক্ষমা না চাওয়াতে পেরেছি…!

রাগে ছটফট করতে করতে সবাই বেরিয়ে যেতে নিবে, এমন সময় ফুপি এসে সামনে দাঁড়ালো, সবার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
-সবাই মাথা ঠান্ডা করো।সালমা বানুর বিচার পরেও করতে পারবে।আর দোষ শুধু সালমা বানুর একার না তোমাদের বাবা চাচা মামা ফুপাদেরও কম না।অই মহিলা বিচার এনেছে বলেই বিচার বসাতে হবে তাদের?সে যাই হোক পরে দেখা যাবে সেটা। ওদিকে পরীমা সেই বিকেল থেকে দরজা আটকে ভেতরে আছে।আমরা নক করছি দরজা খুলবে তো দূরে থাক কোনো সাড়া শব্দ নেই মেয়েটার, আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।তোমরা এখন কি করবে করো আমার পরীমাকে চাই।রাগের বশে মেয়ে আমার কিছু করে না বসে!

ফুপির মুখে এই কথা শুনে ভাইদের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো নিমেষেই।মাথা থেকে রাগ সরে গিয়ে চিন্তা ভর করলো ফুলকে নিয়ে।

সাত ভাই সাথে সাথে উপরে গেলো ফুলের রুমের সামনে গিয়ে নক করতে লাগলো।

আশিক আয়মান দরজাতে নক করতে করতে ডাকতে লাগলো,
-বোন ঘুমিয়েছিস? পুতুল বোন দরজাটা খোল দেখ তোর ভাইয়েরা তোর জন্য কি এনেছে।
-……………………(ভেতর থেকে নো রেস্পন্স)
-পুতুল বোন রাগ করেছিস ভাইদের ওপর দেরি করেছি বলে? বোন আমার দরজা খোল । খোলে যা শাস্তি দিবি আমরা ভাইয়েরা মাথা পেতে নেবো। বোন!
-…………………

একের পর এক সব ভাই ই ফুলকে ডাকছে আর ফুল কোনো সাড়া শব্দ দিচ্ছে না ভেতর থেকে।দেবে কি করে ও তো ঘুমে বিভোর অবস্থা!ভেতর থেকে ফুলের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে সব ভাই আরো বেশি চিন্তিতো হয়ে পড়লো,আয়েশা বেগম মুখ শুকনো করে ছেলেদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে মনে হচ্ছে তখন ফুলকে ওভাবে কথা না শুনালেও পারতো,ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধ হচ্ছে খুব।

আয়মান আর নিজাম প্রচন্ড রাগারাগি করছে মা চাচীদের সাথে।এমন সময় পারভেজ পলাশ আশিক মিলে বুদ্ধি বের করলো দরজার লক ভাঙবে। আকাশ দৌড়ে করাত, হাতুরি, প্লাস, যা যা প্রয়োজন লাগে সব নিয়ে এলো।

যখনি দরজার লকে আঘাত করতে যাবে ঠিক তখনি ফুল দরজা খুলে দাঁড়িয়ে হামি তুলতে তুলতে চোখ ঢলতে ঢলতে তাকালো।ফুলকে সামনে দেখে ভাইয়েদের দেহে প্রাণ ফিরে এলো।রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে ফুল সবার দিকে তাকালো,ঘুম থেকে উঠলেও রাগ বিন্দু পরিমাণ কমে নি।এখন তো ভাইদের পেয়েছে এখন আহ্লাদে গলে পড়বে আরো।

ফুল কোনো কথা না বলে নিষ্পাপ ভঙ্গীতে ভাইদের দিকে তাকিয়ে রইলো যা দেখে ভাইদের মনে আরো মায়া লাগলো।
-পুতুল বোন রাগ করেছিস ভাইদের উপর?এতোক্ষণ লাগলো কেনো দরজা খুলতে!শরীর ঠিক আছে বোন?

ফুলের কপালে হাত দিলো গায়ের টেম্পারেচার ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য।কিন্তু ফুল এখনো কোনো উত্তর দিলো না।ছলছল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে এই বুঝি আবার কেঁদে দেবে,ভাইয়েরা বুঝতে পারলো ফুলের এমন চুপচাপ থাকার কারণ।নিয়াজ ফুলকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-পুতুল! বোন আমার।মন খারাপ করে না তুই তো জানিস না, ঘুমিয়েছিলিস তো।বাড়িতে এসে বাড়ির সব কটাকে বকেছি। দেখছিস না বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা। বাবা, ছোটো বাবা, মামা, ফুপা সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি।কাল সকালে সালমা বানুকে টাংগাইল শহর থেকে বের করে দেবো।
-আজকে কেনো নয়?
-আজকে কি করে বোন!আজকে তো গরু এনেছি, গরু দেখবি না? কালো রঙের ষাঁড় এনেছি তিনটা আর লাল রঙের দুটো । তুই তো কালো আর লাল রঙের ষাঁড় আনতে বলেছিলিস। বাইরে চল গরু দেখবি।খুব পছন্দ হবে তোর।
-ঠিক আছে যাবো তার আগে তুমি মাকে কিছু বলো। মা আমাকে অপমান করেছে।

নিয়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ছোটো মা তোমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম, যদি ভুলেও কোনো দিন পুতুল বোনকে কিছু বলেছো না, তোমাকে একদম বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।

ফাতেমা বেগম ঠোঁট টিপে হেসে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-ঠিক আছে আর বকবো না।
ফুল মায়ের দিকে তাকিয়ে অভিমানি স্বরে বললো,
-প্রতিবারই তো একই কথা বলো, পরে তো ঠিকি অপমান করো।

আশিক ফুলের গলা জড়িয়ে বললো,
-বোন বাদ দে।নিচে চল বাইরে গরু হাম্বা হাম্বা করছে, চল গরু দেখবি। এসব এখন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।

সবাই মিলে বাইরে গেলো। বাগানে গরু গুলো বেঁধে রেখেছে। ফুলকে নিয়ে ভাইয়েরা গরুর কাছে গেলো, ফুল অনেকটা ভয় পেয়ে গেলো ষাঁড়ের গর্জনে।

আকাশ ফুলের হাত নিয়ে আস্তে আস্তে ষাঁড় গুলোর মাথা হাতিয়ে দিলো।ফুল তো ভীষণ রকম খুশি।ভাইয়েরা সাথে থাকলে ফুলের মন খারাপ অভিমান সব নিমেষেই দূর হয়ে যায়। ঠিক এখন যে রকম ফুল খুশিতে ওর রাগ টা ভুলে গেছে।

ফুল যে একটা উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, শুধু বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা নয়, সে পুরো বংশে একমাত্র কন্যা।

নাজমুল শিকদার ও আয়েশা বেগমের তিন সন্তান বড় ছেলে আয়মান শিকদার সরকারী চাকরী করে বয়স ৩২। বিয়ে হয়েছে,ছোট একটা ছেলেও আছে বয়স আড়াই বছর নাম আমান আর স্ত্রীর নাম কবিতা।

মেজো ছেলে আশিক শিকদার একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে,বিয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করা হয়েছে। ঈদের দুদিন পর বিয়ে।
ও ছোটো মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ফুল
বয়স ১৬ বছর, এই বার SSC দিয়ে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে।

নাজমুল শিকদার কুমুদিনী সরকারি বালিকা কলেজের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক।নিজস্ব ব্যাবসা থাকতেও তিনি শিক্ষকতায় পছন্দ করেন।বর্তমানে তাদের ব্যাবসা বড় ভাই আলতাফ শিকদার ও তাঁর দুই ছেলে
নিজাম শিকদার ও নিয়ম শিকদার দেখাশোনা করছে।
একটা বিশাল সিল্ক ও জামদানী কাপড় শিল্পের ব্যাবসা।বিদেশে কাপড় রপ্তানি করে প্রচুর সাফল্য পাচ্ছে।

নিজামের বয়স ৩৫ বছর একটা ৫বছরের ছেলেও আছে তাঁর নাম নিয়াজ, স্ত্রী সুমাইয়া ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট।
আর নিয়মের বয়স ৩০ বছর, স্ত্রী ঐশী, বাচ্চা নেই,দেড় বছরের দাম্পত্য জীবন তাদের।

ফুলের মা আর বড় চাচী আপন দুই বোন,ফুলের বড় চাচীই ফুলের খালা।

ফুলের একমাত্র ফুপি আসমা বেগম যাদের কোনো সন্তান নেই, ফুপা যিনি খুবই ভালো মানুষ।

মামার ঘরে তিন ছেলে , বড় ছেলে পারভেজ বয়স ৩১ বছর, ছয় মাস আগে বিয়ে করেছে। মেজো ছেলে পলাশ বয়স ২৬বছর, ব্যাংকে জব করে। আর ছোটো ছেলে আকাশ টাংগাইল মেডিকেলে এমবি বিএস কোর্সের ৪র্থ বর্ষে অধ্যয়নরত, বয়স ২৩ বছর।

মামা- চাচা -বাবা সবার ঘরে ছেলে সন্তান হওয়ায় সবাই কন্যা সন্তানের চেষ্টা করে, কিন্তু উপর আলা দান করেন নি।আয়মানের বয়স যখন ১৬ বছর ঠিক তখন অপ্রত্যাশিত ভাবে ফুলের জন্ম হয়। যার কারণে ফুল এতো বেশি আদরের।ফুলের জন্মের পর একটা বিশাল প্লট কিনে নাজমুল শিকদার,আলতাফ শিকদার, এনামুল হক ও আসলাম ভুঁইঞা একই বাউন্ডারিতে পাশাপাশি চারটা ডুপ্লেক্স বাড়ি করে। শুধু মাত্র ফুলের জন্য সবার একসাথে থাকা।

সাত ভাইয়ের পর এক বোনের জন্ম যার কারণে সাত ভাইয়ের এক বোন চম্পার মতো আদরের ফুল।

একেতে পরিবারের সব থেকে ছোটো তার ওপর সাত ছেলের পর একমাত্র কন্যা। আদরের কমতি নেই কোথাও, মাথায় তুলে রাখে সব সময়। আর এই অতি আদরে বাঁদর হয়ে যাচ্ছে ফুল।বয়স ১৬ হলেও মনটা একদমই বাচ্চা বাচ্চা।দুষ্টুমি করাই যেনো একমাত্র পেশা।

৫ ফুট উচ্চতার ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, কালো মনির বড় বড় চোখ, নিচের ঠোঁটে একটা তিল আর গলার বিউটি বোনের ঠিক ২ ইঞ্চি নিচে একটা তিল, হালকা কোকড়া চুল, মাথাভর্তি ঘন চুল কোমর সমান লম্বা। দেখতে পুতুলের মতো, তাই কোনো ভাই পুতুল ডাকে, কোনো ভাই পরী, কোনো ভাই ডল, আবার কোনো ভাই বেলী ফুল বা শেফা ফুল বা রোজ বলে ডাকে। সব ভাইদের প্রিয় ফুলের নাম ধরে ডাকে। রোজ প্যাটেলের একমাত্র নয়নের মণি ফুল!

নাম ফুল হওয়ার কারণ, ফুলের জন্মের পর পরিবারের সবার মনে হয়েছে তাদের ঘরে এমন একটি ফুল ফুটেছে যে তার রঙ,রুপ আর গন্ধ দিয়ে তাদের ঘর সুরভিত করেছে। সাত ভাইয়ের এক বোন বলে কথা । পড়ালেখা মোটেও করতে চায়না, এক নম্বরের ফাঁকিবাজ, শখ – বাগান করা, গান গাওয়ার অনেক অনেক শখ, কিন্তু তার লিরিক্স মনে থাকেনা। তাই সব সময় উল্টাপাল্টা সুরের ভুলভাল গান গায়।বাড়ির সামনের খোলা আরেকপাশে ভাইদের সাথে প্রতি শুক্রবার ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠা তাঁর সাপ্তাহিক রুটিন। আর বেশির ভাগ সময় ফুল কারো না কারো বাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙবেই।

ফুলের মন ভালো করা তো হয়ে গেলো। গরুর কাছে কিছুক্ষণ সময় থেকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো, ফুল আর বাইরে থাকার বায়না করলো না কারণ সব ভাইয়েরা এখন অনেক টায়ার্ড ! এবেলা সবাই গরুর হাটেই পার করেছে।

রাতে ডিনারের সময় সবাই টেবিলে বসেছে ফুল আয়মান আশিকের মাঝখানে বসেছে অপর পাশে নাজমুল শিকদার, আয়মানের পাশে কবিতা বসে আমানকে খাওয়াচ্ছে।সবার সামনে খাবার প্লেট থাকলেও ফুলের নিজস্ব কোনো খাবার প্লেট নেই।সেই ছোট্ট বেলা থেকে সবার পাতে খেয়ে বড় হওয়া ফুলের।ঠিক এখন যেরকম আয়মান আশিক খাচ্ছে আর মাঝখানে ফুলকে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে।পারলে এক গ্লাস পানিটাও ফুলকে মুখে তুলে খাওয়াতে যায় সবাই।ফুলের জীবনে নিজের হাত দিয়ে পানি ছাড়া আর কিছু খেয়েছে বলে মনে পড়ে না। খাওয়ার সময় ফুল আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আবার নজর ফিরিয়ে নিলো,বাবার উপর এখনো অভিমান চেপে আছে। নাজমুল শিকদারও মনে মনে প্রচন্ড আফসোস করছে সামান্য কারণে মেয়েকে এতো বড় শাস্তি দেয়া ঠিক হয় নি। মেয়ের মান ভাঙানোর জন্য যে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই সাহসটাও পাচ্ছে না। এখন ছেলেদের সামনে এ ব্যাপারে মুখ খুলতেও পারছে না কারণ ফুলের আবার মন খারাপ হয়ে যাবে আর ছেলেরা তখন ছেড়ে কথা বলবে না। বাবা মা যাও একটা একটু ফুলের মন খারাপ সহ্য করতে পারে ভাইয়েরা কোনো মতেই সেটা সহ্য করতে পারবে না।

খাওয়া শেষ হতেই ফুলকে ওর রুমে নিয়ে আয়েশা বেগম মাথা হাতিয়ে হাতিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। ফুলকে বেশি রাত জাগতে দেয়া হয় না একমাত্র পড়াশুনার প্রয়োজন ছাড়া।এখন তো ঈদ উপলক্ষে পড়াশুনা নিলামে তুলেছে।যদিও ফুল প্রচুর পরিমাণ ফাঁকিবাজ।
পড়ালেখা শব্দটা ফুলের জীবনের পথের কাঁটা, মাথা ব্যাথা, চোখের ঘুম, সারাদিনের বিরক্তির কারণ। লেখাপড়া একদম ই করতে চায় না। SSC তে কোনো মতে টুকলি করে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে এক্সাম দিয়ে গ্রেড “এ” নিয়ে পাশ করেছে। এতে বাড়ির প্রতিটা সদস্য খুশি হলেও আয়েশা বেগম খুশি হতে পারেন নি কারণ তাঁর দুঃখ তাঁর দু ছেলে পড়াশুনায় এতো ব্রিলিয়ান্ট আর মনোযোগী ছিলো মেয়েটা ছেলেদের থেকে একদম বিপরীত। এ প্লাস টা ওর থেকে আশা করা যেনো মহা পাপ।এমনিতে ফুল খারাপ স্টুডেন্ট না, সমস্যা শুধু অই এক জায়গায় পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করে না, একটু না পুরোটাই অমনোযোগী সে। ছেলেদের মতো ফুলও পড়াশুনায় মনোযোগী হবে এটা আয়েশা বেগমের একটা অপূর্ণ ইচ্ছা। SSC তে এ প্লাস না পাওয়াই কেউ কিছু না বললেও আয়েশা বেগম প্রায় ই খোঁটা দিয়ে বসেন।

রাত পেরিয়ে ভোর হলো, আর একটা রাত পেরুলেই ঈদ। বাড়িতে ঈদের খুশির বন্যা বইছে।

দুপুরের দিকে ফুলের বাড়ির সামনের বাগানে ফুলের অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিনা, বর্ষা, বকুল,বাদল।একটা টুল পেতে দাঁড়িয়ে ফুল সব কটার গালে একটা একটা করে থাপ্পড় মারছে।ওদের অপরাধ কাল ওকে ওভাবে একা ফেলে চলে গিয়েছিলো সবাই।রাগে ফুল দাঁত কিড়িমিড়ি করছে ইচ্ছে করছে সব কটাকে মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলতে।
-ফুল দি এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।আর কখনো এমনটা করবো না দিদি।তুমি যা বলবে তাই ই করবো দিদি।

বাদলের এই কথায় ফুল চোখ বড় বড় করে তাকালো ওর দিকে।ফুল ভেংচি মেরে কিছু একটা বলতে যাবে তখন বাদলের সাথে সাথে বর্ষাও বলে উঠলো।
-ফুল এবারের মতো ক্ষমা করে দে না বোন আর কখনো এমন ভুল হবে না। তুই যা বলবি আমরা তাই করতে প্রস্তুত।

মিনা বকুলও ওদের সাথে মিলিয়ে ফুলের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলো।ফুল এবার থেমে গিয়ে কিছু না বলে ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান কষলো একটা।গোয়েন্দা নজরে ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-যা বলবো তাই করবি তোরা?
সবাই মিলে উত্তর দিলো,
-যা বলবে হরফে অক্ষরে করবো।শুধু মুখ দিয়ে হুকুমের অপেক্ষা।
-ঠিক আছে। যদি তাই করতে পারিস তাহলে সব কটাকে ছেড়ে দেবো।আর যদি না পারিস তাহলে জিকা গাছের ডাল দিয়ে পেটাবো সব কটাকে।
-যতো কঠিন কাজ হোক আমরা পারবো।
-ঠিক আছে শুন তাহলে।

সবাই ফুলের কাছে এসে ভীড়লো ফুল ওদেরকে ওর প্ল্যান বললো।

এমন সময় ফুলের ডাক পড়লো।
ফুল বাড়ির ভেতরে গেলো।
আর ওরা ওদের কাজে লেগে গেলো।
আশিক ডেকেছিলো ফুলকে, ফুল সামনে গিয়ে বললো,
-বলো দাদা কি বলবে।
-পুতুল তোর ঈদের জুতো গুলো আমার পছন্দ হয় নি একদম ই । চল মার্কেটে চল আমি পছন্দ করে কিনে দিবো এখনি।
-কি বলছো দাদা শপিং তো তোমরাই করে দিয়েছো। তোমাদের পছন্দ মতোই সব কিনেছি।আর জুতো গুলো তো অনেক সুন্দর হয়েছে খারাপ কোথায়!
-আমি জুতো পছন্দ করি নি।জামা পছন্দ করে দিয়েছিলাম।এখন চল জুতো কিনে দিবো।

ফুল উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
-ভালো লাগে না এতো জামা জুতো আমি কখন পড়বো।লাগবে না তো আর।

কথাগুলো আশিকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে বলতে আশিক ফুলের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো। ফুল থেমে গিয়ে চুপ করলো।আশিকের ইশারায় কিছু একটা বুঝতে পারলো। আশে পাশে মা ফুফু আর বড় চাচী ছিলো যার কারণে আশিক ইশারায় ই কিছু একটা বুঝালো।
-ঠিক আছে কিন্তু এখন যাবো না বিকেলে যাবো।
-ঠিক আছে তাই ই হবে। আসরের নামাজ পড়েই বের হবো।
-আচ্ছা আমি এখন যাই?
-কোথায় যাবি?
-গরুর কাছে যাবো।জানো আজকে আমি গরুকে অনেক গুলো ঘাস খাইয়ে দিয়েছি।

আশিক হেসে দিয়ে বললো
-আচ্ছা ঠিক আছে যা।তবে সাবধানে! গরু গুলো কিন্তু অনেক ডেঞ্জারাস শিংয়ের ধারে কাছে যাবি না।আর পা থেকে দূরে থাকবি।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে তাই ই হবে আমি গেলাম।

ফুল একটা ভোঁ দৌড় দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

এদিকে মিনা, বর্ষা, বকুল, বাদল ওরা ওদের কাজ প্রায় করেই ফেলেছে।

দুপুরের শেষ বেলায় যা ঘটনা ঘটিয়েছে সেটা সালমা বানুর ধারণারও বাইরে। ফুল বাউন্ডারির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আর ওরা সবাই ওয়াল পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে সালমা বানুর বাড়ির দেয়ালের চারদিকে গোবর দিয়ে লেপে দিয়েছে।যখন সালমা বানু এ দৃশ্য দেখবে তখন হার্ট এট্যাক ও করতে পারে।সাকসেসফুললি ফুলের প্ল্যান মতো ওরা মিশন কমপ্লিট করে বাড়ি চলে গেলো।

সালমা বানুর চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হওয়ার আগেই আন্দাজ করে ফুল আশিকের সাথে শপিংয়ে যাওয়ার উদ্দ্যেশে বেরিয়ে গেলো।
-অই দাদা চলোনা আজকে রিকশায় করে যাই।
-আজকেই রিকশা নিয়ে যেতে হবে?
-হুম আমার খুব রিকশায় ঘুরতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আশিক ফুলের গাল টেনে বললো,
-আমার শেফা ফুলের যেহেতু ইচ্ছে হয়েছে পূরণ তো করতেই হবে।

বাড়ির এরিয়া থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে একটা রিকশা ডাক দিলো আশিক। দুজনে রিকশাতে উঠে সোজা ধলেশ্বরী রোডে চলে গেলো ফুলের জুতো কেনার উদ্দ্যেশে।

ফুল জন্মানোর পর নানা দাদা কাউকেই দেখেনি নানুকেও দেখে নি,দাদুকে দেখেছিলো, ছোটো থাকা অবস্থায় ই সে মারা গেছে।
দাদা নানাকে দেখতে পায় নি বলে ফুল সেই ছোট্ট বেলা থেকে তিন মামাতো ভাইকে নানা/নানাভাই বলে ডাকে। নিজের দুই ভাই আয়মানকে দাদাভাই আর আশিককে দাদা।আর নিজামকে বড় ভাইয়া, নিয়মকে ছোট ভাইয়া বলে ডাকে

দু ভাই বোন গল্প করতে করতে এসে গেলো শপিং মলের সামনে।
রিকশা থেকে নেমে আশিক কেউ একজনকে কল দিলো ফুল বুঝতে পারছে না কাকে কল দিচ্ছে।তবে এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে কেউ এক জনের লোকেশন জানার চেষ্টা করছে আর নিজের লোকেশন বলছে। ফুলের হাত ধরে আশিক ছাত্তার শপিং মলের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে আছে অপজিটেই প্রি-ক্যাডেট স্কুল। ফুল একমনে স্কুলের বাইরের গেটের অই বিশাল সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে । কিছুক্ষণ পর ফুল আশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-অই দাদা তুমি শপিংমল ছেড়ে এখানে দাঁড়ালে কেনো?আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?আর কাকে কল দিচ্ছো এতো, কে আসছে?
আশিক রহস্যময় ভাবে উত্তর দিলো।
-আসলেই দেখতে পাবি ওয়েট কর।
ফুল আশিকের দিকে গোয়েন্দার মতো তাকিয়ে বললো,

-তুমি যে আমার জুতো কেনার ছুতোয় অন্য কোনো উদ্দ্যেশে এখানে এনেছো সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

আশিক ফুলের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,
-পাকা বুড়ি!
ফুল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-আমি আবার কি পাকামো করলাম?
আশিক উত্তর দেবে ঠিক তখনি ওর ফোন বেজে উঠলো,সাথে সাথে রিসিভ করে ফোন কানে নিলো। আর ফুল সেই আবার সাইনবোর্ডের দিকে তাকাতে যাবে এমন সময় রাস্তার অপজিটে নজর গিয়ে আটকে পড়লো।ওদিকে তাকিয়েই আশিককে ডাকতে লাগলো,
-দাদা দাদা দাদা দেখো!

চলবে………
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।ভুল গুলো ধরিয়ে দেবেন শুধরে নেবো।ভালো না লাগলে ইগনোর করুন, ধন্যবাদ)
যারা যারা আমার গ্রুপে জয়েন করেননি তাদের গ্রুপে জয়েন হওয়ার অনুরোধ রইলো।আপনি চাইলে আমার গল্প থেকে যেকোনো মন্তব্য পোস্ট করতে পারে,নিচে গ্রুপের লিংক দেয়া হলো,
https://www.facebook.com/groups/399234587718623/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here