#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫
মৃত্তিকা সিদ্ধান্ত নিলো আজ আদিবের গ্রামের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিবে। তার আশা, আদিবকে সে সেখানে পাবে। আদিব তার নিজের পরিচয় ভালোমতো মৃত্তিকাকে কোনোদিন বলেনি। মৃত্তিকা জোর করলেও বলতো না। এমনকি তার বাবা সম্পর্কেও আদিব তেমন কোনো কথা বলতো না। মৃত্তিকার বেশি জোরাজোরির ফলে একদিন বলেছিল ‘তার বাবা মারা গিয়েছে আর তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে কুমিল্লায়।’ মৃত্তিকা মাঝে মাঝে আদিবকে বুঝতে পারতো না কারণ আদিব স্বয়ং মৃত্তিকাকেও তার পরিবার সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চায়তো না, পরিবার সম্পর্কে মৃত্তিকা কিছু জিজ্ঞেস করলেই আদিব কথাটা এড়িয়ে অন্য বিষয়ে কথা বলতো। তবুও একদিন মৃত্তিকা সন্দেহের চোখে চেয়েছিলো বিধায় আদিব তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা মৃত্তিকাকে দিয়েছিল। আদিবের সাথে অনেক বুঝাপড়া বাকি আছে মৃত্তিকার। আদিব এতো ছোট বিষয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার মতো ছেলে নয়। আর যদি আদিবের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে মৃত্তিকা’ই দায়ী থাকে তাহলে মৃত্তিকা আদিবকে বুঝিয়ে বলবে। মৃত্তিকার কারণে আদিবের এতো সুন্দর ভবিষ্যত নস্ট করার কোনো মানেই হয় না। যদি আদিব তাতেও না মানে তাহলে মৃত্তিকা নিজ থেকেই সরে যাবে। তাই মৃত্তিকা যথারীতি ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে এসে ফ্রেস হয়ে নিলো। এতো কিছুর মাঝে মৃত্তিকা তার একটা ক্লাসও মিস দেয়নি। ঈশান আশেপাশে না থাকলেও ঈশানের কথা মৃত্তিকা প্রতি হাড়ে হাড়ে মেনে চলার চেষ্টা করে। নিয়ম অনুসারে প্রতিদিন পড়াশোনা ঠিকঠাক করে। তার মন না মানলেও সে এখন অন্যজনের অর্ধাঙ্গিনী, কোনো ঘরের বউ।
বিকেলের দিকে মৃত্তিকা হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়লো আদিবের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
মৃত্তিকা হোস্টেল থেকে বেরিয়েই কুমিল্লার বাসে উঠলো। উঠার আগে রিনিকে জানিয়ে দিল কিছু কারণে সে বাইরে যাচ্ছে-পরে এসে সব বলবে। বাসায় কাউকে কিছু না জানাতে।
স্টেশনে এসে মৃত্তিকা বাস ছাড়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়ালো।মৃত্তিকা বাস ছাড়ার অনেক আগেই স্টেশনে এসে পড়েছে যার ফলে আরো অনেকক্ষন বাসে বসে থাকতে হবে। এখনো যাত্রী তেমন আসে নাই মাত্র দুয়েকজন যাত্রী এসে বসেছে। মৃত্তিকা আর কিছু না ভেবে বাসে উঠে বসলো। তার সিট্ জানালার পাশে যার ফলে বাইরের সবকিছুই দেখতে পারছে। মৃত্তিকা সিটে বসে চারদিকে তাকিয়ে এতক্ষন কীভাবে বসে থাকবে ভেবে ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন নিতে নিতে আনমনে জানালার বাইরে চোখ যেতেই থমকে গেল। তার মনে হলো বাইরে এই মাত্র ঈশান ভাইয়ের মতোই কাউকে জানি দেখেছে মাস্ক পরিহিত। কিন্তু ঈশান ভাই তো দেশের বাইরে, উনি এখানে কীভাবে আসবে! সে আবারো বাইরে দূরের ওই দোকানটার দিকে তাকালো কিন্তু এখন খালি! মৃত্তিকা নিজের চোখের ভ্রম ভেবে সিটে বসলো। সারাদিন ঈশান ভাইকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার মাথাটাই বোধহয় শেষ! সে মুচকি হেসে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বাস ছাড়তে আরো অনেকক্ষন আছে। এখনো যাত্রী পুরোপুরি উঠেনি তাই মোবাইলে প্ৰিয় একটি গান ছেড়ে সিটে হেলান দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে ফেলল। গান শুনতে শুনতে ঝিমুচ্ছে মৃত্তিকা। হঠাৎ মনে হলো তার পাশের সিটে কেউ একজন বসেছে। হয়ত যাত্রী ভেবে সে পাত্তা না দিয়ে গান উপভোগ করতে রইল। বাস বোধহয় ছেড়ে দিয়েছে। চলন্ত বাসে জানালার পাশের সিটে বসে চোখ বন্ধ করে গান শোনার মজায় আলাদা। অনেকক্ষন পরে মনে হলো, কেউ একজন পুরুষালি কণ্ঠে মৃত্তিকার কানের পাশে কথা বলছে। পরপর আওয়াজটা আসতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো হয়ত কাউকে ডাকছে। কিন্তু আওয়াজটা তার গানের সুর ভেদ করে আরো তীব্র হতেই বুঝতে পারলো পাশের সিটের মানুষটা হয়ত মৃত্তিকাকেই ডাকছে । মৃত্তিকা গান শুনতে গিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেল। নতুন নতুন গানের তালে তার সুন্দর কল্পনার মাঝে কারো এভাবে ডাকাতে সে বিরক্তবোধ হলো। তার এই মুহূর্তে মোটেও চোখ খুলে দেখার ইচ্ছে নেই। কিন্তু পাশের জন দমে যাওয়ার প্রার্থী নয়। সে এক নাগাড়ে ডেকেই চলছে। আশ্চর্য! কারো কাঁচা ঘুমের মধ্যে এভাবে ডাকার কোনো মানেই হয় না! মৃত্তিকা চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নড়েচড়ে বসতেই পাশ থেকে লোকটা আবারো ডেকে উঠল,
-‘হ্যালো মিস!’
মৃত্তিকা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আধো আধো চোখ খুলে পাশের জনের দিকে তাকাতেই দেখলো আগন্তুকটি দাঁত বের করে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তা দেখে মৃত্তিকার রাগ যেন তড়তর করে বেড়ে গেল। সে বিরক্তিতে ‘চ’-সূচক শব্দ করলো। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে আগন্তুকটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আগন্তুকটি মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল,
-‘মিস,আসলে এই প্রথমবারের মতো কোথাও এতো দূরের জার্নিতে যাচ্ছি। এতো বড়ো রাত জার্নি কাটাতে গিয়ে খারাপ লাগবে ভেবে আপনার সাথে পরিচয় হতে চাচ্ছি।’
মৃত্তিকা আপনমনে বিড়বিড় করে কিছু গালি দিতেই আগন্তুকটি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘মিস, কিছু বললেন?’
ছেলেটির মুখ থেকে ‘মিস’ শোনার পড় মৃত্তিকার রাগ আরো বেশি বেড়ে গেল। সে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কোনোরকম নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে চিবিয়ে চিবিয়ে জবাব দিল,
-‘আমি মিস নয়, মিসেস।’
-‘ওঃ, আপনি বোধহয় বিরক্তবোধ হচ্ছেন?’
ছেলেটির এমন কথা শুনে মৃত্তিকার খারাপ লাগলো। আসলেই তো, বিনা কারণে ছেলেটির উপর রেগে আছে মৃত্তিকা। তার কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ছেলেটির উপর রাগ দেখাচ্ছে কিন্তু এছাড়া ছেলেটির উপর রাগার মতো আর কিছুই তো সে করেনি। হয়ত বাঁচাল টাইপ ছেলে তাই কথা বলা ছাড়া থাকতে পারছে না। মৃত্তিকারও আর কিছু সময় পেরোলে হয়ত একঘেয়েমি চলে আসতো। থাক, একটাকে অন্তত পেলো। গল্প করে কাটানো যাবে। এই ভেবেই মৃত্তিকা হাসিমুখে ছেলেটির জবাব দিতেই ছেলেটি খুশিতে মৃত্তিকার সাথে গল্প জুড়ে দিল।
-‘কোথায় যাবেন মিস? উপস, মিসেস!’
-‘কুমিল্লা।’
-‘আরে! আমিও।’
ছেলেটি উৎফুল্ল হয়ে একটার পর একটা গল্প জুড়ে দিচ্ছে মৃত্তিকার সাথে। এটা-ওটা বলে হাসাতে চেষ্টা করছে মৃত্তিকাকে। ছেলেটির এমন বাচ্চাপনা দেখে মৃত্তিকা আপনমনেই মুচকি হাসলো। এই ছেলেকে দেখতে খারাপ লাগছে না, ভরসা করা-ই যাই। প্রথমে মৃত্তিকা মনে করেছিল হয়ত ছেলেটা খারাপ হতে পারে। আজকাল-কার যুগে তো কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এই ছেলেটার এমন বাচ্চাপনা গল্প শুনে মনে হচ্ছে না ছেলেটা খারাপ হবে। তাই মৃত্তিকাও ছেলেটার কথার এটা-ওটা উত্তর দিলো। কিন্তু মৃত্তিকা বুঝতে পারলো না আর কিছু সময় পরেই তার কপালে কত বড়ো বিপদ অপেক্ষা করছে! আসলেই কী তার ভাবনা অনুসারে ছেলেটা ভরসাযোগ্য!
গল্প করতে করতে মৃত্তিকা ঘুম ঘুম ভাব আসতেই ছেলেটি তা বুঝতে পেরে মৃত্তিকাকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে বলল। এরপর নিজের মোবাইল বের করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসলো। মৃত্তিকাও জানালাটা খুলে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিতে দিতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
.
.
মৃত্তিকা চোখ খুলতেই নিজেকে বদ্ধ অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করলো। সে ভ্রু কুঁচকে উঠে বসতেই খেয়াল করলো তার হাত-পা শক্ত কিছুর সাথে বাধা। সে এখানে কীভাবে এলো তা ভাবতে পারলো না। হিসেব মোতাবেক এখন তো তার স্টেশনে থাকার কথা ছিল তাহলে এখানে কীভাবে আসলো সে! কাল রাত ছেলেটার সাথে গল্প করে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছিল তা খেয়াল করতে পারেনি। এরপর তো আর কিছুই হয়নি। ঘুমানোর পরও তার তো বাসেই থাকার কথা ছিল। এখানে কীভাবে আসলো সে! ঘুমানোর পর কী হয়েছিল মৃত্তিকার সাথে! তার মানে কী তার পাশের মিষ্টবাসি ছেলেটাই এসবের কারণ! মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়েও কোনো আলোর হদিস পেলো না। সে চিৎকার করতে গিয়েই খেয়াল করলো তার চিৎকার বেরোচ্ছে না, তার মুখে কিছু একটা আটকানো। মৃত্তিকা কোনো আওয়াজ বের করতে গিয়েই গোঙানীর আওয়াজ হলো। তাকে কোনো একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলা হয়েছে। ঘাড়টা ভীষণ ব্যথা করছে, হয়ত এভাবে একপাশ হয়ে ঘুমানোর ফলে। মৃত্তিকা পেছনের হাতের বাঁধনটা খুলতে চেয়েও খুলতে পারলো না। অনেক শক্ত করে দুইহাত একসাথে বাধা হয়েছে। মৃত্তিকা হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করতে করতে একসময় দুর্বল হয়ে পড়লো। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ঈশান ভাইয়ের চেহারাটা চোখের উপর ভাসছে।আস্তে আস্তে দুর্বলতা গ্রাস করছে। কী করবে সে এখন! কে এখানে মৃত্তিকাকে বাঁচাতে আসবে! কেউই তো জানে না মৃত্তিকার ঢাকার বাইরে আসার ব্যাপারটা! তাহলে কী এভাবেই কাটাতে হবে! এরপর তার সাথে কী হবে ভাবতেই মৃত্তিকার চোখ গড়িয়ে দু’ফোটা অশ্রু বেরিয়ে এলো।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার নজরে দেখবেন আশা করি। পারলে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, সংশোধন করে নিব ইন শা আল্লাহ। হ্যাপি রিডিং 🥰)