রঙিন রোদ পর্ব-৯

0
727

#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯

-‘হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন! আপনি কী মৃত্তিকা? মানে এই মোবাইলের মালিকের বেস্ট ফ্রেন্ড? এই মোবাইলের মালিক অনেক বড়ো একসিডেন্ট করেছেন। উনার এখন অনেক ক্রিটিকাল অবস্থা। মোবাইলটা এতক্ষনে একটু চার্জ হওয়াতে কললিস্টে আপনার নাম্বার আগে পেয়ে কল দিয়েছি।’

মৃত্তিকার কান দিয়ে এতকিছু ঢুকছে না। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘ক… কোন… হা… হাসপাতালে আছে!’

-‘জি, আমি অ্যাড্রেস মেসেজ করছি। আপনি উনার পরিবারকে খবরটা দিয়ে দিয়েন। উনার অবস্থা অনেক ক্রিটি…’

মৃত্তিকা আর কিছু শোনার প্রয়োজনবোধ করলো না। সে মোবাইল নিয়ে কোনোমতেই তড়িঘড়ি করে ঐভাবেই বেরিয়ে পড়লো।

হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছেই মৃত্তিকা সিয়ার ওখানে দৌড়ে গেল। মৃত্তিকা যেতেই ডাক্তাররা মৃত্তিকার সাইন নিয়ে সিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে ফেলল। অবশ্য, ডাক্তাররা আগে পরিবারকে খুজেছিল কিন্তু অবস্থা বেশি ক্রিটিকাল হওয়ায় মৃত্তিকা ডাক্তারদের বেশি জোর করাতে ওরা অপারেশনের ব্যবস্থা করলো। বাইরের থেকে থিয়েটারের কাঁচ দিয়ে ভেতরে তাকাতেই সিয়াকে এরূপ রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ডাক্তাররা তড়িঘড়ি করে ভেতরের পর্দাটা টেনে দিতেই মৃত্তিকা থিয়েটারের বাইরে মেঝেতে বসে পড়লো। চঞ্চল সিয়াকে এমন শান্ত অবস্থায় মৃত্তিকা সহ্য করতে পারছে না।
হঠাৎ খেয়াল হলো সিয়ার পরিবারকে বলা হয়নি। মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি করে সিয়ার পরিবারকে কল দিয়ে সব জানিয়ে রিনিকে কল করে জানাল। কাঁদতে কাঁদতে মৃত্তিকার চোখ-মুখ ফুলে গেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে ক্রান্ত হয়ে মেঝেতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুসময় পর থিয়েটারের দরজা খোলার আওয়াজে মৃত্তিকা চোখ খুলেই দেখতে পেল একজন ডাক্তার তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসছে। সে কোনোমতে উঠে ডাক্তারের কাছে যেতেই ডাক্তার জানাল – রোগীর জন্য আর্জেন্ট রক্ত লাগবে কারণ অনেক রক্ত কমে গিয়েছে।
মৃত্তিকার হঠাৎ মনে পড়লো তার আর সিয়ার রক্তের গ্রুপ মিল। তারা সবসময় সেটা নিয়ে গর্ব করে বলতো,সবাইকে বলতো ওরা দুইবোন যার ফলে সবকিছুর সাথে সাথে রক্তের গ্রুপও মিল। মৃত্তিকা উত্তেজিত কণ্ঠে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

-‘আমি দিব রক্ত।’

-‘কিন্তু আপনাকে তো দেখতে অনেক দুর্বল লাগছে। পারবেন?’

-‘হ্যাঁ, পারবো।’

মৃত্তিকার জবাব পেতেই ডাক্তার তাড়াতাড়ি করে একটা নার্সকে ডাক দিল। নার্স আসতেই ডাক্তার আবার থিয়েটারে ঢুকে গেল। নার্স মৃত্তিকাকে একটি ক্যাবিনে নিয়ে রক্ত নিতেই মৃত্তিকাকে দুর্বলতা গ্রাস করে যার ফলে নার্স একটি ঘুমের ওষুধ দেয় যাতে মৃত্তিকা ঘুম থেকে উঠেই একটু সুস্থতা অনুভব করে। এরপর নার্স রক্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

নার্স মৃত্তিকার ক্যাবিন থেকে বের হতেই কেউ একজন আড়াল থেকে দেখে সেই ক্যাবিনের দিকে এগিয়ে গেল।
আগন্তুকটি আস্তে আস্তে গিয়ে মৃত্তিকার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মলিন শ্বাস ফেলে এক দৃষ্টিতে মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

-‘কতদিন পরে এই চেহারাটা দেখছি। আজকের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত মৃত্তি। ক্ষমা করে দিও আমায়। আমি না চাইতেও এটা করতেই হলো। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মৃত্তি। চাইলেও কাছে আসতে পারি না। জানো, ভীষণ কষ্ট হয় তোমার দূরে থাকতে। আচ্ছা, ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন হয় মৃত্তি! বড্ড মিস করি তোমায়! আজকে তোমার সবচে কাছের বোন সমান বান্ধবীর এরূপ অবস্থার জন্য আমি দায়ী। না চাইলেও করতে হয়েছে আমায়। ক্ষমা করে দিও আমায় মৃত্তি। আমি যে তোমায় বড্ড ভালোবাসি।’ আস্তে আস্তে কথাগুলো বলতে বলতেই আগন্তুকটার চোখ বেয়ে অশ্রু নির্গত হলো। আগন্তুকটা মৃত্তিকার দিকে ঝুঁকে থাকায় তার চোখের পানি মৃত্তিকার কপালে পড়লো।

কপালের উপর তরল জাতীয় কিছু পড়ায় মৃত্তিকা ঘুমের মাঝেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। তার মনে হচ্ছে, কেউ যেন খুব গভীর-ভাবে তার মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। আগন্তুকটার নিঃশ্বাস মৃত্তিকার মুখের উপর আঁচড়ে পড়ছে কিন্তু মৃত্তিকা চাইলেও তার চোখ খুলতে পারছে না। বারবার চাইতেও আবারো গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।

মৃত্তিকার নড়াচড়া দেখে আগন্তুকটা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। শেষবারের মতো মৃত্তিকার মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

——-

মৃত্তিকা চোখ খুলেই রিনিকে তার পাশে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার নিজের আবার কী হলো! সে শোয়া অবস্থায় ক্যান! আস্তে আস্তে সবকিছু মনে পড়তেই সে তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসল।

-‘রিনি, সি… সিয়া কই?’

সিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই রিনি মুখ পাংশুটে করে ফেলল।

-‘শোন মৃত্তি। সিয়ার বেশি ক্রিটিকাল অবস্থা ছিল যার ফলে ডাক্তাররা চেয়েও তার অবস্থা ভালো করতে পারেনি। তবে চেষ্টায় আছে।’

-‘সোজাসুজি বল রিনি।’

মৃত্তিকার কথা শুনে রিনি মাথা নিচু করে ফেলল।
-‘সিয়ার এক্সিডেন্ট বেশি ভয়ঙ্কর’ভাবে হয়েছে – ডাক্তাররা এমন কল্পনা করতেছেন। শরীরের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। একসিডেন্টের মাঝে সিয়ার পেতে ছুরির আঘাত কোথ থেকে এলো কেউ ভাবতে পারছে না। আপাতত এখানেই তার চিকিৎসা চালাতে হবে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে।’ এরপর রিনি মাথা নিচু করে আবারও বলে উঠল,’আল্লাহ যদি চান তাহলে সিয়া আবারো আমাদের মাঝে ফিরে আস…’

রিনির কথা শুনে মৃত্তিকা যেন থমকে গেল। তার চোখ দিয়ে অঝোরে ধারায় অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। তার কানে একটা মাত্রই কথা বাজছে যে ‘ডাক্তাররা সিয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ‘ মৃত্তিকা রিনির আর বাকি কথাগুলো না শুনে দৌড়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে সিয়াকে আলাদা করে রাখার ক্যাবিনটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন পেছন রিনি এগিয়ে এলো। মৃত্তিকা আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে ক্যাবিনে ঢুকে সিয়ার পাশে দাঁড়াল। সিয়ার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মাথায় ব্যান্ডেজ। শরীরের নানা জায়গায় ব্যান্ডেজ। আজ সিয়া কী শান্তভাবে শুয়ে আছে!

-‘স… সি… সিয়া! এই সিয়া। উঠ না বোন আমার। আমরা গুলশানে যাবো। আড্ডা দিবো অনেক।’

সিয়ার কোনো নড়াচড়া না দেখে মৃত্তিকা রিনির দিকে ফিরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,

-‘ র… রি… রিনি..এই রিনি! আমার সিয়া আবারো আগের মতো আমার সাথে হেসে খেলে কথা বলবে। সে মজা করছে তাই না? তোরা দুইজনে মিলে প্রতিবারের মতো আবারও আমাকে বোকা বানাতে চাচ্ছিস তাই না? আমি কিন্তু এবার আর বোকা হবো না। তোদের চালাকি ধরে ফেলেছি। সিয়া উঠ।’

মৃত্তিকার কথা শুনে পেছনে রিনি ফুফিয়ে উঠলো। মৃত্তিকা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আস্তে আস্তে সিয়ার শরীরে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে চেষ্টা করলো কিন্তু আজ আর সিয়া চোখ খুললো না।

হঠাৎ ক্যাবিনের দরজা খুলে সিয়ার মা দৌড়ে এসে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তেই মৃত্তিকাও ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। তার সিয়া আজ আর তার সাথে মজা করতে আসছে না।

অদূরেই সিয়ার বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সিয়ার মায়ের বেশি কান্না দেখে তিনি তার স্ত্রীর দিকে এগিয়ে স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সিয়ার মা কিছুক্ষন আগেও বেহুঁশ হয়ে ছিল অন্য ক্যাবিনে। হুশ ফিরতেই আবারও মেয়ের কাছে পাগলের মতো ছুটে এসেছে।

একজন নার্স তাদের ডাক দিতে দিতে ক্যাবিনের দরজা খুলে দৌড়ে এসে তাদের উপর বকা-ঝকা করতেই সবাই কন্দনরত চোখে সিয়াকে আরেকবার দেখে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল । সিয়ার মা কাঁদতে কাঁদতে আবারো বেহুঁশের ন্যায় হয়ে পড়লো।

মৃত্তিকা নিজেও তার আগের অবস্থায় নেই। তার বারেবারে মনে হচ্ছে, এইতো সিয়া এখনই শোয়া থেকে উঠে অক্সিজেন মাস্ক ছুঁড়ে ফেলে হেসে বলে উঠবে,’দেখেছো? তোমাদের কীভাবে অতি সহজে বোকা বানিয়ে ফেলেছি!’
তখন মৃত্তিকা দৌড়ে সিয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে এগিয়ে গিয়ে দুইটা থাপ্পড় লাগাতেই সিয়া মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে তার রাগ কমানোর চেষ্টা করবে। এক পর্যায়ে সফলও হবে। মৃত্তিকার রাগ কমে গিয়ে হেসে দিবে।

মৃত্তিকা বারবার সিয়ার ক্যাবিনের দরজার কাঁচ দিয়ে সিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। এই বুঝি সিয়া উঠে যাবে কিন্তু আজ আর মৃত্তিকার ইচ্ছে সফল হলো না। সিয়া উঠলো না। নিশ্চুপভাবে শুয়ে আছে আজ। আজ আর মৃত্তিকার মন খারাপ অবস্থায় হাসাতে চেষ্টা করতে এলো না সিয়া।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। গল্পের সাথে বাস্তবতা মিলাবেন না আশা করি। অনেকে বলছেন, রহস্য খুলে দিতে কিন্তু আপনারাই বলুন? মাত্রই তো কিছু রহস্য শুরু হয়েছে। এটাকে আরেকটু গভীর করতে গেলে অবশ্যই আরো কয়েক পর্ব টানতে হবে তারপর আস্তে আস্তে খুলতে পারবো। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ। আমি চেষ্টা করবো, আমার সাধ্য অনুসারে আগানোর। রি-চেক করা হয়নি।ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার নজরে দেখবেন আশা করি। পারলে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, সংশোধন করে নিব ইন শা আল্লাহ। হ্যাপি রিডিং💙)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here