আমার রাজ্যের রানী পর্ব-৮

0
3271

#আমার রাজ্যের রানী
#Part : 8
#Writer : Sriti Nur Avni

🍁
তুমি আমার থেকে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো,আমার সাথে থেকে তোমার লাইফ টা নষ্ট করো না।

সম্পর্কের ২ বছর পর মাহিনের মুখে এমন কথা শুনার পর আমি অবাক হলেও খুব বেশি অবাক হইনি।আমি অনেকদিন যাবৎ ই মাহিনের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিলাম।

মাহিনের কথা শুনে আমার ওকে কি বলা উচিৎ বুঝতে পারছিলাম না তবে মনে মনে প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো আর মনে মনে ভাবছিলাম,,,,
আমি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করি সেটা তোমার এতো দিনে মনে হলো?যখন রিলেশনের আগে দিনরাত পিছন পিছন ঘুরতে একটু কথা বলতে চাইতে তখন এই কথা মনে ছিলো না?আমি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করি নাকি তুমি আমার থেকে রূপবতী কাউকে পেয়ে গেছো বলে এইসব বলছো?সে কি আমার থেকেও বেশি ভালোবাসবে তোমাকে? নাকি শুধু রুপ টাই দেখে এমন রং বদলে ফেললে?
ভাবতে ভাবতে রাগে নিজের নখ দিয়ে নিজেকেই আঘাত করছিলাম।

মাহিন কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বললো,,, দেখো বি প্রাক্টিক্যাল।ইমোশন আর আবেগ দিয়ে জীবন চলে না,,,আমার পড়াশোনা শেষ করে জব নিতে নিতে আরো অনেম সময়। ততদিনে তোমার বয়স তো আর কমবে না বরং বাড়বে তখন তোমার আর বিয়ের বয়স থাকবে না।তুমি তোমার ফ্যামিলির পছন্দ মতো বিয়ে করে নাও।আমি জানি তুমি আমার থেকে আরো ভালো ছেলে পাবে।

আমি শুধু মাহিন কে মিনমিন করে বলেছিলাম,কিন্তু আমি তো তোমার ক্যারিয়ার গড়ে উঠার আগে পর্যন্ত তোমার হাতে হাত রেখে পাশে থাকতে চাই।তাতে যতো বাঁধাই আসোক না কেন দুজন একসাথে থাকলে ঠিক সামলে নিতে পারবো।

কিন্তু আমি চাই না রিলেশন কন্টিনিউ করতে,, একজনের ইচ্ছায় সম্পর্ক টিকে থাকে না।তোমাদের মতো মিডেল ক্লাসের মেয়েদের আমার ফ্যামিলি মেনে নিবে না অভনী (মাহিন)

আমি সেদিন মাহিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম রেস্টুরেন্ট থেকে।যার কাছে আমার চোখের জলের কোনো মুল্য নাই কি দরকার বলুন তার সামনে কেঁদে কেটে ভালোবাসা ভিক্ষা চাওয়ার?আমার ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিলো না তাহলে?আমার মধ্যেও সেদিন পুরনো কথা গুলো খুব মনে হচ্ছিলো। আমি মনে মনে শুধু একটা কথাই ভাবতে ছিলাম,,,এতো ঘুরিয়ে পিছিয়ে কথা বলার কি ছিল মাহিন এতোদিন কথা বলতে না চেয়ে কষ্ট না দিয়ে একেবারে বলে দিতে পারতে আমাকে আর ভালো লাগছে না তোমার।পুরোনো হয়ে গেছি আমি।

সেদিন রাতে ঘুরন্ত সিলিং ফ্যান এর দিকে একনজরে তাকিয়ে ছিলাম আমি কিন্তু কিছু করার মতো সাহস আমার ছিলো না,,,বাবা মায়ের মুখটা বারবার মনে হচ্ছিলো।

গুধূলি লগ্নে জিক জিক করা নদীর পানির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেই একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস নিলো অভনী।তার একটু দূরে বসে থাকা ছেলেটিও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পানির দিকে।

শহর থেকে বেশ অনেক টা দূরে নদীর পাড়ে এসেছে ওরা।নীলের মন খারাপ হলে বা খুব খুশি থাকলে প্রায়ই নীল এই জায়গায় চলে আসে,,,আজকেও তার মন খারাপ।মিটিং শেষ করে আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেছে তাদের।অভনী প্রথম আসতে না চাইলেও মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হচ্ছিলো,,, ক্ষতি কি মানুষ টার মন খারাপের সময় একটু পাশে থাকতে পারলে?অভনী তার মা কে আগেই কল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আসতে লেট হবে।

🍀
বিকেলের গোধূলি লগ্নে নদীর পাড় ধরে গাঁছের ছায়ায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে অভনীর।আজ ওর ও মন খারাপ ছিলো কিন্তু মন খারাপের সময় এমন একটা জায়গাই মন ভালো করার জন্য যথেষ্ট। কোলাহলশূন্য জায়গা টাতে নদীর কিনারা ধরে কিছু নৌকা আর নদীর মাঝখানে কিছু জেলে মাছ ধরছে।
অভনী নিজের জুতো জোরা হাতে নিয়ে নীলের হাত টা ধরে বললো,,,

—জুতু খুলুন হিরো সাহেব।

অভনীর কথায় আর কাজে নীল চরম রকমের অভাক হলো,,,ভ্রু কুঁচকে অভাক হয়ে বললো,,

—কেনো?

—নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটবো তারপর সেই পা নিয়ে হাঁটবো এই নরমন ঘাসে।আপনি শহরে থেকেছেন মন খারাপের সময় এখানে এলেও এমন ভাবে কখনো হাঁটেননি,,,কিন্তু আমি গ্রামের মেয়ে নদীর পাশেই আমাদের বাসা ছিলো ছোট বেলা যখন সবাই এক সাথে এমন করে হাঁটতাম খুব মজা হতো কিন্তু বড় হবার পর আর মা দেয়নি। অনেক দিন যাবৎ নদীর পানির মধ্যে পা ভিজিয়ে হাটা হয়না তাই এখন হাঁটবো।খুলুন খুলুন।(অভনী)

—কিন্তু ওখানে তো কাঁদা অভনী।(নীল)

—আপনার পা দুটো কি সিলিং ফ্যানের সাথে জুলিয়ে রাখবেন নাকি জাদুঘরে তুলে রাখবেন?যে ময়লা লাগলে জামেলা?হিরো সাহেব এই পৃথীবি টাই একটা ময়লা ভর্তি নোংরা জায়গা।এতো এতো ময়লার মধ্যে থেকেও ময়লা কে ভয় পেলে কি চলে?চলুন না আমার সাথে সাথে আপনিও বেশ ভালো লাগবে আপনার।এই ময়লা ভর্তি নষ্ট পৃথিবীর ময়লা গায়ে মেখে একদিন এই মাটির ঘ্রান টা নিয়ে দেখুন না দেখবেন কতোটা আপন লাগে সেই ঘ্রান। (অভনী)

নীল হালকা মুচকি হাসলো,,, জুতো দুটো খুলে হাতে নিয়ে অভনীর সাথে নেমে গেলো নদীর কাঁদাময় জলে।বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর অভনী দৌঁড়ে চলে গেলো আরেকটু সামনে পরে থাকা ছোট ছোট ঝিনুকের কাছে।অভনী ঝিনুক কুড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। মিষ্টি কালারের শাড়ির আঁচল আর লম্বা চুল গুলো উভয়ই ভাসছে নদীর জলে,,,,কি অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য!!।সেদিকে অভনীর কোনো খেয়াল নেই সে ব্যাস্ত ঝিনুক কুড়াতে। কিন্তু নীল অভনীর আড়ালে বেশ কয়েক টা ছবি তুলে নিয়েছে।
খিলখিল করে হাসির সাথে বেসে যাওয়া আচঁল কি অদ্ভুত মায়াতেই না জরাচ্ছে এই বাতাস টাকে,,এই নদী টাকে আর সামনে দাঁড়ানো সুদর্শন পুরুষ টাকে।অভনী বেশ কয়েক টা ঝিনুক নিয়ে ফিরে এলো নীলের কাছে।

—খুব ভালো লাগছে না হিরো সাহেব?

—হুম খুব।গোধুলির লগ্নে সন্ধ্যার হালকা রোদের আলোতে এমন ভাবে হেঁটে বেড়াতে কার না ভালো লাগবে বলো?আবার মাঝে মাঝে অপূরুপ সুন্দর দৃশ্য গুলোও সামনে চলে আসছে।আমি কিন্তু এখনি যাচ্ছি না এখান থেকে থাকুক না আর কিছু সময় ভালোলাগার।😍

—কিন্তু এখন তো আপনার মন ভালো হয়েছে তাছাড় এখান থেকে যেতে যেতে ও তো সময় লাগবে বেশি লেট হয়ে যাবে তো হিরো সাহেব।

—জিনা বেশি দেরি হবে না তুমি তো আমাকে হিরো সুপারম্যান সব ই বলো আমি না হয় সুপারম্যান হয়েই গাড়ি চালাবো।

নীলের কথা শুনে অভনী খিলখিল করে হাসি শুরু করলো তার সাথে সাথে অবনীর দিকে তাকিয়ে নীল ও হেসে উঠলো,,,,এমন একটা পরিবেশে অভনীর খিলখিল করে হাসির প্রতিধ্বনি যেন বার বার ফিরে আসছে চার পাশ থেকে নীলের কানে।

—আর ৫-১০ মিনিট পর অনেক টাই অন্ধকার হয়ে যাবে আর যেহেতু জোছনা রাত তাই চাঁদ ও উঠে যাবে তাড়াতাড়ি।জানো এই চাঁদের আলোতে নদীর ঠিক মাঝখান টায় বসে থাকতে কতো ভালো লাগে..?তুমি ছোট থেকে নদীর পাশে থাকলেও তুমি মেয়ে মানুষ তাই রাতের বেলার এমন একটা পরিবেশ হয়তো উপভোগ করোনি কখনো।চলো না আজ আমার সাথে দুজন এক সাথে জোছনা বিলাশ করি বেশি সময় না শুধু ই একটু। (নীল)

নীলের এমন বাচ্চামি দেখে অভনীর খুব হাসি পাচ্ছে। আসলেই মাঝে মাঝে খুব কঠিন মনের বড় মানুষ ও বাচ্চা হয়ে যায়। এক তার মায়ের কাছে আর আরেক তার ভালোবাসার মানুষ টার কাছে। ওরা আরো কিছুদূর হেঁটে বেড়ালো।তখনি সন্ধ্যা নেমে চারদিক থেকে আধার নেমে এলো কয়েক জন মাঝি নৌকা রেখে বাসায় চলে যেতে লাগলো আবার অনেকে আসতে লাগলো,,,।
নীল একটা মাঝি কে ডেকে বললো,,,

—আংকেল আমাদের কে ওই যে নদীর মাঝখান টায় নিয়ে যেতে পারবেন?(নীল)

—আরে বাবা তু,,,,

মাঝি পুরো কথা শেষ করার আগেই অভনীর আড়ালে নীলের ইশারায় থেমে গেলো,,,মাঝি আবারো বলতে লাগলো,,

—হু বাবা আসো (মাঝি)

নীল আর অভনী নৌকায় উঠে পড়লো,,,নৌকার পাটাতনে আধশোয়া হয়ে বসে আছে নীল।চোখ দুটো তার আকাশে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।অনেক দিন যাবৎ আসা হয়না এখানে। কতদিন মন খুলে মুক্ত আকাশ দেখা হয়না তার।কতদিন নিশ্বাসের স্বাদ টা নেয়া হয়না তার।কতদিন আকাশের সাথে মন খুলে কথা বলা হয়না। চোখ দুটো আকাশের দিকে করে হাত দুটো ছরিয়ে বসে আছে নীল।
তার ঠিক অপর পাশেই অভনী কাপড় শহ পা দুটো পানিতে রেখে ভাবলেশহীন ভাবে নাচিয়ে যাচ্ছে পা গুলোকে ।দুজনেই মুগ্ধ নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।মুগ্ধ তো হবার ই কথা এমন একটা মুহূর্তে সময় টা যদি থমকে যায় তাহলে কতোই না ভালো হতো।কিন্তু সময় চলছে তার আপন গতিতে।
বেশ কিছু সুন্দর মুহূর্তে পার করার পর তাদের উঠতে হলো নিজে গন্তব্য যাওয়ার জন্য।

নীল মাঝি কে জরিয়ে ধরে ধন্যবাদ দিয়ে তার পাওনা থেকে আরো বাড়িয়ে বকশিশ দিয়ে দিলো লোকটা নিতে চাচ্ছিলো না তবুও নীল জোর করে দিয়ে এসেছে হয়তো মাঝি আগে থেকেই চেনে নীল কে তাই নিতে চাচ্ছিলো না।
নীল এতো বড়লোক হবার পরেও মাঝির সাথে এতো সুন্দর ব্যাবহার খুব সহজেই অভনীর মনে নাড়া দিয়ে গেলো,,,লোকটার অহংকার বলতে কি কিছু নেই?,এতো সহজে কিভাবে মিশে যায়?অভনী ভাবে আর অভাক হয় তার সাথে বাড়ে কৌতুহল,,,নীল কে জানার কৌতুহল,, ,।

ওরা দুজন এখনো জুতো জোরা হাতে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গাড়ির উদ্দেশ্য,,,, কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর কয়েক টা বখাটে ছেলের সামনে পরলো তারা।অভনী কে দেখে সিটি বাজানো থেক শুরু করে নিম্ন মানের কথা গুলোও চলতে থাকলো তাদের মাঝে।অভনীর গা জ্বলে যাচ্ছে ইচ্ছে করছে সব গুলোকে ঠাটিয়ে চড় মেরে সোজা করে দিক কিন্তু কত জন কেই বা সোজা করতে পারবে সে যেখানে যায় সেখানেই তো এমন উল্টো চড় মাড়লে সেই রাতের মতো যদি আবারো খেপে যায়।অভনী ভয় মাখা অসহায় চোখে তাকালো নীলির দিকে কিন্তু এতে নীলের কোনো হেলদুল নেই।সে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলে গুলোর দিকে।
ছেলেগুলো আসতে আসতে সামনে আসতে লাগলো আর অভনী ভয়ে কুকরিয়ে নীলের শার্ট খামছে ধরলো,,,,তার গলা শুকিয়ে কাট হয়ে যাচ্ছে ছেলে গুলো দেখে মুটেও ভালো ঠেকছে না অভনীর। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে হাত দিয়ে খামছে ধরে আছে নীলের শার্ট। যখনি ছেলে গুলো একেবারে অনেক টা কাছে চলে আসলো তখন নীল বললো,,,

—অভনী ঠিক এই মুহূর্তে আমার চেহারা টা দেখে বলো তো আমায় কেমন লাগছে?

মোবাইলের লাইট জালিয়ে মুখের দিকে করে নীল জিজ্ঞাসা করলো অভনী কে,,,নীলের কথায় অভনী ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সাথে ছেলেগুলোও।অভনীর রাগ হচ্ছে নীলের পর এমন একটা সময় কি এইসব বলার সময়? তা একদমি মাথায় ঠেকছে না তার।তবুও চোখ পিট পিট করে নীলের দিকে তাকালো তার সাথে তাকালো ছেলেগুলোও,,,,ছেলেগুলো নীলের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলো,,, রেগে অগ্নিমূর্তী হয়ে আছে নীল চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে।একজন ছেলের মুখ দিয়ে অস্পষ্ট সুরে বেড়িয়ে এলো,,,
—ফারহান ভাই।

ছেলে গুলো আর এক মুহূর্তে ও ওইখানে না দাঁড়িয়ে দৌঁড়ে চলে যেতে লাগলো,,,।আর অভনী অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে একবার ছেলো গুলোকে তো একবার নীল কে।

চলবে,,,,
(গল্পে একটু রোমান্টিক তো থাকতেই হয়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here