ফিঙের_ডানা পর্ব-১৮

#ফিঙের_ডানা
পর্ব-১৮

বসন্তকাল। আমাদের ঘরের পেছনে ঝোপালো একটা পলাশের গা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। দূর থেকে দেখলে আগুন লেগেছে বলে ভ্রম হয়৷ লিলির মা উঠোনের কোণে কয়েকটা সূর্যমুখীর গাছ লাগিয়েছে। সেগুলো মাথায় আমাদের ছাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার পায়তারা করছে। সারাদিনের সেখানে ভ্রমরের আনাগোনা। আমার বিষন্ন সুন্দর জীবনটা এসবের মাঝে খানিকটা রঙিন। সেদিনের পর থেকে সোহান হুটহাট চলে আসে। যদিও অনেকদিন পরপর, তবে আসে। আর আমি রোজ তার অপেক্ষায় বসে থাকি৷

ইদানীং আরেকটা চিন্তা জুটেছে আমার৷ মা’কে নিয়ে চিন্তা। আমি চলে গেলে মায়ের কী হবে?- ভাবনাটা আগে থেকেই ছিল। আর আমারও ইচ্ছে ছিল নিজে চাকরি করে বাড়ি করে তাকে রাখব। কিন্তু একদিন একটা ঘটনায় মনে হলো ব্যাপারটা অন্যরকম হলে মন্দ হয় না।

কিছুদিন আগে মা জ্বরে পড়েছিল। খারাপ ধরনের জ্বর। অনেকগুলো দিন সেটা ভুগিয়েছিল মাকে। এমনিতেও তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। কোমর ব্যথা, প্রেশার বাড়া কমার মধ্যে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছিল। ডাক্তার এন্টিবায়োটিক দিয়েছিল। সেটা খেয়ে তবে জ্বর কমল। এর মধ্যে মায়ের ছুটিও ফুরিয়ে এলো। মা ছুটল অফিসে। দুপুরে খেয়াল করলাম সে ঔষধ নিয়ে যায়নি। এদিকে এন্টিবায়োটিক ঠিকমতো না খেলে রোগও ভালোভাবে ছাড়বে না। আমি ঔষধ নিয়ে ছুটলাম অফিসে। মায়ের সাথে দেখা হওয়ার আগে দেখা হলো এক সিনিয়র অফিসারের সাথে। নাম শফীক আজাদ। আমার পরিচয় পেয়ে খুব খাতির করে আমাকে তার রুমে নিয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ গল্প করলেন। চা নাস্তা খাওয়ালেন। আমি বেশ আশ্চর্য তার এই আচরনে। অবশ্য তাকে জিজ্ঞেস করিনি কিছু। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা এড়িয়ে গিয়েছিল।

এর চার-পাঁচদিন পর মায়ের সহকর্মী শেফালী আন্টি বাড়িতে এলেন। মায়ের অগোচরে আমাকে বলে বসলেন, শফীক আজাদ নামের লোকটা নাকি মাকে পছন্দ করে। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে কয়েকবার। মা প্রতিবারই প্রত্যাখ্যান করেছে। সেটা যে আমার জন্য তা বোঝাই যায়। নইলে মায়েরও নাকি তাকে পছন্দ। তিনি অনেক ভালো লোক। এখানে আসার পর মায়ের অনেক সাহায্য করেছেন। তিনিও বিপত্নীক। এক ছেলে এক মেয়ে আছে, সবাই কানাডা থাকে। শেফালী আন্টি আমাকে বলে গেলেন আমি যেন মাকে বুঝিয়ে বলি। এই বয়সে উনার জন্য এরচেয়ে ভালো কিছু হতেই পারে না।

আমার নিজেরও শফীক আঙ্কেল মানুষটাকে ভালো লেগেছে। আমার সাথে এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন নিকটাত্মীয়, অনেকদিন পর দেখা হয়েছে।

সমস্যা হলো এ বিষয়ে মাকে কিছু বলা। আমার নিজেরও মেনে নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। নিজের মায়ের সাথে বাবা ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করাটা ভীষণ কষ্টের। যতই ভালো লোক হোক, মায়ের ভাগ দিতে কি মন মানে? আমার ইচ্ছে মাকে সারাজীবন নিজের কাছে রাখার। কিন্তু মায়ের দিকটাও তো ভাবতে হবে। তিনিই বা কেন আমার জন্য একটা সুন্দর জীবন ছেড়ে দেবেন? একা একা বাকি দিনগুলো পার করবেন? আমি কি এতটা স্বার্থপর হব?

এখন পর্যন্ত এই নিয়েই ভাবছি। কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না। সকালবেলা মা বেরিয়ে গেল। লিলিও চলে গেল কলেজে। আজ আমার একটা ক্লাস, তাও জরুরি নয় বলে গেলাম না। এখনো হালকা শীতের ছোঁয়া রয়েছে। রোদে বসে উঠোনে রৌদ্র-ছায়ার খেলা দেখছি, তখনই কাকের বাসার আগমন। তিনি মাথা দুলিয়ে গুনগুন করতে করতে আসছেন। আমাকে দেখে বাঁকা হাসি হেসে বলল, “এক জায়গায় যাবে?”

“কোথায়?”

“বেড়াতে। গাজিপুরে একটা রিসোর্টে।”

রিসোর্ট মানে ফার্মহাউজ বলে যে ওগুলো নাকি? ‘ফার্মহাউজ’ শব্দটা শুনলে প্রথমেই বাংলা সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। ভিলেনরা নায়িকাদের ফার্মহাউজে নিয়ে গিয়ে…ছি ছি! কিন্তু কাকের বাসা তো আর ভিলেন না, তার ওপর আমার স্বামী।

“কী ভাবো? আজকেই যাব। সাথে আরও একটা কাপল যাবে। এক বন্ধু আর ওর গার্লফ্রেন্ড। ওর গাড়িতে যাব। আধঘন্টা পর রওনা হব। গেলে দ্রুত রেডি হবে।”

আমার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করল। আরও এক জোড়া যাবে যারা আমার প্রেমিক প্রেমিকা। মেয়েটার কি ভয়ডর নেই? প্রেমিকের সাথে এতদূর যাবে! প্রেমিক যদি ভালো ছেলে না হয়?”

সোহান এবার চিৎকার করে বলল, “তুমি কি যাবে নাকি যাবে না?”

“আমরা কি আজকেই চলে আসব?”

“জি না। রাতে থাকব। কালকে আসব।”

“মা বকবে।”

“কেন বকবে?”

“না বলে গেলে।”

“না বলে যাবা কেন? ফোন করো।”

“যদি যেতে না দেয়?”

“১০০% দেবে। তুমি ফোনটা তো করো!”

মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে মা বলে দিল চলে যেতে। এত সহজে অনুমতি পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি!

অনুমতি পেতেই আমি তৈরি হতে গেলাম। কী পরব সেটাও একটা সমস্যা। সোহান কয়েকটা জামা কিনে দিয়েছে, ঈদের জামাটা পরা হয়নি, আবার শাড়িও আছে দুটো। আমি কিছুক্ষণ আলমারি খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম। সোহান ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে ঘরে ঢুকেছে। নিজেই বেছে একটা হালকা গোলাপী রঙের জামা বের করে দিল। এটার সালোয়ার ওড়না সাদা। জামাটা সুন্দর, গোল গোল আয়না বসানো।

আমি রেডি হতে হতে সোহানও জামাকাপড় বদলে এলো। গাড় সবুজ শার্ট, চোখে রোদচশমা।

আমরা রওনা দিলাম এগারোটার একটু আগে। সোহানের বন্ধুর নাম অভি, অভির প্রেমিকা স্নেহা। দুজনেই একটু হাই হ্যালো করে গাড়িতে সামনের সিটে উঠে বসল। আমি আর সোহান পেছনে। রওনা হওয়ার পর খেয়াল করলাম কেউ কোনো কথা বলছে না। যেন রাজ্যের নিরবতা ভিড় করেছে গাড়িতে। অভি গাড়ি চালাচ্ছে, স্নেহার কানে হেডফোন, সোহান গাড়িতেই রোদচশমা করে বসে আছে। কোনদিকে তাকাচ্ছে বোঝার উপায় নেই। সোহান ওদের বলেছে আমি নাকি তার গার্লফ্রেন্ড। কী লজ্জার ব্যাপার! তখন থেকে আমার মুখ বন্ধ। এরা আমার সম্পর্কে কী ভাবছে? অবশ্য এরা নিজেরাই তো এমন।

মহাসড়কের দু’পাশে কৃষ্ণচূড়া দেখতে দেখতে কখন যেন চোখদুটো লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙল সোহানের ডাকে। দেখলাম গাড়ি থেমে আছে। গাড়ি থেকে নেমে পার্কিং এরিয়া থেকে বের হতেই আবিষ্কার করলাম ভীষণ সুন্দর সাজানো একটা জায়গায় চলে এসেছি। পুরোটা সবুজে ঘেরা চমৎকার জায়গা। সামনেই সুইমিং পুলে নীল পানি। একটু পাশে একটা ফোয়ারা। তার সামনে অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি। দূরে একটা ছাউনি ঘেরা ঘর দেখা যাচ্ছে, যার মাথার ওপর লাল, হলুদ রঙের বাগানবিলাস ঝুলছে। তবে সব চোখ মেলে দেখা যাচ্ছে না, মাথার ওপর তাঁতানো সূর্য। সোহান বলল, “চলো ছায়ায় গিয়ে বসি। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে।”

(এটা ছোট হয়েছে, তাই পরের পর্ব তাড়াতাড়ি দিব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here