#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২২
“তোমাকে আমি আসতে বলিনি। তাহলে আসলে কেন? এখন কাঁদলে তো চলবে না।” মুখটা খুব কঠিন করে বলল সে।
আমি চোখ মুছে বললাম, “আমি কেন কাঁদছি তুমি কী করে জানলে?”
“এখানে এসে কষ্ট হচ্ছে বলেই তো?”
আমি আর জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। ওকে বলে এলাম যেন খেয়ে নেয়৷ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বাড়ির পেছনে। রোদ এখনো পড়েনি৷ বাড়িতে থাকা লোকজন বেশিরভাগ বিশ্রাম নিচ্ছে, তাই আমাকে কেউ দেখতে পেল না৷ বাড়ির পেছনে মস্ত এক কাঁঠাল গাছ৷ আরেকটু পেছনে বাঁশঝাড়। একটা সরু পথ চলে গেছে মাঝখান দিয়ে। গা ছমছমে ভুতুড়ে জায়গা। এরই একধারে একটা বাঁশের মাচা বানানো। এখানে এটা কোন কাজে লাগে কে জানে! জায়গাটা বেশ ঠান্ডা। আমি মাচায় বসে পড়লাম৷ এখন কষ্ট লাগছে না, অদ্ভূত শান্তি লাগছে।
সোহান আমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো একটু পর। পাশে বসে বলল, “তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করা উচিত হয়নি। স্যরি।”
“ইটস ওকে।”
“এখানে থাকতে পারবে?”
“তুমি পারবে?”
“জানি না।”
“না পারলে কী করবে?”
“তাও জানি না। এই টপিক বাদ দাও।” বলে সে অন্যদিকে ঘুরে বসল। আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সে আমার দিকে ফিরে মুচকি হাসল। হাসিতে কষ্ট জমাট বাঁধা। আমার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। কী থেকে কী হয়ে গেল এটা! কোনোদিন কল্পনাও করিনি এমন হতে পারে। সোহান বলল, “চলো ঘরে। মোবাইল রেখে এসেছি। আপু ফোন করতে পারে।”
“ওহ আমার তো মনেই নেই। তুমি ফোন করে আমাদের আসার খবর দিলেই পারতে।”
“নাম্বার নেই। রোকন ভাইয়ার একটা গোপন সিমকার্ড ছিল, সেটা আমাকে দিয়ে দিয়েছে। সে একটা নতুন সিম কিনবে, তারপর সেটা দিয়ে এটাতে ফোন করলে খবর জানাতে পারব। আসল নাম্বারগুলোতে ফোন করলে পুলিশ ট্রেস করে ফেলে যদি!”
আমার মনে পড়ল আমার মোবাইলটাও তান্নি আপু রেখে দিয়েছে সুইচ অফ করে। বলেছে আমার সাথে কথা বলে মায়ের কাছে সে খবর দেবে। বললাম, “কী ঝামেলা!”
“হুম, আর তুমি ঝামেলাতে নিজ থেকে জড়িয়েছ। চাইলেই ভাইয়া আপুকে না করে দিতে পারতে।”
“তোমার কি আমাকে নিয়ে অনেক বেশি অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে?”
“তা না। তবে আমার জন্য তুমি বিপদে পড়লে আমার ভালো লাগবে না।”
“তার জন্য তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলবে?”
সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখো শিফা, আমার মেজাজ খুবই খারাপ। ভালো কথা বলার প্রবৃত্তিই হচ্ছে না। টেনশনে মাথা কাজ করছে না, তার ওপর ভয় তো আছেই। তারপরেও তুমি আমার কাছ থেকে কেমন কথা আশা করো?”
আমি কিছু বলার আগেই সে হনহন করে হাঁটা ধরল বাঁশঝাড়ের পাশের সরু পথ দিয়ে। পথটা কোথায় গেছে কে জানে! আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করল।ঘরে ফিরে এলাম। ওর চিন্তা হচ্ছে জানি, আমার কি হচ্ছে না? এই অচেনা অজানা জায়গায় শুধু ওর জন্য এসেছি সেটা কেন দেখছে না? শুধু তান্নি আপুর কথায় আমি এসেছি সেটা কেন ভাবছে? আমি ওকে ভালোবাসি, ওর জন্য চিন্তা হয় এতটুকু তো অন্তত বুঝবে!
আমি চুপচাপ ঘরে বসে রইলাম। সন্ধ্যা হয়ে এলো। এদিকটা গ্রামের ভেতরের দিক বলে অনেক দূর থেকে আবছা আজানের ধ্বনি কানে আসে। ঢাকার মতো আশেপাশে অনেক মসজিদের আওয়াজ শোনা যায় না। কেমন অদ্ভূত বিষন্নতায় ছেয়ে যাওয়া জায়গা। সোহান এখনো ফেরেনি। চিন্তা হচ্ছে। গেল কোথায়?
দরজায় টোকার শব্দে সোহান এসেছে ভেবে খুলে দেখি মামী এসেছেন। বললেন, “ঘর আন্ধার কইরা বইসা আছ কেন? এই সময়ে আন্ধারে থাকা ভালো না। বাত্তি জ্বালাও। কারেন্টের লাইন আনছে গত বছর। এই ঘরে লাইট ফ্যান দুইটাই আছে।”
বলতে বলতে উনি নিজেই ঘরে ঢুকে লাইট ফ্যান চালিয়ে দিলেন৷ কম পাওয়ারের হলুদ বাতি। সরাসরি চোখে লাগে। উনি বললেন, “সোহান কই?”
“বাইরে গেছে।”
“হেয় কি কিছু চিনে? এই সন্ধ্যাবেলা গেল কই? কেউ সাথে গেছে?”
“না মামী। একাই গেছে।”
“খাড়াও, তোমার মামারে কইতেছি খুঁইজা আনতে।”
আমি মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম। মামী বের হতে হতেই সোহান চলে এলো। মামী কী যেন বললেন ওকে। সেও কিছু একটা বলে ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই সটান বিছানায়। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় গিয়েছিল। উত্তর এলো না। বলল, “লাইটটা বন্ধ করো তো।”
“মামী বলেছে এই সময়ে আলো জ্বালিয়ে রাখতে।”
“উনি কি জানে আমার জীবনটাই অন্ধকার হয়ে গেছে, এখন রাতের আঁধারে আর কী হবে!”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতিটা নিভিয়ে দিলাম। নামাজের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওযু করে এসে মামীর কাছ থেকে জায়নামাজ চেয়ে নিয়ে এলাম। নামাজের আগে সোহানকে কয়েকবার বললাম সেও যেন নামাজ পড়ে নেয়। কে শোনে কার কথা! কানেও তুলল না৷ পড়ে রইল পাথরের মতো।
রাতে খাবার এলো আটটার দিকেই। আইটেম খারাপ না, মাছ ভাজি, মাসকলাইয়ের ডাল, ছোট মাছের তরকারি, আরেকটা ভর্তা, কিসের বোঝা গেল না। খেতে খেতে বললাম, “এখানে থাকলে যে খরচ লাগবে সেটার কী হবে?”
“রোকন ভাই পাঠাবে। কিছু টাকা গতকাল পাঠিয়েও দিয়েছে মামার কাছে। নইলে ওনাদের নিজেদেরই চলে না, আমাদের কীভাবে রাখবে।”
“এই টাকাগুলো পরে তুমি শোধ করে দেবে?”
সোহান খাওয়া বাদ দিয়ে এক পলক আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “যদি সুযোগ পাই তাহলে করব। আর না পেলে তুমি করে দিও?”
আমার সাথে সাথে চোখে পানি চলে এলো। আমিও নিচের দিকে ফিরে নিঃশব্দে খাওয়া সারলাম।
ন’টার মধ্যে পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সন্ধ্যার পরেও কোলাহলে ছেয়ে ছিল। অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চার খেলাধুলায় মেতে ছিল উঠোন৷ এখন সব শুয়ে পড়েছে। সোহান তো শুয়েই আছে। আমিও তার পাশে জায়গা করে শুয়ে পড়লাম৷ খাটটা ডাবল হলেও তোষক তুলনামূলক ছোট। তার ওপর মশারি টানানোতে আরও ছোট হয়ে গেছে ভেতরের জায়গা। সোহানের গা ঘেঁষে শুয়ে আমার কেমন অদ্ভূত অচেনা অনুভূতি হতে থাকল। বুকের ভেতরে চাপ ধরা কষ্ট। আমাদের একসাথে থাকার সময়টা মোটেও এরকম হওয়ার কথা ছিল না! আমি চুপচাপ একভাবে পড়ে রইলাম অনেকক্ষণ। গতরাতে না ঘুমানো আমার ঘুম এলো না একেবারেই।
বাইরে কী একটা রাত জাগা পাখি ডাকছে। শুনলেই গা ছমছম করে। তার ওপর আরও হাজারটা রাতজাগা পোকামাকড়ের শব্দ মনে হলো আমায় গিলে খেতে আসছে। সোহানের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রাত আরও গভীর হলো। হঠাৎ টিনের চালে তুমুল শব্দ। বুঝলাম বাতাস দিচ্ছে। বাইরের বাতাস টিনের ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরেও ঢুকছে। আরামদায়ক আবহাওয়া। আরও বেশি স্বস্তি পেলাম যখন টুপটাপ বৃষ্টি শুরু হলো। রীতিমতো শীত লাগতো শুরু করল। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল, একই সাথে কেমন প্রশান্তিও ছেয়ে গেল ভুবনে। আমি উঠে ফ্যানটা বন্ধ করে দিলাম। শুয়ে পড়তেই সোহান বলল, “আমার ভয় করছে।”
ওর গলার স্বর শুনে আমারও ভয় করতে শুরু করল। ওর গায়ে হাত রেখে বললাম, “কী হয়েছে?”
সে কিছু বলল না। আমার হাতটা চেপে ধরে রইল। তারপর একসময় আমাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। খানিক পর বুঝলাম সে কাঁদছে। কাঁদুক। একটু হালকা হোক। ধীরে ধীরে তার বুকের কাঁপুনি থেমে এলো। ক্লান্ত ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ল। পরিস্থিতি কী না করতে পারে! সোহান আমাকে জড়িয়ে ধরেছে এমন কল্পনা এতদিন বহুবার মাথায় এসেছে। সেই কল্পনাতেও যতটা উত্তেজনা ছিল এখন বাস্তবে তার ভগ্নাংশও নেই। মনে হচ্ছে একটা বিধ্বস্ত মানুষ শেষ আশ্রয় খুঁজছে। আমি তার সেই আশ্রয়। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যতদিন সুস্থ না হয়ে ওঠে। এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝে আমিও কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। পাখি ডাকছে। উঠে একটা জানালা খুলে দিতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকে আমার সব মন খারাপ, ক্লান্তি দূর করে দিল। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, “আমাদের জীবনেও যেন এই ভোরটা খুব দ্রুত চলে আসে।”
(চলবে)