ফিঙের_ডানা পর্ব-২৩

#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২৩

বৃষ্টি রইল টানা তিনদিন। এই বৃষ্টির মাঝে সোহান একবার ঘন্টা দুয়েকের জন্য উধাও হয়ে গেল। বৃষ্টিটাও বাড়ল তক্ষুনি। আমি ভয়ে কাটা হয়ে রইলাম পুরোটা সময়। সে ফিরল কাকভেজা হয়ে। চোখ টকটকে লাল। তারপর থেকেই উথাল-পাথাল জ্বর। রোজ রাতে ভুলভাল বকে আর দিনের বেলা চাদর গায়ে রোদে বসে থাকে। জ্বর কমার লক্ষণ নেই। ভাবলাম আর একটা দিন দেখি। যদি না কমে তো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব সদরে।

এর মাঝে একদিন ঘটল মজার কান্ড। আমাদের এই মামা আবার কবিরাজি জানে। তার কাছে গ্রামের বহু লোক আসে ঝাড়ফুঁক করাতে। ঝেড়ে দেয়, শেকড় বাকড় দিয়ে লোকজনের অসুখ সারায়৷ সোহানকেও বার দুই ঝেড়ে দিয়েছেন, লাভ হয়নি কোনো।

সকালবেলা সোহান বসে আছে ঘরের সামনে একটা টুলে। তখন এক মহিলা এলো। সাথে ছোট ছেলে। ছেলের দুই সপ্তাহ ধরে জ্বর। ঔষধ খেয়েও কমছে না। ছেলের বাবা আবার কবিরাজিতে বিশ্বাস করে না তাই একদিন আসতে পারেনি। এবার মা লুকিয়ে নিয়ে এসেছে। এসে দেখে মামা বাড়িতে নেই।

গ্রামের মহিলা। কবিরাজকে না পেয়ে ছেলেকে সোহানের পাশে একটা পিড়িতে বসিয়ে রেখে চলে গেল অন্য মহিলাদের সাথে গল্প করতে। সোহান তখন কী মনে করে যেন বাচ্চাটার সাথে কথা বলতে শুরু করল। আমি তখন ঘরে জামাকাপড় গুছিয়ে রাখছি। বের হয়ে দেখি সোহান ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ফরসা ন্যাড়া মাথা, বড় দাড়িগোঁফ আর গেরুয়া রঙের চাদরে তাকে ঋষিদের মতো দেখাচ্ছে। ছেলের মাও তখন ফিরল। সোহানকে জিজ্ঞেস করল, “ভালো আছেন?”

সে উত্তর দিল, “জি। চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলে ভালো হয়ে যাবে।”

মহিলা “দোয়া কইরেন।” বলে ছেলেকে নিয়ে রওনা হলো বাড়িতে।

সন্ধ্যার দিকে সেই মহিলা আবার ফিরে এলেন মহা উল্লাসে। তার ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস সোহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে বলে তার ছেলে সুস্থ হয়েছে। সোহানের নাকি বিশেষ ক্ষমতা আছে। আমরা যতই বলছি ও এসব কিছু জানে না, মহিলা বিশ্বাসই করল না৷ সোহানকে ডাকা শুরু করল ‘বাবা’ বলে।

আশ্চর্যজনকভাবে সেদিন রাতে সোহানেরও জ্বর নেমে গেল। আর এলো না৷ পরদিন খেয়াল করলাম গ্রামের অর্ধেক মানুষ জেনে গেছে সোহানের ক্ষমতার কথা। সকাল হতেই দুজন উপস্থিত হয়েছে রোগী নিয়ে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম৷ এত কুসংস্কার এখন পর্যন্ত এই দেশে রয়ে গেছে!

সোহান তাদের অনেকক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রইল। সে কিছুতেই এসবে সায় দেবে না। এদিকে মহিলারাও কিছুতেই যাবে না। বাবা তাদের ওপর রাগ করেছেন ভেবে বসে রইল দরজার কাছে। আমাদের সকালে খাওয়া হয়নি। ছেলেটা মাত্র জ্বর থেকে উঠল। আমি বুঝিয়ে বললাম, “এদের বিদায় করো প্লিজ৷ শুধু গিয়ে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই চলে যাবে। তারপর যখন দেখবে কাজ হয়নি, তখন আপনাতেই তোমার কাছে আসা বন্ধ করে দেবে।”

সোহান আমার কথা গুরুত্ব সহকারেই নিল। দরজা খুলে বের হয়ে রোগী দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। একজন রোগী মহিলা, তার নাকি কিসের বাতাস লেগেছে। অন্যটা বাচ্চা মেয়ে। রাতে চোখে দেখতে পায় না।

ওরা চলে যাওয়ার পর আমি খুব হাসলাম৷ ওকে বললাম, “তুমি একটা ব্যবসা শুরু করে দাও। বড়লোক হয়ে যাবে।”

সে গম্ভীর মুখে বলল, “ফালতু কথা বলবে না। চুপ!”

এরপর থেকে সোহানকে আমিও মাঝে মাঝে বাবা বলে ডাকছি। যতবার ডাকছি, সে অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার মজা লাগছে খুব। আবার এই সুযোগে তার মনও অন্যদিকে ঘুরে গেছে। পরদিন বিকেলে দেখলাম বাড়ির দুটো বাচ্চাকে বারান্দায় বসে গল্প শোনাচ্ছে।

আমার এদিকে কোনো কাজকর্ম নেই। সারাদিন শুধু শুধু বসে থেকে হাত পা ব্যথা হওয়ার জোগাড়। বাড়ির কোনো কাজে মামী হাত লাগাতে দেয় না৷ অবশ্য তার সাহায্যের তেমন দরকারও নেই। তার দুই ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার। ছেলের বউ দুটো ভীষণ কাজের। এরা সকালে উঠেই কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়ে। খেয়াল করে দেখেছি, এরা প্রতিযোগিতা করে কাজ করে। কে কার চেয়ে বেশি করতে পারে। আজব ব্যাপার স্যাপার।

আমি একটা কাজ পেয়ে গেলাম। বাড়ির বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করলাম। এরা স্কুল থেকে এসে সারাদিন খেলতে থাকে। আমি পড়ানোর কথা বলাতে ওদের মা বাবা খুবই খুশি হলো। সন্ধ্যার দিকে সবাই আমার ঘরে এসে গোল হয়ে পড়তে বসল৷ বড় ভাবী এসে আবার আমার হাতে একটা বাশের কঞ্চিও ধরিয়ে দিয়ে গেলেন পড়া না পারলে শাস্তি দিতে। আমি বেত হাতে পড়াতে শুরু করলাম। নিজেকে মনে হতে লাগল গ্রামের স্কুলের আপা। সোহানকে দেখলাম পড়ার সময়টা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

বাইরে ভালো থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে শান্তি হয় না কিছুতেই। আমার কাকের বাসাটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। রোজ রাতে কত আদর করে জিজ্ঞেস করি, “কী হয়েছিল সেদিন?”

সে প্রত্যুত্তর দেয় না। অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। আমার তখন ভীষণ কান্না পায়৷ মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসতে চায় না। জানালার পাশে বসে রাত কাটিয়ে দেই।

এখানেও ঝামেলা লাগল। জানালা দিয়ে একটা তালগাছ দেখা যায়। একদিন মাঝরাতে জানালা খুলে সেদিকে তাকাতেই দেখি কে একটা বিশাল লম্বা মানুষমতো লোক তালগাছে উঠছে। একদম মাথায় উঠে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। আমি অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলাম। জিনিসটা আর নড়ল না। তারপর যখন দূর থেকে আজানের শব্দ এলো, তখন এক লাফে নিচে নেমে উধাও হয়ে গেল। আমি এত ভয় পেলাম যে পরদিন রোদ ওঠা পর্যন্ত ঠকঠক করে কাঁপলাম।

মামা আমাকেও দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিলেন। আর কড়া নিষেধ করলেন রাতে জানালা খুলতে। আমার এই জায়গা থেকে পুরোপুরি মন উঠে গেল।

কিছুদিন পর আপু টাকা পাঠালেন। টাকা ওঠাতে যেতে হবে সদরে। মামার সাথে আমিই গেলাম। সোহানকে কোথাও পাঠাতে ভয় হয়।

বিকাশের দোকানে মোটামুটি ভিড়। আমি একটা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম৷ দেখি দোকানে ওয়াইফাই আছে। পাসওয়ার্ড দেয়া নেই। খুব ইচ্ছে হলো একবার আমার ফেসবুক একাউন্টে ঢুকে দেখতে। লিলি নিশ্চয়ই অনেক মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে, খুব চিন্তা করছে। ও সব জানে। কিন্তু ফোন নাম্বার নেই বলে যোগাযোগ নেই। আমিও যোগাযোগ করিনি তান্নি আপুর কড়া নিষেধ থাকায়। আজকে খুব লোভ হলো। আমি ফেসবুকে লগইন করলাম৷ মেসেজ অপশনে গিয়ে দেখি আসলেই লিলির প্রচুর মেসেজ। কিন্তু তারচেয়ে বেশি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল স্নেহার মেসেজগুলো। দশটার বেশি মেসেজ দিয়ে রেখেছে সে। ওটাই আগে ওপেন করলাম৷ মেসেজগুলো এমন-

“তুমি কোথায় শিফা?”

“সোহানের সাথে আছ?”

“তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”

“সোহান কেমন আছে?”

“তুমি কি অনলাইনে আসছ না?”

“আচ্ছা আমি বলে রাখি৷ তুমি যখন আসবে, দেখে নিও।”

“এখানে এখনো প্রচুর ঝামেলা চলছে। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। সোহানের জন্য আমাদের খুবই চিন্তা হচ্ছে। ওকে ইচ্ছে করে ফাঁসানো হয়েছে। রাকিবের সাথে ওর আগের শত্রুতা ছিল সেটার সুযোগ নিয়ে প্রথমে ওদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়েছে, তারপর রাকিবের নিজের দলের লোকেরাই ওকে মেরে সোহানের নাম দিয়েছে। আমরা সব জানলেও কোনো প্রমান নেই।”

“সোহান ওদের অনেক বড় পথের কাঁটা ছিল, যেটা সরিয়ে দিতে এই পর্যন্ত নেমেছে।”

“অবশ্য ভেতরে অন্য ঘটনা থাকতে পারে যেটা আমরা জানি না।”

“সোহানের সাথে কথা বলা খুব দরকার। ও কি তোমাকে বলেছে কী হয়েছিল?”

“শিফা প্লিজ তুমি মেসেজগুলো দেখলে আমাকে আপডেট দিও। আমরা খুবই টেনশনে আছি।”

মেসেজগুলো দেখে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করল। এতদিন মোটামুটি ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি, এখন সরাসরি সমস্যায় ঢুকে যাচ্ছি। আমি কী লিখব স্নেহাকে? ওকে কি পুলিশ কিছু বলেছে? যদি মেসেজের উত্তর দিলে ঠিকানা ট্রেস করে পুলিশ চলে আসে?

আবার মনে হলো স্নেহা ভালো মেয়ে। আর আমার সাথে সোহানের বিয়ের কথা ও ছাড়া কেউ জানে না৷ পুলিশ তো না ই। তাহলে ও কেন খামোখা শত্রুতা করবে? ও তো সোহানের ভালো বন্ধু।

আমি লিখলাম, “সোহান ঠিক আছে। আমরা একসাথে আছি।”

তারপর লগআউট করে ফেললাম৷ টাকা নিয়ে ফিরলাম বাড়িতে। গিয়েই ফোন করলাম তান্নি আপুকে। খুলে বললাম মেসেজের কথা। আপু প্রথমে একটু বকলেও কথাগুলো শুনল। বলল, “এসব জেনে আর কী হবে বলো? আসল মানুষই তো মুখে তালা লাগিয়ে বসে আছে। আমার তো মনেই হয় ও খুন করেছে। নইলে এরকম চুপ হয়ে আছে কেন?”

আমি বললাম, “আমার সেরকম মনে হয় না। আপু তুমি কি কোনো প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঠিক করতে পারবে যে আমাদের হয়ে ঘটনা তদন্ত করে দেখবে?”

“বাংলাদেশে কি সেসব আছে?”

“থাকতে পারে। তুমি রোকন ভাইকে একটু বলে দেখো না।”

“আচ্ছা দেখছি।”

ফোন রেখে ভাবলাম আজকে সোহানকেও ধরতে হবে ভালোমতো। অন্তত এতটুকু জানতে হবে রাকিবের সাথে ওর শত্রুতা ছিল কী নিয়ে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here