#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২৬
রাকিব থাকত পাঁচতলা বাড়ির চার তলায়। পুরানো বাড়ি, একসময় গোলাপী রঙ ছিল, এখন নোনা ধরে গেছে দেয়ালে। গেটে কোনো দারোয়ান নেই। আশেপাশে বাড়িঘরের চাপে ভেতরের সিঁড়িটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। শৌভিক আজ সকালেই পুলিশের সাথে কথাবার্তা বলে এসেছে। রাকিবের ফ্ল্যাটটা পুলিশ সিল করে দিয়ে গেছে, সেখানে অনুমতি ছাড়া ঢোকা যাবে না।
ড্রইংরুম, দুটো বেডরুম, দুটো বাথরুম, ডাইনিং এর জন্য খানিকটা জায়গা। বারান্দাটা বেশ বড়। রাকিব একা থাকত এখানে, তাহলে এত বড় বাড়ি নিয়ে কেন থাকত? বাড়িতে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু পাওয়া গেল না। পুলিশ আগেই সব তন্ন তন্ন করে খুঁজে রেখে গেছে। সে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে পাশের ফ্ল্যাটে কলিংবেল চাপল।
একটা মাঝবয়সী লোক বেরিয়ে এলো, “জি বলুন।”
“আমি রাকিবের খুনের তদন্ত করতে এসেছি, একটু কথা বলা যাবে?”
লোকটা কিছু জিজ্ঞেস করল না৷ হয়তো পুলিশের লোক ভাবল। বলল, “ভেতরে আসুন।”
শোভিক ভেতরে ঢুকল। সোফায় বসতে দেয়া হলো তাকে।
“পুলিশ তো অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। আরও কিছু জানার আছে কি?”
“আমি পুলিশের লোক নই। গোয়েন্দা। কিছু প্রশ্ন করলে আশা করি সঠিক উত্তর পাব?”
“জি জি অবশ্যই।”
” রাকিব ছেলেটা কেমন ছিল বলুন তো?”
“উচ্ছৃঙ্খল টাইপ ছিল। বেয়াদবি কখনো কারেনি, কিন্তু সামনে পড়লে কথা বলত না কখনো। নিজের মতো থাকত। মাঝে মাঝে জোরে সাউন্ড দিয়ে আজেবাজে গান শুনত। আসলে ও তো বেশিদিন থাকেনি এই বাড়িতে তাই অতটা জানি না।”
“কতদিন ধরে ছিল এখানে?”
“তিন মাস।”
“তার আগে কোথায় ছিল বলতে পারেন?”
“না। বললামই তো তার সাথে আমার কথাই হতো না।”
“আচ্ছা। বাড়িতে বন্ধুবান্ধব আসত?”
“হা তা আসত মাঝে মধ্যে দুই একজন।”
“তাদের দেখলে চিনবেন?”
“হ্যাঁ তবে খুনের দিন যে ছেলেটা আসল, সে সেবারই প্রথম এসেছিল।”
শৌভিক সোহানের একটা ছবি দেখিয়ে বলল, “এই ছেলেটাই তো?”
“হ্যাঁ এটাই।”
“সেদিন কি ও একাই এসেছিল নাকি আরও কেউ ছিল সাথে?”
“এই ছেলে একাই ছিল। ভুল করে আমার বাসায় বেল টিপলে আমি বের হয়ে বলেছিলাম রাকিবের বাসা ওপাশেরটা।”
“সেদিন আর কেউই কি আসেনি?”
“আমার জানামতে না৷ বাইরে রাকিব আর ওই ছেলের জুতাই ছিল শুধু।”
“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী খুনের সময় রাত বারোটার পর। ওই সময়ের আশেপাশে ওখান থেকে কোনো শব্দ কি পেয়েছেন? ধস্তাধস্তি বা এ ধরনের কোনো শব্দ?”
“জি না। আমরা সেদিন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন রাকিবের লাশ আমিই পাই। রক্ত গড়িয়ে আসছিল দরজার নিচ দিয়ে।”
“তার আগে কি ওদের কথা কাটাকাটির শব্দ পেয়েছেন?”
“না। তবে ওরা ড্রিঙ্ক করছিল সেটা দেখেছি।”
“কীভাবে দেখলেন?”
“পিজ্জা ডেলিভারি দিতে এসেছিল, সেটা নিতে দরজা খুলেছিল রাকিব৷ আমি তখন বাইরে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। তখনই দেখে বুঝেছি মদটদ খেয়েছে। ভেতরে যে ছেলেটা ছিল তাকেও এক নজর দেখেছি, চোখ লাল। বোঝা যাচ্ছিল গিলেছে প্রচুর।”
“আচ্ছা ধন্যবাদ। উঠি এখন।”
বাড়ি থেকে বের হয়ে শৌভিক চলল ইউনিভার্সিটির দিকে। গেটে জিকোর সাথে দেখা। ভার্সিটির ক্লাস পুরোদমে চলছে। দুটো ছেলে শুধু নেই। একজন মরে গেছে, আরেকজন কোথায় কে জানে!
শৌভিক বলল, “রাজনীতির বাইরে পার্সোনালি রাকিবের সবচেয়ে ভালো বন্ধু কে ছিল?”
“ঠিক বলতে পারব না স্যার৷ কিন্তু ও যে কয়েকটা ছেলের সাথে চলত তাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে পারব৷ ওরা বোধহয় একসাথেই আছে৷ এ সময়ে টিএসসির দিকে থাকে৷ ”
“চলো সেখানেই।”
রাকিবের বন্ধুর দলকে পাওয়া গেল। জিকো জানাল, ইনি গোয়েন্দা। সাহায্য করলে তাদের বন্ধুর সুবিচার পেতে সুবিধা হবে। ছেলেগুলোকে আগ্রহী দেখা গেল।
শৌভিক জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রাকিবের আচরণে কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা নজরে এসেছিল তোমাদের? কয়েকদিনের মধ্যে?”
সবাই দেখা গেল একে অপরের মুখের দিকে চাইছে। একজন বলল, “স্যার কয়েকদিনের মধ্যে না, বেশ অনেকদিন হলো রাকিব চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। আগের মতো ছিল না।”
“আগের মতো মানে কেমন?”
“ও হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে। কষ্ট করে চলত। হঠাৎ কী হলো, খুব টাকাপয়সা ওড়াতে শুরু করল। প্রথমে ভেবেছিলার লটারি পেয়েছে বোধহয়। পরে দেখা গেল ওর লাইফস্টাইল পুরো চেঞ্জ! আমাদের সাথেও আগের মতো আন্তরিকতা ছিল না।”
“এই পরিবর্তনটা কতদিন ধরে হয়েছে?”
“এই তিন-চার মাস হবে।”
“ও বাসাও পাল্টেছে তাই না?”
আরেকজন বলল, “হ্যাঁ। আগে আমরা একসাথেই থাকতাম মেসে। কয়েকদিন আগে বড় ফ্ল্যাট ভাড়া নিল৷ একাই মাস্তিতে থাকতে শুরু করেছিল।”
“তোমাদের বলেনি এত টাকা কোথায় পাচ্ছে?”
“না। আগে টিউশনি করত, শেষ দিনগুলোতে তাও ছেড়ে দিয়েছিল।”
“রাজনীতি করে কি সে টাকা পেত?”
“আরে না। ওদের দলের অবস্থা এমনিতেও খারাপ।”
“আচ্ছা তোমাদের কী মনে হয়, খুনটা রাজনৈতিক কারনে হয়েছে?”
এই প্রশ্নে একেকজনের একেক রকম মত পাওয়া গেল। কারো ধারণা রাজনৈতিক কারনে, কারও ধারণা সোহানের সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য।
শৌভিক এবার শেষ প্রশ্নটা করল, “তোমাদের সবাই কি শিওর খুনটা সোহান করেছে?”
সবাই খানিকটা চমকে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। শুধু একজন ক্ষীণ গলায় বলল, “পুলিশ তো প্রমাণ পেয়েছেই। তবে আমার কেন যেন বিশ্বাস হতে চায় না।”
“কেন?”
“জানি না স্যার। সোহান আমার বন্ধু ছিল না। তবু ওকে ভালো লাগত। খুন করেছে কথাটা বিশ্বাস হয় না।”
“আর রাকিব যে খুন হয়েছে সেটা নিয়ে আশ্চর্য হওনি?”
“তা তো হয়েছিই। তবে একটা কথা কী, ও খুব বাড় বেড়েছিল। খারাপ যে কিছু হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু মরেই যাবে এমনটা ভাবিনি।”
“ওর কি কোনো প্রেমিকা ছিল?”
“এমনিতে ছিল না, তবে শুনেছি ফেসবুকে নাকি প্রেম করে কারো সাথে। আমরা চিনি না।”
“ঠিক আছে। প্রয়োজন হলে আবার কথা হবে।”
ওখান থেকে সরে আসতেই জিকো জিজ্ঞেস করল, “স্যার কী বুঝলেন?”
“কোথাও ঘাপলা আছে। ওর কললিস্ট দেখতে হবে ভালো করে।”
“ওর টাকার রহস্যটা বুঝলাম না।”
“হঠাৎ করে এত টাকা আসার একটাই উপায়, অবৈধ কাজ। কিন্তু সেটা কী?”
“অবৈধ কাজের জন্যই কি ছেলেটাকে ওর পার্টনাররা মেরে ফেলল?”
“সেটা হওয়ার খুব সম্ভাবনা আছে।”
“তাহলে সোহান ফাঁসল কেমন করে! সেদিনই ও ওই বাড়িতে গিয়েছিল। এত কাকতাল!”
“উহু! সমস্যা আরও গভীর জিকো। ভাবতে হবে।”
(চলবে)