ফিঙের_ডানা পর্ব-২৯

#ফিঙের_ডানা
পর্ব-২৯

দিনটা পরিষ্কার চোখের সামনে সেটে থাকার মতো। রাতে ঠিকমতো না ঘুমিয়েও খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সোহান তখন ওপাশ ফিরে শুয়ে। গতরাতে ভালো করে কথা বলেনি। ওইযে অভিমান হয়েছিল সজলের সাথে ফিরেছি বলে, সেই অভিমান কমেনি। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও যখন তাকে টলাতে পারিনি তখন আমিও এপাশ ফিরে শুয়েছি৷ এখন কাকডাকা ভোরেই ঘুম পগার পার। উঠে পূর্বের জানালাটা খুলে দিলাম৷ দূর বাঁশবাগানের মাথায় এইমাত্র ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা দেখা দিল। প্রকৃতিকে উদ্ধার করল আঁধারের গ্রাস থেকে। কী আকর্ষণে যেন মোহাবিষ্টের মতো অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইলাম সূর্যের দিকে। বোধহয় এজন্য যে দিনের অন্য সময়ে তাকে প্রাণভরে দেখা যায় না, চোখ ঝলসে যায়। আকাশটাও বর্নিল লাগছে। মেঘগুলোতে রঙের ছোঁয়া লেগেছে।

পাখির কিচিরমিচিরের সাথে গ্রামটাও জেগে উঠল। শাড়ি পরা মহিলাকে দেখা গেল কলসি নিয়ে পুকুরের দিকে যেতে। এক দুধওয়ালা দুধের পাত্র হাতে ঝুলিয়ে যাচ্ছে। ছোট একটা মেয়ে কয়েকটা ছাগল নিয়ে মাঠের দিকে রওনা হয়েছে। চিরচেনা অথচ মুগ্ধকর দৃশ্য। কোনো শিল্পীর হাতে তুলি থাকলে এক্ষুনি তার দৃশ্যটা বেঁধে ফেলতে ইচ্ছে হতো কাগজের বুকে।

এ সময় সোহানের উপস্থিতি টের পেলাম পাশে। আঁড়চোখে দেখলাম জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল। আমি সেদিকে মনোযোগ দিলাম না। সে অনুতপ্ত গলায় বলল, “স্যরি।”

অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, “ওমা! কেন?”

সে হেসে আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল, “তুমি তো জানোই আমার খুব খারাপ অভ্যাস হলো রাগ। আগে সবার ওপর দেখাতে পারতাম, এখন তুমি ছাড়া কেউ নেই। বেশি রাগ জমে গেলে দম ফেটে মরে যাব। তাই মাঝে মাঝে একটি আধটু দেখাই।”

আমার রাগ হলো। মরার কথা বলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা এই ছেলের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি ওর দিকে চাইলাম না। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সে আমাকে জোরে করে তার দিকে ফেরাল। কপালে চুমু খেয়ে বলল, “স্যরি তো! এত্ত সুন্দর সকালে কেউ রাগ করে থাকে?”

আমার রাগ পড়ে গেল। ঘুম থেকে ওঠার পর ওর চুল হয়েছে ভয়ানক এলোমেলো। হাত দিয়ে সেটা আরও এলোমেলো করে দিয়ে বললাম, “কাকের বাসা!”

সেও হেসে দিল। তখনই ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল চোখেমুখে। বাইরে চেয়ে দেখি সুন্দর দিনটা হঠাৎই কেমন পাল্টে যাচ্ছে! পাখিদের জোর চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। কোথা থেকে কালো কালো মেঘের স্তুপ এসে জমা হয়েছে মাথার ওপর। উথাল পাথাল হাওয়া এসে উল্টেপাল্টে দিচ্ছে সবকিছু। ধুলো আসছে দেখে জানালা বন্ধ করে দিলাম। একটু পরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল।

আমাদেরও কেমন মনটা খারাপ হয়ে গেল। সকালে মামী খাবার দিয়ে গেল। বৃষ্টিদিনে ভাত আর কুমড়ো ফুলের বড়া ভালোই লাগল। খেয়েদেয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলাম আমরা। সোহান বলল, “চা খেতে ইচ্ছে করছে।”

“ইশ ঢাকায় থাকলে এতক্ষণে কত কাপ চা হয়ে যেত!”

“হুম। চলো কোনো মন্ত্রবলে ঢাকায় গিয়ে চা খেয়ে আবার ফিরে আসি।”

আমি হেসে দিলাম। ঠিক মিনিট দশের পর জোরে জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে উঠে পড়লাম৷ খুলে দেখি মামার ছোট ছেলে রতন ভাই। গুড়ের ব্যবসা করেন। বাজারে দোকান আছে। সম্ভবত সেখান থেকেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। তাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়ে বললাম, “কী হয়েছে ভাইয়া?”

“পুলিশ।”

পুলিশ! শব্দটা শোনামাত্র আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। “কোথায়?”

“বাজারে। সোহান ভাইয়ের খোঁজ করতেছে।”

আমার মাথায় বজ্রপাত হলো যেন৷ আমার ভুলের জন্য! শৌভিক লোকটাকে বিশ্বাস করতে গেলাম কেন! আমার জন্য সোহান ধরা পড়ছে! ওর দিকে তাকানোর সাহসই হলো না আমার৷ বুকে তুমুল জোরে হাতুড়িপেটা শুরু হলো।

রতন ভাই বললেন, “আমি আপনাদের লুকানোর ব্যবস্থা কইরা দিতে পারি। দক্ষিণ পারায় আমার বন্ধুর বাড়িতে পলায় থাকলে ওরা খুঁইজা পাবে না। আপনারা চলেন তাড়াতাড়ি।”

আমি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। কিন্তু সোহানের কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। সে ধীরে হেঁটে গিয়ে খাটে বসে পড়ল। বলল, “আর কত পালাব? পারব না। আমি ক্লান্ত।”

রতন ভাই হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন। আমি সোহানের চোখ দেখে বুঝতে পারলাম ওকে আর বলে লাভ নেই, কাজ হবে না।

পুলিশ চলে এলো একটু পরেই। কতগুলো নীল পোশাক পরা লোক অত্যন্ত অভদ্রভাবে ঘরে ঢুকল। তারপর যা হলো সেই দৃশ্য আমি আর মনে করতে চাই না।
___________

সোহানকে ওরা নিয়ে যাওয়ার পরপরই আমিও ঢাকার পথে রওনা হলাম। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একা একা এমন গন্তব্যে যেখানে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। ঘোরের মধ্যে কাটল পুরো সফর।

ঢাকায় পৌঁছে তান্নি আপুদের বাড়িতে গেলাম৷ মা এখানেই ছিল। খবর পেয়ে এসেছেন। মায়ের সাথে দেখা হলো কতকাল পর! মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললাম। পৃথিবীতে এই একটি মানুষ শুধুই আমার নিজের। তখনো রাত ভোর হয়নি। মাঝরাতে গাড়ি থেকে নেমেছি। তান্নি আপু বলল বিশ্রাম নিয়ে নিতে। হাতমুখ ধোয়ার পর খাবার নিয়ে এলো আপু। আমি কিছুই মুখে দিতে পারলাম না। ইচ্ছেই হলো না খাবার ছুঁয়ে দেখতে।

সোহানের ঘর পরিষ্কার করে রেখেছে। আমি দোতলায় উঠে গেলাম৷ সেই ঘর! পুরো ঘরে সোহানের ছোঁয়া লেগে আছে। সব জিনিস ওর নিজের। বইয়ের তাক, টেবিলে জড়ো করা কত রকমের পেন্সিল, কাগজ, ছবি, জামাকাপড়ের আলনা সবই আছে শুধু মানুষটা দূরে চলে গেছে। এইতো গতরাতেও আমার পাশেই শুয়েছিল!

কান্নারা দলা পাকিয়ে আসতে শুরু করল। মনে হতে লাগল ওকে আমি চিরজীবনের জন্য হারিয়েছি। বুকের ভেতর এত যন্ত্রণা হতে লাগল যে মনে হলো এরচেয়ে মরে যাওয়া ভালো। আর কোনোদিন কি সে মুক্ত আকাশের নিচে আমার হাত ধরে দাঁড়াবে? ওর কী শাস্তি হবে? ও এখন কী করছে? জেলের বন্দি সেলের ভেতরে বসে বসে কী ভাবছে? খুব কি কষ্ট হচ্ছে? কিছু কি খেয়েছে?

শুতে পারলাম না৷ ছটফট করতে করতে ভোর হলো। ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে এসে দাঁড়ালাম৷ অনেকদিন পর এই বাড়িতে সকাল দেখা হলো। গতদিনও কি জানতাম আবার এখানে চলে আসব? পেছনের পুকুরের পানিতে নতুন ওঠা সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। আমার কেমন বিস্বাদ লাগতে লাগল সবকিছু। এত আশা করলাম বিধাতা কেন শুনলেন না ডাক? শৌভিক আহসান যখন বললেন এইটি পারসেন্ট সম্ভাবনা আছে সোহানের নির্দোষ হওয়ার, তখন কেন বিশ পার্সেন্ট সম্ভাবনা মিলে গেল? নির্দোষ হলে তো আর উনি পুলিশ পাঠাতেন না! সোহানের কিছু হলে আমি কী করব? মরে যাব? ছাদ থেকে লাফ দেবার কথা মনে হলো৷ কিন্তু এখান থেকে পড়লে মরব না। রিশানেরই কিছু হয়নি, আর আমি তো বয়সে বড়ই!

কেমন ক্লান্ত বিধ্বস্ত লাগছে নিজেকে। রোদ ওঠার পর আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ঘরে ঢুকলাম। গা এলিয়ে দিলাম সোহানের বিছানায়৷ ঘুমে তলিয়ে গেলাম পরক্ষণেই।

মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল। সোহান আর আমি বেড়াতে গেছি চাঁদের দেশে। চারপাশটা গাঢ় নীল। কোনো মানুষ নেই। আমি ভয়ে ওর হাত ধরে ফেললাম৷ ও হেসে বলল, “কিচ্ছু হবে না শিফা। চিন্তা করো না।”

ঘড়িতে বাজে এগারোটা বিশ। আমারও ইচ্ছে করছে সোহানের কথামতো চিন্তা না করতে। তান্নি আপু আমাকে ডেকে নিয়ে গেল নিচে। জোর করে মা ভাত খাইয়ে দিল। রোকন ভাইয়ের সাথে দেখা হলো তখন৷ হাসার চেষ্টা করে বললেন, “ভালো আছ?”

আমি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “শৌভিক আহসানের সাথে কথা হয়েছে ভাইয়া?”

রোকন ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বললেন, “উনার ফোন বন্ধ।”

আমার অসম্ভব রাগ হতে লাগল। বললাম, “সোহানকে দেখতে যাওয়া যাবে?”

“এখন না যাওয়াই ভালো। তুমি রেস্ট নাও, কালকে ওকে কোর্টে তুলবে। কাল যাব সবাই।”

কোর্টে তুলবে! “আচ্ছা ওর কি কালকেই বিচার হয়ে যাবে?”

“সম্ভবত।”

“ওর কী শাস্তি হবে?”

রোকন ভাই হতাশ গলায় বললেন, “জানি না।”

____________

“গরুর ডাক আর ঘোড়ার ডাক কি শুনে আলাদা করা যায়?”

রোকন ভাই বিষন্ন মুখে বললেন, “যায়।”

অনেকক্ষণ ধরেই এইসব আবোল তাবোল বকে যাচ্ছেন অ্যাডভোকেট প্রণব কুমার রায়৷ সোহানের হয়ে লড়ার জন্য এই লোকটাকে ঠিক করে দিয়েছেন শৌভিক আহসান নিজেই। শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। রোকন ভাইয়ের সাথে তার ফোনে কথা হয়েছে। সোহানকে এরেস্ট করার বিষয়ে বলেছেন, “নির্দোষ প্রমান হওয়ার জন্যও তো ধরা পড়তে হবে!”

কিন্তু সত্যি নির্দোষ কি না বা তিনি তদন্তে কতদূর পৌঁছেছেন সে বিষয়ে কোনোকিছুই খোলাসা করেননি।

প্রণব কুমার রায়ের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, রোগা শরীর। তবু দেখলে কেমন ভরসা হয়৷ চোখে আশ্চর্য দীপ্তি আছে। যদিও তখন থেকে কী বলছে কিছু মাথায় ঢুকছে না৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সোহানের কেস নিয়ে আপনারা কতটা আশাবাদী?”

“তিনি চশমা ওপরে তুলে আমার মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন৷ বাঁকা হেসে বললেন, “দেখাই যাক না কতদূর কী হয়৷ শোনো মেয়ে, ঘোড়ার ডাক আর গরুর ডাক কিন্তু আলাদা। এক করতে যেও না।”

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে৷ আমারা সবাই জড়ো হয়েছি আদালতে। আর একটু পরেই বিচারকার্য শুরু হবে। ভয়ে গলা বুক শুকিয়ে আসছে। এই সময়ে শৌভিক আহসানের দেখা। লোকটাকে আগে না দেখলেও কেমন করে যেন চিনে ফেললাম৷ পোড়া ঠোঁট, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি আর চটপটে স্বভাব৷ লোকটা আমাকে দেখে বলল, “গুড লাক মিসেস শিফা!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here