লীলাবালি🌺 পর্ব-১৪

0
1850

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_১৪
আফনান লারা
.
কুসুমের চোখের সামনে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসলো।যখন চোখ খুললো নিজেকে হাসপাতালের সাদা বিছানায় দেখে চমকে উঠে বসলো সে।পায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা।সাদা কাপড় বাঁধানো।পাশে তাকিয়ে দেখলো কলি হাতের উপর মাথা রেখে জানালার সাথে লেগে ঘুমাচ্ছে।রুমে আর কেউ নেই।মা বাবা সেসময়ে রুমে ঢুকে ওকে উঠে বসে থাকতে দেখে কাছে এসে দাঁড়ালেন দুজনে।কুসুম তার পা ধরে তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো তার কি হয়েছিল।

-‘তোর পায়ে বিষ ঢুকে গিয়েছিল রে মা।কলি যখন আমাকে ডেকে নিয়ে আসে তখন তোকে অচেতন অবস্থায় দেখে আমরা হাসপাতালে নিয়ে আসি তোকে।ডাক্তারবাবু দেখে বললেন তোর পায়ে নাকি বিষ ঢুকেছে।তো বিষ তারা বের করে নিয়েছে।তোকে কি কিছু কামড়ে ছিল??’

কুসুম মাথায় হাত দিয়ে ভেবে বললো,’একটা পোকা কামড়ে ছিল।কিন্তু তারপর….’

-‘কেমন পোকা?’

-“তারপর একটা লোক এসে তীর আমার পায়ে বিঁধে রক্ত বের করলো।তারপর থেকেই পায়ে হঠাৎ ব্যাথা শুরু হলো’

বাবা চমকে কুসুমের পাশে বসে বললেন,’কি বললি?একটা লোক?দেখতে কেমন ছিল?কেমন তীর?’

-‘মাফলার ছিল বলে চিনি নাই।তবে অনেক কালো ছিল দেখতে।আর হাতের তীরটা সবুজ রঙের ছিল।চেনো?

বাবা কুসুমের মায়ের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে আসলেন ওখান থেকে।কুসুমের মা পিছু পিছু এসে কেঁদে বললেন,’এটা নিশ্চয় আমির তিয়াজির লোক’

-‘হুমম।এখন কি করবো আমরা??ডাক্তার তো বলেছেন কুসুম আর দশ/বিশদিনেও হাঁটতে পারবেনা।ভারত যাবে কি করে?’

-‘ভারত যেতে এখনও সতেরো /পনেরো দিন বাকি।দেখি কি হয়’

-‘কুসুমকে তো এখন বাড়িতে রাখাও অনিরাপদ হয়ে দাঁড়াবে।কি করবো?কেমন করে বাঁচাবো আমাদের মেয়েটাকে?আচ্ছা ওরা ইচ্ছে করে এমন করেনি তো?যাতে আমাদের কুসুম ভারত না যেতে পারে?তারা কি খবর পেয়ে গেছে কোনোভাবে?’
——
-‘এগারোটা বছর ধরে আমরা অপেক্ষা করেছি ঐ কুসুকে আমাদের ঘরে তুলতে।এগারোটা বছর!!!এটা কি তাদের কাছে কম মনে হয়??
কুসুকে তারা তাহলে ভারতে লুকিয়ে রেখেছিল।ঐ যে একটা কথা আছেনা।ভগ্যে থাকলে তুমি লুকায় পার পাইবা কেমতে??
এখন হইছে তাই।এতবছর আমাদের চোখের আড়াল করে রেখেছিল ওরে, সেই আমরা যখন উত্তর থেকে ফিরে আসলাম সেইক্ষণে মেয়েটাকেও বাড়িতে পেয়ে গেলাম।’

-‘আব্বা তাহলে কি আমরা ঐ মাইয়ারে তুইল্লা আনবো?’

আগুন জ্বালিয়ে মাটিতে পাতা বিছিয়ে আমির তিয়াজি আর তার সাঙ্গপাঙ্গররা কথা বলছিল।পেছনে নারকেল গাছের তলায় রাখাল বসে বসে কুসুমের পায়ের নুপুরটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বললো,’তুলে আনবো না তো কি করবো?ঐ লোক তার মেয়েকে আমাদের হাতে তুলে দেবে?আমাদের ভয়ে সেই আবারও ভারতে পাঠানোর ফন্দি আঁটছে”

রাখালের মা মুন্নি তিয়াজি ওর দিকে ফিরে বললেন,’ঘুঘুকে আমরা নিজেরাই ফাঁদে ফেলেছি। মেয়ের পা বিষাক্ত করে দিয়েছি।এবার সে শুয়ে শুয়ে যাওয়া ছাড়া ভারত যাইতে পারবেনা’

রাখাল নুপুরটা মুঠো করে ধরে বুকে হাত রেখে বললো,’ওরে আমার এক্ষুণি লাগবে’

-‘বাপ সবুর কর!ওরে আমি তোর লগেই বিয়া দিমু।কিন্তু অপেক্ষা করা জরুরি।যদি পুলিশ নিয়ে আসে তাহলে বিপদে পড়বো আমরা।’

আমির তিয়াজি কমদামী নেশাদ্রবের একটা বোতল হাতে নিয়ে ছিপি খুলতে খুেতে বললেন,’মাইয়াটাকে তুলে আনলে ওরা মরে গেলেও আর আমাদের ঠিকানা পাবেনা।আমার মনে হয় ওকে তুলে নিয়েই আসা উচিত’

রাখাল উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তবে আমি যাই ওরে তুলে আনতে?? আজ রাতেই?’

-‘নাতি তোমায় আরও সবুর করতে হবে।এগারোটা বছর অপেক্ষা করেছো আর এগারোটা দিন অপেক্ষা করতে পারবেনা??তোমায় আমি কি কথা দিছি?কুসু হইলে তোমার হইবে আর নানহইলে কারোর হইবেনা’

রাখাল নুপুরটাকে ধরে রেখে তাদের বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো রেগে।আজকে কুসুমের পায়ের থেকে নুপুরটা সে নিয়ে এসেছিল।।কুসুম বুঝতেই পারেনি।
——
অর্ণব ভোরবেলায় নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে আসার পথে মসজিদের বাহিরে একটা সুই সুতার দোকান খোলা পেয়ে কিনে নিলো সুই সুতা।মেসে ফিরে এসে মশারির ভেতর ঢুকে বসলো মালা গাঁথতে।প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে এসে সে আবার ঘুমায়।তারপর আটটায় উঠে রেডি হয়ে ভার্সিটিতে যায়।
আবছা আলোয় মালা গাঁথতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে গাঁথা শুরু করলো সে।কানের কাছে একটা কথা বাজছে যতবার সে ঝিনুকের মাঝে সুই গাঁথছে।

-‘আপনি হাত পরে ধরিয়েন।’

কাজের ফাঁকে হেসে ফেললো অর্ণব।তারপর মনে আসলো এই মেয়েটার সাথের সব সম্পর্ক সে শেষ করে এখানে এসেছে।
এটা তো সত্যি।তাহলে কেন তাকে ভুলতে এত দ্বিধা?
কেউ নাকি কাউকে ভুলতে না পারা মানে ঐ মানুষটাও তাকে ভোলেনি।তাহলে কি কুসুম ও আমায় ভোলেনি?সে কি আমায় এখনও মনে রেখেছে?আচ্ছা সে কি আমার ব্রেসলেটটা যত্ন করে রেখেছে?
রাখুক!আমার কি তাতে??বাচ্চা একটা মেয়ের বাচ্চামিতে গলে জুস হয়ে গেছি।ধুর ধুর!!মালাটা ওকে ফেরত দিয়ে দিব।নাহলে এই মালা যতদিন আমার কাছে থাকবে আমার রাতে ঘুম হবেনা।
নিজের ইচ্ছেতেই তো ওরে জীবন থেকে বের করে দিয়েছি তাহলে এত মনে কেন পড়তেছে বুঝতেছিনা।ও হ্যাঁ মানুষের যখন কোনো কাজ থাকেনা তখন সে হুদাই উল্টাপাল্টা চিন্তা করে।আমারও হয়েছে তাই।
এত আবেগ ভাল না অর্ণব!বি স্ট্রং!তুমি শক্ত মনেী মানুষ।এটা জুথি বলেছিল।অথচ কথাটা কুসুমের বলা উচিত ছিল।
—–
কুসুম মা বাবার সাহায্যে সকাল সকাল বাড়ি ফিরে এসেছে।বাবা মা ওকে রাখালের কথা এখনও বলেননি।একটা কথাই বললেন আজ থেকে কুসুমের বাহিরে বের হতে মানা।কুসুম ভাবলো তার পায়ে বিষ ঢুকেছে বলে তারা এ কথা বলেছেন।
আজ সকালেই অর্ণবের বাবা ফোন করেছিলেন খোঁজ খবর নিতে।কুসুমের অবস্থার কথা শুনে তিনি বললেন অর্ণবের মাকে সঙ্গে করে এখানে আসবেন কুসুমকে দেখতে।
কুসুম শুনলো তাদের আসার কথা।মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো।যাদের সাথে কোনো লেনাদেনা নেই, বিচ্ছেদ ঘটেছে তাদের আসার কথা শুনে খুশি হতে চাইলেও বড্ড কষ্ট হয়।
—–
অর্ণব মাকে ফোন করেছিল এমনিতে কথা বলতে।কুসুমের কথা মা জানাতে চাননি ওকে।শেষে কলে থাকাকালীন বাবা চেঁচিয়ে বললেন,’তোমার গুনধর ছেলেকে শোনাবেনা?কুসুমের শরীর খারাপের কথা?নাকি তার কথা শুনলেও উনার অস্বস্তি লাগে?’

-‘জানিস কুসুমের পায়ে কি যেন কামড় দিয়েছিল।এমন বিষক্রিয়া হলো যে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে।মেয়েটার শরীর ভালনা।বিশ দিন নাকি হাঁটতে পারবেনা শুনলাম’

অর্ণব আশ্চর্য হয়ে বললো,’এখন কেমন আছে?সাপে কামড়েছিল নাকি?’

-‘নাহ।বললো তো কিসের যেন পোকা’

-‘ওহ।তোমরা দেখতে যাবে?’

লাউড স্পীকারে ছিল বলে অর্ণবের কথা বাবা শুনছিলেন।শেষের কথাটা শুনে এগিয়ে এসে ওর মায়ের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে কানে ধরে তিনি বললেন,’তো কি তের মতো অকৃতজ্ঞর মতন ওদের ভুলে যাবার জন্য দিন গুনবো?তোর তো কিছু যায় আসেনা! কুসুম মরলেও বাঁচলেও।কিন্তু আমাদের তো যায় আসে।কারণ আমরা ওকে আপন করে নিয়েছি।তুই তো আর আমাদের মতন না।তোর কাছে ছোট মাছ ভাল্লাগেনা অথচ সেগুলো উপকারী।তোর তো বড় রুই কাতল ভাল্লাগে।তো বিয়ে কর বয়সে বড় একটা মেয়েকে।আমরাও দেখি কেমন করে কুমিল্লায় পা রাখোস।’

অর্ণব থ মেরে বসে আছে।বাবার কথা শুনে নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে।আজীবন বাবা খোঁটা দেবে কুসুমকে নিয়ে।যা বোঝা গেলো ভবিষ্যতে বিয়ের পর তাদের মুখ দেখতে গেলেও ডাস্টবিন ছুঁড়ে মারবে কপালে’

-‘কি হলো কথা বলিস না কেন?সাহস দেখা একবার।আমিও দেখাবো তোকে আমার এই বয়সে এসে সাহস এখনও আগের মতনই আছে।আমাদের আর ফোন দিবিনা তুই।মায়ের কিসের খবর রাখতে ফোন দেস?তোর মা যে কুসুমের জন্য কাঁদে তখন তোর মায়ের প্রতি আদর ভালবাসা কই থাকে?’
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/260300312617922/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here