লীলাবালি🌺 পর্ব-২৫

0
1684

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৫
আফনান লারা
.
পেটে খিধে নিয়ে কুসুম বিছানায় উঠে বসে আছে।অর্ণব বারান্দায় গিয়ে রকিং চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
কুসুম হাঁটু গেড়ে একটু একটু করে বিছানা দিয়ে বারান্দার আগে যে জানালাটা আছে সেটার কাছে গিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে ছিল।মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দরজায় ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে নেমে গেলো দেখতে।কুসুমের মা খাবার হাতে এসেছেন। কুসুম আজ সারাদিনে কিছু খায়নি তা জানা ছিল বলেই খাবার নিয়ে আসলেন তিনি।আরেকটা প্লেট দিয়ে বললেন অর্ণবকে খেতে বলতে।কুসুম জানে সে এখন অর্ণবকে খেতে বললে কথা শুনতে হবে তাকে।
তাই খাবারটা টেবিলে ঢেকে রাখলো।অনেক খিধা লাগলেও অর্ণব খায়নি বলে তার ও খাওয়ার ইচ্ছা জাগলোনা।নিজেরটাও ঢেকে রেখে দিলো।বিছানায় ফিরে যাবার আগে অর্ণবের ফোন জ্বলতে দেখে কাছে গিয়ে দেখলো সে।
জুথির কল।নাম পড়তে পারলোনা।অর্ণবের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে ধরে বললো,’আপনার ফোন’

অর্ণব ফোনের দিকে তাকিয়ে জুথির নাম দেখে ফোন আর নিলোনা।বললো টেবিলে রেখে দিতে।
কুসুম চুপচাপ আগের জায়গায় ফোন রেখে এসে বসলো বিছানায়।কিন্তু জুথি বারবার কল করে যাচ্ছে।অর্ণব আবারও চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে গেলো।কুসুম পা টিপে টিপে ফোনটার কাছে এসে ভাল করে দেখতে লাগলো।কি লেখা আছে তার আগাগোড়া কিছুই মাথায় ঢুকছেনা।পর পর বেজেই যাচ্ছে শুধু।
শেষবার বাধ্য হয়ে আবারও ফোনটা নিয়ে উঁকি দিয়ে বললো, আপনার ফোন বাজছে এখনও।কি করবো?

অর্ণব রেগে গিয়ে বললো,’ভেঙ্গে ফেলো।এক্ষুনি’

কথাটা বলার পর।বারান্দার দরজা থেকে কুুসম সরে যাবার পাঁচ সেকেন্ড পর ঠুস করে আওয়াজ পেলো সে।আশ্চর্য হয়ে ছুটে রুমে এসে দেখলো কুসুম সত্যি সত্যি ফোন ভেঙ্গেছে।এখন অর্ণবের দিকে চোরের মতন তাকিয়ে আছে।অর্ণব হাসবে নাকি কাঁদবে কিছুই বুঝতেছেনা।কুসুম আমতা আমতা করে বললো,’আপনি যেটা বললেন সেটাই করলাম।’

কিছু না বলে অর্ণব নিচ থেকে ফোনের অংশগুলো গুছিয়ে নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছে এখন।কুসুম একটু এগিয়ে এসে বললো,’আপনি বললেন তাই করেছি’

অর্ণব মাথা তুলে বললো,’এই কারণে আমি কম বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চাইনি।সাধারণ জ্ঞানবোধ তোমার নেই যে, রেগে বলা কথা আর সিরিয়াসলি বলা কথায় আকাশ পাতাল তফাৎ’

-‘আমি যে ছোট সেটা বুঝি আপনি আজ জানলেন?খুব জানেন আমি রাগে বলা আর সত্যি সত্যি বলার তফাৎ জানিনা তাহলে এখন ভাঙতে বললেন কেন?আমি না ছোট?’

কুসুমের কথায় অর্ণবের কথাই বন্ধ হয়ে গেলো।চুপচাপ ফোন ঠিক করে অন করতে পেরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
আবার গিয়ে বারান্দায় বসলো সে।কুসুম দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে আবারও দেখছে ওকে।সেটা অর্ণব বুঝতে পারেনি।ফোন টিপে দেখলো জুথির পনেরোটা মিসড্ কল।
স্ক্রিনের প্রতিবিম্বে কুসুমকে দেখে ফোন হটিয়ে পেছনে তাকালো সে।কুসুম লুকিয়ে পড়েছে।
-‘শুরু থেকে যে পরিমাণ জ্বালাচ্ছে আমি এতক্ষণ কি করে ঠাণ্ডা আছি তা ভেবে পাইনা।এতক্ষণে মেরে ভূত বানিয়ে দেওয়ার কথা ওরে অথচ আমি চুপচাপ আছি।কেন?কারণ দোষ ওর না।দোষ আমার কপালের।’

ফোন রেখে চোখ বন্ধ করতেই ঘুম নেমে আসলো চোখে।মশার কামড়ে চোখ খুলে গেলো রাত দুটোর দিকে।হাত চুলকাতে চুলকাতে উঠে বারান্দা থেকে বের হতে গিয়ে দেখতে পেলো কুসুমকে।সে একটা চেয়ারে পা তুলে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ঘুমাচ্ছে।মনে হয় যেন পাহারা দিচ্ছিলো।ওর পাশ দিয়ে রুমে ঢুকে টেবিলে দুটো প্লেটে খাবার ঢাকা দেওয়া পেলো সে।মানে সে খায়নি বলে কুসুম ও খায়নি।

-‘এই!শুনো??কুসুম!’

নিজের নাম শুনে কুসুম হকচকিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে।মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে বললো,’কি হয়েছে?’

-‘টিপিক্যাল বউের মতন করলে সকাল বিকাল আমার হাতে শুধু মার খাবা।তোমাকে এটা কে শিখিয়েছে বর না খেলে বউয়ের খেতে হয়না??আমি খাইনি বলে তুমি তোমার খাবার ঢেকে রেখেছো কেন?আমার মেজাজ কেন এত খারাপ করতেছো?’

কুসুম হঠাৎ দরজা খুলে চলে গেলো।অর্ণব মাথার চুল ধরে টানতে টানতে বিছানায় বসে আছে।কোন দোষ করেছিল যে এমন বাচ্চা বয়সী একটা মেয়ে তার বউ হতে গেলো।কিসের শাস্তি পাচ্ছে সে??
-‘খায়নি কেন তা বলছি তাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেছে।আশ্চর্য!’

দু মিনিট পর কুসুম আবার আসলো।অর্ণব ওর আসার অপেক্ষা করছিল।ওকে দেখে বললো,”কি বিচার দিছো আমার নামে?’

-“আমি ঔষুধ খেয়েছি।বমি আসছিল তাই মিশু ভাবীর ঘর থকে ঔষধ নিয়ে খেয়ে এলাম’

-অর্ণব লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বললো,’খাও।নাহলে লাইট অফ করো।খাবার নিয়ে এত প্যাচাল করতে পারবোনা।মুড নাই আর’

কুসুম লাইটটা সঙ্গে সঙ্গে অফ করে দিয়েছে।অন্ধকারে চুপিচুপি আগের চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।অর্ণব ল্যাম্প শ্যাড অন করে বললো,’তোমাকে এক কথা কয়শবার বলল তোমার মাথায় ঢুকবে?শুরুতেই বলেছি বিছানায় শোবে!’

কুসুম বললো,’না।পরপুরুষ!!না মানে কিছুনা আমি এখানে ঠিক আছি’

-“পরপুরুষ? দুবার বিয়ে করে পরপুরুষ? তুমি এমন করে আমার মুড ঠিক করার চেষ্টা করছো?তবে তুমি কি জানোনা আমার মন খারাপের কারণ কে?’

-‘আমি।তাই তো আমি….’

-‘শোনো আমার মন খারাপ কেউ ভাল করতে পারেনা।আমি নিজের মন খারাপ নিজেই ঠিক করি।শুধু শুধু আমার মন আরও খারাপ করবেনা।এখানে এসে শুয়ে পড়ো।কাল ঈদ।অনেক অনেক কাজ আমার’

কুসুম খাটের উল্টো পাশ দিয়ে এসে ওর পাশে শুয়ে পড়লো।বুকের ভেতর কেমন কেমন করছে।অর্ণবের গায়ের গন্ধে পিঠটাকে বিছানায় লাগাতেই লজ্জা করছে ওর।কোনোমতে আলগা করে শুয়ে চোখ বুজে রাখলো।দুজনের চোখেই ঘুম নেই তাও চোখ বন্ধ করে রেখেছে তারা।কুসুমের মাথায় ঘুরছে খিধার কথা আর অর্ণবের রাগের কথা।অর্ণবের মাথায় ঘুরছে বিয়েটা কেন এভাবে হলো।এতগুলো বছর এই বিয়েটা আটকে রেখেছিল বলে এমন করে বিয়েটা হলো যে তার মানতেই কষ্ট হচ্ছে?জুথিকে কি করে ইগনোর করবে?জুথি কি ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে?
যদি সামনে এসে কান্নাকাটি করে?
মেয়েদের কান্না দেখলে তো আমার মন চায় নিজের কলিজাটা খুলে দিয়ে দিই সেখানে জুথি কাঁদলে কি করবো?মৃদুলের সাথে কথা বলতে হবে আমায়।ও পারবে জুথিকে বুঝাতে।
আমি জুথিকে বুঝানোর রিস্ক নিতে পারবোনা।আমার এত সাহস নেই।’

এত ভাবনার ভেতর কারোর পেটের ভেতরের গুরগুর আওয়াজ কানে আসতেই অর্ণব উঠে বসলো।কুসুম ও উঠে পড়েছে।খিধায় ওর পেটে ডাক দিচ্ছিলো।
অর্ণব ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,’যখন জীবনে কাজের কমতি হয়,চিল মুড আলা লাইফ লিড করতে থাকি আমরা,অতীতে ভাগ্যের সাথে নাছোড়বান্দা গিরি দেখিয়ে থাকি তখন নিয়তির খেলা একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে সংসার পেতে দেয়।জোর করে!’

-‘আমি বিয়েটার কথা কাউকে জানাইনি।আপনি ঢাক ঢোল পিটিয়ে দ্বিতীয় বার কেন বিয়ে করতে গেলেন?এখন আমার উপর চেঁচাচ্ছেন কেন?’

-‘তুমি ভুলে যাচ্ছো তুমি বিয়েটা আমায় করেছিলে।আর সেটা আমার থেকে গোপন রাখতে চেয়েছিলে?তোমার কথায় প্রায় সময় বুঝদার মনে হতো কিন্তু এই রাতে আমি নিশ্চিত হলাম তোমার যে বয়স তুমি একসের একটা বাচ্চাই বটে!যাও খেয়ে নাও।প্লিজ আমায় ঘুমোতে দাও’

-“আপনার পেট ও একবার ডেকেছিল।আমি শুনেছি।হয়ত আপনারও মনে আছে’

অর্ণব নিজের পেটে হাত দিয়ে মুখ ঘুরে শুয়ে পড়লো।কুসুমের মুখে হাসি ফুটলো সাথে সাথে।হাসতে হাসতে সেও শুয়ে পড়েছে।
অর্ণব কুসুম ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পেরে ফোন নিয়ে বারান্দায় গিয়ে মৃদুলকে কল করলো।সাথে সাথে ও রিসিভ করেছে।করেই বললো,’কিরে বিয়ে সাদি করলি আমাদের জানালি না।?’

-‘তুই জানলি কি করে?’

-“তোর ভাবী ফেসবুকে আপলোড করেছে তোর আর বাচ্চা ভাবীর ফটো।শেষমেষ ঐ বাচ্চারেই বিয়ে করলি তাহলে?’

-“ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করে কজনে জেতে?আমি হেরে গেলাম।’

-‘তো এখন না তোর বাসর?বাচ্চা বউ কি করে তোর?’

অর্ণব পেছনে তাকালো।কুসুম গভীর ঘুমে।চোখ সরিয়ে নিয়ে গ্রিলে হাত রেখে বললো,’আমি ভাবছি অন্য কিছু’

-“জুথি তোরে লাইক করে।কাঁচা চিবাবে তোর বিয়ের কথা শুনলে।ভাই ওরে আমি ডরাই।আমাকে বুঝাতে বলিস না’

-‘আমিও ভয় পাচ্ছি।সত্যিটা জানলে কি করে বসবে তাই ভেবে আমার গলা দিয়ে খাবারও নামছেনা।খিধায় মরে যাচ্ছি’

-“তোর বাবু বউরে বল তোকে খাইয়ে দিতে’

-‘সে নিজেও খায়নি।গ্রামীণ বধূদের মতন আমি খাইনি বলে সেও খাবেনা।’

-‘এই বাচ্চা বড় হওয়া ছাড়া তুই ওর মাঝে নিজের বউরে দেখবিনা কোনোদিন।আহারে আমার বন্ধুটারে!সহজ সরল বন্ধুটা রে… আহ হারে!!!
কাল আসছি আমরা সবাই।তুই তো দাওয়াত দিবিনা।কিন্তু আমরা তো বৌভাতের অনুষ্ঠান মিস দিতে পারিনা।জুথিকে ইনবাইট করবো?’

-‘খবরদার!আমি ওর সাথে আর কথাই বলতে পারবোনা। আমার ভয় করছে।কোনোদিন যদি তোকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, দয়া করে বলে দিস আমি ওর সাথে যে অন্যায় করেছি তাতে যেন আমায় মাফ করে দেয়’

-“কেস ক্রিটিক্যাল।তুই নিজে বোঝালে ও বুঝবে’

-“নাহ।ও কাঁদবে।প্রচুর কাঁদবে।আজ আমার হাত ধরে আমাকে চাইছিল সে।আমাকে সহজে ভুলতে পারবেনা তা জানি আমি।হয়ত কখনওই ভুলবেনা।
আমি পরোক করে বলতে পারি ও আমার বিয়ের কথা শুনলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়বে।আর ওর কান্না দেখার সাহসটুকু আমার মাঝে নেই।তুই প্লিজ আমার হয়ে ওকে সামনা সামনি বোঝাবি।বলবি যা দোষ সব আমার কপালের।ওর কোনো দোষ নেই।কাউকে ভালোবাসা অপরাধ না।কিন্তু নিয়তির কাছে আমার কিছু করার ছিলনা।তিন বছর আগ থেকে এই বিয়েটা আটকানোর হাজারটা যুদ্ধ আমি করেছি কিন্তু কুসুমের নাম আমার স্ত্রীর নামের জায়গায় লেখা ছিল।যেটাকে আমি বদলাতে পারিনি।ও যদি কাঁদে এই কথাটাও আমায় ফের বলবিনা।ও কেঁদেছে শুনলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে।ভীষণ!শেষে বলবি….থাক কিছুনা।’

-‘ও যদি আমার কলার টেনে ধরে তবে আমি সত্যি বলছি তোর বাসার এড্রেস দিয়ে দিব’

চলবে♥
মেঘ বলেছে বৃষ্টি নামবে অর্ডার লিংক
https://www.facebook.com/Bookshelfsc/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here