লীলাবালি🌺 পর্ব-২৭

0
1572

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৭
আফনান লারা
.
কুসুম চলে এসেছে ওখান থেকে।অর্ণব ভাবছে ফোনটা বন্ধ করে রাখবে কিনা।
.
কুসুম বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমগাছটা মনযোগ দিয়ে দেখছিল।বিশাল বড় আমগাছটা।একটা আম ও নেই।মনে মনে সে ভাবলো গরমকালে কতইনা আম ধরবে এটাতে।আচার খাবে কিছু দিয়ে,আর কিছু দিয়ে আমসত্ত্ব বানাবে।বাকিগুলো মরিচের গুড়া আর লবণ দিয়ে মিশিয়ে খাবে।জিভে এখনই পানি চলে আসে।সেসময়ে অর্ণবের বাবা ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,”এই গাছের আম অনেক টক।আমরা খেতেই পারিনা।যত চিনি দেওয়া হোক না কেন টক যায়না।
মানুষ এমনি নিয়ে যায়।অনেক পুরনো তাই কাটতেই মন চায়না।কুসুম বললো,’টক আমার অনেক প্রিয়’

অর্ণবের বাবা হেসে বললেন,’তাহলে তো আমাদের বাড়ির একজন সদস্য হলো যে এই গাছের আম মুখে দিতে পারবে।’

বাবা চলে যাবার পর মাটির সরু পথটাতে একটা ছেলেকে দেখে কুসুম চেয়ে রইলো।পরনে ছিল ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট।তার সাথে ছিল কালো রঙের শার্ট কাঁধে কালো রঙের একটা ব্যাগ।সঙ্গে একটা মেয়ে।মেয়েটার গায়ে শাড়ী।কড়া নীল রঙের শাড়ী।ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে হেঁটে এদিকেই আসছিল।কুসুম এক ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।পোশাক দেখে শহরের মনে হলো তাদের।যাওয়ার সময় অর্ণবের সাথে জোরেশোরে একটা ধাক্কা লেগে গেলো ওর।
অর্ণবের শক্ত শরীরে ধাক্কা লেগে সে নিজেই ব্যাথা পেয়ে ব্রু কুঁচকে চেয়ে আছে এখন। অর্ণব ধমকিয়ে বললো কেন সে উন্মাদের মতন ঘোরাফেরা করে সবসময়।
কুসুম আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আসছে এদিকে।
মনে হয় শহর থেকে আসছে।অর্ণবের মনে হলো পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।মৃদুল আর জুথি নয়তো?তাহলে সে আজ শেষ।কুসুম ওকে এমন রোবটের মতন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ওখান থেকে চলে গেলো চুপচাপ।অর্ণব ভাবছে কি দিয়ে শুরু করবে।কিন্তু ঠিক তখনই সামনে মৃদুল এসে দাঁড়ালো।অর্ণব ওকে সরিয়ে বেরিয়ে গেলো জুথি এসেছে কিনা দেখতে।কিন্তু সেখানে জুথি ছিলনা।ছিল অন্য একটা মেয়ে।মৃদুল পেছনে তাকিয়ে বললো,’ও আমার বোন।ঘুরতে এলাম।আসার জন্য জোরাজুরি করলো তাই ওকেও নিয়ে এসেছি’

অর্ণব দম ফেলে ভেতরে চলে আসলো আবার।মৃদুল ওর পাশে সোফায় বসে বললো,’জুথি আমায়ও কল করেছিল।কথা বলিনি।আসলে আমিও বুঝতেছিনা কি করে ওকে বোঝাবো।তুই আমার কথা ধর,জুথিকে সামনা সামনি বোঝা।দেখবি ও বুঝে যাবে’

-‘তার জন্য আমার নিজের মনকে শক্ত করতে হবে।আমি ভেঙ্গে পড়েছি মৃদুল।কোনো কিছুতে আর শান্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। সব কিছু বিস্বাদ লাগে।’

-“কুসুম কই?’

কথাটা বলে মৃদুল সামনে তাকাতেই দূরে দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়েকে দেখতে পেলো।পরনে সবুজ রঙের সেলোয়ার কাামিজ।চুলে জুটি করা।ঠোঁটে হাসি।সে মৃদুলকে দেখছিল মনযোগ দিয়ে।মৃদুল চোখ সরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললো,’ও?’

-“নাহ।ও কুসুমের ছোট বোন’

মৃদুল একটু নড়েচড়ে বসে বললো,’আমার দিকে ওমন তাকিয়ে আছে কেন?আমি বাচ্চা মেয়েদের মধ্যে ইন্টারেস্টেড না।ওকে বল আমাকে যেন এমন করে না দেখে’

অর্ণব মৃদুলের বোনকে বসতে বলে বললো,’আমারও ইন্টারেস্ট ছিলনা।ভাগ্য ইন্টারেস্টকে দুমড়ে মুচড়ে মুখের ভেতর পুরে পানি দিয়ে গিলিয়ে দিয়েছে।সো আমি কিছু বলছিনা এ বিষয়ে’

কুসুম ইয়া বড় ঘোমটা টেনে পিঠা আর সেমাই এনে রাখলো মৃদুলের সামনে।এরপর সালাম দিয়ে চেয়ে রইলো মৃদুলের বোনের দিকে।কি সুন্দর করে শাড়ী পরেছে, চুল বেঁধেছে।এর আগে এমনটা সে দেখেনি বলে আগ্রহ নিয়ে দেখছিল মেয়েটাকে।মৃদুল কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেছে।কুসুম এত সুন্দর একটা মেয়ে জানলে অর্ণবের আগেই এসে সে নিজেই বিয়ে করে নিতো।কি সুন্দর তার কোঁকড়ানো চুল।চুলের কারণে আরও বেশি সুন্দর লাগে।কোনো কৃত্রিম সাজগোছ মেয়েটা করে আসেনি।অথচ তার চেহারার ঝলক যেন চিৎকার করে বলে যাচ্ছে মেয়েটার নিষ্পাপ হওয়ার যথাযথ প্রমাণ।
ওকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্ণব বললো,’রুপে মোহিত হইওনা ভৎস।প্রথমত বয়সে সে বাচ্চা,দ্বিতীয়ত সে বিবাহিত ‘

মৃদুল হা বন্ধ করে বললো,’আচ্ছা তাই?এই মেয়েকে তুই প্রত্যাখান করে আসছিলি এতদিন?আমার তো মন চাইছে তুলে নিয়ে গিয়ে পরকিয়া করি’

অর্ণব কপাল টিপতে টিপতে বললো,’জানিনা এই পিচ্চি কবে মানুষ হবে।আমার দ্বারা হচ্ছেনা’

-‘আমাকে দে।পরকিয়া করে ম্যাচিউরিটি এনে দেবো।’

-“কুসুম হয়ত তোর এসব কড়া কথা বুঝতেছেনা বলে কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢুলছে,কিন্তু তোর পাশে যে তোর বোন বসে আছে সে কিন্তু বয়সে ছোট না।সব বুঝতেছে।মুখ বন্ধ করবি নাকি চটকানা মেরে তোর বকবকানি বন্ধ করে দিতাম?’

মৃদুল কুশন একটা কোলে ধরে অর্ণবের দিকে ফিরে বললো,’ক্যান?জ্বলতেছে তোর?একদিনেই গায়ে লাগছে?’

-“সেটা কখন বললাম।ধুর!তুই কি এসেছিস আমার মেজাজ আরও খারাপ করতে?আইডিয়া দে কি করে সামনে এগোবো’

দূর থেকে কুসুম অর্ণব আর মৃদুলের ফিসফিস করা আলাপ বুঝতে না পেরে চলে এসেছে ওখান থেকে।রুমে ঢোকার আগে দেখলো মিশু ভাবী আর কলি কিসের ব্যাগ এনে এনে বিছানায় রাখছে।মনে হলো ফুলের ব্যাগ।তাই সে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো এগুলো কেন।
ভাবী ওকে বললেন এখন যেন সে রুমে না আসে।কলি ওকে ধাক্কা মেরে বের করে দিলো রুম থেকে।কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছেনা তার।সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।তাই সে আবারও উঁকি দিয়ে মৃদুলের বোন মমকে দেখছে চুপিসারে। অর্ণব ওকে দেখতে পেয়ে ডাক দিলো এসে মৃদুলের সাথে কথা বলার জন্য।তাই ধীর পায়ে হেঁটে কাছে এসে দাঁড়ালো সে।মৃদুল হেসে বললো,’কেমন আছেন?’

-“ভাল।’

-“আমার বন্ধু ধমকায়??’

-“না’

-“এইটা মিথ্যা বললেন।আমার বেশ জানা আছে অর্ণব কাছের মানুষদের সাথে তিন লাইনে পাঁচবার ধমকিয়ে কথা বলে, সেখানে আপনাকে তো মনে হয় হাজারবার ধমকানো হয়ে গেছে ওর।’

কুসুম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।মৃদুল তার বোনকে বললো কুসুমের সাথে ঘুরে আসতে।তাই সে উঠে কুসুমের সাথে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলো।
মৃদুল এবার অর্ণবের দিকে ফিরে বললো,’শোন।যা হবার তা তো হয়েই গেছে।মেয়েটাকে কষ্ট দিস না।ওর মুখ দেখে এখন আমার খারাপ লাগছে।আমি আগে ওর ব্যাপারে কত কি বলেছিলাম তোকে।বাচ্চা একটা মেয়ে।ওকে বুঝিয়ে,পড়িয়ে নিজের মতন করে নে, দেখবি শান্তি আবার ফিরে এসেছে’

অর্ণব এক দৃষ্টিতে সামনের ওয়ালের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’আমি চেহারায় মুগ্ধতা খুঁজিনা মৃদুল।যদি তাই হতো তবে বিয়ের আগে কুসুমকে দেখে আমি আবারও বিয়ের ব্যাপারে না করে দিতাম না।একটা মানুষ চেয়েছিলাম যে আমায় বুঝবে, আমি কেন তাকে জোর করবো আমায় বুঝতে?’

-“কুসুম ও তোকে বুঝবে।কিন্তু তার জন্য ওকে সময় তো দিবি।গাছের চারা মাটিতে বুনলে সেদিনই ফল পাস??’

-‘গাছ আর মানুষের মাঝে অনেক তাফৎ।সব চেয়ে বড় কথা হলো কুসুমের প্রতি আমার বিশাল আকারের রাগ জমে আছে কিন্তু রাগটা আমি চেয়েও প্রকাশ করতে পারছিনা।এ সবকিছুর জন্য ও দায়ী।কিন্তু আমি!ওকে শাস্তি না দিয়ে উল্টে নিজে শাস্তি পাচ্ছি তার সাথে শাস্তি পাচ্ছে জুথিও’

-‘এই শোন!কুসুমকে কিসের শাস্তি দিবি তুই?ও যে বাচ্চা তা বারবার প্রমান করছে,বয়সের কথা তো বাদই দিলাম।আর যাই হোক সে এখন তোর স্ত্রী হয়ে গেছে।ওকে তো আর ফেলে দিতে পারবিনা’

-‘সারারাত ঘুমোতে পারিনি।জুথির কথা ভেবে আমার কেমন যেন খালি খালি লাগছে সব।ওর সাথে এটা হওয়া উচিত হয়নি।একেবারেই উচিত হয়নি।আমি ওর মতন একটা মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে চেয়েছিলাম’

মৃদুল পিঠা একটা মুখে পুরে বাড়িটার সামনে ঘুরতে যেতে যেতে বললো,’এর কারণে আজ সে তোর স্ত্রী নয়।
মানুষ যাকে চায় তাকে পায়না।আর যাকে চায়না তাকেই পায়।যাকে পায় তাকে নিজের মনমত করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়।এমন করেই জীবন সংসার।তোকে সংসারের সংজ্ঞা বুঝতে হবে।দুজন পারফেক্ট মানুষ একই জুটিতে আবদ্ধ হতে পারেনা।যদি হয় তবে তাদের স্বভাবের এত মিলের কারণে সংসার স্বাদহীন লাগে।কুসুমকে নিজের মতন করে সাজিয়ে নেওয়ার যে মূহুর্তগুলোর সাথে তুই পরিচিত হবি তখন বুঝবি মৃদুলই ঠিক ছিল’

অর্ণব ভাবছে অনামিকা ওকে এমন ছ্যাঁকা দিছে।ব্যাটা কবি হয়ে গেছে।যাহা বলে অন্তরস্থল থেকে বলে।স্যার সে কারণে সবসময় ওকে ভাষণ দেওয়ার দায়িত্ব টা দিতেন।

কুসুম কোথা থেকে ছুটে এসে বললো,’আপনার ফোন আবার জ্বলছে।
ধরিনি।আপনি তো মানা করেছেন’

অর্ণব এবার বললো,’ফোন ধরবানা, ফোনের দিকে তাকাবেও না।কি বললাম মনে থাকবে?’

কুসুম কিছু না বলে আবার চলে গেছে।মৃন্ময়ীর ফোন কেন অর্ণব ইচ্ছে করে ধরছেনা তা ভাবছিল সে।আপুটা কি কোনো দোষ করেছে?তার দোষ কি আমার চেয়েও বেশি?
তাহলে উনি আমাকে যেমন ধমকালেন উনাকে ওরকম ধমকালেই তো হয়।রাগ কমে যেতো তাতে।
এরপর লুকিয়ে মিটমিট করে হাসতেন।যেমনটা আমকে বকে আবার তার ঠোঁটের কোণায় আমি হাসি দেখেছিলাম সেরকম।’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here