#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৯
আফনান লারা
.
সকাল সকাল অর্ণব বেরিয়ে পড়েছে।প্রথমে ভার্সিটিতে যাবে তারপর হাসপাতালে গিয়ে রিপোর্ট নেবে।
অর্ণবের বাবা মা আরও কিছুক্ষণ পরে চলে গেছিলেন বাসা থেকে।আরও কটা দিন থাকতে চেয়েছিলেন তবে সেটা হলোনা দেশের বাড়ি ফাঁকা বলে।
কুসুম বাসায় একা একা মাথায় যা আসে তাই ভেবে রান্নায় নেমেছে।পেঁয়াজ কেটে কড়াইয়ে দেওয়ার সময়টাতে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে কাজ রেখে গিয়ে দরজা খুললো সে।
একজন ডেলিভারিম্যান এসেছে।কুসুমের হাতে পার্সেল দিয়ে বললো সই করে দিতে।কুসুম জানালো সে সই করতে পারেনা।তাই লোকটা চলে গেলো উপায় না পেয়ে।
পার্সেলটা ভেতরে এনে ছিঁড়ে ভেতর থেকে হাসপাতালের রিপোর্ট বের করলো সে।এটা হলো কুমিল্লার ডাক্তারের রিপোর্ট।লেখা কিছুই বুঝতে পারলো না সে তাই টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার কাজে চলে গেছে।
—
আজ ভার্সিটিতে প্রচুর ভীড়।কেন ভীড় তা বুঝতেছেনা অর্ণব।রেসাল্ট তো ঐদিন দিয়েছিল তবে আজ এত ভীড় কেন?
হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো মৃদুলের সাথে।সে তো অর্ণবকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরার পর থেকে আর ছাড়ছেইনা।ওকে ছাড়িয়ে অর্ণব জানতে চাইলো ব্যাপার কি।এত ভীড় কেন।পরে মৃদুল জানালো একজন স্যারের বিদায় অনুষ্ঠান।
সে তো এতদিন ভার্সিটিতে আসে নাই তাই এই ব্যাপারে জানেনা।
মৃদুলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে সবার কথা জিজ্ঞেস করছিল সে ঠিক তখনই মৃদুল হঠাৎ জুথিকে ডাক দিলো।জুথি তার একটা বান্ধুবীর সাথে বসে ভেলপুরি খাচ্ছিল।সে অর্ণবকে দেখেনি।মৃদুলের ডাক শুনে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসেছে।
মৃদুল এগিয়ে গিয়ে ওর বান্ধুবীকে সরিয়ে পাশে বসে জুথির হাত থেকে একটা ভেলপুরি ছিনিয়ে মুখে পুরে বললো,’কিরে অর্ণব আয় বোস’
জুথি অর্ণবের নাম শুনে সামনে তাকিয়েছে।অর্ণব চেয়ার টেনে বসে বললো,’আমাকে কেউ ভেলপুরি খাওয়াবেনা?’
জুথি কিছু বলছেনা শুধু অর্ণবকে দেখছে।মৃদুল টপাটপ ওর প্লেটের সব ভেলপুরি মুখে পুরে নিয়েছে, এখন কথাও বলতে পারছেনা।অর্ণব আরও তিন প্লেট অর্ডার দিয়ে এসে আবার বসেছে জুথির সামনে।ওর এমন চুপ হয়ে থাকা লক্ষ কর সে বললো,’জুথি মনে হয় ভাবতে পারেনি আমি হুট করে সামনে চলে আসবো।বিশ্বাস দেওয়ার জন্য চিমটি কাটবো নাকি?’
মৃদুল জুথিকে একটা খোঁচা মারলো নখ দিয়ে।জুথি এবার নড়েচড়ে বসেছে।জোর করে মুখে হাসি ও ফোটালো সে।চোখে হঠাৎ করে পানি চলে আসলো তখন।হাত দিয়ে মুছে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে।মৃদুল কথা কাটাতে অট্টহাসি দিয়ে বললো,’অনেক ঝাল দিয়েছে মামা।জুথির তো চোখে পানিই চলে আসলো।তুমি বুঝি ঝাল কম খাও?’
অর্ণব শক্ত চোখে তাকিয়েছিল।
মৃদুলের কথা শুনে হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে ফিরে বললো,’জুথি হাঁড় ভাঙ্গা ঝাল খায়।ভেলপুরির ঝালে ওর চোখে পানি আসার কথা না।তবে আমার মনে হয় আমি এখানে আসায় ও সহজবোধ করছেনা।তোরা খা।আমি একটু ঘুরে আসি’
‘দাঁড়ান ভাইয়া,বসুন।যে অর্ডার দিয়েছেন সেটা কে খাবে?আমি তো বলিনি আমি সহজবোধ করছিনা।বরং আমি চলে যাই’
মৃদুল গাল ফুলিয়ে বললো,’কাউকে কোথাও যেতে হবেনা😒বেশি কথা বললে আমিই চলে যাব।যাবার সময় ভেলপুরি ও নিয়ে যাব”
ভেলপুরি এসে গেলো তখন।মৃদুল নিজের প্লেট রেখে বারবার জুথির প্লেটের সব ভেলপুরি সাবাড় করতে চাইছে।জুথির খাওয়ার প্রতি ইচ্ছেই উঠে গেছে।এদিকে অর্ণব ও খেতে পারছেনা।ওদের দুজনের এমন ভাব দেখে মৃদুল বললো,’ভাই তোরা খাইস না।আমাকে দিয়ে দে।খাবার সামনে নিয়ে নাটক ভাল লাগেনা আমার’
—-
কুসুম দুপুরের রান্না শেষ করেছে।মা যেমন শিখিয়েছিল সেগুলো কিছু কিছু মনে ছিল।সেই স্মৃতি ধরে আজ সে পটল দিয়ে টেংরা মাছ রেঁধেছে,বাবা সকালে যাবার সময় বাজার করে দিয়ে গেছিলেন।
খাবার সব ঢাকনা দিয়ে রেখে নিজের শাড়ীগুলো থেকে বেছে একটা লাল শাড়ী বার করলো সে।এটা তাকে তার নানি দিয়েছিলেন,ছোট কালে।মা বলেছিল এটা।শাড়ীটা মূলত মায়ের কাছেই ছিল।
পড়া হয়নি কারণ এটা অনেক ভারী।কোনো কারুকাজ নেই তাও সুতোয় ভারী লাগে অনেক।
গোসল করে বেরিয়ে জবা ফুল গাছটার পাশে অনেকক্ষণ বসেছিল সে।একটা ফুল কানে দিয়ে দেখবে কেমন লাগে।লাল শাড়ী,লাল জবা,দৃশ্যটা একবার দেখার অনেক ইচ্ছা।আজ কেন যেন মনে হলো ফুল ছিঁড়লেও অর্ণব বকবেনা।যদিও বকেও জবা ফুলের ক্ষেত্রে কুসুম আজ পর্যন্ত ওকে ভয় পায়নি।ও হাজারবার বকলেও ঘুরেফিরে সে জবা ফুল নিয়ে কানে গুজবেই।
উত্তরের বাতাস এসে গায়ে লাগতেই কাল রাতে অর্ণবের মাথার উপর দিয়ে হাত রাখার কথাটা মনে পড়ে গেলো ওর।মুচকি হেসে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলো সে।সকালে ঘুম থেকে উঠার পরও ওর হাতটা সেই একই জায়গাতেই ছিল।কুসুমের ইচ্ছে করছিল একটিবার ওকে জড়িয়ে ধরতে।অর্ণব ঘুমাচ্ছে দেখে আলতো করে ওর বুকে কপালটা ছুঁয়ে সঙ্গে সঙ্গে সে সরে গিয়েছিল।এত বড় সাহস দেখিয়েছে ভেবে এখনই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার।
তারপর দাঁত কেলিয়ে শাড়ীর আঁচল ঘুরাতে ঘুরাতে দরজা খুলে বের হলো বাসা থেকে।সোজা এসে দাঁড়ালো জবা ফুলগাছটার নিচে।কত কত ফুল ফুটে আছে।নিচে ঘাসের উপর বসে সবুজগাছে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকা জবা ফুলের সমাহার দেখছে সে।
—-
রিপোর্ট হাতে অর্ণব অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল ডাক্তারের সিরিয়ালের অপেক্ষায়।শেষে তার ডাক পড়ায় হাঁপ ছেড়ে ভেতরে ঢুকেছে।
ডাক্তার রিপোর্টের পাতা উল্টেই চশমা ঠিক করে নড়েচড়ে বসলেন।
সামনে থাকা পানির গ্লাসটা থেকে দু ঢোক পানি খেয়ে বললেন,’ওহ আচ্ছা এটা সেই ফাইলটা।কুসুমের ফাইল।আপনি ওনার কি হোন যেন?’
‘হাসবেন্ড’
‘বিয়ের কতদিন?’
‘এক মাস হতে চললো’
‘নিউলি ম্যারিড।বলতে আমার খারাপ লাগছে কিন্তু এই বিষয়টা রোগীর আগে তার আপনজনের জানার অধিকার সব চাইতে বেশি আর আপনি তো ওনার হাসবেন্ড।দেখুন ভেঙ্গে পড়বেননা।সু চিকিৎসায় এটা ভালও হয়ে যেতে পারে’
অর্ণবের কপাল ঘেমে গেছে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপাল মুছে বললো,’কি হয়েছে ওর?’
‘ব্রেইন টিউমার’
অর্ণবের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।বুকে হাত রেখে সে মাথা নিচু করে আছে। ডাক্তার পানির গ্লাসটা এগিয়ে বললেন,’আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা।কিন্তু এখন আফসোস করার সময় না।জলদি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।আপাতত কেমোথেরাপি, সার্জারি দিব আমি।সেটার ব্যবস্থা শুরু করবো শীঘ্রই। আপনারা রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসবেন কালকের মধ্যে।এমনিতেও বড্ড দেরি করে ফেলেছেন।টিউমার আকারে অনেক বড়।ওয়েট আ মিনিট।আমি আপনাকে সিটি স্ক্যানের রেসাল্ট দেখাচ্ছি।
কথাটা বলে ডাক্তার সিটি স্ক্যানের রিপোর্টটা সামনে ধরলেন লাইট অন করে।
অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে আছে।কথা বলতে পারছেনা।বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে বললো,’বাঁচবে তো?’
ডাক্তার ওর কথা শুনে রিপোর্টটা টেবিলে রেখে হেলান দিয়ে বসলেন।চশমাটা খুলে বললেন,’গ্যারান্টি দিতে পারছিনা।আপনারা অনেক দেরি করে ফেলেছেন।রোগের লক্ষণ শুরু হয়েছে আজ থেকে আট/নয় মাস আগেই।এক বছর হতে চললো কিংবা তার ও বেশি।তখন যদি আসতেন তবে এতদিনে চিকিৎসা অনেকদূর এগিয়ে আসতো।
তারপরও আমরা হাল ছাড়বোনা।চেষ্টা চালিয়ে যাব।আপনি যত জলদি পারেন রোগীকে হাসপাতালে এডমিট করান।আর এক মিনিট দেরি করাও রিস্কি ‘
——
কুসুম তার শাড়ীর আঁচল ধরে চরকার মতন ঘুরছিল জবা ফুলগাছটার তলায়।খালি পায়ে নরম ঘাসে ঘুরতে তার অনেক অনেক ভাল লাগছিল।ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ অর্ণবকে দেখে থেমে গেলো সে।দূরে গেটের কাছে সে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে রিপোর্ট।
কুসুম চট করে কান থেকে লাল জবাটা নিচে ফেলে দিয়ে চোরের মতন দাঁড়িয়ে থাকলো।অর্ণব ধীরে ধীরে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।কুসুম মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’আমি এখনও খাইনি,আপনার সাথে খাব বলে।এত দেরি করলেন যে?
ওহ হ্যাঁ।আজ একজন লোক এসেছিল।কিসের যেন কাগজ দিয়ে গেলো।টেবিলে রেখেছি
দেখবেন চলুন’
অর্ণব যেন কুসুমের কোনো কথাই শুনতে পেলোনা।নিচু হয়ে ঘাসের উপর থেকে লাল জবাটা তুলে কুসুমের কানে গুজে দিল সে।কুসুম অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ণব ওর মুখের দিকে একটিবার তাকিয়ে আরও কাছে এসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলেছে।
কুসুম অবাকের পর অবাক হয়ে যাচ্ছে।অর্ণব হঠাৎ এমন কেন করছে সে বুঝতেছেনা।অর্ণব কাঁদছে।
ওর কান্নার আওয়াজ শুনে কুসুম অর্ণবের বুকে হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চাইলো কিন্তু পারলোনা।রিপোর্ট ফেলে অর্ণব দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে কুুসুমকে।
কুসুম ওকে সরাতে সরাতে বললো,’কি হয়েছে?বলবেন তো!আপনি কাঁদছেন কেন?আমাকে বলুন’
অর্ণব কিছু বলতে পারছেনা।শুধু কাঁদছে।কুসুম সরাতে ব্যর্থ হয়ে হাত ছেড়ে দিলো।অর্ণবের চোখের পানিতে ওর কাঁধ ভিজে গেছে।সে কিছুতেই আজ কুসুমকে ছাড়ছেনা।কুসুম শেষে বললো,’রাস্তার মানুষ দেখছে’
কথাটা শুনে অর্ণব ওকে ছেড়ে দিলো।পাঞ্জাবি দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হনহনিয়ে বাসার ভেতর চলে গেলো সে।কুুসুম নিচ থেকে রিপোর্টটা তুলে ওর পিছু পিছু ছুটেছে।দোতলায় এসে দেখলো অর্ণব ফোন নিয়ে বাবাকে কল করছে ব্যস্ত হয়ে।বাবা ফোন ধরেনি বলে মৃদুলকে ফোন দিল।মৃদুল ও ধরছেনা।শেষে একটা চিৎকার করে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো সে।কুসুমের পায়ের কাছে গিয়ে পড়েছে ফোনটা।
নিচ থেকে সেটা তুলে কুসুম ওর সামনে এসে বললো,’কি হয়েছে আমায় বলবেন না?’
অর্ণব বারবার তার কপাল টিপছিল।এক অসহ্যকর যন্ত্রনা তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে।
শরীর খারাপ লাগছে।কি কষ্টের মাঝে সে হাসপাতাল থেকে বাসা অবধি এসেছে তা শুধু সে জানে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।কুসুমের কাছে পানি চাইলো বাধ্য হয়ে।কুসুম ছুটে গিয়ে পানি এনে ওর সামনে ধরে রাখলো।মাথার চুল টানতে টানতে অর্ণব পানি পুরোটা খেয়ে গ্লাস এক পাশে রেখেছে।
কুসুম ওর এমন ব্যবহারে ভয় পেয়ে আছে।ভয়ের কারণে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা আর একবার যে কি এমন হলো।
অর্ণব জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো,’খেয়েছো?’
‘না’
‘চলো খাবে’
কথাটা বলেই সে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো টেবিলের কাছে।
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/