লীলাবালি🌺 পর্ব-৮৬

0
1498

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৬
আফনান লারা
.
কুসুমকে আর কি সামলাবে অর্ণব আজ নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
কি গায়ে ব্যাথা!!মনে হয় হাঁড় কাঁপানো জ্বর আসতে চলেছে।এই বুঝি ঝড় আসার পূর্বলক্ষণ!
বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তি হারিয়েছে।শুয়ে শুয়েই দেখছে কুসুম দোলনায় দোলে।পা তার শূন্যে।আলতা রাঙা পা।ঘন্টা কয়েক আগে কলি স্বাদ করে ওর পায়ে রঙ করে দিয়েছিল।
সে পা শূন্যে দুলাতে দুলাতে ছাদ দেখছে।এখনও জানেনা অর্ণব অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে।অর্ণব অবশ্য বলেনি।বললে এমন দৃশ্য দেখা হবেনা।
কুসুমের মুখের হাসি তার কাছে এত বেশি দামি মনে হচ্ছে যে চোখ ফেরাতেও ইচ্ছের কাছে জানতে চাইতে হয়না।মুগ্ধ নয়নে এই বালিকার প্রাণচঞ্চল ভাবটা মনের আনন্দ দিয়ে উপভোগ করে নিচ্ছে।কুসুমের বাঁকা চুলগুলো বাতাসের সাথে দুলছে।যেন আজ অন্য একটা কুসুমকে সে দেখতে পায়।
তার কোনো রোগ নেই,সে একেবারে সুস্থ।ওর এমন রুপ দেখে অর্ণব হাসতে গিয়েও পারেনি,কাশি এসে গেলো।তার কাশির আওয়াজে কুসুম দোল খাওয়া বন্ধ করে পা মেঝেতে রেখে বললো,’কি হলো?’

‘নাহ কিছুনা,দোলো।আমি দেখি’

‘আপনার গলা ওমন শোনায় কেন?শরীর খারাপ নাকি?’

দোলনা ছেড়ে কুসুম ওর পাশে এসে বসে কপালে হাত দিয়ে বললো,’একি!অনেক জ্বর।আমাকে বলেননি কেন?’

এবার সে দেরি না করে ছুটলো মাকে জানাতে।কিন্তু অর্ণব ওর আঁচলটা ধরে ফেলে বললো,’না।যাবেনা।বসো এখানে’

‘আপনার তো সেবা দরকার।নাহলে জ্বর অনেক বেড়ে যাবে’

‘তুমি বসে থাকলেই হবে’

‘পোটি দিতে হবে তো’

‘না।বোসো এখানে’

অর্ণবের জোরাজুরিতে আগের জায়গায় এসে বসলো সে।অর্ণব যেইনা আঁচলটা ছাড়লো ওমনি সে দৌড়ে গেলো বাহিরের দিকে।অর্ণব বিরক্ত হলো।সে চায়নি এ কথা অন্য কাউকে জানাতে,আর কুসুম হন্য হয়ে জানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে আছে।এতক্ষণে সবাইকে খবরটা দিয়েও দিয়েছে হয়ত।
পাঁচ মিনিট পর কুসুম একটা মগ আর একটা নরম সুতি কাপড়ের টুকরো নিয়ে এসে হাজির।কাপড়টাকে ভিজিয়ে চিপে অর্ণবের কপালে লেপে দিয়ে বললো,’আমি কাউকে জানাইনি’

‘ভাল করলে।এসবের ও দরকার ছিলনা।আমার অসুখ খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যায়।তোমার মতন না’

কয়েক মিনিট ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে অর্ণবের কপালের জ্বরের তাপমাত্রা কমিয়ে এনেছে কুসুম।তারপর ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ও দিয়েছে।
অর্ণব ওর হাতটা বারবার ধরে আটকে ফেলছে আর বলছে সে যেন এত টেনসন না করে।ডাক্তার তাকে টেনসন করতে মানা করেছে।
—-
আকাশ আজ ভারী।মেঘের সাথে মেঘের ঝগড়া লেগেছে।একজন আরেকজনকে বকছে।
তাদের ঝগড়া শেষ হলে বৃষ্টি শুরু হবে।যখন শুরু হবে তখনও হয়ত তাদের একটু একটু ঝগড়া হবে।ডাক শোনা যাবে মেঘের।
অর্ণব ঘুমায়।কুসুম দুবার রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসেছে।দুজন মা আর মিশু ভাবী তাকে কোনো কিছুতে হাগ লাগাতে দেয়না বলে সে শুধু ঘুরে চলে আসে।কত কি রান্না হচ্ছে আজ,কিন্তু অর্ণবের যে অবস্থা সে হয়ত কিছুই মুখে তুলতে পারবেনা।তখন মা ধরে ফেলবে তার অসুখ।এমনিতেও তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যাবে তার যে কত জ্বর।কেন যে মায়ের থেকে লোকাচ্ছেন!মা জানলে কত কি টোটকা কাজে লাগিয়ে জ্বর সারিয়ে তুলবেন তা বুঝি তিনি জানেন না?তিনি কি সুস্থ হতে চান না?
ঘাঁড় ঘুরিয়ে একবার বিছানার দিকে তাকালো কুসুম।অর্ণব উপুড় হয়ে ঘুমায়।তার এভাবে ঘুমানোটা দেখতে কত যে ভাল লাগে কুসুমের।একটু কাছে গিয়ে দেখছে সে এখন।ইচ্ছে হলো নিজের সেই পুরোনো গানটা গাইতে,কিন্তু অর্ণবের ভয়ে গাইলোনা।অর্ণব জানেও না সে যতক্ষণ না থাকে ততক্ষণ কুসুমের সময় কাটেনা।প্রতিটা সেকেন্ড কাটে বছরের সমান।
সে যদি এটা জানত তবে কখনওই ঘুমাতোনা,কোথাও যেতোনা।সারাক্ষণ ওর চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকতো।
অর্ণবের অপরিষ্কার পাঞ্জাবি গুলো ঝুঁড়িতে জমিয়ে রাখা ছিল।গুনে গুনে ১০/১২টার মতন হবে।সে একসাথে সব ময়লা হলে তারপর ধোয়।
মা বলে স্বামীর জামাকাপড় ধুয়ে রাখতে হয়।এতদিন অর্ণব ওকে এসব করতে বলেনি,দেয় ও নি।চট করে ধুয়ে দিয়ে বাগানে মেলে দিয়ে আসতো দড়িতে।কিন্তু আজ কয়েকদিন সে ওকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে জামাকাপড় ধোয়ার সময় কৈ।
কুসুম তাই আজ সব একত্র করে ধুয়ে দিয়েছে।শরীর তার ও খারাপ।কিন্তু যেটা কখনও করেনি সেটা করে দেখতে ক্ষতি কি?
সব বাগানে মেলছে এখন,কিন্তু আকাশের অবস্থা দেখে মন খারাপ হলো।মনে হয় বৃষ্টি হবে।এত কষ্ট করে এক ঝাঁক পাঞ্জাবি মেলে দেবার পর এই দৃশ্য মনটাই খারাপ করে দিয়েছে।
অর্ণব মায়ের ডাকে উঠে গেছিল।দুপুর দুইটা বাজে,এতক্ষণ ঘুমিয়েছে মনে করে নিজেই নিজেকে বকে নিলো।
কত কাজ বাকি সেসব রেখে এত ঘুমালো!!এরপর কুসুমের কথা মনে আসায় তড়িগড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো ও কোথায়।মা নিজেও জানেননা।তাই বলতে পারলেননা।
কলি দোলনায় গিয়ে বসতে বসতে জানালো কুসুম নাকি বাগানে।
তাই সে ওদিকেই গেছে।এসে দেখে তার বউ সব ধুয়ে শুকাতে দিচ্ছে।রাগ হলো অনেক।এই শরীর নিয়ে এত খাটনি করেছে বলে তার প্রচণ্ড রাগ হলো ওর উপর।কিন্তু কুসুমের গলায় সুন্দর একটা গান শুনে মনটা গলে গেলো সবসময়কার মতন।কুসুমের উপর করা রাগ কখনও ঘন্টা পার হয়না।এই মেয়েতে জাদু আছে,কঠিন জাদু।এই জাদু আমাকে গ্রাস করবে একদিন।

যেতে যেতে ওর একদম কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে।তার এলোমেলো পাতলা চুলগুলোকে সরিয়ে নরম ঘাঁড়ে হাত দিলো সে।সম্ভবত এভাবে ছোঁয়ার চিন্তা তার ছিল না।ওকে ডাকতেই সে হাত রেখেছে।কুসুম আচমকা ভয় পেয়ে পেছনে তাকিয়েছিল,ভেবেছে কে না কে!
অর্ণবকে দেখে তার ভীতি কমলো কিছু।মুচকি হেসে তাই আবারও পাঞ্জাবি মেলতে মন দিলো।

‘কি হলো?এড়িয়ে চলছো?’

‘একদম না’

‘তবে মুখ ঘুরিয়ে পিঠ দেখালে কেন?’

‘দেখতে বলছে কে?’

হুট করে মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু।দৌড়ে যে পালাবে তার সময়টুকু বৃষ্টি দিলো না,ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু।
কুসুম অর্ণবের হাত ধরে দৌড় দিলো বাসার দিকে।কিন্তু অর্ণব গেলোনা।থেমে গেছে সাথে থামিয়ে রেখেছে কুুসুমকেও।

‘আরে আপনার খুব জ্বর। এই বৃষ্টির পানিতে আরও বেড়ে যাবে,চলুন যাই’

কুসুম হাত কপালের উপর চ্যাপ্টা করে রেখে কথাগুলো বলছিল।অর্ণব ওকে কাছে টেনে ধরে ওর মাথার উপর নিজের হাত রেখে বললো,’আমার কিছু হবেনা,তোমারও হবেনা দেখো’

‘আমার কথা আমি ভাবছিনা,আপনাকে তো সুস্থ থাকতে হবে’

‘আমার কথাও আমি ভাবছিনা।বিয়ের পরের প্রথম বৃষ্টি আমাদের,না ভিজলে ভুল হবে।চলো ভিজি’

কথাটা বলে অর্ণব কুসুমের মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে ফেললো।বৃষ্টিতে ভিজতে কুসুমের দারুণ লাগে তবে এখন তার কাছে সব চাইতে জরুরি অর্ণবকে বাসায় নিয়ে যাওয়া।জ্বরের মধ্যে শীতল বৃষ্টির পানিতে ভিজলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

অর্ণব আরও নাছোড়বান্দা,কুসুমের দুহাত ধরে আরও একবার কাছে নিয়ে আসতে গিয়ে কি ভেবে যেন দোতলার বারান্দার দিকে একবার তাকালো। কেউ যদি দেখে,যদি সাগর ভাইয়া দেখে তো লজ্জায় আর থাকা যাবেনা।
এসব ভেবে কুসুমের হাত ধরে জবা ফুল গাছটার তলায় নিয়ে আসলো সে।

‘এখন ঠিক আছে।গাছের কারণে বৃষ্টির পানি কম লাগছে গায়ে।তাই না?’

‘শোনো আমি কিন্তু কখনও তোমার ঠোঁটের স্বাদ কেমন সেটা জানতে যাইনি।মৃদুল বলেছিল স্বাদ এমন হয়।ওটা থেকে বলেছি।তুমি আবার ভেবোনা যে আমি তোমায় ছুঁয়েছিলাম তোমাকে না বলে’

‘তা কেন ভাবতে যাব?’

অর্ণব হালকা কেশে বললো’আচ্ছা যদি এখন ছুঁই?রাগ করবে?’

‘কেমন ছুঁবেন?’

‘ছোঁয়ার ধরণ আছে?থাকলে সেটা জানো কিভাবে?কে বললো?’

‘না জানিনা,এমনি জানতে চাইলাম’

মেঘে ডাক দিলো।অর্ণব আর কুসুম নড়েচড়ে দাঁড়িয়েছে।কুসুম দুষ্টুমি করে বললো,’শেয়ালের ডাকে ভয় পান,মেঘের ডাকে ভয় পান না?’

‘মেঘ এসে কামড়াবেনা আমাকে,শেয়াল কামড়াবে’

কুসুম হাসি আটকে দুহাত দিয়ে তার হাতগুলো চেপে দাঁড়ালো।শীত লাগছিল ভীষণ
এরপর করুণ চোখে বাগানে মেলা পাঞ্জাবিগুলো দেখছিল সে।কেন যে এত কষ্ট করে মেলতে গেলো।সব এখন পানিতে ।
অর্ণব কুসুমের পিঠের পাশ দিয়ে হাত নিয়ে ঘাঁড় ধরলো ওর।কুসুম মাথা নিচু করে ভেজা,স্যাঁতসেঁতে মাটি দেখছে।সেখানে পড়ে আছে ঢাল সমেত জবা ফুল।ঝড়ের দাপটে ছিঁড়ে পড়েছিল ওখানে।নিচ থেকে সেটা তুলে নিলো সে।কানে গুজে অর্ণবের দিকে ফিরে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বললো,’অসাধারণ’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here