#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৯১(শেষ পর্ব)
আফনান লারা
.
সেদিন জুথি বাসায় ঢুকতে গিয়েও ঢোকেনি।চলে গেছে তার বাসার দিকে।সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা যতটা সহজ সেটা মুখের ভাষায় প্রকাশ করা তার চেয়ে বেশি কঠিন।জুথির ক্ষেত্রে সেটাই হলো।সে পারলোনা তার মতামত কাউকে জানাতে।নিজেকে একা করে দেবার জন্য সে ছুটে এলো বাসায়।নিজের রুমে একান্তে বসে ভাববে কি করে কথাগুলো পেশ করা যায়।
মৃদুল তার মেসে ফিরে গেছে সেদিনই।সে ভেবেছে জুথি হয়ত অর্ণবকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে।এখানে থাকলে জুথিকে অর্ণবের সাথে দেখে তার অস্বস্তি হবে।
দোতলাটা বাবা ওর জন্য তৈরি রেখেছিলেন,ওর বিয়ের পর বউকে নিয়ে থাকবে বলে।ওর বউ তো আসবে ঠিক তবে অন্য কারোর হয়ে।এটা সে সহ্য করতে পারবেনা বলেই মহাখালী ছেড়ে মেসে চলে এসেছে।পড়াশুনার অধ্যায় শেষ।তারপরেও তার মেসে ওঠা।চাকরি নেবে আর বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে।কত কি পরিকল্পনা রপ্ত করা হলো তার।সেটার কোনো হিসেব নেই।একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছে,সে আর কখনওই ওদের সামনে যাবেনা।অর্ণবের ভাল যেমন চায় তেমন জুথির ভালটাও সে চায়।এসব কিছু ভেবে দূরে থাকা শ্রেয় বলে মনে হলো
—-
কয়েকটা দিন কেটে গেছে।অর্ণব হাসপাতালে ভর্তি,না খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।তারপর সবাই ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।মিশু ভাবী মৃদুলের কাছ থেকে জুথির নাম্বার নিয়ে রেখেছিল,ওকে কয়েকবার ফোন করার পরেও সে ধরেনি।অনেকক্ষণ পর কলব্যাক করেছিল যদিও।
করে জানতে পারলো অর্ণবের অবস্থা খুবই খারাপ।
জুথি ওকে দেখতে আসবে বলে দিলো।আসতে আসতে মৃদুলকে ফোন করতে গিয়ে দেখে সে নাম্বার বন্ধ রেখেছে।হঠাৎ নাম্বার কেন বন্ধ করেছে তার কারণ জুথি জানেনা,এ কটা দিনে কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি ওর।
মৃদুল তো সিম বন্ধ রাখার মানুষ না।
হাসপাতালে এসে অর্ণবকে একবার একা দেখতে রুমে ঢুকেছে সে।বাকিরা বাহিরেই ছিল।
অর্ণবকে দেখে চেনাই যাচ্ছেনা।চোখ মুখের কি বেহাল অবস্থা তার,ওর কাছে একটা টুল নিয়ে বসেছে জুথি।
অর্ণবের হাত নড়ে,মনে হয় জ্ঞান ফিরেছে।জুথি উঠে বাকিদের বলতে যাওয়া ধরতেই অর্ণব বললো,’দাঁড়ান।’
‘কিছু বলবেন?’
‘বসেন’
জুথি আবার বসলো।অর্ণব ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে বললো,’আমি জানতে পেরেছি বাবা,ভাবী মিলে আমার সাথে আপনার বিয়ের কথা বলছে।এটাই স্বাভাবিক! কুসুমের ইচ্ছার কথা তারা সবাই জেনে গেছে।’
‘তার আগে আমি কিছু কথা বলতে চাই,তবে এখন না।আপনি সুস্থ হয়ে নিন’
অর্ণব তাচ্ছিল্য করে হাসলো।বললো,’আমার সুস্থতা মরে গেছে,আর কোনোদিন আমি সুস্থ হবো না।একটা মানুষ যদি বাঁচার ইচ্ছে টাই হারিয়ে ফেলে সে সুস্থ থাকে কি করে?’
‘আপনি এসব নিয়ে এখন ভাববেন না।আমি চাই আগে যে অর্ণব ভাইয়া ছিল তিনি যেন এখনও তেমন থাকেন।কুসুমের চাওয়া কিন্তু এটা ছিলনা ভাইয়া’
‘কুসুম যা চাইবে তা আমায় করতে হবে?সে পরিস্থিতি আদৌ বোঝে?বোঝেনা।সে অবুঝ,তার মাথায় যা খেলে গেছে সে সেটাই লিখেছে।সে জানেও না আমার উপর কি বয়ে যাচ্ছে,না জেনে কি না কি লিখে ফেললো আর সেটাকে আমার গোটা পরিবার মাথায় তুলে ফেলেছে।’
‘আপনি শান্ত হোন ভাইয়া।বিয়েটা হচ্ছেনা।আপনাকে সুস্থ হতে হবে।’
কথাটা বলে জুথি এক প্রকার পালিয়ে চলে আসলো।বাহিরে বের হতেই অর্ণবের বাবা মা ওকে চেপে ধরলেন বিয়ের ব্যাপারে।
‘দেখুন আন্টি,আঙ্কেল,আমি আপনাদের যথেষ্ট সম্মান করি,কিন্তু অর্ণব ভাইয়াকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
অর্ণবের মা ব্রু কুঁচকে বললেন,’তুমি না আমার ছেলেকে ভালবাসতে?’
‘বাসতাম।এখন বাসিনা,তার প্রতি ভালবাসা মুছে ফেলতে পরিস্থিতি জোর করেছে,আপনারা জোর করেছেন।এখন আবার আপনারাই জোর করছেন বিয়ের জন্য?বিয়েটা আপনাদের নিয়ে না,বিয়েটা একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে হয়।সবার আগে তাদের মতের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।যেটা আপনারা করেন না।
অর্ণব ভাইয়াকে আমি শ্রদ্ধা করি।এর বেশি কিছুনা’
—
জুথি সেবার চলে আসার পর থেকে অর্ণব কিংবা তার পরিবারের কারোর সাথে কেনো যোগাযোগ করেনি।মৃদুলের সাথে কনট্যাক্ট করার সব চেষ্টা করে সে ব্যর্থ।আগে মৃদুল পাগল হয়ে যেতো আর এখন সে নিজে।মৃদুল যে মেসে থাকতে পারে তা সে কল্পনাও করেনি।ওদের বাসায় গিয়েও খোঁজ নিয়েছিল।
সপ্তাহ কেটে যাবার পর হঠাৎ একদিন অর্ণবের বাবার কল আসলো জুথির নাম্বারে।
তিনি কাঁদছেন,কেঁদে কেঁদে মিনতি করছেন একবার এসে অর্ণবকে দেখে যেতে।অর্ণবের অবস্থা করুণ। ভাত,তরকারি তো দূরে থাক সে পানি খেতে গিয়েও যুদ্ধ করছে সবার সাথে।
তার খাওয়ার প্রতি মন উঠে গেছে।খেতে গেলেই মনে পড়ে যায় কুসুমকে সে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে সবসময়।মেয়েটা বমি করে ফেলতো তারপর রাত জেগে তাকে আবারও খাইয়ে দেবার জন্য অপেক্ষা করতো সে।এমন ও হয় রাতের দুইটার সময় সে কবর জড়িয়ে কাঁদে।তাকে সাগর ভাইয়া আর বাবা মিলেও ফিরিয়ে আনতে পারেনা।সে চায় কুসুমকে নিয়ে আসতে।একবার ওর সাথে কথা বলতে।কিছুতেই মানতে চায়না কোনো কিছু।
অন্তত পাশে বসে দু চারটা কথা বলে ওর মন ঠিক করতে পারলেও ভাল হতো।’
জুথি মানলো।সে তৈরি হয়ে অর্ণবের বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছে।
ওর দরজা আটকে ছিল।লক না,এমনিতেই বন্ধ করা।
জুথি দরজাটাকে ঠেলতে ঠেলতে বললো’ভাইয়া আমি আসতেছি।আপনি কই?’
কোনো সাড়া না পেয়ে জুথি ভেতরে ঢুকলো।রুমটায় এক ফোঁটা আলো নেই।একে তো সন্ধ্যা আরেক তো সব বন্ধ।আলো জ্বালিয়ে বিছানায় অর্ণবকে দেখেছে সে।
চোখ বুজে শুয়ে আছে।বাম হাতটা কুুসুম যে জায়গায় শুতো সেই জায়গার চাদরটাকে মুঠো করে ধরা।জুথি কাছে এসে বললো,’ভাইয়া আসুন আমরা একসাথে ডিনার করবো।’
অর্ণবের সাড়া নেই।জুথি আরও দু তিনবার ডাকলো।অর্ণবের কোনো নড়চড় না দেখে ওর বাবাকে ডাক দিয়েছে সে।
বাহির থেকে সাগর ভাইয়া ছুটে এসে বললেন,’মনে হয় আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।এভাবে না খেয়ে থাকলে কি করে চলে।শুধু পানি খেয়ে থাকলে কি সুস্থ থাকা যায়?’
অর্ণবের হাতটা ছুঁতেই জুথির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।দেরি না করে নাড়ি চেক করে নিলো সে।
এরপর যা বুঝলো তাতে ওর রুহু কেঁপে উঠেছে।পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে জুথি।সাগর ভাইয়া ওকে নাড়ি চেক করতে দেখেছিলেন,এখন ওর রিয়েকশান দেখে তার ও বুকের ভেতর ধুক করে উঠেছে।সে ফোন নিয়ে বাসার কাছের সেই ফার্মেসীতে বসা ডাক্তার কে আসতে বললো।এরপর নিজে চেক করলো।
যেমনটা কুসুমের বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেটা।
জুথি মুখে হাত দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে।ওর কান্নার আওয়াজে মা,বাবা সবাই ছুটে এসেছেন।কারোর বিশ্বাস হচ্ছেনা অর্ণব আর নেই।ডাক্তার এসে নিশ্চিত করলো সে সত্যি নেই।অর্ণবের রুম খুঁজে পাতায় পাতায় ঘুমের ঔষুধ মিললো।কখন,কিভাবে এগুলো সে কিনেছে এবং খেয়েও নিয়েছে কেউ জানেনা।
এ ডাক্তারের কথায় কেউ কান দেয়নি।বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো ওকে।সেখানের বড় ডাক্তার জানালেন মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ঔষুধ খাওয়ার ফলে অর্ণবের মৃত্যু ঘটেছে।
সবাই হাসপাতালে গেলেও জুথি যায়নি,সে জেনে গেছে অর্ণব আর নেই।
বিছানায় একটা জবা ফুল দিয়ে একটা চিঠি রাখা ছিল একেবারে শেষ কোণায়।জুথি ফুলটা সরিয়ে সেই চিঠি হাতে নিলো।শুরুতেই লেখা মৃন্ময়ী। মানে অর্ণব এটা ওর জন্যই লিখেছে।
মৃন্ময়ী,
আমি জানি বাবা মা হাতে পায়ে ধরে হলেও আপনাকে বিয়েতে জোর করাবে,কিন্তু একটা কথা কি জানেন?আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবোনা।আমার উপর জোর তারা খাটাতে পারবেনা।কুসুমের বেলায় ও পারেনি।একমাত্র আমার কপালে ও ছিল বলে বিয়েটা হয়েছিল।আপনি আমার কপালে কখনওই ছিলেননা।হতেনও না।
আমি আপনাকে কেমন করে বিয়ে করি বলেন?আমি যে কুসুমকে ছুঁয়ে ফেলেছি।একজন পিতা হয়ে গেছি।যার বাবা ডাক শোনা হয়নি আমার।আমি আপনাকে কখনওই বিয়ে করতাম না। সেই চিন্তা আমার নেই।বাবা মার জোর করাতে নয়।
আমি না এই জগৎয়ে থাকতেই পারছিনা।আমার ভীষণ কষ্ট হয়,আমি কুসুমকে ছাড়া বাঁচতে পারছিনা।এটা সত্যি।আমার দম বন্ধ হয়ে থাকে সারাক্ষণ,একটিবার শ্বাস নিতে আমার অনেক কষ্ট করতে হয়।আমি আমার চারপাশে কুসুমকে দেখি।কিন্তু ছুঁতে পারিনা।ওর হাওয়া,ওর স্পর্শ আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয়না।আমি বেঁচেও মরার মতন হয়ে আছি।ওর কবর দেখতে যেয়ে একদিন মনে হলো ঘুমের ঔষুধ কিনবো।অনেক অনেক।
সব একসাথে খেয়ে আমি ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিব।সেখানে আমার কুসুমের সাথে দেখা হবে।দেখা হবে আমার সন্তানের সাথে।সেখানে আমি ওকে ছুঁতে পারবো।আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না।আমি নিজের ইচ্ছেতেই এই পথ বেছে নিয়েছি।আপনাকে হয়ত অনেক কষ্ট দিয়েছিলাম।আমায় মাফ করে দিয়েন।মৃদুলকে বিয়ে করবেন নাকি করবেননা এটা আপনার একান্তই ব্যাক্তিগত ব্যাপার,তবে করতে পারেন।ও অনেক ভাল ছেলে।আপনার বাকি জীবনটাকে সুন্দর করে রাখবে।ভাল থাকবেন।
ইতি
অর্ণব
জুথি কাগজটা রেখে বের হয়ে গেছে রুম থেকে।ফোন খুঁজে মিশু ভাবীকে কল করে হাসপাতালের ঠিকানা জানতে চাওয়ার পর তিনি বললেন তারা অর্ণবকে নিয়ে চলে আসছে।ডাক্তার বললেন সে আর নেই।দোতলার সিঁড়ি বেয়ে জুথি ধীরে ধীরে নামলো।বাগানে এসে পা ফেলে একবার জবা গাছটার তলায় কুসুমের কবরের দিকে চেয়ে রইলো।স্মৃতি এত কষ্ট কেন দেয়!
অর্ণব মারা গেছে এক সপ্তাহ কেটে গেছে।আজ ৮ম দিন।
কুসুমের চিঠিটা আর অর্ণবের চিঠিটাকে একটা কাঠের বাক্সে ভরে ব্যাগে পুরে নিয়েছে জুথি।মৃদুলের সাথে কথা বলা হয়নি তেমন।অর্ণবের মৃত্যুতে সেও শোকের মধ্যে আছে।জুথির সঙ্গে যে দু দণ্ড কথা বলবে সেটাও করছেনা।কেমন যেন হয়ে গেছে।জুথির ও মনে হয় আর এখানে থাকা যাবেনা।দুটো আপন মানুষের শোকের ছায়া তাকে গ্রাস করছে।আজ সন্ধ্যায় ওর সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট।বাবা,মা,নানু,ফরহাদ সবাই যাবে।চাচা কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছেন বেড়াতে।তারা দাদা দাদির খেয়াল রাখবেন।
ততদিন বাবা সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসবে।
মৃদুল জানে জুথি আজ চলে যাচ্ছে।তাদের মাঝে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।সেই বেনামি সম্পর্কটা যতবার নাম নিতে চেয়েছে ঠিক ততবার বিপদ এসে দরজায় কড়া নাড়িয়েছে।এখন ঐ সম্পর্ককে টানতে গেলেও ভয় হয়।অর্ণবকে কুসুমের পাশেই সেই জবা গাছটার তলায় কবর দেওয়া হয়েছে।
শেষবারের মতন ওদের দুজনের কবর দেখতে জুথি আজ মৃদুলদের বাসায় এসেছে।কুসুমের কবরে সারি সারি জবা ফুল ঝরে পড়ে আছে,আর অর্ণবের কবরের উপর পাতা।জুথি পাতা গুলোকে ফেলে দিয়ে কুসুুমের কবরটার দিকে তাকালো।মেয়েটার প্রতি এক অন্যরকম মায়া কাজ করতো আর সে চলে গেয়ে সেই মায়ার টানটা গাঢ় করে গেলো।যেতে ইচ্ছে করছেনা এই মানুষ গুলোর টানের কারণে।কিন্তু তাদের স্মৃতি যে প্রতিদিন কষ্ট দেয় তা কি তারা বোঝে?
বিদেশ কেন চলে যাচ্ছে মৃদুলকে রেখে তা সে নিজেও জানেনা,একটা মানুষের থেকে ভালবাসায় কষ্ট পেয়ে যে মেয়েটা দেশ থেকে চলে গিয়ে অনেকদিন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল, তারপর হালকা শক্ত হয়েছিল!
সেই মানুষটার দুনিয়া থেকে চলে যাবার দুঃখ সে কতবছরে ভুলবে?কত বছরে শক্ত হবে?
একদিন তো এই মানুষটাকে সে ভালবেসেছিল।
অর্ণবের প্রাণ ছিল কুসুম,মেয়েটার সাথে শত্রুটা হতে পারতো কিন্তু হলো মায়ার টান।সেই টানে আজ তার চোখ ভিজে আছে।বারবার ওর কবরটা ছুঁয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।
দুটো কবর ছুঁয়ে সে চলো গেলো।মৃদুলের সামনে দাঁড়িয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বিদায় জানানোর সাহস তার নেই।সে পারবেনা মৃদুলকে আরও একবার এড়িয়ে চলতে।তার চেয়ে বরং পালিয়েই যাবে।
বিমানবন্দরে তার অবুঝ চোখজোড়া মৃদুলকে খুঁজেছিল বহুবার।পাগল ছেলেটার পাগলামো দেখেনি বলে মন খারাপ হলো ।ভেবেছিল একটিবার দেখা করতে নিশ্চয় আসবে সে।কারণ সে জানে আজ মৃন্ময়ী চলে যাচ্ছে।
বিমানে এসে বসে ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো জুথি।বাবা মা, ফরহাদ আর নানু একসাথে সিট পেলেও জুথি একটু দূরে সিট পেয়েছে।তার পাশে বসে আছে সাদা পাঞ্জাবির একজন ভদ্রলোক। শুরু থেকে তার মুখের সামনে খবরের কাগজ দেওয়া ছিল।মনযোগ দিয়ে পড়ছিলেন কিনা।বিমানটা ছাড়ার অনেকক্ষণ পর যখন আকাশের বিশাল উচ্চতায় পৌঁছে গেলো ঠিক তখন ঐ সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটা তার মুখ থেকে খবরের কাগজ সরালো।সেই লোকটা মৃদুল। জুথি জানালা দিয়ে বাহিরে দেখছিল।নিজের হাতের উপর অন্য কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে চট করে সরে বসে রাগী চোখে পাশে তাকালো সে।মৃদুলকে দেখে মুখের কথা হাওয়া হয়ে গেলো তার।মুখে হাত দিয়ে বললো,’আপনি এখানে কি করে?’
‘পাসপোর্ট সেদিন বানাতে দিয়েছিলাম যেদিন তুমি সিঙ্গাপুরে চলে যাবার হুমকি দিয়েছিলে,অনেক অনেক আগে।সময় মত পাসপোর্ট এসেও গেলো,আর দেখো আমি তোমার সামনে’
‘এসব কি করে!’
‘এত টাকা কই পেলাম ভাবছো?আমি তো বেকার তাই?তো শুনো।ধার নিয়ে করেছিলাম,সেটা শোধ করেছি কি করে শুনবে?
বাবার সেই শেয়াল দুটো চড়া দামে বেচে দিয়েছি এক বিদেশী বিক্রেতার কাছে।
আর বাবার জন্য রেখে এসেছি বাত ব্যাথার মোক্ষম ঔষুধ।হাহাহাহা!আচ্ছা পরে হাসবো।এই ওড়নাটা মাথায় পরো।
তমাল,অন্তু সবাই মোনাজাত ধরো,আর তৈকির আঙ্কেল দোয়া শুরু করেন।এদের সবাইকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার জন্য কত কি প্ল্যান করেছিলাম আমি,আমি কিন্তু নিজের খরচে তাদের নিচ্ছিনা।তমাল যাচ্ছে পড়ার জন্য,অন্তু যাচ্ছে ওর বাবার কাছে আর তৈকির আঙ্কেল তার ছেলে মেয়ের কাছে যাচ্ছেন।
আজ এই মূহুর্তে আমি মৃন্ময়ীকে বিয়ে করতে যাচ্ছি,রাজি আছে তার বাবা মা দুজনে,আর আমার বাবা মা তো অবশ্যই।কি হলো জুথি ঘোমটা দাও’
‘মানেহ এসব কি!’
‘অনেক দেরি হয়ে গেছে।বিয়েটা আরও আগে করা উচিত ছিল।জলদি মাথা নিচু করো।বিয়ের সময় মাথা উঁচু করতে হয়না।বলো!! কবুল বলে ফেলো।কাউকে ভালবাসলে সাথে সাথে বিয়ে করে নিতে হয় নাহলে তাকে না পাওয়ার চান্স থাকে।আমি এই ভুল করেছিলাম একবার,আরও একবার করেছিলাম পরে নিয়তি চোখে আঙুল দিয়ে সব বুঝিয়ে দিলো আর দেখো দেরি যেন না হয় সেজন্যে বিমানেই বিয়ের ব্যবস্থা করে নিলাম।ঐ দেশে গেলে আবার তোমার সাদা চামড়ার বফ টানাটানি করবে আমি আর রিস্ক নিতে চাইনা তোমাকে নিয়ে।কবুল বলে ফেলো’
জুথি মুখে হাসি ফুটালো।হুজুর দোয়া শেষে ওকে কবুল বলতে বললেন আর সে বলেও দিলো।হাজার ঝড়ঝাঁপটা শেষে মৃদুল- মৃন্ময়ীর বিয়ে সম্পন্ন হলো।
অর্ণব,কুসুমের চিঠি দুটোর বাক্সটি জায়গা পেলো আলমারির ভেতরের শীর্ষ তাকে।
আলমারি খুললে কিংবা কোথাও লাল জবা দেখলে সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যাবে লীলাবালির কথা।
ও হ্যাঁ!বাক্সটি জুথি অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিল।তাতে লেখা ছিল”লীলাবালি”
সমাপ্ত