কোথাও কেউ ভালো নেই -১১
সুরভীর জ্ঞান ফিরলো কামরুলের কাঁধে। অচেনা লোকের কাঁধে নিজেকে দেখে সুরভী নেমে যাবার জন্য লাফ দিয়ে উঠলো। কামরুলের শক্ত হাতে চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো না।কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো কঠোর হাতের লোকটা তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
বাড়ির কথা ভাবতেই ভয়ে সুরভীর গলা শুকিয়ে গেলো। এই বাড়ি সুরভীর কাছে জেলখানার চাইতেও নিকৃষ্ট।সুরভী আকুল গলায় ডাকলো,”বুবু,বুবু গো কই তুই।আমাকে কেনো বাড়িতে পাঠিয়ে দিলি তুই?
আমি এখানে কিভাবে থাকবো?
আমি কি তোকে বেশি জ্বালিয়েছি না-কি? তবে কেনো তুই এভাবে লুকিয়ে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলি বুবু?তোকে ছেড়ে আমি থাকবো কি করে। আমার আর কে আছে এই দুনিয়ায় তুই ছাড়া বুবু?
মা মরে গিয়ে তোর কাছে রেখে গেছে,তুই কার কাছে দিলি আমাকে বুবু?”
————–
তানভীর পূরবীকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো,পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।
হাতে পায়ে তেল মালিশ করতেই আস্তে-ধীরে পূরবী চোখ খুলে তাকালো।তারপর কোথাও সুরভীকে না দেখে চিৎকার করে বললো,”আমার বোন কই?
আমার বোনকে ওরা কেনো নিয়ে গেছে?আপনি আমার বোনকে নিয়ে আসেন।আমার বোন আমার কলিজার টুকরা। এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র আপনজন শুধু আমার বোনটাই আছে।এতো কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুবু বলে ডাকার জন্য আল্লাহ একটা মানুষকেই দিয়েছে।আমার বোনকে আপনি ফিরিয়ে আনেন না প্লিজ,কেনো গেলেন আপনি বাজারে।আপনি থাকলে তো ওরা আমার বোনকে নিয়ে যেতে পারতো না এভাবে।আপনার জন্য আমার বোনকে ওরা নিয়ে গেছে।”
পূরবীর কথা শেষ হলে তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”কে নিয়ে গেছে,আমাকে বলো আগে সব খুলে।”
পূরবী একে একে সব কিছু খুলে বললো। নিজের মায়ের ব্যবহারে তানভীরের মাথা লজ্জায় নিচু হয়ে গেলো।
সব বলার পর পূরবী আবারও কাঁদতে লাগলো। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিতে দিতে বললো,”আপনি এখনই যান,আমার বোন কে নিয়ে আসেন আপনি। আমি মরে যাবো আমার বোনকে না পেলে।আমার সুরভীর যে ভীষণ জ্বর ছিলো। ওকে যদি ছোট মা আবারও মারে ও তো মরে যাবে।আমার মা তো আমার হাতে দিয়ে গেছে এই ছোট্ট পাখিকে।আমি কেনো পারলাম না তাকে রক্ষা করতে। আপনি যান এখনই। ”
কিছু সময়ের জন্য ঝড় থেমে আবারও প্রলয়ঙ্কারী ঝড় শুরু হলো। মনে হচ্ছে যেনো আকাশ প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়বে।বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লাগার যোগাড়। মেঘে মেঘে আঘাত লেগে কড়াৎ কড়াৎ শব্দ হচ্ছে।
তানভীর পূরবীর হাত ধরে বললো,”কাল সকালেই যাবো পূরবী। এখন দেখো কেমন ঝড় হচ্ছে। এই রাতে আমরা কিভাবে যাবো বলো?
তুমি ও তো হাটতে পারবে না। ঝড় থামুক,দিনে গিয়ে নিয়ে আসবো।”
————–
সুরভীর গলা শুকিয়ে গেলো। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে সুরভীর।সুরভীদের ঘরের পিছনে পারভীনের কবর।সুরভী চিৎকার করে ডাকলো এবার নিজের মা’কে। মেয়ে থেকে ৫-৬ হাত দূরে মাটির ঘরে শুয়ে থাকা পারভীন পারলো না কোনো জবাব দিতে।
কামরুল ঠিক করেছে রাতটা এখানেই থেকে যাবে।এই ঝড়বৃষ্টির রাতে আর এতো দূরের পথ যাওয়া সম্ভব হবে না।কিছু মানুষকে শয়তান তার কঠিন অনুসারী বানিয়ে ফেলে,যাদের মানুষ বলে শয়তানের চ্যালা। কামরুল ও তেমন। লোকে কামরুলকে বলে, “বাঘে ছুঁলে হয় ১৮ ঘা, পুলিশে ছুঁলে হয় ৩৬ ঘা,আর ওসি কামরুল ছুঁলে হয় ১৩৬ ঘা।”
অর্থ ও নারী লোভী কামরুলের চোখে ৭ বছর বয়সী শিশু যা,২৭ বছরের যুবতী ও তা আর ৭০ বছরের বৃদ্ধা ও তা।
পূরবীকে দেখে কামরুলের মনে যে কামনার আগুন জ্বলে উঠেছে তা এই রাতের ঝড় যেনো আরো বাড়িয়ে দিলো।এই রাতে একটা নারীদেহ না পেলে কামরুলের কিছুতেই চলবে না।
সালমা কামরুলের মনোভাব বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছু জানতে চাইলো না কামরুলের কাছে।আর না কোনো কিছু বললো। কামরুল থাকতে চাইলে সালমা সাদরে গ্রহণ করলো।
কামরুল হেসে বললো,”তোর ঘরে থাকলে মজা পামু না,তুই তো এখন ডিমওয়ালা মাছের মতো।”
কামরুলের অশ্লীল কথায় সালমা খিলখিল করে হাসলো।তারপর বললো,”ওই ঘরে দুইডা বিছানা আছে কামরুল ভাই।তোমার কোনো অসুবিধা অইবো না অই ঘরে। ”
সুরভীর ঘরে এসে কামরুল সুরভীকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখলো।হাটু পর্যন্ত পরনের সেলোয়ার উঠে আছে।সুরভীকে অচেতন মনে করে কামরুল হাত দিলো সুরভীর হাটুতে।একটা নোংরা স্পর্শে ঘৃণায় রি রি করে উঠলো সুরভীর সারা শরীর।
বিড়বিড় করে কামরুল বললো,”পা তো নয়,যেনো মাখন।ছোটটা এরকম কচি,বড়টা তো তাইলে একেবারে রসালো।শালার আমার **ভাগ্য আসলেই ভালো। এই রকম একটা রাতে এরকম তাজা ফুল কেউ পায় না-কি! ”
এসব অশ্লীল কথার মানে সুরভী না বুঝলেও এটুকু বুঝলো স্কুলে ম্যাডামরা মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্য সবসময় যেসব উপদেশ দিতো,যেসব লোকদের থেকে দূরে থাকতে বলতো এই লোকটা তেমনই লোক।এদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতেই কতো মেয়েরা নিজের প্রাণ ত্যাগ করে তবুও নিজেকে ধরা দেয় না এদের হাতে।
কামরুলের হাত সুরভীর কোমরে উঠে আসতেই সুরভী চিৎকার করে উঠে বসলো। তারপর বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে ধরলো কামরুলের গালে।দুই হাত দিয়ে কামরুল এলোপাতাড়ি কিল বসাতে লাগলো সুরভীর পিঠে।
মার খেয়ে সুরভীর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো কিন্তু তবুও ছাড়লো না সুরভী।
মেয়েদের মন অল্পতেই অনেক কিছু বুঝে যায়।তাই সুরভী ও বুঝে গেলো এই লোকটা তার সাথে খারাপ কিছু করতে চায়।কিছুতেই সে এই লোকের উদ্দেশে সফল হতে দিবে না।
কামরুল সুরভীর চুলের মুঠি চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই সুরভী ছেড়ে দিলো। কিন্তু যেটুকু সময় পেয়েছে তাতেই কামরুলের গাল কেটে রক্ত বেরুতে লাগলো।সুরভী নিজের জিহবায় রক্তের নোনতা স্বাদ পেলো।
বুনো পশুর মতো কামরুল হানা দিলো সুরভীর উপরে। ছোট পাখির বাচ্চার মতো হালকা শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো মানুষরূপি জানোয়ারের নিচে পড়ে।
সুরভীর দুই ঠোঁট কামড়ে ধরলো প্রচন্ড রাগে।ব্যথায় সুরভী চোখে সর্ষে ফুল দেখলো যেনো।অসুরের ন্যায় শক্তিশালী একটা লোকের সাথে এভাবে পেরে উঠবে না সুরভী বুঝতে পারলো।
একে এভাবে না অন্যভাবে পরাস্ত করতে হবে,যায় তবে প্রাণ যাবে তবুও এভাবে নিজেকে খাবলে খেতে দিবে না সে এই লোককে।
সুরভী নিজের নড়াচড়া বন্ধ করে দিলো।কামরুল ভাবলো সুরভী হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এমনিতেই সে দেখছে জ্বরে এই মেয়ের শরীর পুড়ে যাচ্ছে,তাছাড়া এরকম ছোট একটা মেয়ের তার সাথে পেরে উঠার কথা না এতোক্ষণ সময়।
আবারও একবার কামরুলের অহংকার হলো নিজের শক্তি দেখে।কামরুল সুরভীর দুই হাত ছেড়ে দিয়ে পরনের জামা টেনে খোলায় মনোযোগ দিলো।
দেহে অবশিষ্ট যেটুকু শক্তি ছিলো সুরভী সেটুকু সঞ্চয় করে লাফিয়ে উঠে নিজের দুই আঙুল ঢুকিয়ে দিলো কামরুলের একচোখে।
একটা তীব্র আর্তনাদ এই ঝড়-ঝঞ্ঝা ভেদ করে সালমার কানে গিয়ে পৌছালো। চোখ চেপে ধরে কামরুল গোঙ্গাতে লাগলো। চোখ থেকে রক্ত পড়ছে তার।
দুই লাফে সুরভী উঠে নেমে গেলো বিছানা থেকে। তারপর সোজা গিয়ে ঘরের তাকে থাকা ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে নিলো। চোখ চেপে ধরে কামরুল হাতড়ে হাতড়ে উঠে এলো সুরভীকে ধরার জন্য। সুরভী দ্রুত দৌড়ে বের হয়ে গেলো।
বিষক্রিয়া ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। নীল হয়ে গেলো ফর্সা মুখখানা। অবসন্ন দেহটা কোনোমতে নিয়ে গেলো মায়ের কবরের উপর। চিৎকার করে পূরবীকে ডেকে বললো,”বুবু রে, ও বুবু…..
আমি মরে যাচ্ছি রে বুবু,আর কোনো দিন তোর বোন তোকে ডাকবে না রে বুবু।আর জ্বালাবে না তোকে। তোলে আর বোনের চিন্তা করতে হবে না।এই পৃথিবীর মানুষেরা বড়ই নিষ্ঠুর বুবু,এরা সবাই একটা নোংরা মন নিয়ে চলাফেরা করে। এরা আমাকে আরো কয়েকটা দিন বাঁচতে দিলো না এই পৃথিবীতে। মা একজন এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর মানুষেরা তাদের আসল রূপ দেখিয়ে দিলো আমাকে।আমার আশ্রয় কারো কাছেই হলো না বুবু।তুই ও পারলি না আমাকে আশ্রয় দিতে।আমি আবার আমার মায়ের কাছে চলে যাচ্ছি।আমার মা-ই পারবে শুধু আমাকে তার বুকের মধ্যখানে জায়গা দিতে।”
তারপর মায়ের কবর জড়িয়ে ধরেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো একটা অবুঝ ও নিষ্পাপ পাখি। যে পাখি আর তার মধুর সুরে বুবু বলে ডাকবে না কাউকে।যে পাখি আর বারবার ক্ষিধে পাওয়ায় বোনকে জ্বালাতন করবে না।
যাকে নিয়ে সবার চিন্তা ছিলো,সবার চিন্তার অবসান ঘটিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে।
চলবে……..
জাহান আরা