# পদ্মপাতার_জল
# পর্ব_০৯
দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো শুভ্রা।চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে অনির্বানকে ডাকা শুরু করলো।
__’শুনছো!আটটা বাজতে চলল।উঠে পড়ো এখন!অফিস আছে।’
অনির্বান হালকা নড়ে কানে বালিশ চাপা দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
শুভ্রার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করলো।শরীরে তার যতটুকু শক্তি জমে সব অনির্বানকে ভোরবেলা ডাকতেই নিঃশেষ হয়ে যায়!মরা কাঠের মতো পরে থাকে।উঠার নাম করে না!
শুভ্রা আরো দু বার ডাকলো অনির্বানকে।কিন্তু কোনো প্রতিত্তর পেলো না।এবার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে একটানে উঠিয়ে বসিয়ে দিল অনির্বানকে!
অনির্বান প্রথমে চমকালেও পরে সামলে নিলো নিজেকে।এটা নতুন কিছু নয়।শুভ্রার দিকে তাকিয়ে একগুচ্ছ হাসি ছুঁড়ে দিল।
শুভ্রা রেগে বলল,
__’শোনো,তোমায় রোজ সকালে এত কষ্ট করে ডেকে উঠাতে পারবো না আমি।আজ পর্যন্ত এক ডাকে কোনোদিন তোমায় ঘুম থেকে উঠাতে পেরেছি? না, পারিনি।আর ভবিষ্যতেও পারবো না।তাই তোমাকে আর ডাকাডাকির মধ্যে নেই আমি!ওদিক দিয়ে অফিসের সব কাজ লাঠে উঠুক তাতে আমার কি!’
অনির্বান এপাশ ওপাশ তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
__’সেটাই! তোমার কি!তোমার তো কিছুই না।তাহলে এক কাজ করি।আরেকটা বিয়ে করি।যে বউ আমায় রোজ সকালে ডেকে তুলবে।আমাকে গুছিয়ে অফিসে পাঠাবে।কেমন হবে?’
মুহূর্তে শুভ্রার সারা মুখ কালো হয়ে গেল।চোখ দুটো কানায় কানায় ভরে উঠলো।যেনো সুযোগ পেলেই ঝরনার মতো ঝরে পড়বে।সেই দাঁতে দাঁত চেপে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
অনির্বান মাথা তুলে একবার শুভ্রার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো।সে একটানে শুভ্রাকে নিজের কোলে বসালো।
শুভ্রার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
__’যাহ,বাবা!আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম।এতেই মহারাণী কেঁদে টেদে একাকার! এই,তোমার চোখের জল এত দ্রুত চলে আসে কেন?নাকি অশ্রু গ্রন্থিকে বলে রাখো যে কেউ কিছু বলার সাথে সাথে তোমাদের কাজ শুরু করে দিবে?’
শুভ্রা রেগে উঠে যেতে নিতে অনির্বান তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
সে রোজ ইচ্ছে করে দেরিতে উঠে।শুভ্রার দুষ্ট মিষ্টি ধমক আর বকা খাওয়ার জন্য।সে এই মেয়েটিকে আরো হাজার জনম পাশে চায়, রোজ সকালে যার রাগান্বিত ফোলা ফোলা নাক দেখে তাকে আরো একটু রাগাবে!তারপর নিজেই সেই রাগ ভাঙাবে।
সে জনম জনম শুভ্রার রাগের কারণ এবং রাগ ভাঙিয়ে মুখে হাসি ফোটানোর কারণ দুটোই হতে চায়।
__________________
মৃন্ময়ীর সদ্য ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে অনিরুদ্ধ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
__’আমায় ভালোবাসো?’
মৃন্ময়ীর কোনো ভাবন্তর হলো না।সে চুপচাপ অনিরুদ্ধর বাহুতে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।
অনিরুদ্ধ একটু জোরে বলল,
__’কি হলো মৃন?বল না,আমায় ভালোবাসো?’
মৃন্ময়ী মুচকি হেসে চোখ খুলল।তারপরে অনিরুদ্ধর বুকে মাথা রেখে বলল,
__’জানি না!’
অনিরুদ্ধর মনটা কেমন করে উঠলো।মৃন্ময়ী সত্যি সত্যি তাকে ভালোবাসে তো?সে তো মৃন্ময়ীর মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে চায়। নিজ কানে শুনতে চায়!
মৃন্ময়ীকে নিজের সাথে মিশিয়ে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো অনিরুদ্ধ।ঘড়িতে বেলা দশটা আটাশ বাজে!
সে আজ অফিস যাবে না।সারাদিন মৃন্ময়ীর সাথে থাকবে।তার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে।মনে হচ্ছে, সুযোগ পেলেই মৃন্ময়ী তাকে ছেড়ে চলে যাবে দূরে কোথাও। একদম দূরে,যেখানে সে হাজার চেষ্টাতেও পৌঁছাতে পারবে না।নাহ!সে মৃন্ময়ীকে ছাড়বে না।কিছুতেই না।কোনো কিছুই তাকে মৃন্ময়ীর থেকে আলাদা করতে পারবে না।
অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর দিকে তাকালো।ঘুমিয়ে পরেছে মৃন্ময়ী।কি সুন্দর লাগছে দেখতে!শ্রাবণ ঝরা সন্ধ্যার,শেষ বিকেলের লাল আভা ফুটে উঠেছে সারা মুখে।
সে এই ঘুমন্ত মুখটা বুকের মাঝে নিয়ে প্রতিটা সকাল ঘুম থেকে উঠতে চায়!
ফোনের মেসেজ টিউন বেজে উঠলো।ডক্টর আজগর মেসেজ পাঠিয়েছে।
“অপারেশনের সব ব্যবস্থা কমপ্লিট।এখন কিন্তু পেছন ফেরার অবকাশ নেই।সময় মতো যা যা করার সব করো।”
তিনটা বাক্যের মেসেজটি পড়ে অনিরুদ্ধর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।বুকের কোথায় যেনো রক্ত ক্ষরণ শুরু হলো।তার দম বন্ধ হয়ে আসছে!
মৃন্ময়ীকে বুকের উপর থেকে সাবধানে সরিয়ে বালিশে মাথা রেখে এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গেল।চোখে মুখে পানি দিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল।
আজ রাত দশ-টায় মৃন্ময়ীর চোখের অপারেশন!কাউকে জানায়নি অনিরুদ্ধ। এমনকি মৃন্ময়ীও কিছুই জানে না।কাজটা সে সবার অগোচরে করেছে।কারণ কেউ কেউ হয়তো বাঁধ সাধতো।এতবড় অপারেশনে মৃন্ময়ীর যে প্রাণের ঝুঁকি আছে।
সে নিজেও চায় না এ অপারেশন যেটাতে মৃন্ময়ীর ক্ষতি হবে।ছোটবেলা একটা ভুলের জন্য মৃন্ময়ীর আজ এই অবস্থা।
সেদিন শেষ বারের মতো মৃন্ময়ীকে হসপিটালে দেখেছিল সে সেন্সলেস অবস্থায়।তারপর যে কদিন দেশে ছিল একবারো মৃন্ময়ীর সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি।ভিতরে অপরাধবোধ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।বিদেশ যাওয়ার পর সে এতগুলো বছরে কাউকে না জানিয়ে পার্ট টাইম জব করে মৃন্ময়ীর অপারেশনের সব টাকা জোগাড় করেছে।সে চায় না মৃন্ময়ীর অপারেশনের টাকা অন্য কেউ দিক!
কিন্তু দেশে ফেরার পর ঢাকার নামকরা ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারে, এ অপারেশনে প্রাণ ঝুঁকি আছে।সেজন্য সে চায়নি।মৃন্ময়ী যেমন আছে তেমনই চায় তাকে।কিন্তু প্রতি রাতে ঘুমের ঘোড়ে মৃন্ময়ী ছটফট করে।অনিরুদ্ধকে দেখতে চায় সে।
বাড়ির সবাইকে দেখতে চায়।দেখতে চায় এই পৃথিবীকে,স্বাদ নিতে চায় মুক্ত প্রকৃতির।তারপর ডক্টর আজগর যখন বলল যে সে আই ডোনার পেয়েছে,তখন না করেনি।অনেক ভেবে অপারেশন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনিরুদ্ধ রুমে চলে আসলো।মৃন্ময়ীকে নিয়ে বের হবে এখন সে।
_________________
___’অনিরুদ্ধ, আপনার কোন ফুল পছন্দের? ‘
অনিরুদ্ধ ঘাড় ঘুড়িয়ে মৃন্ময়ীর দিকে তাকালো।সে এতক্ষণ উদাস দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়েছিল।
এখন বিকেল প্রায়।তারা একটা নদীর তীরে বসে আছে।নদীর জল বুড়িগঙ্গার মতো কুচকুচে কালো।মরা নদী। পানির গভীরতা অনেক কম।কালো জলকে মনে হচ্ছে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছাড়া কিশোরীর এলোকেশ।
মৃন্ময়ীর হাতের ভাঁজে রাখা অনিরুদ্ধর হাতটাতে চাপ পড়লো।সে শান্ত গলায় বললো,
__’মৃন,আমার স্পেসিফিক কোনো পছন্দের ফুল নেই।ফুল তো ফুলই।সব ফুলই আমার পছন্দের।’
মৃন্ময়ী মুচকি হাসলো। পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বলল,
__’ভুল বললেন অনিরুদ্ধ। ফুল তো ফুলই নয়!সব ফুলের জীবনচক্র এক নয়।এদের জীবনও মানুষের মতো।কেউ গভীর পরিচর্যায় বেড়ে ওঠে,কেউ বা অযত্নে অবহেলায়।পঁচা পানিতে বা ডোবায় জন্মানো কচুরিপানার সাথে কি আপনি বিলাসবহুল প্রাসাদে জন্মানো অর্কিডের তুলনা করতে পারবেন?পারবেন না।বিয়ের পরের দিন এমনই এক বিকেলে আপনি আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার প্রিয় ফুল কি?মনে পড়ে?’
অনিরুদ্ধ মাথা নেড়ে বলল,
__’হু,মনে পড়ে।তুমি সেদিন কোনো উত্তর দাওনি।’
__’আজ আপনাকে উত্তর দিবো।আমার প্রিয় ফুল হলো পদ্মফুল।হ্যাঁ,পদ্মফুল।আপনি জীবনে পদ্মফুল দেখেছেন?হয়তো দেখেননি।আমি দেখেছি।বুবুর বিয়ের কিছুদিন আগে বাবা আমার মাসহ দুবোন কে নিয়ে পাবনা বেড়াতে গিয়েছিল।সেটাই ছিল আমার পরিবারের সাথে শেষ ঘোরা।তারপর আর সুযোগ হয়নি!
পাবনাতে যে বাড়িতে আমরা গেছিলাম সেই বাড়িটি ছিল টিনের তৈরি।বাড়ির চারপাশে বিল আর বিল।তখন বর্ষাকাল ছিল। বিলে তখন পদ্মফুলে টইটম্বুর।
একদিন ভোরবেলা বাবা দেখি বাবা নৌকা নিয়ে বিলে শালুক তুলতে যাচ্ছে।বাবার কাছে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতেই আমায় এক টানে নৌকায় তুলে নিলেন।
সারা বিলে পদ্মফুল তার ইয়া বড় বড় পাতা আর শেকড় দিয়ে জাল বিছিয়ে রেখেছিল যেনো।অনেকটা আত্মরক্ষার স্বার্থে।অনেক কষ্টে বাবা বিলের মাঝে পৌঁছায়।নৌকা দাঁড় করিয়ে বাবা পানিতে ঝাঁপ দেয়।বাবা শালুক তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আর আমি নৌকার উপর থেকে পদ্মপাতায় হাত দিয়ে পানি ছিটাতে থাকি।কিন্তু যতবার পানি দেই পদ্মপাতা পানি ঝরিয়ে ফেলে,নিজের গায়ে সদ্য দেয়া পানিটুকুর চিহ্ন রাখে না।ওইটুকু বয়সে বিষয়টাতে অনেক মজা পাই,আর বার বার করে পানি দিতে থাকি।কিন্তু প্রতিবারই ম্যাজিকের মতো পানির চিহ্ন থাকে না।সেদিন থেকে পদ্মফুল আমার পছন্দ।
বড় হয়ে বুঝলাম আমি একটা পদ্মফুলের মতোই।আর আমার জীবনটা হলো পদ্মপাতা।যে পাতায় সমস্ত দুঃখ কষ্ট, হতাশা,গ্লানি,বেদনা এসে ঝরে যায়।পদ্মপাতা যেমন জলকে নিচে রেখে হাসিমুখে তার উপর ভেসে থাকে,আমান জীবনটাও তেমন।সমস্ত কষ্টকে জীবনের নিচে চাপা দিয়ে হাসার চেষ্টা করি।পদ্মফুল যেমন অযত্নে,পঁচা ডোবায় বা আপনাআপনি জন্মায়,আমিও তেমন।বড় হয়েছি অনেকটা অযত্ন, অবহেলায়।
সবাই আমাকে যতই কষ্ট দিক বা কটু কথা শোনাক,সব আমার কাছে #পদ্মপাতার_জল।যা আমি কখনো গায়ে মাখি না।ঝরিয়ে ফেলে দিই।
জানেন,ভবিষ্যতে আমার একটাই স্বপ্ন।ছোট্ট একটা পুকুর থাকবে আমার।যে পুকুর জুড়ে থাকবে পদ্মপাতা আর মাঝে মাঝে পদ্মফুল।পুকুরের দক্ষিণের কোণ ঘেঁষে একটা ডিঙি নৌকা বাঁধা থাকবে।কোনো শ্রাবণ সন্ধ্যায় বা জোসনা রাতে বা কুয়াশা মাখা সকালে নৌকায় ভেসে থাকবো পদ্মপাতার মতো।হাতে থাকবে একগুচ্ছ পদ্মফুল।দারুণ হবে না?’
অনিরুদ্ধর ঘোর কাটলো মৃন্ময়ীর ঝরণার মতো হাসির কলতানে।মৃন্ময়ীর প্রতিটা শব্দ তার বুকে গিয়ে বাজছে।সে দুহাতে মৃন্ময়ীর মুখটা উঁচু করে বলল,
__’আমায় সেই নৌকার মাঝি বানাবে?তোমার চলার পথের সাথী বানাবে?’
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে হু বলল।অনিরুদ্ধ একগাল হেসে বলল,
__’ভালোবাসো আমায়?একবার মুখে বল না?’
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
__’এই,আপনার মাথা কি পুরাই গেছে নাকি?গতরাত থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কতবার একই প্রশ্ন করলেন সে খেয়াল আছে?’
__’কতবার করেছি?’
__’এখনকার টা দিয়ে টোটাল তেইশ বার হলো।’
__’আল্লাহ!এতবার বলেছি!কিন্তু তুমি তো একবারো উত্তর দিচ্ছো না।সুনিপুণ ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো।’
মৃন্ময়ী হেসে ফেলল। অনিরুদ্ধর বেশ কিছু কাজ এখনো একদম ছেলেমানুষী বৈকি কিছুই নয়।অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
__’সময় হলে বলবো।’
অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর ডান হাতটা শক্ত করে ধরলো।সে আদৌ জানে না সে সময় আসবে কি না।কিন্তু এ জীবন থাকতে সে মৃন্ময়ীকে ন্যানো সেকেন্ডের জন্য কষ্ট পেতে দিবে না।
_________________
অপারেশন থিয়েটারের সামনে সবাই বসে আছে।
(চলবে)
{জীবন্ত লাশ}💞