এবং_স্ত্রী
পর্ব_৩০
#Jannatul_Ferdos
গোধুলির লগ্নে নিরুপমা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।বাতাসে তার খোলা চুল গুলো আপন মনে উড়ছে।আজ এতোগুলো বছর পর তার মায়ের মৃত্যুর শোক তাকে জেঁকে ধোরেছে।সত্য কতোটা নির্মম, নিষ্ঠুর তা নিরুপমা আজ বুঝলো।বাস্তবতা মানতে আমাদের সকলেরই খুব বেশি কষ্ট হয় নিরুপমার ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম কিছু ঘটলো না।উৎস নিরুপমাকে রুমে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে আসে। মেয়েটাকে খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে।উৎসের নিজের যে খারাপ লাগছে না তা না সে অনেক বেশি অনুতপ্ত। মিসেস ডালিয়ার জন্য সে নিরুপমার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছে গায়ে হাত তুলেছে পর্যন্ত কিন্তু সেই মিসেস ডালিয়া পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানুষ গুলোর মধ্যে একজন।একটা মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে তা বোধ হয় মিসেস ডালিয়া আর পারুল বেগমকে না দেখলে সে বুঝতো না।সে নিরুপমার কাছে গিয়ে কাধে হাত দেয়।নিরুপমা উৎসের স্পর্শ পেয়ে চোখের নোনা পানি গুলো মোছার মিথ্যা চেষ্টা করে।কিন্তু কথাই আছে আমরা কিছু লুকাইতে চাইলে সেইগুলো বার বার সামনে চলে আসে আর নিরুপমার চোখের অবাধ্য পানি ও বার বার চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
“আমাকে তুমি মাফ করে দেও নিরুপমা
” ক্ষমা চাইছেন কেন?
“আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি অনেক নিরুপমা। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ……উৎসের চোখের কোনায় পানি দেখেই নিরুপমা বুঝতে পারে উৎস অনুতপ্ত।
নিরুপমা একটা ম্লান হাসি দেয়।
” বাবা চলে যাবেন তোমার জন্য অপেক্ষা করতেছে।
“ওহ আচ্ছা চলেন
উৎস আর নিরুপমা দুজনে মিলে নিচে যায়।মিসেস ডালিয়া বেশ কিছুক্ষণ আগে বেড়িয়ে যায়।নিরুপমার মুখোমুখি থাকার সাহস তার নেই।সে যা করেছে এর ক্ষমা হয় না।নয়ন রহমান নিরুপমার থেকে বিদায় নিয়ে পারুল বেগম,ঝুমুর ও লতিফকে নিয়ে বের হয়।তিনি বাড়িতে গিয়ে একটু শান্তিতে ঘুম দিতে চান।বাবা হিসাবে তিনি আজ পর্যন্ত কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারেন নি।আজ সে অনুতপ্ত মা হারা মেয়েটাকে সে কতোটা কষ্ট দিয়েছেন অবহেলা করেছেন।আচ্ছা বেশিরভাগ বাবারা কেন এমন হয়ে যায়?দ্বিতীয় বিয়ে করলে তখন প্রথম সন্তানকে তারা অবহেলা অনাদরে বড় করেন।এগুলাই শুধুই সৎ মায়ের দোষ নাকি আংশিক ভাবে হলে ও বাবারা ও দোষী?এক হাতে কি তালে বাজে?দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তাদের এমন ব্যবহার হয় যেন আগের ছেলেমেয়ে গুলো তার না। তখন দ্বিতীয় বউয়ের প্রতি এতোটা মুগ্ধ থাকে যে দুনিয়ার বাকি দিকে তাদের লক্ষ থাকে না।হায়রে দুনিয়া সবাই এমন কেন?
নিরুপমার দিন ভালোই কাটছে মুসকানকে নিয়ে।মুসকান এখন দৌড়ে বেড়ায়।যখন হাসে নিরুপমার কলিজাটা জুড়িয়ে যায়।এতো মায়া কেন মুসকানের মুখে?মুসকান আদো আদো কথা ও শিখেছে।তবে মুসকান খুবই জেদি ও রাগী হয়েছে। যে জিনিস একবার না বলবে কোনো মতেই তাকে কিছুতেই আর সেই কাজ করানো যায় না।নিরুপমা ভিষণ হিমশিম খাচ্ছে মুসকানকে সামলাতে।এর মধ্যেই প্রেমা আসে নিরুপমার কাছে…
“আজ ভার্সিটিতে যাও নি
প্রেমা মুসকানকে কোলে নিতে নিতে বলে..
” আজ তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কোনো ক্লাস নাই সেজন্য।
“ওহ আচ্ছা।মনে হচ্ছে আমার ননোদিনী কিছু বলবে আমাকে হুম?কি ব্যাপার
” ইয়ে মানে ভাবি হইছে কি
“কি হইছে বলো তো
” নিশান ওর বাড়িতে আমার কথা জানিয়েছে।ওনারা আমাদের বাড়িতে আসতে চান
“আলহামদুলিল্লাহ এটাতো ভালো খবর।
” কিন্তু আমি বাড়িতে কিভাবে বলব?আমার তো ভয় করছে।
“প্রেম করছো কয় বছর?
” প্রায় ৫ বছর…প্রেমা মাথা চুলকে বলল
“৫ টা বছর প্রেম করলে ভয় করে নি আর এখন যখন অনিশ্চিত ভালোবাসা পূর্নতা পাবে তখন এতো ভয় কিসের হুম?ভয় নেই আমি পাশে আছি তো
” থ্যাঙ্কিউ ভাবি।আমি জানতাম তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমি কারোর সাথে মনের কথা বলতে পারব না।
“পাগলি একটা। আমার বোন না তুমি?তোমার হাসিমুখ না দেখলে কি আমার ভালো লাগবে?
” আচ্ছা ভাবি তুমি কখনো কারোর প্রেমে পড়ো নি?বা ভাইয়ার আগে কাউকে ভালোবাসো নি?
নিরুপমা স্মিত হাসিটা যেন বিলীন হয়ে গেল।সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল..
“আরে ধুর এগুলা রাখো চলো মায়ের কাছে গিয়ে নিশানের ব্যাপারটা বলি
” উহু না আগে বলো।আমি জানি তুমি কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছো
নিরুপমা চুপ থাকে।প্রেমা আবার বলে…
“আমাকে তো বলতে পারো ভাবি?
” ভালোবেসেছিলাম এখনো ভালোবাসি।তখন বয়সের আবেগ বলে উড়িয়ে দিলে ও তা কখনো আবেগ ছিল না মনের ভিতর থেকে রক্তক্ষরণের মতো সেই ভালোবাসার রঙ ক্ষরিত হয়েছিল।
“এখনো ভালোবাসে মানে বুঝলাম না ভাবি?
” মানুষটা উৎস…নিরুপমা একটা ম্লান হাসি দেয়
“হোয়াট?মানে ভাইয়াকে তুমি আগে থেকেই ভালোবাসতে?
” হুম
“মানে কিভাবে কি? আমার মাথায় ধোরতেছে না।
” তখন ক্লাস টেনে পড়ি।তোমার ভাইয়ের তো তখন বিয়ে হয় নি।অরিত্রা আপুর সাথে রিলেশন। আমি তো এতোকিছু জানতাম না। আমি ছোট থেকেই বোরকা পড়তাম।একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে কিছু ছেলে আমাকে উত্যক্ত করে।আমাদের এলাকার ছেলে।ওরা প্রায় আমাকে বিরক্ত করতো। কিন্তু ওরা সেদিন আমার গায়ে হাত দেয়। তোমার ভাই প্রতিদিন ওই রাস্তা দিয়ে যেত সেদিন সে আমাকে দেখে ছেলেগুলো আমাকে বিরক্ত করছে।তখন উৎস গিয়ে ওদের বাধা দেয় ওরা তখন উৎসকে হুমকি ধামকি দেওয়া শুরু করে।উৎস ওদের তখন ইচ্ছামত মারে আর পুলিশে ফোন দিয়ে তাদের পুলিশের কাছে দেয়।আমি ওই সময়টা শুধু উৎসের দিকেই তাকিয়েছিলাম।আমি কেমন জানি একটা নেশায় ডুবে যাচ্ছিলাম।মানুষটা এতো সুন্দর কেন?আমার তাকে একটা বারের জন্য ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছিল কিন্তু আমি তো তা পারব না। তখন উৎস আমার কাছে এসে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে আর আমি তাকে গভীর ভাবে দেখে যাচ্ছি ঘাড়ের কাছে একটা তিল ইস কি মারাত্মক লাগছিল সেদিন তাকে।এরপর উৎস আমাকে একটু জোরে ডাকলে আমার ধ্যান ভাঙ্গে।
“এই যে মিস?কি হলো কথা বলছেন না কেন?
” ইয়ে না মানে ধন্যবাদ আপনাকে। ছেলেগুলো আমাকে প্রায় বিরক্ত করতো
“বাসা কোথায় আপনার?
” এইতো সামনেই।
“ওহ আচ্ছা। এভাবে চুপ করে থাকবেন না।প্রতিবাদী হবেন কেমন?সবসময় কিন্তু আমি থাকব না এসব ছেলেদের থেকে আত্মরক্ষা নিজেকেই করতে হবে বুঝলেন?
” জ্বী বুঝেছি।
“স্কুলে যাচ্ছেন?আমি ড্রপ করে দিয়ে আসি?
” ধন্যবাদ কিন্তু আমি একাই যেতেই পারব
“শিওর? ” হ্যা পাক্কা।
“ওকে।আসি সাবধানে যাবেন কেমন?
“আচ্ছা শুনুন
” কিছু বলবেন?….উৎস ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
“আপনি কি এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যাওয়া আসা করেন?নাকি আজকে কোনো কাজে এসেছিলেন? ” কেন?
“না এমনিতেই জানতে ইচ্ছা করলো।
“আমার বাসা থেকে আমার ভার্সিটি যাওয়ার এই একটাই রাস্তা।সো এই রাস্তা দিয়েই যাওয়া হয়…উৎস মৃদু হাসে
আমি প্রতি উত্তরে একটা হাসি দিয়ে চলে আসি।তার পর থেকেই আমি ওই সময়ে স্কুলে যেতাম।কেন জানি উৎসকে এক নজর দেখার জন্য মনের ভিতর অস্থিরতা ভর করতো। কোনোদিন উৎসকে দেখতে পেতাম কোনোদিন পেতাম না।কিন্তু পেলেও কয়েক সেকেন্ড এর জন্য কারন ও গাড়িতে থাকত।আর যেহেতু উৎস ড্রাইভ করতো ওকে দেখতে সুবিধা হতো।উৎস হয়তো আমাকে কখনো আর সেভাবে লক্ষ করে নি।আমি ছোট থেকেই বাস্তবতা শিখেছিলাম তাই উৎসের প্রতি আমার এমন অনুভূতিকে আমি আবেগ ছাড়া অন্য কোনো নামে আখ্যায়িত করতে পারছিলাম না।তার পর আবার উৎসের আর্থিক অবস্থা আর আমার অবস্থা দুইটা যখন মিলাইতাম মনে হতো বামন হয়ে আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার চেষ্টা করছি।এরপর আর উৎসকে দেখার জন্য একি সময়ে আর যেতাম না।কয়েকদিন উৎসকে দেখতে না পেরে কেমন জানি দম বন্ধ লাগা শুরু হয়ে গেল।তবুও উৎসকে দেখার অদম্য ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে পড়াশোনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম।এর মধ্যে এসএসসি পরিক্ষা শুরু হলো।পরিক্ষার চিন্তায় কিছুদিন উৎস নামক ভুতটা মাথায় চেপে বসতে পারল না।ভালো রেজাল্ট করে কলেজে ভর্তি হলাম।এরপর একদিন উৎসকে আমাদের কলেজে দেখতে পাই ফিজিক্সের স্যার এর সাথে কথা বলছিল।তাকে দেখে আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছিল।তার সাথে অরিত্রা আপু।অরিত্রা আপু শাড়ি পরে আছে।উৎসের হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে দুজনের মুখেই অনাবিল হাসি। সদ্য বিয়ে করা দম্পতি মনে হচ্ছিল তাদের।বুকের মধ্যে অসহ্য তীব্র যন্ত্রণা শুরু হতে লাগলো।চোখ মুখে ঝাপসা দেখছি এমন মনে হতে লাগলো। যখনই নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে যাবো আমাকে মাবিহা ধোরে ফেলে।
“নিরু কি হয়েছে তোর।শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
আমি আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করে উৎসকে দেখিয়ে অস্ফুটস্বরে বললাম” উৎস
মাবিহা তাদের দেখে যেন সে নিজেই অবাক হয়ে গেল।
“ওইটার তোর ফুফাতো বোন না ” হ্যা
“কিন্তু ওরা এতো ঘনিষ্ঠ ভাবে?এক মিনিট আমি শুনেছিলাম উৎসের নাকি একটা সিরিয়াস রিলেশনশিপ আছে। তুই কষ্ট পাবি বলে আমি তোকে জানাইনি।কিন্তু সেই মেয়ে অরিত্রা আপু এটা আমি জানতাম না।
আমি কিছু না বলে উৎসের কাছে গেলাম।আমার কেন জানি জানতে ইচ্ছে করলো অরিত্রা আপু কি শুধুই তার প্রেমিকা?নাকি এর থেকে বেশিকিছু? কিন্তু মাঝপথে যাওয়ার পর আর যাওয়ার সাহস হলো না আমার।আমি আবার ফিরে আসলাম।পরে জানতে পারি ওদের বিয়ে হয়েছিল ৪ দিন আগে।ফিজিক্সের স্যার অরিত্রা আপুর বাবার বন্ধুর ছেলে।স্যারের সাথে দেখা করতেই তারা আমাদের কলেজে এসেছিল।
” এরপর?…প্রেমা তার বিষন্নতা গ্রাস করা মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো
“এরপর আর কি উৎসকে ভুলে নতুন ভাবে জীবন শুরু করার চেষ্টা করলাম কিন্তু মোনাজাতে সে সবসময় থাকত।অনেক কথা হয়েছে এখন এগুলা বাদ দাও তো। আম্মুর কাছে যাই চলো।
নিরুপমা আর প্রেমা তনিমা বেগমের কাছে যায়।তনিমা বেগম তখন সোফায় বসে টিভিতে নিউজ দেখতেছিল।বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার কোনো এক ফ্লাইটের বিমান ক্র্যাশ করেছে।সেটা নিয়েই নিউজ তোলপাড় চলছে।তনিমা বেগম খুব মনোযোগ সহকারে দেখছিলেন নিউজটি। পুত্রবধূ ও মেয়েকে দেখে তিনি হাসলেন।নিরুপমার উদ্দেশ্য নিশানের ব্যাপারে কথা উঠাবে।সেই মূহুর্তে নিরুপমার ফোনে একটা কল আসে। কলটা কানে নিয়েই নিরুপমা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাতের থেকে ফোনটি পরে যায়।নিরুপমার শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে সে কি ঠিক শুনলো?
চলবে!!!
সরি সরি সরি সরি এত্তোগুলো সরি।আমি এতোদিন এতোবেশি অসুস্থ ছিলাম বলার বাইরে।জ্বর, বমি, মাথা ব্যথা সব মিলিয়ে আমি অনেক বেশি অসুস্থ ছিলাম এজন্য গল্প দিতে পারি নি।
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি!