#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৪
দুর্জয় ভাইয়া ট্রাউজার্সের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।কিছুটা চমকে উঠলাম আমি। সাথে কেন জানি নার্ভাস লাগছে।কি আছে উনার মাঝে যে উনার উপস্থিতি আমাকে এতটা কাহিল করে দিচ্ছে!
‘ না না! আমি..আমি তো এমনিই ঘুরে দেখছিলাম।কলম লাগবে না আ..আমার।’
কোনোরকমে কথাটা বলে চুপ করে গেলাম।উনি কয়েকপা সামনে এগিয়ে আসলেন।আমার ছটফটে মন বারবার বলছে প্লিজ দূরে থাকুন।কাছে আসবেন না।আমার থেকে অন্তত দশ হাত দূরে থাকুন।
দুর্জয় ভাইয়া টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেই কলমটা বের করে বলল,
‘ তখন ভুলবশত কলম নিয়ে চলে এসেছিলাম তাই বলে কারো জিনিস এভাবে রাখতে অভ্যস্ত নই আমি।টেইক ইট!’
আমি থমথমে মুখে কলমটা হাতে নিলাম।উনার কথাবার্তার স্টাইল আমার শরীরে জ্বলন ধরিয়ে দিল।বদ লোক একটা! একটু ডিসেন্টলি কথা বলতে পারে না নাকি।নেহাত খালামণির ছেলে বলে কিছু বললাম না।
উনি যাওয়ার জন্য সামনে মুড়তেই আমি চটজলদি প্রশ্ন করলাম,
‘ আজ রাস্তায় আমাকে দেখে আপনি চুপ করে ছিলেন কেনো?আপনি তো আমাকে চিনতেন তাহলে?’
‘ এখনই সব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করবি না।মাথা হ্যাং হয়ে যাবে।শুধু মনে রাখিস আরিয়ান খান দুর্জয় কারণ ছাড়া কিছু করে না।!’
একদফা রহস্যের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দুর্জয় ভাইয়া গটগট পায়ে বের হয়ে গেলেন।উনার কথার কূলকিনারা খুঁজে না পেয়ে মাথা চুলকাতে লাগলাম আমি।কি ডায়লগই না দিয়ে গেল।আরিয়ান খান!নিকুচি করেছে আরিয়ান খান।আমার সাথে ভাব দেখাতে এসেছে উনি।কে পাত্তা দেয় উনার এসব ভাব!আর এক সেকেন্ডও থাকব না উনার রুমে।
নাকের ডগায় লেগে থাকা চুলগুলোকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে আমিও চলে গেলাম নিচতলায়।
.
শতবার মানা করা সত্ত্বেও খালামণি ডিনার না করিয়ে ছাড়লেন না।খালামণির হাতের রান্নার প্রশংসা না করে পারছি না।প্রত্যেকটা আইটেম ছিল ফাটাফাটি! আমি তো ঠিক করে নিয়েছি যতদিন পর্যন্ত বিয়ে না হয় ততদিনে খালামণির থেকে সব রান্না শিখে ফেলব।এরপর শ্বশুর বাড়ির লোকদের রান্না করে খাইয়ে ধামাকা করে ফেলব।
সকলের সাথে কথাবার্তার ফাঁকে আমি চারদিকে ভালোভাবে নজর রাখছিলাম দুর্জয় ভাইয়া আছে কিনা। নাহ্ উনাকে দেখতে পেলাম না এমনকি ডাইনিং টেবিলেও দেখি নি।কিন্তু যখন বাড়ি ফেরার জন্য সবাই তৈরি হচ্ছিল ওই সময় তিনি হঠাৎ কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে আমার হার্টবিটের গতি বাড়িয়ে দিলেন।
খালামণি আমাদের এগিয়ে দিতে এসে বললেন,
‘ যেহেতু রাত হয়ে গেছে দুর্জয় না হয় তোদের পৌঁছে দেবে।এই রোডে এমন সময় অটো,রিকশা কম থাকে।তাই সমস্যায় পড়ে যাবে।’
এই কথা শুনে আমি দুর্জয় ভাইয়ার দিকে আড়চোখে তাকালাম।উনি দূরে দাঁড়িয়ে অহনা আপুর সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলেন।
ভেবেছিলাম উনি রাজি হবেন না কিন্তু খালামণি বলার সাথে সাথে গ্যারেজে চলে গেলেন গাড়ি বের করার জন্য। বাহ্ এ তো দেখছি মায়ের বাধ্য ছেলে।যতই হ্যান্ডসাম হোক আর যতই বাধ্য হোক উনার কথাবার্তার ধরণ আমার মোটেও পছন্দ হয়নি।
এতক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক থাকলেও গাড়িতে উঠতে গিয়ে ঘটল আসল বিপত্তি। পেছনের সিটে মা,বড়মা এবং সুহানা আপু বসে পড়েছে।বাকি রইল ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটা।আমাকে তাহলে দুর্জয় ভাইয়ার সাথে বসে যেতে হবে।ও আল্লাহ্! এই মানুষটা আমার আশেপাশে থাকলেই আমার কেমন অস্থির অস্থির লাগে তাহলে এতটা রাস্তা এমন কাছাকাছি বসে থাকব কি করে।
মুখ ফোটে কিছু বলতে না পেরে বসে পড়লাম যথাস্থানে। গাড়ি চলতে শুরু করল নিজ পথে।এখন বোধ হয় প্রায় দশটার উপরে বাজে।কিন্তু রাস্তাঘাট এখনো জমজমাট। মেইন রোড এখনো যানবাহন চলাচল করছে। পেছনের সিটে মা এবং বড়মা নিজেদের মত করে আলাপে মগ্ন।সুহানা আপু ফোন গুতাচ্ছে।বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ঘুম ধরে যাচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার মুখ।এতে যেন ঘুমের রেশ আরো জেঁকে ধরছে।
ঠিক তখন পাশ থেকে দুর্জয় ভাইয়া ভারী গলায় বলে উঠলেন,
‘ তোর সেলফোন টা দে তো!’
তৎক্ষনাৎ আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল।উনি আমার দিকে না তাকিয়েই ড্রাইভ করে যাচ্ছেন। আমি চুপচাপ পার্স থেকে ফোন বের করে উনার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম।
‘ এটা নিউ ফোন নাকি?’
‘ জ্বি।আগেরটা হারিয়ে ফেলেছি।’
উনি ফোন নিয়ে কি যেন কতক্ষণ স্ক্রল করে একমিনিটের মধ্যে ফেরত দিয়ে দিলেন।আমি আরো ভাবলাম উনার ফোনে হয়তো ব্যালেন্স নেই তাই আমার ফোন ইউজ করছেন।কিন্তু কাউকেই তো কল করলেন না।
বাড়ির সামনে পৌঁছতেই ঝটপট নেমে পড়লাম সবাই।আম্মু ভাইয়াকে ভেতরে আসার জন্য বললেন।উনি সৌজন্যতার সাথে তা প্রত্যাখান করে গাড়িতে উঠে বসলেন।উনি তো দেখি বাকিদের সাথে কি মিষ্টি ব্যবহার করেন শুধুমাত্র আমার সাথেই রোবোটিক টাইপের কথাবার্তা। কেনো রে আমাকে কি তোর মানুষ বলে মনে হয় না!আমি কোনো বাচ্চা নই।আই এম ম্যাচিউরড।
বাড়িতে ঢুকে আমি এবং সুহানা আপু ইমন ভাইয়ার সাথে কিছুক্ষণ হাশি তামাশা করে যার যার রুমে চলে গেলাম।কাল যেহেতু শুক্রবার ক্লাসের প্যারা নেই।তাই আজরাতে একটা মুভি দেখা যাবে।আমার থ্রিলার টাইপের মুভি খুব ভালো লাগে।প্রেম ভালোবাসা, রোমান্টিক মুভি মনে ধরে না।হিহিহি।ভদ্র মেয়ে আমি।
হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় আসলাম।ভেজা টাওয়ালটা মেলে লম্বা একটা শ্বাস নিলাম।খোলা চুলগুলোকে কাটা দিয়ে আটকে দিলাম উঁচু করে।দুর্জয় ভাইয়ার গোমড়ামুখো চেহারাটা ভেসে উঠল চোখে।লোকটা কেমন রহস্য নিয়ে তাকায় আমার দিকে।আবার রহস্য নিয়ে কথা বলে।এমন কেনো সে!
হঠাৎই রাস্তার দিকে চোখ যেতে সমস্ত চিন্তা ভাবনা বন্ধ হয়ে গেল আমার। দুর্জয় ভাইয়া গাড়িতে হেলান দিয়ে বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন।উনার শীতল চোখের চাউনি আমারই দিকে।
এই লোক আমাকে শক দিতে দিতে হয়রান করে ফেলবে!নিজের বাড়ি না গিয়ে উনি এখানে কি করছেন?রাস্তা থেকে আমার বারান্দার দূরত্ব বেশি না হওয়ায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি উনার চোখের দৃষ্টি পলকহীন।আমিও কি করব বা কি করা উচিত তা বুজতে না পেরে চুপ করে তাকিয়ে আছি।
উনি পকেট থেকে ফোন বের করে কি যেন ঘাটাঘাটি করে কানে লাগালেন!তৎক্ষনাৎ রুম থেকে আমার ফোন বেজে উঠার আওয়াজ পেলাম।
ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলাম ফোন রিসিভ করতে।স্ক্রিনে দুর্জয় নামটা দেখে সব স্পষ্ট হয়ে গেল।তখন গাড়িতে তাহলে নাম্বার সেভ করার জন্যই ফোন চেয়েছিল।
আমি পুনরায় বারান্দায় এসে কল রিসিভ করলাম।উনি শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ এত রাতে বারান্দায় কি?ঘুম নেই?’
মনে মনে মুখ ভেঙচালাম আমি।আমি কি করব না করব সেটা উনি বলে দিতে হবে নাকি?
উনার দিকে চোরা চাহনি দিয়ে বললাম,
‘ আপনিও তো এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন!ভেতরে আসছেন না কেনো?’
‘ তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।তোর বারান্দায় গ্রিল নেই কেনো?রাতের বেলা যদি কোনো চোর ডাকাত উঠে আসে কি করবি?’
নিঃশব্দে ঢোক গিললাম আমি।গতকাল রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল আবার।এতক্ষণ তো মনেই ছিল না।শুকনো গলায় বললাম,
‘ আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন কেনো ভাইয়া!আপনি বাড়ি যান।খালামণি আপনার জন্য চিন্তা করবে।’
দুর্জয় ভাইয়া চুপ করে রইলেন।রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আগের মতই আমার দিকে স্থির চাহনি দিয়ে রেখেছেন!
হঠাৎ বলে উঠলেন,
‘ কাউকে ভালোবাসিস?’
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত একটা প্রশ্ন শুনে ধাঁধায় পড়ে গেলাম আমি।উনি কি পাগল টাগল হয়ে গেছে নাকি।কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেল।
‘ না ভাইয়া! ‘
‘ কখনো কাউকে ভালোবেসেছিস?’
এবার ভাইয়ার কন্ঠে আমি একধরনের আকুলতা শুনতে পেলাম।মনে হচ্ছে উনি আমার থেকে পজেটিভ আনসার শুনতে চাইছেন।
আমি বললাম,
‘ না ভাইয়া!প্রেম ভালোবাসা আমার ভালো লাগে না।তাই কখনো ভালোবাসিনি কাউকে।কিন্তু আপনি হঠাৎ এসব কেনো জিজ্ঞেস করছেন?’
‘ কিছু না।যা তুই ঘুমাতে যা।’
দুর্জয় ভাইয়া কল কেটে দিলেন।বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম উনি গাড়ির ভেতর ঢুকে প্রচন্ড শব্দে দরজা অফ করলেন।আমি ভয় পেয়ে গেলাম।হঠাৎ এমন রেগে গেলেন কেনো?
চোখের পলকে ধুলো উড়িয়ে চলে গেলেন।আমি ভাবতে লাগলাম এই মানুষটা এত রহস্যময় কেনো?ধীরে ধীরে উনি আমার কাছে একধরনের ধোঁয়াশায় পরিণত হচ্ছেন। উনি আমার থেকে আসলে কি চায়?
একগাদা উত্তরহীন প্রশ্ন ভর্তি মন নিয়ে রুমে আসলাম আমি।দরজা জানালা সব ভালো করে আটকে দিলাম।বলা তো যায় না যদি ওই ক্রিমিনাল আবার হানা দেয়।তাই সাবধান থাকা ভালো!
_____________________________
চেঁচামেচির আওয়াজে সকালের ঘুম ভাঙলো আমার।একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলাম।ডাইনিং থেকে ইমন ভাইয়া এবং সুহানা আপুর তর্কাতর্কির শব্দ ভেসে আসছে।নিশ্চয়ই নাস্তা করতে বসে দুটোয় সাপে নেউলের মত লেগেছে।
আজ তো আবার শুক্রবার। সবাই বাড়িতে থাকবে।বড়আব্বু আর আমার আব্বু বাড়িতে থাকা মানে সারদিন ড্রয়িংরুমে বসে নিউজ দেখবে পাশাপাশি দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলাপ আলোচনা চলতেই থাকবে।মাঝেমাঝে আমার এমন মনে হয় যে এদের দুজনকে দেশের রাজনীতিতে নামিয়ে দিলে কিছু একটা করে জনগণকে চমকে দেবে।
ফ্রেশ হয়ে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে।আব্বু বড়আব্বু কেউই বাড়িতে নেই।বোধ হয় দুইজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাজার করতে গেছে।ছুটির দিনে আমাদের বাড়িতে জমজমাট রান্নাবান্না হয়।বড়মা আর আম্মু শ্বাস ফেলার ফুসরত পান না।
রিমোট দিয়ে একের পর এক চ্যানেল পাল্টাচ্ছি আর পরোটা গিলছি।এমন সময় দেখতে পেলাম জিন্স টপ পড়া আমার বয়সী একটা মেয়ে মেইনডোর দিয়ে দৌড়ে এসে একবারে জড়িয়ে ধরল আমায়।ভড়কে গেলাম আমি।মেয়েটা জাপটে ধরে হড়বড় করে বলতে লাগল,
‘ পূর্ণতা কেমন আছিস তুই?জানিস কত কষ্ট করে তোর ঠিকানা জোগাড় করে বাসা খুঁজতে খুঁজতে এখানে হাজির হয়েছি! আই মিসড্ ইউ ইয়ার!উফ্ কত্তদিন পর দেখা আমাদের।’
মুখে পরোটার শুকনো টুকরোটা কোনোরকমে গিলে আমি অবাক হয়ে তাকালাম মেয়েটার দিকে।আমার বিস্ময়তা দেখে সে সন্দিহান হয়ে বলল,
‘ কিরে এতবছর পর আমায় দেখলি আর তোর এই রিয়্যাকশন!মনে হচ্ছে যেন চিনতে পারছিস না আমায়?’
মেয়েটার চিল্লানোর আওয়াজে আম্মু বড়মা বেরিয়ে আসলেন কিচেন থেকে।মেয়েটাকে দেখে আম্মু হাসিমুখে বলল,
‘ আরে তৃষা তুই এখানে কিভাবে?তোরা না ঢাকা থাকতি?’
মেয়েটি আম্মুকে সালাম দিয়ে বলল,
‘ আব্বুর চাকরি আবার চট্টগ্রাম ট্রান্সফার হয়েছে আন্টি।কিন্তু পূর্ণতার কি হয়েছে?স্কুলে থাকতে দুইজন একসাথে কত ফুচকা চটপটি খেয়েছি।সে কি এসব ভুলে গেল নাকি?’
এমন প্রশ্নে ড্রয়িংরুমে নীরবতা নেমে আসলো।আম্মু শুষ্ক কন্ঠে বলে উঠল,
‘ মাসকয়েক আগে পূর্ণীর একটা বড় রোড এক্সিডেন্ট হয়।পুরনো কিছু কিছু স্মৃতি ওর ব্রেইন থেকে মুছে গেছে।প্রথম প্রথম তো সে আমাকে আর ওর আব্বুকে ছাড়া কাউকেই চিনতে পারত না।ও তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়।মাঝেমাঝেই মাথা ব্যথার কারণে ছটফট করে।’
আম্মুর কথা শুনে তৃষার চেহারায় যেন বিষাদের ছায়া নেমে আসল।আমি মৃদু হেসে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চলবে…
[ আমি গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসছি।এখানে নেট না থাকার কারণে ফেসবুকে প্রায় ঢোকাই যায় না।তাই কয়েকদিন গল্প দিতে পারব না😥।]