শুভ বিবাহ পর্ব-১

0
5347

শুভ বিবাহ লেখা #AbiarMaria পর্ব ১ আমি লিটারেলি বুঝ হওয়ার পর থেকে যেই মেয়েকেই ভালো লাগত, তাকে বলতাম, “বিয়ে করবা?” ঐ মেয়ের সাথে প্রথম কথাই আমার এইটা থাকত। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন প্রথম আমার এক বান্ধবীকে এই কথা বলছিলাম। মেয়েটা খুব সুন্দর করে লাল ফিতে দিয়ে দুই ঝুটি করত, কিংবা দুই বেণী। ওর এত সুন্দর চুল বাঁধা দেখে মনে আওড়াতাম, এই সুন্দরীর সুন্দর বিনুনি আমি সারাদিন দেখতে চাই! খুশিতে ওকে “বিয়ে করবা?” জিজ্ঞাসা করার পর ও চোখ বড় করে ভয়ার্ত চোখের আমাকে দেখছিল। তারপর ম্যামকে ডেকে বলল, “ম্যাম! শুভ আমাকে বিয়ে করতে চায়!” ম্যামও আমাকে পিঠের উপর দুমাদ্দুম লাগালো। বলাই বাহুল্য, স্যারদের প্যাঁদানি ছেলেদের গায়ে লাগলেও ম্যামদের প্যাঁদানি গায়ের উপর হালকা আঁচড় মনে হয়। আমি তখন কিছু না বললেও পরে ওকে দেখে ভালোমতো চোখ মেরে দিয়েছিলাম। সেই থেকে শুরু হলো আমার অশুভ যাত্রা! না, মানে, ক্লাসের অতি ভদ্র মেয়েরা আদর করে আমাকে অশুভ ডাকতো। দ্বিতীয় বার বলেছিলাম অষ্টম শ্রেণির শেষে। ঐ মেয়েটা একেবারে ধবধবে ফর্সা ছিল। এত সাদা মেয়েকে প্রথম কড়া রোদে দেখে মনে হচ্ছিল চোখ ঝলসে যাচ্ছে! সাদা চামড়ায় রোদের ঝলকানি দেখে সেটাকে রূপের ঝলকানি দেখে বিকালে স্কুল ফেরার পথে ওর রাস্তা আটকে ভেটকি মেরে বলেছিলাম, “বিয়ে করবা?” বিনিময়ে গালের উপর একটা ঠাটা চটকানা মিলেছিলো। আমি ভাবিনি ও চড় মারবে। ভেবেছিলাম, বেশি হলে না হয় একটু রাগ করবে! তাই বলে চড়? তবে সেই চড় আমাকে দমাতে পারে নি। যেহেতু নবম শ্রেণিতে উঠলে ছেলেদের পেছনে একটা পাখা গজায়, আমিও সেই চেষ্টা তখন থেকে শুরু করলাম। ওর নাম ছিল শামসুন্নাহার। আমি ওকে রাস্তাঘাটে দেখলেই দাঁত বের করে বলতাম, “বিয়ে করবা?” শামসুন্নাহার এর বড় ভাই ছিল না কোনো, ওর বাবাও প্রভাবশালী কেউ ছিল না। তাই ও আমাদের এহেন অত্যাচার মাথা নিচু করে মেনে নিত। আমি ওর মাথা নিচু আর বড় করে হাসি দিয়ে বলতাম, “বিয়ে করবা না, না?” কয়েক মাস পর শামসুন্নাহারের বিয়ে হয়ে গেল। কয়েকদিন ওকে স্কুকে না দেখে ওর বাসার আশেপাশে গিয়ে সেটা জানলাম। না, এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখবোধ হলো না, বরং এরপর যেদিন স্কুলে এসেছিল, সেদিন বেহায়ার পর ওর কাছে বনরুটি আর চায়ের টাকা চেয়ে নিয়ে খেয়েছিলাম। মেয়েটা বোধহয় জীবনে কোনো দিন এমন শক খায়নি। যে ছেলেটা ওকে বিয়ে করবা বলে কথা বলা শুরু করেছিল, সেই ছেলে ওর কাছে ট্রিট নিচ্ছে? ছ্যা ছ্যা ছ্যা! এ তো প্রেম নামের কলঙ্ক! আমি ওর চোখের ভাষায় স্পষ্ট পুরোটা পড়তে পারলেও আমার মনোযোগ ছিল বনরুটু আর চায়ের চিনির দিকে। চাচা চায়ে চিনি কেন কম দিবে, হ্যাঁ?! আফটারঅল, চড় খেয়েছি এক কালে, বার পেট ভরে খেয়ে শোধ নিতে হবে তো! যদিও বনরুটি আর চা খুব বেশিকিছু না, তাই কয়েকটা বিস্কিটও পকেটে ভরে নিলাম। তারপর ওর দিকে ফিরে ফিচকি হাসি মেরে বললাম, “বিল দিয়া দিও সুন্দরী!” এসএসসি পাশের পর ঢাকায় গেলাম কলেজে পড়তে। আব্বুরও ব্যবসা ঢাকায় ভালো হচ্ছিল, আমরাও এই সুযোগে ঢাকায় ঢুকে গেলাম। ওখানে যাওয়ার পর ঢাকা কলেজে চান্স হলো। এইখানে তো কোনো মেয়ে নাই, তাই কাউকে বলতেও পারি না বিয়ের কথা। তবে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর পাখনা গজিয়েছে ভালো মত। বন্ধুদের সাথে কলেজের বাহিরে আড্ডাবাজি করতাম, ঘুরতে যেতাম। মাস কয়েকের মধ্যে বন্ধুরা তাদের গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে নিল, কেউ আবার স্কুলের বান্ধবীদের নিয়ে আসত। সেখানে ওদের একটা কমন বান্ধবী ছিল, পল্লবী। সবসময় পেছন ঝুটি করে সামনের দিকে দুই গাছি চুল গালের দুপাশে ফেলে রাখত। পল্লবীর সাথে প্রথম দুইবার দেখা হওয়ায় একেবারেই কিছু বললাম না। তৃতীয় বার ওর কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, “বিয়ে করবা?” পল্লবী সুন্দরী, তার উপর ওর সাথে কম বেশি সবাই ফ্লার্ট করে। তবে আমার মত কোনো ব্যাটার এত বড় কলিজা নাই, নিশ্চিত আমি। আমার মুখে বিয়ের কথা শুনে সে বুদ্ধিমতির মত বলল, “কাকে বিয়ে করব?” আমি নিজের দিকে ইশারা করলাম, “এই যে, জ্বলজ্যান্ত মানুষটাকে চোখে পড়ে না? বর হিসেবে খারাপ নাকি? বরের টুপি আমার মাথায় মানাবে না?” এইবার সে মনে দোলা লাগানো হাসি দিল আমার দিকে তাকিয়ে। আমি দাঁত বের হেসে ওর সাথে ফ্লার্টিং চালু রাখলাম। সবার সামনে সেদিন লাইন মারার পর বন্ধুরা খুব মজা নিল। জোর করে ধরে চা সিগারেটের ট্রিট নিল। পল্লবীর সাথে আস্তে আস্তে খুব সখ্যতা হলো। ও এদিক ওদিকের কথা বললেও আমার সেই পুরোনো অভ্যাস, বিয়ে নিয়ে খোঁচাতাম। কাজী অফিসের দেয়াল লিখন সামনে পড়লেই ওকে দেখাতাম, আর পল্লবী লজ্জায় হেসে কুটি কুটি হতো। না, এই ফাতরা প্রেম বেশিদিন না, সাত মাসের মাথায় ভেঙে গেল। ভেঙে গেল বলতে আমি তো পুরোটাই ফাজলামোতে পরিপূর্ণ একটা মানুষ। তাই ধীরে ধীরে যখন যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম, তখন পল্লবীও খুব একটা ঝামেলা করল না। সে আবার ভালো স্টুডেন্ট, এজন্য তাকে ভালো ভার্সিটিতে চান্স পেতে হবে। আমি সরে আসাতে ও বোধহয় খুশিই হলো। আমি ভাবি নি এত সহজে এই মেয়ের হাত থেকে নিস্তার পাবো। এক মাস পর ফোন করে খবরাখবর নিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আমি যে যোগাযোগ করি না, সময় দেই না, খারাপ লাগে না?” “খারাপ লাগার কি আছে? তোমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার পড়াশোনা। ওসব আলমারিতে তুলে দিয়ে এখন কি কান্নাকাটি লাগাবো নাকি? ওসবের সময় নেই” ফোনের ঐপাশে আমি দাঁত কেলাচ্ছিলাম। এরকম মেয়েই তো চাই! তবে আমার অভ্যাস খারাপ, এক মেয়ের সাথে বেশিদিন কথা বলতে পারিনা। সবটা জানা হয়ে গেলে তাকে বিরক্ত লাগা শুরু হয়। একটা মানুষকে নিয়ে মানুষ বছরের পর বছর কাটায় কি করে, মাথায় ঢুকে না ভাই! সেকেন্ড ইয়ারের শেষ দিকে, যখন পোলাপান ফাইনালি পড়ালেখা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে, তখন নীলক্ষেতে একটা নীলপরীকে দেখে খুব ভালো লাগলো। ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, “এই, বিয়ে করবা?” মেয়েটা বোধহয় শুনেছে, কিন্তু এমন ভাবে বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো যেন শুনতে পায় নি। দ্রুত বই নিয়ে সে আরেকটু ভেতরে আরেকটা দোকানের সামনে গিয়ে আবার কি একটা বই খুঁজছে। আমি হাসিমুখে বললাম, “বিয়ে করলে আমি তোমাকে বই কিনে দিতাম!” মেয়েটা আমার দিকে ফিরে বলল, “বিয়ে করে একটা বাচ্চাও হয়ে গেল। এখন আসলেই জামাইকে বিরক্ত লাগতেছে। চলো, ওরে তালাক দিয়ে বাচ্চা ফালায় তোমাকে বিয়ে করি। কি বলো?” আমি ঘাবড়ে গিয়ে দেখি, এইটা আসলে মেয়ে না, বয়স আছে এর, অন্তত আমার থেকে কয়েক বছরের বড় তো হবেই! আমি “আন্টি আসসালামু আলাইকুম!” বলে ওখান থেকে পালালাম। বুকে থুতু দিতে দিতে নিজেকে বললাম, হায়রে আল্লাহ, এই ‘বিয়ে করবা’ রোগ আমাকে কবে না আবার গণপ্যাঁদানি খাওয়ায়! এইচএসসি পরীক্ষার আগে থেকে একটা কোথাও ভর্তির আগে পর্যন্ত আমি আর এসবে পা দিলাম না।অনেক কষ্ট করে রাত দিন বই নিয়ে পড়ে থেকে বইগুলোকে বিয়ে করে নিলাম ছয় মাসের জন্য। ছয় মাস পর ঢাবির ডি ইউনিটে সিলেকশন লিস্টের শেষের দিকে নিজের নাম দেখে মনে হলো, আমার এই ছয় মাসের পুস্তক বিবাহ পূর্বক সংসার সার্থক হয়েছে! সিরিয়াল অনুযায়ী আমার কপালে ইংরেজি বিভাগ জুটবে। খুশিতে তখন আমি মাটিতে না, আকাশে ঘুরে বেড়ানো মেঘের উপর হেঁটে বেড়াচ্ছি। সেই খুশিতে মা আমাদের বিল্ডিংয়ের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন, আর আমি ছাদে গিয়ে বাড়িয়ালার মেয়েকে বলে বসলাম, “বিয়ে করবা?” চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here