শুভ বিবাহ পর্ব-২

0
3187

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

পর্ব ২

আমি দেখতে পাচ্ছি, বাড়িওয়ালার মেয়ে আমার কলার চেপে ধরে বলল,
“এই বেয়াদব ছেলে! তোর এত সাহস কিভাবে হয়? কোন সাহসে তুই আমাকে বিয়ের কথা বলিস? আজকেই আব্বুকে বলে তোদের বাসা থেকে বের করব! এত স্পর্ধা নিয়ে কিভাবে আমার বাসায় থাকিস, সেটাও দেখিয়ে দিব!”
তারপর ধুপধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে ওর মায়ের কাছে গিয়ে আমার নামে নালিশ দিল। তারপর সেই বাড়িওয়ালী এসে আমার মাকে বলল,
“আপনার ছেলের এত বড় স্পর্ধা?! আমার মেয়ের লেভেল কি এত নিচে নেমে গেছে যে আপনার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে? কোন সাহসে সে আমার মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়? কি আছে ওর, হ্যাঁ?! এরকম কয়েক’শ ঢাকা ইউনির ছেলে পেলে আমার মেয়ের পিছনে ঘুরে! কিন্তু এত বড় স্পর্ধা নিয়ে তারা বাসায় এসে এসব কথা বলে না! কি দিল আপনার অর্থব ছেলেকে এই চান্স? কে দিল?”

তার কথা শুনে আম্মু আমার কান টেনে বলল,
“তুই আর মেয়ে পেলি না? বাড়িওয়ালার ফকিন্নিটাকেই চোখে পড়ল? তোর কি কিছু কম আছে? এত যোগ্যতা থাকার পরও মেয়ে নিয়ে এত নাক উঁচা হবে কেন তার, এ্যাঁ? এইসব ছোটলোকের বাড়িতে থাকার দরকার নাই! আজকেই বের হয়ে যাব! আমার সোনার টুকরো ছেলের যোগ্য নাকি ঐ মেয়ে?”
তারপর সবাই মিলে একটা গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলল!

নাহ, এরকম কিছুই হলো না। এতক্ষম যা হলো, পুরোটা আমার হতচ্ছাড়া কল্পনা। বাড়িওয়ালার মেয়েটা কেমন যেন ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকালো। মাথায় ওড়না টেনে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে পালালো। আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম! বাড়িওয়ালার মেয়ে কেন আমার সাথে ঝগড়া করবে না? তেজ দেখাবে না? আমার সাথে যুদ্ধ লাগাবে না? ঢাকার বাড়িওয়ালার মেয়েগুলো এমন উজবুক কেন? ঝগড়া জানেনা নাকি? আমি বিরক্ত হয়ে পাশের ছাদে তাকালাম। বাড়িওয়ালার মেয়ে বোধহয় কলেজে পড়ে, ওখানে তারচেয়ে দুয়েক বছর ছোট একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুতকুত খেলছে তার চেয়েও পিচ্চি পিচ্চি মেয়েদের সাথে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে চশমাটা নাকের দিকে একটু ঠেলে দিল। ইচ্ছামত তেল দিয়ে চুল গুলো দুই বেণী করে রেখেছে। কুতকুত খেলতে আসলেও বুঝি কেউ চশমা পরে? নিশ্চয়ই কানি একটা মেয়ে, চশমা ছাড়া তার দুনিয়া আন্ধার! আমি বিরক্তি নিয়ে ছাদ থেকে চলে আসলাম। ভাবলাম বিয়ে করা নিয়ে আজ একটা হাঙ্গামা হবে, হলো না। জীবনে এক্সাইটমেন্টের অভাব হয়েছে, সেটাও জুটলো না।

বাসায় ঢোকার পর আম্মু হিন্দি সিরিয়ালের প্রাউড মাদের মত একটা হাফ পিরিচে করে আমার প্রিয় লাড্ডু নিয়ে আসলো। লাড্ডু আমাদের বাসার জন্য বিশেষভাবে কেনা হয়েছে। আম্মু এসে আমার মুখে লাড্ডু ঠেসে প্রশংসাসূচক নানান বাক্য ছাড়ছেন। এর মধ্যে আমার ছোট বোন শায়লা সেখানে আসলো। ওর আমার বুদ্ধিমত্তা কাছাকাছি হলেও সে আমার বিপরীত চরিত্রের অধিকারী। এবার নবম শ্রেণিতে উঠেছে সে। জীবনের কতগুলো বছর পার করে দিল, অথচ বাড়িতে একবারও ওর নামে অভিযোগ আসলো না! কি আশ্চর্য, জীবনে এত ভালো মানুষ হয়ে কি লাভ শুনি? ওর এত ভদ্রভাবে থাকার দরুন আব্বুর কাছে ও প্রিয়; আর আমি আম্মুর কাছে।

আম্মুর কাছে অবশ্য আমার গুরুত্ব বেশি। কারণ আমার বড় চাচী পাঁচ মেয়ের মা হওয়ার পরও তার ছেলে হয়নি, অথচ আমার মায়ের প্রথম বারেই ছেলে হয়েছে। ছেলের মায়েদের নাকি অন্য রকম ভাব থাকে, তাদের দাম নাকি মেয়ের মায়েদের চেয়ে বেশি হয়। আমার মায়ের দামও আমার জন্মের দিন থেকে রাতারাতি বেড়ে গেল। সেই বাতাস এসে আমার গায়েও লেগেছে। আমার বাবা, চাচা, চাচাতো বোন, ফুফাতো ভাই বোন, সবাই আমাকে ‘বংশের বাত্তি’ হিসেবে মাথায় তুলে রাখতো! আমি খুশি মনে সব সুবিধা নিয়েছি। এই কারণে আমার সাত খুনও আম্মুর কাছে মাফ পায়। অন্যদিকে আব্বু আমাকে প্যাঁদানি দেয়া শুরু করলে পৃথিবীর ঘূর্ণয়ন থেমে যেত। যখন প্যাঁদানি শেষ হতো, তখন যেন আবার নতুন করে পৃথিবী ঘুরত, এমন ইনফিনিট সময় নিয়ে আমাকে প্যাঁদাতো! আজ অবশ্য আলাদা, আব্বু আজ মিষ্টি এনে আমাকে কাঁধ জড়িয়ে এমন ভাবে প্রশংসা করছিল যেন আমি না, উনিই আমাকে চান্স পাইয়ে দিয়েছে।

এদিকে শায়লা এসে মুখ গোঁজ করে আম্মুকে বলল,
“তুমি এখানে? কমলা আন্টি তোমাকে ফোনে খুঁজছে। যাও, ফোন ধরো, উনি লাইনে”
আম্মু উঠে গেল ফোন ধরতে। আমাদের বেশিরভাগ কল ল্যান্ডলাইনেই আসে। মেট্রিকের আগে আব্বু ছাড়া কারো ফোন ছিল না। কলেজে উঠার পর আমাকে নোকিয়া ২৩০০ কিনে দিয়েছিল। আমি শায়লাকে ইশারা করলাম,
“লাড্ডু খা”
“লাগবে না”
“কেন? হিংসা হচ্ছে?”
“যেদিন আমি ভালো কলেজে চান্স পাবো, সেদিন খাবো। তোমারটা তুমি খাও”
আমার রাগ উঠল ওকে চলে যেতে দেখে। জোরে জোরে বললাম,
“জীবনেও ভালো কোথায় চান্স হবে না তোর মত বেয়াদবদের!”

ওর সাথে আজকে সকালে ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়া করে ওর সামনের কয়েকটা চুল এলোমেলো করে কেটে দিয়েছি। ও ঘরে মাটিতে পা ছড়িয়ে কান্না করছিল। ভাগ্যিস তখন আম্মু বাজারে ছিল! এখন সেই চুল গুলো লুকিয়ে রেখেছে। আমি আপনমনে টিভি অন করে নাটক দেখছি।

দেড় মাস পর ক্লাস শুরু হবে। আমি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াই আর যেসব বন্ধুবান্ধব ভালো কোথাও চান্স পায়নি, তাদের সান্ত্বনা দেই। আজকালকার পোলাপান একদম ধৈর্য্য ধরতে জানে না। একটু কষ্ট না করলে ভালো ইউনিভার্সিটি সুযোগ দেয় নাকি?

দেখতে দেখতে প্রথম দিন চলে আসলো। ওরিয়েন্টেশনের দিন কলাভবনের ভেতরে গিয়েই দেখলাম কলেজের তিন বন্ধুও সেখানে আছে। একজন ইতিহাসে, একজন মনোবিজ্ঞানে, আরেকজন আমার সাথে। খুব আনন্দ হচ্ছিল পরিচিত মুখ পেয়ে। ওরিয়েন্টেশনের পর আমি ক্যানটিনে খাবার কিনতে আসলাম। সেখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চুলগুলো গাড় পর্যন্ত ছোট করে কাটা, পরনে একটা কামিজ, জিন্স আর জিন্সের জ্যাকেট। মেয়েটা হেসে হেসে ক্যান্টিনের মামার সাথে কথা বলছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ওকে বললাম,
“বিয়ে করবা?”

মেয়েটা বিরক্ত হয়ে আমার দিকে চেয়ে আবার নিজের খাবার বুঝে নেয়ায় মন দিল। আমি আরেকটু স্পষ্ট করে বললাম,
“বিয়ে করবা নাকি?”
মেয়েটা আমার দিকে ফিরল।
“এক্সকিউজ মি?”
“নো এক্সকিউজ। আন্সার মি। বিয়ে করবা?”
“তোর মত ছ্যাচড়াকে কেউ বিয়ে করবে না!”

খুব আনন্দ হলো এই জবাব পেয়ে। হাবাগোবা মেয়ে আমার পছন্দ না, গালি দেয়া মেয়েদের খুব ভালো লাগে। এই মেয়ের পিছে লাগতে হবে, একদম এক্সেপশনাল। আমার সাথে জমবে খুব, হে হে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here