নীড় পর্ব-৮

0
1588

নীড়
রেশমী রফিক
৮।।
তুবার অনেক ভালো লেগেছিল তিতলি আসাতে। সেরকম ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তিতলিকে কেন জানি খুব ভালো লাগে ওর। তিতলির মতো হতে ইচ্ছে করে। তবে মা পাল্টানো চলবে না। তার নিজের মা হাজার দজ্জাল হলেও বড় চাচির মতো অত কঠিন ঘরানার না। চাচিকে দেখলে তুবার দম আটকে আসে। মায়া হয় তিতলি আপুর জন্য। আহারে, বেচারীর জীবনটা কী কঠিন!
তবে এই মুহূর্তে তুবার একটুও মায়া হচ্ছে না তিতলিকে। উলটো মনে মনে গালাগালি করেছে,
– অসভ্য কুত্তি তুই আসছিলি আমার বোনের বিয়ে খাইতে। এর মধ্যে ছেলে পটানো লাগবে কেন তোর? যতই ভালো মানুষ সেজে থাকিস না কেন, আমি ঠিকই বুঝতে পারছি তুই কোনো কাহিনি করছিস। নাইলে শারার ভাই বিয়েবাড়িতে এত সুন্দরী সব মেয়েদের ভীড়ে তোরেই কেন পছন্দ করবে?
এরপর সবথেকে খারাপ গালিটা দিল তিতলির উদ্দেশ্যে। একটা গালি দিয়েই থেমে থাকল না। আরও সব অশ্রাব্য গালি দিল। ভাগ্যিস মনের কথা শোনার উপায় এখনো আবিস্কৃত হয়নি। নয়তো তুবার মনে কী সব জঘন্য গালির প্রয়োগ চলছে। আশপাশের মানুষজন টের পেলে নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যেত। আর যাকে উদ্দেশ্য করে এই গালাগালি, সে অতি অবশ্যই কোমায় চলে যেত। আর শারার ভাই? উনি এইসব গালি শুনতে পেলে কী করতেন?
শারার কী করত, তুবা তা ভাবার আগেই উপস্থিত হলো সে। দূর থেকেই তাকে দেখা গেল ফুডকোর্টের দিকে এগিয়ে আসতে। চোখজোড়া এদিক-সেদিক ঘুরছে। কাউকে খুঁজছে। হাতে মোবাইলে। তুবা যেখানে বসে আছে, জায়গাটা একটু চাপা ধরনের। কাচের দেয়াল ঘেঁষে টেবিল। ওদিকে সচরাচর চোখ পড়বে না কারও। শারারও খুঁজে পাচ্ছে না। তুবা একবার ভাবল হাত তুলে ডাকবে। পরক্ষণে মন পাল্টাল। থাক, আগ বাড়িয়ে ডাকার দরকার নেই। আজ অ্যালবাম ঘেঁটে তিতলি বান্দরনিকে সনাক্ত করতে পারলেই গত কয়েকদিনের দেখাসাক্ষাতের সমাপ্তি ঘটবে। শারার আজ নিশ্চয়ই তিতলির ফোন নম্বর জানতে চাইবে। ফেসবুক আইডিটাও জেনে নিবে। তারপর? তারপর আর তুবার কোনো খোঁজ রাখবে না। তিতলির পেছনে ঘুরবে বেহায়ার মতো। তিতলিকে তো চেনে তুবা। উপরে যতই আলাভোলা চেহারা ধরে রাখুক না কেন, পেট ভর্তি দুনিয়ার প্যাঁচ। হবেই তো প্যাঁচালো। কোন মায়ের মেয়ে দেখতে হবে না? থাক, মা পর্যন্ত গিয়ে কাজ নেই। মায়েদের দোষ একটু-আধটু থাকেই। তুবার নিজের মা-ই কম কীসে? মেয়ে প্রেম করে, শুনলে কী কাহিনি ঘটিয়ে ফেলবে আল্লাহ মালুম। বড়াপুকে মেনে নিলেও আজ পর্যন্ত ভালোভাবে কথা বলতে চায় না। বড়াপু বাবার বাড়ি আসছে শুনলেই মায়ের যত রকমের মাথাব্যাথা আর অসুখের পাঁয়তারা শুরু হয়। জামাতাকে রান্নাবান্না করে খাওয়ানোর জন্য তখন দিবা-তুবাকেই ব্যতিব্যস্ত হতে হয়। ভাইয়া প্রেম করে বিয়ে করেনি, শুধুমাত্র এই কারণে আদৃতা ভাবি ভীষণ রকম হিংসুটে আর নাক সিটকানো স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও মায়ের একমাত্র প্রিয় বৌমা। ভাবির সমস্ত অন্যায় আবদার আর বদামি মাথা পেতে সহ্য করেন শেফালি। পারলে ছেলের বৌকে কোলেই তুলে রাখেন। মেজপুর হচ্ছে আধ-প্রেমের বিয়ে। এজন্য সাইফুল ভাইকে কতরকম দৌড়ানি দিয়েছে মা। বিয়ে ঠিক হবার পরও আপুকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হলো যেদিন, সকালে মামি এসে মাকে কথায়-কথায় কানপড়া দিল।
শেফালি বেগম বেশ গর্বভরে বলছিলেন,
– দিনা বাদে আমার সবগুলো ছেলেমেয়ে লক্ষী। আমার একটামাত্র ছেলে। কত আদরের! আমি তো ভাবছিলাম, ওর পছন্দের মেয়েকেই বউ করে আনব। কিন্তু দিনার বলল, ওর নাকি পছন্দ নাই কোনো। আমার পছন্দে বিয়ে করবে। ভাবো একটু! আজকালকার দিনে বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করে, এমন সোনার টুকরা ছেলে কি পাওয়া যায়? আমার দিনার হীরার টুকরা। মায়ের মন সে বুঝে। এজন্যই আদৃতাকে আমি পছন্দ করছি শুনেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। আর দিবাকে দেখো। সাইফুল এত্ত ঘুরছে ওর পেছনে। সে পাত্তাই দেয় নাই। কেন? কারণ, সে মায়ের পছন্দ ছাড়া বিয়ে করবে না। সাইফুলকে তো সরাসরি বলে দিছে, বাবামায়ের মনে একটুও কষ্ট দিতে চাই না। এইজন্য বিয়েও করব তাদের পছন্দে। এরপর সাইফুল সরাসরি বাসায় এসে হাজির।
বলা বাহুল্য, ঘটনা যতটুকু ঘটেছে, ইনিয়েবিনিয়ে বলার সময় তিল থেকে তাল হবেই। শেফালি বেগমের কথায় তা আরও একবার প্রমাণিত। দিনার-দিবা যে মায়ের ভয়ে টু শব্দ করেনি, এই কথা কেউ মুখে না বললেও কারও অজানা নয়। আত্মীয়স্বজনরা প্রত্যেকেই জানে, দিদারুল ইসলাম সাহেবের ছেলেমেয়েরা মায়ের ভয়ে তটস্থ থাকে সারাক্ষণ। ছোটবেলা থেকে এভাবেই ওদের জীবন পার হয়েছে।
তুবার মামাতো বোন বর্ণার প্রেমের বিয়ে। সামাজিক বিচারে ছেলের অবস্থান অপেক্ষাকৃত নীচু। গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে। ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি কিচ্ছু নেই। বাবা-মা ভাইবোনেরা সব গ্রামেই থাকে। ছেলের একমাত্র যোগ্যতা, সে প্রচণ্ড মেধাবী। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছে। তার রেজাল্ট ছিল কল্পনাতীত ভালো। ছেলের ভাগ্যও সুপ্রসন্ন। পরীক্ষার ফলাফল বের হবার পর পরই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তার নিজ ডিপার্টমেন্টে রিসার্চের জব পেয়ে গেছে। তবে ক্যারিয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলেও সাংসারিক জীবনের ঠুকাঠুকি চলছে। ছেলে বড় বাসা ভাড়া করে বাবামা আর ভাইবোনকে নিয়ে এসেছে ঢাকায়। তাদের সবার ঝামেলা এখন বর্ণার ঘাড়ে। সে প্রায়ই ফোন করে মামির কাছে কান্নাকাটি করে। তার শ্বশুরবাড়ির মানুষরা কত জঘন্য, তা বিস্তারিত আলোচনা হয় তখন। মামির কিছু করার নেই আসলে। বড়জোর মেয়েকে বলতে পারেন তালাক নিয়ে চলে আসতে। কিন্তু মামা খুব কঠোর। তিনি জামাতাকে মেনে নিয়েছেন ঠিকই। তাই বলে মেয়ের কথায় দৌড় দেবার মতো মানুষ নন। তার ভাষায়, শ্বশুরবাড়ির সাথে মানিয়ে চলতে হবে বর্ণাকে। সে তো সব জেনেশুনেই প্রেম করেছিল। বিয়েও করেছে শ্বশুরবাড়ির হালহকিত জানার পর। এখন আবার কান্নাকাটি কীসের? মামি একদিন কিছুটা গাইগুই করেছিলেন, মেয়েকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। মামা কঠিন সুরে জানিয়েছেন, তার বাড়ির দরজা বর্ণার জন্য বন্ধ। ডিভোর্সি মেয়েকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর টাকা তার নেই। থাকলেও খরচ করবে না সেই বাবদ। বর্ণা নিজের কপাল নিজে ঠিক করেছে। তিনিও অমত করেননি। সামর্থ অনুসারে যতটা সম্ভব, ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করেছেন। মেয়েকে সাজিয়ে-গুছিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়েছেন। এখন ঘরে আরেক মেয়ে স্বর্ণা আছে। এখন তার সমস্ত চিন্তা ওকে নিয়েই।
মামা তার চুড়ান্ত কথা জানিয়ে দিলেও মামির দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। বর্ণাও মায়ের কাছেই সবটা খুলে বলার আশ্রয়টুকু পেয়েছে। বলা বাহুল্য, এমতাবস্থায় শেফালির গর্বিত ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো তার গায়ে শুলের মতো বিঁধেছে। তাই জ্বালা মেটাতে তিনিও মুখ বাঁকা করে শুনিয়ে দিলেন,
– শোনো, আজকালকার ছেলেমেয়েদের সাথে পেরে উঠা যায় না। এরা বহুত চালাক। তুমি তো ভাবতেছ, তোমার মেয়ে ইনোসেন্ট। কিছুই জানে না। সব দোষ সাইফুলের। সে তোমার মেয়েকে দেখে ফিদা হয়ে গেছে। তলে তলে দেখো গে কাহিনি অন্যরকম। এগুলো দিবা আর সাইফুলেরই প্ল্যান। দিবা জানত, প্রেমের বিয়ে তুমি সহজে মানবা না। এইজন্য দুইজন মিলে এই প্ল্যান করছে। তোমাকে বোকা বানাইছে।
রাগে শেফালির চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। পারলে ভাইয়ের বউকে ভস্ম করে দেন চোখের আগুনে। আর মেয়েকে তো তখনই মেরেকেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবার মতো অবস্থা। তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি করেছিলেন সেদিন। দিবা তার ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। শেষমেশ মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। তুবার মামা একচোট ধমকেছেন স্ত্রীকে। দিবার বাবার বাড়ির মানুষরা শেফালির মতো না ক্ষেপলেও আড়ালে-আবডালে মুখ বেঁকিয়েছে। বর্ণা-স্বর্ণার মা নিজের মেয়েকে সামলাতে পারে না, ঠিকঠাক আদব-কায়দা শেখাতে পারে না। আবার এসেছে অন্যের মেয়েকে নিয়ে গল্প বানাতে! দিবার কাহিনি কতটা সত্য, কতটা মিথ্যে, কেউ জানে না। তবে সকলেই একমত, প্রেম করুক আর যাই করুক, পালিয়ে তো যায়নি। নিজেরাও কাহিনি করে বিয়ে করেনি। সাইফুল ওর পরিবারকে নিয়ে এসেছিল বাসায়। দিবাকে তারা পছন্দ করেছে। এরপর পারিবারিকভাবেই বিয়ের কথাবার্তা বলা হয়েছে।
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here