নীড় পর্ব-১২

0
1757

নীড়
রেশমী রফিক
১২।।
স্বর্ণপাতার থালা রেস্টুরেন্টের পেছন দিকে একটা ঘর আছে। অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূলত ওটা স্বর্ণর ঘর। প্রতিদিন কাজের ফাঁকে ওখানে বসে কিছুক্ষণ। ঘরটায় টেবিল-চেয়ার ছাড়াও একটা সোফা আছে। সামনে ছোট একটা সেন্টার টেবিল। বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত কেউ রেস্টুরেন্টে এলে তাকে ওখানে বসানো হয়। কিচেন থেকে খাবার এনে সার্ভ করা হয়। ঘরটায় একটামাত্র জানালা। তাতে ভারী পর্দা দেয়া। এমনকি পাল্লাও আটকানো। এই এলাকা রেস্টুরেন্টের জন্য উপযুক্ত হলেও মেয়েমানুষের অফিস ঘরে উঁকি মারার মানুষের অভাব নেই। খিলগাঁও আর বাসাবোর মধ্যিখানে পড়েছে এই এলাকা। এখানে জনসাধারণের জীবনযাত্রা নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলা যায়। এই এলাকায় শহরের আধুনিকত্ব এখনো খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। সম্ভবত হাউজিং কোম্পানীগুলোর নজর এড়িয়ে গেছে। তাই এখনো গ্রাম্য পরিবেশ রয়ে গেছে। চারদিকে বেশ খোলামেলা আর মনোরম পরিবেশ। স্থানীয়রা বলতে গেলে গ্রামের মানুষের মতোই জীবনযাপন করে। শিক্ষার মানও খুব বেশি নয়। তবে আশপাশে স্কুল-কলেজ থাকায় প্রায়ই ইউনিফর্ম পরা ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তায় দলবেঁধে চলতে দেখা যায়। এছাড়াও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের অনেকে আড়ালে-আবডালে প্রেম করে এই এলাকায় এসে। নিরিবিলিতে একটু ঘুরাঘুরির নাম করে কপোত-কপোতীদের আনাগোনা চলে। রাস্তার উপর ভ্যানগাড়িতে বিক্রি হওয়া ফুচকা, চটপটি আর আইসক্রিম এদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। যেন পৃথিবীর আর কোথাও ফুচকা-চটপটি বিক্রি করা হয় না। ঘুরেফিরে এখানেই আসতে হবে খেতে! এই রেস্টুরেন্ট চালু হবার পর যেন আকর্ষণ বহুগুণে বেড়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা আজকাল স্বর্ণপাতার থালে খেতে আসার বাহানা খুঁজে। বলা বাহুল্য, ইদানীংকালে এই জায়গা আর রেস্টুরেন্ট প্রেম করার অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত। স্বভাবতই অনৈতিক কর্মকান্ড ঘটে প্রায়ই। এই নিয়ে স্থানীয়রা মোটামুটি ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, এই রেস্টুরেন্টের কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। চার দেয়ালের বাইরে অতশত সুযোগ মেলে না প্রেমের নামে নোংরামি করার। কিন্তু রেস্টুরেন্টের ভেতর আধ-আবছায়ার মাঝে সুযোগের কমতি নেই।
এর আগে বেশ কয়েকবার রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকার বিশিষ্ট শিল্পপতি ফখরুদ্দিন আহমেদের মেয়েকে ঘাটানোর সাহস এখন অবধি কারও হয়নি। স্বর্ণকে আপাতদৃষ্টিতে একাকি চলতে-ফিরতে দেখা গেলেও সবাই জানে, তার আশপাশে কমপক্ষে দশ-বারোজন ছেলে-ছোকরা থাকে, যারা ঝুটঝামেলার সময় হাজির হতে একটুও দেরি করে না। এই রেস্টুরেন্টকে ঘিরে বারদুয়েক দু’পক্ষের হাতাহাতি-মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। একদল এসেছিল ভাঙচুর করতে, যাতে স্বর্ণ ভয় পেয়ে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেয়। বুঝে উঠতে পারেনি, পালটা হামলা চলে আসবে। শেষমেশ পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। দু’পক্ষের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছিল তাৎক্ষনিকভাবে। পরে ফখরুদ্দিন সাহেবের সুপারিশে স্বর্ণর পক্ষে যারা ছিল, তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বিনা শর্তে। অপর পক্ষের নামে হয়রানি মামলা করা হয়েছে। সেই মামলার নিষ্পত্তি হতেও সময় লাগেনি। সবখানে স্বর্ণর পক্ষে লোক আছে। তাই আসামীপক্ষকে মোটা অঙ্ক জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে সশ্রম কারাদন্ড। এদের বেশিরভাগ স্থানীয় ছেলেপেলে। ফলে ক্ষোভ রয়ে গেছে। পরিস্থিতি সাপেক্ষে এই ক্ষোভ গুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে।
এলাকাবাসী তখন থেকেই ঠারে-ঠারে ছিল যাতে সুযোগ মিলতেই স্বর্ণকে নাকানিচুবানি খাওয়ানো যায়। তুবা-শারারের ঘটনাটা ছিল মোক্ষম সময়ে উচিত মওকা। সেজন্যই যত না ঘটল, তার চেয়ে বেশি হৈ-হল্লা হচ্ছে। বহুদিনের ক্ষোভ আজ উগরে পড়েছে। একে তো কথিত অনৈতিক কর্মকান্ড হয়েছে স্বর্ণর রেস্টুরেন্টের সীমানার ভেতর। তার উপর যখন লোকজন জানতে পারল, শারার স্বর্ণর পরিচিত, দুয়ে-দুয়ে চার মিলানোর বাহানায় তারা স্বর্ণর উপর চড়াও হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না। অর্থাৎ খবর রটে গেল চারদিকে, স্বর্ণ আসলে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ের আড়ালে নানারকম অনৈতিক কাজকর্মের সাথে জড়িত। তার মদদেই যত ধরনের নোংরামি চলে এই রেস্টুরেন্টে।
স্বর্ণ বুঝতে পারেনি, ঘটনা এভাবে বিগড়ে যাবে। শুরুতে যখন শুনল পার্কিংয়ে হৈ-চৈ হচ্ছে, কে বা কারা আপত্তিকর অবস্থায় পাকড়াও হয়েছে, সঙ্গত কারণে সে নিজেও ঘটনাস্থলে এসেছিল। তারপর গাড়ির মধ্যে শারারকে স্থান-কাল ভুলে আচানক বলে ফেলেছে,
– শারার! তুমি এখানে?
ব্যস, আর যায় কোথায়? তুবা-শারারকে ফেলে দলবল এবার স্বর্ণর উপর চড়াও হয় পারলে।
শারারের তখন অবস্থা গুরুতর। প্রাণ যাই যাই করছে। আরেকটু হলেই জ্ঞান হারাবে নিশ্চিত। পরনের শার্ট টানাটানির চোটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এদিকে বুকের মধ্যে মিশে আছে তুবা। তার অবস্থাও কম শোচনীয় নয়। তবে মেয়েটা আর আগের মতো চিৎকার করছে না এখন। এমনকি টু শব্দও শোনা যাচ্ছে না। তুবা কি তবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল? প্রশ্নটা মনের মধ্যে খট করে বাজলেও মাথা ঝুঁকে দেখার জো নেই। লাঠির বাড়ি কয়টা পড়েছে গায়ে, নিজেও বলতে পারবে না। এছাড়াও খালি হাতের কারিশমা তো আছেই। চুল এত জোরে টেনেছে, মাথায় আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি না, শারার অনুভব করতেই পারছে না কিছু। তার মাথা কেবলই ঝিমঝিম করছে। চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসছে।
ঠিক এমন সময়, পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে শারার চিৎকার করে উঠল,
– স্বর্ণ! প্লিজ হেল্প মি! এরা আমাকে মেরেই ফেলবে।
স্বর্ণ আর কী সাহায্য করবে। সে নিজেও কি বিপদের গন্ধ পাচ্ছে না? উত্তেজিত জনতার মনোযোগ এবার তার দিকে ঘুরেছে। খানিক আগে গাড়ির ভেতর উঁকি মেরে তুবার যে অবস্থা দেখেছে, তারপর আর সাহস বলতে কিছু নেই। ভয়ে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বেগতিক পরিস্থিতিতে পড়লে সে তার ভাড়া করা দলবলকে খবর দেয়। এই মুহূর্তে সেই খবরটাও দেবার উপায় নেই। মোবাইল রেখে এসেছে রেস্টুরেন্টের অফিস রুমে। তবে আল্লাহ সহায় ছিলেন। তাই অল্পের উপর দিয়ে গেছে। আমজনতার মধ্যে একটা দল যখন স্বর্ণ আর ওর দু’জন কর্মচারীকে ঘিরে ফেলেছে, আরেকদল তুবা-শারারের পেছনে লেগে আছে, সেসময় আচমকা ভোজবাজির মতো উদয় হলো স্বর্ণর নিরাপত্তা বাহিনী। তারা মুহূর্তেই প্রতিপক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে ফেলল। তবে তাদের মুল লক্ষ্য ছিল স্বর্ণকে নিরাপদ অবস্থানে সরিয়ে ফেলা। তুবা-শারারকে খুব একটা খেয়াল করেনি। দ্রুত স্বর্ণকে চারদিক বেষ্টন করে ঘিরে ফেলল তারা। তারপর নিয়ে গেল রেস্টুরেন্টের ভেতর।
অফিসে পা দিয়েই স্বর্ণ তার নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিল তুবা-শারারকে উদ্ধার করতে। একই সাথে, থানায় কল করতেও ভোলেনি। অতঃপর দশ-পনের মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসেছে ঘটনাস্থলে। প্রতিপক্ষের হামলা বন্ধ হবার পর তুবা আর শারারকে কড়া নিরাপত্তায় রেস্টুরেন্টের ভেতর নিয়ে আসা হয়েছে।
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here