নীড়
রেশমী রফিক
১৯।।
১৯।।
এমপি মাসুদুল করিম র সাথে দেখা করতে তার কার্যালয়ে এসেছেন শফিকুল চৌধুরী। সাথে ওসি আছেন। এমপি সাহেব ব্যস্ত মানুষ। সচরাচর তার দেখা মিলে না। কোনো জরুরী দরকার থাকলে তার পিএসের সাথে কথা বলতে হয়। ওসি সাহেব খবর পাঠাতে চেয়েছিলেন, পুলিশ এসেছে। কিন্তু শফিকুল চৌধুরী তার নামটাই বলে পাঠালেন। ওসিকে ইশারায় বললেন,
– আপনি চুপচাপ তামাশা দেখেন। এই এমপির খেল আমি বের করব আজ।
কথা ফলতে সময় লাগবে। কিন্তু তার লক্ষণ দ্রুতই দেখা দিল। মিনিটখানেক আগেও এমপির পিএস বলেছিল, স্যার জরুরী মিটিংয়ে আছে। দেখা হবে না। অথচ এখন বলছে, এমপি নাকি তাদেরকে বসতে বলেছেন। এর পেছনের কারণটা অবশ্যই শফিকুল চৌধুরী নন। এমপি আসলে কল পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সচিবের সেক্রেটারি নিজে কথা বলেছেন তার সাথে। মাসুদ অবশ্য তাতে ভড়কে যাননি। তবে বুঝে-সমঝে কথা বলেছেন। সেক্রেটারি হলেও ফোনের ওপাশের লোকটার ক্ষমতা নেহাতই কম নয়। সচিব তো নাম-মাত্র। তার মূল কাজকর্ম ছাড়াও যত রকমের দৌড়াদৌড়ি আছে, সবকিছু সেক্রেটারি সম্পন্ন করে। সচিব শুধু নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন। একারণে বিভিন্ন জায়গায় সচিবের নিজের যতটা না পরিচিতি আছে, সেক্রেটারির গন্ডি তার চেয়েও বড়।
এমপি মাসুদ ব্যস্ত মানুষ। কিন্তু এই লোক তার চেয়েও বেশি ব্যস্ত। তবু কী কারণে এরকম সাধারণ একটা খুচরো ঘটনায় তিনি নাক গলাচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। মাঠ-পর্যায়ের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোতে তার মতো উচ্চস্তরের কাউকে সচরাচর জড়িত হতে দেখা যায় না। কিন্তু স্বর্ণপাতার থালা প্রসঙ্গে সেক্রেটারি নিজে কল করেছেন, তার মানেই বুঝতে হবে ব্যাপারটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ব্যস্ত মানুষ, তাই সংক্ষেপে কথা শেষ করেছেন। কেবল এতটুকুই বলেছেন,
– আপনার এলাকায় কি কাজকর্ম কিছু নাই? দেশের উন্নয়ন কি সব প্রথম বছরেই করে ফেলছেন যে, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? যতসব ফালতু ঘটনায় পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। ব্যাপারটা আসলে কী, বলুন তো। স্বর্ণপাতার থালা নিয়ে আপনার অবজেকশন কোথায়? কেন ওই মেয়েটাকে বারবার হ্যারাস করছে আপনার লোকজনরা?
এই এতটুকু কথাতেই মাসুদ বুঝে নিয়েছেন, স্বর্ণকে সহজভাবে নেয়াটা ভুল হয়েছে। শিল্পপতির মেয়ে হলেও রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট ভালো সংযোগ আছে তার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কল এসেছে মানে বাপের থেকেও মেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। এতদিন শামুকের মতো গুটিয়ে রেখেছিল নিজেকে। সাধারণ মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করছিল। অসহায় সেজে আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। এবার ভোল পাল্টে ফেলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আজ কী এমন ঘটনা ঘটেছে ওই রেস্টুরেন্টে?
সেক্রেটারি ফোন রাখার আগে কাট-কাট করে বললেন,
– যত দ্রুত সম্ভব, ঝামেলা শেষ করেন। এই রেস্টুরেন্ট নিয়ে আমি যেন আর কোনো ফোনকল না পাই। আপনার কাজকর্ম না থাকলেও আমার আছে। একটু বেশিই আছে। সচিব স্যারের পুরো রেস্পন্সিবিলিটি আমার ঘাড়ে। সো, এতসব নখরামো দেখার সময় আমার নাই।
মাসুদুল করিমের তখন বলতে ইচ্ছে হয়েছিল,
– আপনি যখন এতই ব্যস্ত, তাহলে ইগনোর করলেন না কেন? এই স্বর্ণপাতার থালা নামের দুই আনা রেস্টুরেন্ট নিয়ে আপনাকেইবা কেন মাথা ঘামাতে হচ্ছে। যেভাবে আমাকে বললেন, সেভাবে অপর পক্ষকেও বলতে পারতেন, এই সব খুচরো ঝামেলায় নাক গলানোর সময় নেই।
বললেন না। যতই ক্ষমতাধর হন না কেন, মাথার উপরেও আরেক মাথা থাকে। তাকে সহসা কিছু বলা যায় না। কেবল মাথা নিচু করে শুনতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। মাসুদ কিছুক্ষণ ‘জি স্যার-জি স্যার’ করে ফোন রাখলেন। ঠিক তখন পিএস এসে খবর দিল, শফিকুল চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ী এসেছেন তার সাথে দেখা করতে। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল না। জরুরী ভিত্তিতে এসেছেন। সাথে ওসি আছেন। পিএস নিজেও ঘটনার বিস্তারিত জানে না। তবে শফিকুল চৌধুরী যে স্বর্ণপাতার থালা সম্পর্কিত কথাবার্তা বলতে এসেছেন, তা বলতে বাকি রাখেনি। এমপি মাসুদ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন, তাদেরকে সসম্মানে আপ্যায়ন করতে। তবে একবার যেহেতু বলা হয়েছে, তিনি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন। চট করে দেখা করবেন না। তার আগে আজকের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। সবটা জেনে, কথাবার্তা গুছিয়ে তবেই শফিকুল চৌধুরীর সাথে দেখা করবেন। নয়তো হিতে-বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আর বল একবার কোর্টের বাইরে চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এলাকার এমপি তিনি। এলাকার পার্টি অফিসের ছেলেপেলেদের একমাত্র ভরসা। ওদেরকে ধসিয়ে দেয়া চলবে না। তবে পরবর্তীতে হুঁশিয়ারি জারি করতে হবে যেন কারও সাথে পাল্লা দেবার আগে তার গতিবিধি আর পরিচিত গন্ডি দেখে নেয়।
পার্টি অফিসের নেতা নাইম সবসময় এই বিষয়গুলো সামাল দেয়। স্বর্ণপাতার থালাকে ঘিরে যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে, তার মূল হোতা নাইম। তিনিই ওকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন কায়দা করে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। একে তো অল্পবয়সী মেয়ে, তার উপর এলাকায় এসে আরামসে ব্যবসায় শুরু করেছে। কোনোরকম চাঁদা দেয়নি। কয়েকজন ছেলেছোকরা গিয়েছিল চাঁদা চাইতে। তাদের সাথে কঠিন আচরণ করেছে। উলটো হুমকি দিয়েছে, আরেকবার চাঁদাবাজি করতে আসলে পুলিশকে জানাবে। মামলা করবে ওদের নামে। এছাড়াও ক্ষমতাধর প্রভাবশালী বাবার ভয় দেখিয়েছে। নাইম তখন থেকে বেদম ক্ষেপে আছে। তার ভাষ্যমতে, মেয়েটা এক নম্বরের বেয়াদব। নাইমকে নাকি সে গোণায় ধরে না। এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে এসেছিল। তখনই মাসুদকে জানিয়েছে, স্বর্ণর বাবা বিরোধী দলের সমর্থক। তাও এমন একজনের সাথে স্বর্ণদের লতায়-পাতায় আত্মীয়তা, যার সাথে মাসুদুল করিমের সাক্ষাৎ শত্রুতা। রাজনীতিতে বিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের সাথে দেখা হলে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখাটা, আন্তরিক হবার ভান করাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই লোক সামনে পড়লে মাসুদ সেই হাসিটুকু দেবার দরকার মনে করেন না। না দেখার ভান করে এড়িয়ে যান। স্বভাবতই তিনি আশ্বাস দিয়েছেন নাইমকে। যা কিছু হোক, ওর পক্ষে থাকবেন। বিষয়টা বেগতিক পর্যায়ে গেলে সামাল দেবেন। এতকাল ঝামেলা যতটুকুই হয়েছে, তাকে এর মধ্যে নাক গলাতে হয়নি। স্বর্ণপাতার থালা নিয়ে কী হয়েছে, ঠিকঠাক জানেনও না। নাইম তাকে অল্পসল্প আপডেট দিয়েছে শুধু। অথচ আজ কিনা সরাসরি ফোনকল চলে এসেছে তার কাছে। বিষয়টা অবশ্যই বেগতিক।
নাইমের কাছে সবটা শোনার পর এমপি মাসুদের ভ্রু কুঁচকে গেল। নাইমও শুনল তার কথা। অস্থির সুরে বলল,
– ভাই, আপনার কাছে রিকুয়েস্ট। কোনোভাবে সচিবের সেক্রেটারি স্যারকে ম্যানেজ করেন। নাইলে বিষয়টা পাকা ধানে মই দেয়ার মতো হয়ে যাবে। এতদিন যাওবা ধুনফুন চলছে। আজকে একদম হাতেনাতে ধরছি টাইট কইরা। ফান্দে পইড়া ওই মাইয়ার এখন আর ডাইনে-বায়ে কোনোদিকে যাওয়ার উপায় নাই। এইজন্য এরে-ওরে দিয়া কল করাইতেছে। কিছুক্ষণ আগে এলাকার এক বড় ভাইকে ডাকাইছিল। তাকে পুলিশ ভয় দেখাইছে। উনি ভদ্রলোক। পিছিয়ে গেছেন। এখন আমরা ফিল্ড দখল করছি। একেবারে প্রাইম টাইম। এখন যদি বলেন পিছানো লাগবে, তাইলে তো ভালো রকমের সমস্যা। বিষয়টা এখন হারজিতের দিকে আগাইছে। একটু ভাবেন, ভাই। এই মেয়ে একবার আমাদের অ্যাগেইন্সটে জিতে গেলে তার আস্পর্ধা কতদূর যাইব। আর দলের মধ্যে আপনার পজিশনটাও জুত থাকল না। আমাগো দল ক্ষমতায় থাকতে আমাগো এলাকায় বিজনেস করতে আইসা জিত্তা যাইব বিরোধী পার্টি। ইজ্জতের তো পুরাই দফারফা। একটু দেখেন ভাই।
নাইমের কথা একদমই ফেলে দেবার মতো নয়। খানিকক্ষণ ভাবলেন মাসুদ। তারপর বললেন,
– তুমি এক কাজ করো। আমার অফিসে চলে আসো। ওই ছেলের বাবা এসেছে আমার সাথে কথা বলতে। ওসি আছেন। ঘটনার সময় তুমি যেহেতু ওখানে ছিলে, এই আলোচনায় তোমার প্রেজেন্ট থাকাটা জরুরী। সবথেকে ভালো হয় যদি তুমি ওদেরকে হ্যান্ডেল করো। বাট ইন অ্যা প্রপার ওয়ে। টাইট যেহেতু দিয়েছ, অল্পসময়ের মধ্যে গুটি চেলে দাও। কাহিনি ঝটপট গুছিয়ে ফেল। বুঝতে পারছ তো, কোন জায়গা থেকে কল এসেছে। এবং আরও একবার সেখানে কল করার উপায় রাখা যাবে না। অলরেডি ওদেরকে বলা হয়েছে, আমি মিটিংয়ে আছি। তাছাড়া আমার ছেলের বাচ্চা হবে আজ। অ্যাপোলোতে যেতে হবে। আমার সময় হবে না। আমি জাস্ট তোমাকে ইন্ট্রুডিউস করিয়ে দেব।
– জি ভাই। আমি এখনই আসতেছি। আপনি একদম চিন্তা কইরেন না।
– হ্যাঁ চলে আসো। আর ব্যাপারটা আজকেই শেষ করবা।
– আচ্ছা ভাই। (চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়।