নীড়
রেশমী রফিক
৩১।।
শারারের ঘরটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। খুবই অন্যরকম। এ ধরনের ঘর তুবা আগে কখনো দেখেনি। অবশ্য এতক্ষণে শারারদের বাড়িটা সম্পর্কে তার মোটামুটি ধারণা হয়েছে। বসার ঘর আর বারান্দা দেখলেই বুঝা যায় বাড়ির অন্য ঘরগুলো কেমন হবে। বসার ঘর থেকে বের হয়ে শারারের শোবার ঘর পর্যন্ত যতটুকু দেখেছে, পুরোটাই হা হয়ে ছিল ওর মুখ। ঘরের ভেতর ঢুকতেই মুখে হাত চাপা দিল সে। সিলিঙয়ে পুরোটাই মহাকাশ। নীল-বেগুণী রঙের বুকে কতশত তারা রুপালী বিন্দুর মতো ফুটে আছে। দেয়ালগুলো গাঢ় নীল। আসবাবপত্রগুলো সাদা। ঘরের ভেতর খুব বেশি কিছু নেই। একটা খাট, একটা আলমারি আর একটা ড্রয়ার। পাশে দেয়াল জুড়ে প্রায় ছয় ফিট লম্বা আয়না, রুপালী ফ্রেমের।
অভূতপুর্ব কিছু নয়, কিন্তু তুবা হতবাক হয়ে রইল। শারার ততক্ষণে ওয়াশরুমে গেছে। সেখান থেকে বের হয়ে তুবাকে বলল,
– ওয়াশরুমে যাবে? গেলে যাও। হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।
তুবা কিছু বলল না। শারার ওর সামনেই পরনের শার্ট পাল্টাল। তারপর ঘরের দরজা খুলে ফিসফিস করে বলল,
– তুমি ফ্রেশ হও। আমি একটু পর আসছি।
– কোথায় যাচ্ছেন?
– আসছি। জলদি আসব।
বলেই বের হয়ে গেল। তুবা ধীরেসুস্থে ওয়াশরুমে গেল। শারারের কথামতো হাত-মুখ ধুয়ে নিল। বেসিনের পাশেই তোয়ালে ঝুলানো। তাতে মুখ মুছল। তারপর চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখল। ঘরটা যেমন ছবির মতো দেখতে, ওয়াশরুমটাও। ঘরের সমান অত বড় নয়। তবে ওয়াশরুম হিসেবে বেশ বড়। তুবাদের বাসায় ওয়াশরুমের যে সাইজ, তার দ্বিগুণ তো হবেই এটা। সবথেকে বেশি ভালো লাগল যেটা, তা হলো পুরো ওয়াশরুমে অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ। নাম-না-জানা কোনো এক ফুলের। একটা জানালা আছে। পাল্লাটা অল্প একটু খোলা। এর সামনেই ছোট একটা ফুলদানিতে হালকা বেগুণি রঙের কিছু ফুল রাখা। তাজা নাকি প্লাস্টিকের, কে জানে। তুবার খুব ইচ্ছে করছিল একটু ছুঁয়ে দেখতে। গেল না সেদিকে। শরীর কাহিল হয়ে আছে খুব। হাত-পায়ে চিনচিন ব্যাথা করছে। আজ সারাদিনে খুব ধকল গেছে। এমনিতেও গরম ছিল খুব। চারদিক অন্ধকার হবার সাথে-সাথে গরমের প্রতাপ খানিক কমেছে। বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ করেছিল সন্ধ্যায় ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। এখনো অল্পসল্প পড়ছে বোধহয়। প্রকৃতি এখন স্নিগ্ধ-শান্ত। হালকা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।
শারারের এই ঘর লাগোয়া বারান্দাও আছে। বারান্দার সাথে বড় জানালা। পাল্লাগুলো সব খোলা। পর্দাগুলো অবশ্য টেনে দেয়া। বাতাসে হালকা উড়ছে। ঘরটা খুব ঠান্ডা হয়ে আছে। বিছানার দিকে তাকাতেই তুবার হাত-পা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবার জোগাড়। এত আরামদায়ক লাগছে চোখে। ইচ্ছে করছে এখনই শাড়ি-টাড়ি সব খুলে সটান শুয়ে পড়তে। আচ্ছা, আজ কি এই ঘরেই ঘুমুবে? এই বিছানায়? কী যেন শুনল, শারার চাইছে না ওকে বাসায় ফেরত পাঠাতে। তবে কি এখন থেকে এখানেই থাকবে সে? এই বাড়িতে? খুব ভালো হয় তাহলে।
‘বিয়ে’ শব্দটার সাথে তুবা কমবেশি পরিচিত। প্রায়ই কারও না কারও বিয়েতে গেছে। কদিন আগে নিজের আপন বোনেরই বিয়ে হলো। কত আনন্দ করেছে। এই আনন্দে পড়াশুনা সব লাটে উঠেছিল। সব আত্মীয়স্বজন আর কাজিনরা মিলে রাত জেগেছে। সাতটা দিন যেন ঈদের চেয়েও আরও বেশি খুশির জোয়ারে ভেসে গেছে। তাই বলে কখনো নিজের বিয়ের কথা মাথায় আসেনি। বিয়েতে কী হয়, সে জানে। বিয়ে কীভাবে পড়ানো হয়, তাও জানে। কিন্তু বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবনে কীরকম পরিবর্তন আসে, তা কখনো ভাবায়নি ওকে। এই যেমন, দিবা আপু এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকে। সাইফুল ভাইয়ের ঘরে। তার জীবনটা কি এখন আগের মতোই আছে? অবশ্যই না। আগে ছিল বাবার আদুরে কন্যা। ঘুম থেকে উঠেই বেড-টি পেয়ে যেত চোখের সামনে। তারপর টেবিলে এসে দেখত নাশতা তৈরি। ঘরসংসারের কোনো কাজে হাত দিত না। কেবল পড়া আর কলেজ। কখনো বন্ধুমহল। এটাই ছিল তার দুনিয়া। অথচ এখন সে ঘুম থেকে উঠেই বেড-টি পায় না। সেদিন আক্ষেপ করে বলছিল, এখন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় তাকে। সাইফুল ভাই অফিসে যাবে। তার জন্য সকালের নাশতা, দুপুরের খাবারসমেত টিফিন বাক্স তৈরি করতে হয়। কেবল সাইফুল ভাইয়ের কাজগুলোই। বাকিটুকু না করলেও চলে। বাসায় কাজের মানুষ আছে। সায়রা আপু নিজের কাজ নিজেই করে।
এই পরিবর্তন তুবা নিজ চোখে দেখলেও কখনো মনের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেনি। এখন টের পাচ্ছে। এই ‘হোক সুন্দর তবু অপরিচিত’ ঘরটায় আজীবন থাকার কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। এই মুহূর্তে বিছানাটা ওকে চুম্বকের মতো টানলেও প্রতিদিন এই বিছানার ঘুমুবার কথা মনে হলেই গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসে যাচ্ছে। আর এই বাড়ি? এখানে সে থাকতেই পারবে না পুরো একটা দিন। বাড়িটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। হয়তো যে কোনো মেয়েই চাইবে এই বাড়ির বউ হতে। সেও চায়, এরকম একটা বাড়ি তার নিজের থাকুক। কিন্তু মনের ভেতর কোথাও যেন একটু খচখচ করছে। বাড়িটাকে আপন ভাবতে পারছে না কোনোভাবেই। আর বাড়ির মানুষগুলো? শারারের বাবা রাশভারী স্বভাবের। খুব দূরের মানুষ যেন। ওর নিজের বাবার মতো সহজ নয়। আর শারারের মা? ও মাগো, ওই মহিলার সাথে এক ছাদের নিচে থাকার কথা ভাবলেই হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে পেটের ভেতর। মহিলা যেন চোখ দিয়েই ওকে ঝলসে দেয়। কী ভয়ঙ্কর চাহনি! রইল বাকি শারার ভাই। তার সাথে কিছুদিন ধরে দেখাসাক্ষাৎ হলেও প্রতিদিন এক ঘরে, প্রতি রাতে এক বিছানায় ঘুমুনো অসম্ভব। রাতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুনোর অভ্যেস ওর। তাছাড়া পাশে কেউ থাকলে ঘুমের ঘোরে তার গায়ে হাত-পা তুলে দেবার বদভ্যেসও আছে। দিবা যতদিন ওর সাথে ঘুমিয়েছে, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খ্যাচর-ম্যাচর করেছে। ওর কারণে তার ঘুম হয় না রাতে। শারার ভাইও খ্যাচখ্যাচ করবে। তার আগে সবথেকে বড় কথা হচ্ছে, তার গায়ে সে হাত-পা তুলে দিতে পারবেই না।
(চলবে)
কালকের পর্বে দেখলাম কমেন্টে সবারই এক কথা, এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে কেন? আমি আসলে পাঠকদের চাপে পড়ে তাড়াতাড়ি শেষ করেছি। কারণ পাঠকরা অপেক্ষায় ছিল। আগেই বলে রেখেছিলাম বইমেলা শেষ হলেই দেয়া শুরু করব। তাছাড়া, বই প্রচারণার ব্যস্ততা ছিল। সাথে পারিবারিক ব্যস্ততা তো আছেই। তাই একটু তাড়া ছিল। নয়তো আরও অনেকটা টেনে নিতাম গল্প। আপাতত এটুকু থাক। পরে যখন ব্যস্ততা কমবে, লেখার মুড আসবে, তখন নাহয় আবার লিখব। তবে আমার মনে হচ্ছে, এখানে শেষ হলেই ভালো হয়। গল্পটা অযথা টেনে নিলে পাঠকদের যেমন পড়তে বোর লাগবে, আমারও লিখতে অনীহা হতো। এমনিতেও কিছু কিছু পাঠকদের কাছে গল্পটা বোর হয়ে গেছে। তাদের মনে হয়েছে, আমি অযথাই গল্প টানছি।
গল্প টানার প্রসঙ্গ কোনো লেখকেরই শুনতে ভালো লাগে না। কারণ, সব লেখকই গল্প লেখার আগে ঠিক করে নেয়, কোথা থেকে শুরু করবে আর কোথায় গিয়ে শেষ করবে। আর ড্রাফট গল্প লিখে পোস্ট করার বেলায় গল্প গুছিয়ে লেখা সম্ভব হয় না। যা মাথায় আসে, সেটাই চট করে লিখে ফেলতে হয়। ফেসবুকে গল্প পড়ার সময় এই ব্যাপারটা পাঠকের মাথায় রাখা উচিত। কারণ, যে গল্পটা আমি ইন্সট্যান্ট লিখব, সেটাই কিন্তু ফেসবুকে দিব। যেটা আমি লেখা শেষ করে এডিট করব, গুছিয়ে সাজাব, সেটা ফেসবুকে আমি কেন, কেউ দিবে না। সরাসরি বই প্রকাশ করবে। যাই হোক, কমেন্টের যা অবস্থা দেখলাম, সবাই শকড হয়ে আছেন। সেজন্য শেষ পর্বটা ভাগ করে প্রথম অংশ এখন দিলাম। আগামীকাল সম্ভব হলে আরও দুই ভাগ করব।