#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#ষোড়শ_পর্ব
২৩.
চন্দ্রা সকাল থেকে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদিকে রাশেদ মুখ কালো করে বসে আছে। তার মুখ কালো করার কারন হচ্ছে চন্দ্রার বাবা সকালে ফোন দিয়ে বলেছে চন্দ্র কালকে নিতে আসবে। চন্দ্রাও হ্যাঁ বলে দিয়েছে। সেখানে যদি রাশেদ বলতো না সে চন্দ্রাকে যেতে দিবে না তাহলে সেটা খারাপ হতো। তাই সেও রাজি হলো। চন্দ্রা কত দিনের জন্য যাচ্ছে সেটাও বলে যাচ্ছে না। রাশেদের সচরাচর রাগ উঠে না কিন্তু আজ রাগ উঠছে। চন্দ্রা টুকটাক গোছানো শুরু করে দিয়েছে। এত্তবড় লাগেজ নামিয়েছে সেটা দেখে মনে হচ্ছে মিনিমাম ছয় মাসের জন্য যাচ্ছে। এতে রাশেদের রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছে। তাই সে ঠিক করলো হাসপাতালে চলে যাবে। চন্দ্রা আড়চোখে সব খেয়াল করছে। আর মিটিমিটি হাসছে।
রাশেদ তৈরি হয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় চন্দ্রা সমনে এসে বললো,
কোথায় যাচ্ছেন?
হসপিটালে।
এতো তাড়াতাড়ি কেন? এখনো তো সময় হয়নি।
এমনি।
কিছু খেয়ে যান।
থাক এই কয়দিন নিজেই করে সব করতে হবে। আসছি আমি।
আমার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছেন। তাই না?
রাগ করার মতো কিছু করেছো তুমি?
মনে হচ্ছে করেছি।
কী করেছো বলে মনে হয়?
আপনাকে জিজ্ঞেস না করে বাবাকে বলে দিয়েছি আমি চলে যাব।
বুঝতেই তো পেরেছো।
সরি। আসলে বাবা এতো করে বললো আমি না করতে পারি নি। আমার ওদের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে।
ইট’স ওকে।
নো ইট’স নট ওকে। আমি কী বাবাকে মানা করে দিবো?
না না চন্দ্রা এসব কী বলছো? না করবে কেন? দোষ আমারি তোমাকে ছয় মাসের মধ্যে নিয়ে যেতে পারি নি। যাচ্ছো যাও। তাড়াতাড়ি চলে এসো।
তাড়াতাড়িই আসবো।
তাই? তাহলে এতো বড় লাগেজ নিচ্ছো কেন? দেখে মনে হচ্ছে ছয় মাসের আগে আসবে না।
চন্দ্রা ফিক করে হাসলো। তারপর বললো, আমার ছোট লাগেজ নেই সে জন্য।
ও তাই বলো। আচ্ছা আসার সময় নিয়ে আসবো।
না না দরকার নেই।
রাশেদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, তুমি সব কিছুতে না না করো কেন?
কোথায় সবকিছুতে না না করি?
আমি খেয়াল করেছি যখনই তোমাকে নিজে কিছু দিতে চাই তুমি না করো। আসলে তোমাকে জিজ্ঞেস করাই উচিত হয়নি। একেবারে নিয়ে আসা উচিত ছিলো।
তাহলে নিয়েই আসতেন।
বলছো? ঠিক আছে নিয়ে আসবো।
আচ্ছা খেয়ে নিন। তারপর যান প্লিজ।
রাশেদের রাগ গলে গেছে। সে হেসে বললো, আচ্ছা একটু পরেই যাবো তাহলে। তুমি আস্তে আস্তে করো সব।
ঠিক আছে।
খাবার টেবিলে বসে চন্দ্রা রাশেদকে বললো, রাশেদ টুকুকে কী করবো?
ওর কথা আমার মাথা থেকে বের হয়ে গেছিলো। আসলেই তো কী করবো ওকে নিয়ে?
আমি বলছিলাম কী ওকে কয়দিনের জন্য ওর বাড়ি পাঠিয়ে দেই? আমি আসার পর না হয় চলে আসবে।
আচ্ছা।
আপনি একটু ওর মামাকে কল করে বলে দিয়েন। কাল যেন নিয়ে যায় ওকে।
ঠিক আছে বলে দিবো।
আপনার এই কয়দিনে খাবারের খুব কষ্ট হবে তাই না?
ব্যাপার না আমি সামলে নিবো।
আমি আম্মুকে বলে দিয়েছি প্রতিদিন কাউকে দিয়ে দুপুর আর রাতের খাবার পাঠিয়ে দিবে। সকালটা একটু ম্যানেজ করতে হবে নিজেকে। ঘরে চাপাতা, চিনি, দুধ, বিস্কিট সবকিছু এনে রেখেছি। রান্নাঘরের বামপাশের কেবিনেটে থাকবে। আর রাতে আমি রুটি বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিবো। সময়মতো সেঁকে খেয়ে নিবেন।
এতে কিছু করতে হবে না চন্দ্রা। আই ক্যান ম্যানেজ।
এককাজ করুন কয়দিনের জন্য বাসায় চলে যান। কয়েকদিনের তো ব্যাপার। শুধু কষ্ট করে আসা যাওয়া করতে হবে আর কী।
চন্দ্রা কেন এতো ব্যস্ত হচ্ছো? কিছু হবে না আমার।
রাশেদ একটা ভুল হয়ে গেছে।
কী হয়েছে?
তুমি অসুস্থ এখন আমার যাওয়ার জন্য উচিত হয়নি।
রাশেদ মৃদু হাসলো তারপর ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা চন্দ্রার হাতটা ধরে বললো, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ চন্দ্রা। ওই ঘটনার অনেকদিন তো হলো। সুস্থ না হলেই কী আর হসপিটালে যেতে পারতাম। তুমি শুধু শুধু টেনশন করছো?
আপনি তো একা খেতে পারেন না। না খেয়েই কাটিয়ে দিবেন তাই না?
এতক্ষণ তুমি বলছিলে সেটাই তো ভালো লাগছিলো। আর রইলো বাকি একা খাওয়ার কথা তুমি প্রতিদিন খাওয়ার সময় ভিডিও কল দিতে পারো। আর হ্যাঁ এই আপনি আপনি করাটা বাদ দাও তো।
চন্দ্রা থতমত খেয়ে বললো, এতক্ষণ তুমি বলছিলাম নাকি?
হ্যাঁ। আর সেটাতেই থাকো।
চেষ্টা করি তো কিন্তু পারি না।
পারবে। এখন আসি। দেরি হয়ে গেছে অলরেডি।
ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।
আচ্ছা।
রাশেদ যাওয়ার পর চন্দ্রা বিরস মুখে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। তারপর মনে পড়লো রাশেদ বলেছিল ব্যাগ নিয়ে আসবে। তাহলে শুধু শুধু এটা গুছানোর মানে কী? তারপর সব আবার নামিয়ে রাখলো। চন্দ্রা মন খারাপ নিয়ে বসে থাকলো। একসময় তার নিজের উপর রাগ হলো। কী দরকার ছিলো রাশেদকে না নিয়ে একা যাওয়ার? তারপর আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলো কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার ঠিক সামলে নিতে পারবে।
পরের দিন রাশেদ গেলো চন্দ্রাকে ট্রেনে তুলে দিতে। চন্দ্রার ভীষন মন খারাপ। সে নিজেকে নিজে গালমন্দ করলো কতক্ষণ। তারপর রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো, সরি রাশেদ।
রাশেদ হেসে বললো, সরি বলার কী হলো?
এইযে একা করে রেখে যাচ্ছি।
তাহলে কী তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে? এটা কী সম্ভব? মন খারাপ করে থেকো না। যাও ঘুরে আসো ভালো লাগবে।
আপনি আমাকে নিতে আসবেন?
তুমি চাও আমি তোমাকে নিতে আসি?
হ্যাঁ। চন্দ্রা অকপটে স্বীকার করলো।
রাশেদ হাসলো। তারপর বললো, আচ্ছা নিতে যেতে পারি কিন্তু কোথায় নিয়ে আমাকে ঘুরতে যাবে বলো?
আমাদের বাগান বাড়িতে। যেখানে ঈদে গিয়েছিলেন সেখানে।
তাহলে তো যেতেই হবে।
রাশেদের কথার ধরনে চন্দ্রা হেসে ফেললো।
এভাবে হাসবে। মুখ ওমন করে রাখো কেন?
আচ্ছা হাসবো।
চন্দ্রা সাবধানে থেকো। ট্রেন ছেড়ে দিবে। গিয়ে আমাকে কল করবে। ঠিক আছে।
আপনিও সাবধানে যাবেন। সময়মতো খাবেন লক্ষীটি অনিয়ম করবেন না। আমি চাই না সেদিনের ঘটনা আর পুনরাবৃত্তি হোক।
আচ্ছা খাবো।
ট্রেন নড়ে উঠলো। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলো। রাশেদ ট্রেন থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো। হাত নাড়িয়ে হাসলো। চন্দ্রা কিছু বলতে পারলো না। সে চোখ ভর্তি জল নিয়ে নিচে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের জল সে অন্য কাউকে দেখাতে চায় না। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন তার? মনে হচ্ছে শরীরের একটা অংশ সে রেখে চলে আসছে।
২৩.
চন্দ্রা সিলেট এসেছে আজ তিনদিন। চারদিন তার কাছে চার বছর বলে মনে হচ্ছে। রাশেদের সাথে কথা হয় প্রতিদিন চার পাঁচবার তারপর তার ভালো লাগে না। খেতে বসলে মনে হয় সে কী খাচ্ছে ঠিকমতো? যদিও রাশেদের খাওয়ার সময় সে ভিডিও কল দেয়। রাশেদ খেলেও ওর মনে হয় ঠিক করে খায়নি। মোটকথা সে বিরক্ত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ছুটে চলে যায়। কিন্তু তার বাবা কড়া গলায় বলে দিয়েছে মিনিমাম সাত দিন থাকতে হবে। আজকে মাত্র চারদিন বাকি তিনদিন কীভাবে কাটাবে সেটা ভাবতেই চন্দ্রার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
রাত আটটায় কলিং বেল বাজলো। এতো রাতে কে এলো ভাবছে। সবাই তো ঘরেই আছে। সে তার ঘর থেকে উঁকি দিলো। রাশেদকে ঢুকতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই কী রাশেদ এসেছে নাকি সারাদিন তার কথা ভাবায় তার চোখে ভুল দেখছে? রাশেদ সকলের সাথে কথা বলে ভেতরে এলো। চন্দ্রা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। রাশেদ মৃদু হাসলো।
সে বললো, চন্দ্রাবতী কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি কী আমাকে খুশি হননি?
চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো, আমাকে একটা চিমটি কাটুন তো। বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।
বলেই সে হাত বাড়িয়ে দিলো। রাশেদ সেই হাত ধরে টেনে চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো, এবারও বিশ্বাস হচ্ছে না।
চন্দ্রা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। একটা কথাও সে বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর রাশেদ বললো, তুমি খুশি হওনি?
হয়েছি।
তাহলে কথা বলছো না কেন?
ইচ্ছে করছে না।
তাহলে কী ইচ্ছে করছে? এভাবে জড়িয়ে থাকতে?
চন্দ্রা সরে আসতে চাইলো। রাশেদ ছাড়লো না। রাশেদ বললো, এতো ছটফট করো কেন? এতো দূর মানুষ বিয়ে করে। জার্নি করতে করতে জীবন শেষ। আমার চেনা কেউ থাকলে তাকে বলবো ভাই আর যেখানে বিয়ে কর কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সিলেট করবি না।
সিলেট খারাপ কী?
এইযে এতো দূর আসতে হলো। আট নয় ঘন্টা জার্নি কী কম নাকি? বউকে চাইলেও দেখতে পারি না। আজ যদি কাছে হতো চট করে দেখে চলে আসতাম।
ইসস ঢং!
তোমার কাছে তো এমনই মনে হবে। জানো কত মিস করছিলাম? তাইতো না বলে চলে এসেছি।
চন্দ্রা এবার হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো, রাশেদ সাহেব আপনি প্রেমে পড়েছেন কঠিন প্রেমে। আমার চোখ ফাঁকি দেয়া এতো সহজ নয় ডাক্তার সাহেব।
তাই?
জ্বি।
বলো তো কার প্রেমে?
বলবো না।
রাশেদ চন্দ্রার হাত ধরে সামনে নিয়ে এলো। তারপর কানে কানে বললো, আমি বলবো?
চন্দ্রার কান ঝিনঝিন করে উঠলো। সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না।
রাশেদ কানে কানে বললো, চন্দ্রা গান শুনবে?
চন্দ্রা চট করে উত্তর দিলো, না।
কেন?
এতো বাজে গলা! বলেই চন্দ্রা হেসে ফেললো।
তাই? এই বাজে গলা আর আমাকে যে সারাজীবন সহ্য করতে হবে। আমাকে যে এভাবে জ্বালাচ্ছো তার শোধ নিব।খুব তাড়াতাড়ি। রেডি থাকো। এখানে আসলে তো ভূলেই যাও। কালকেই ফিরছি সকাল সকাল আর এক বছরের আগে আসতে দিবো না।
বললেই যেন মানছি। আমি ঘুম থেকেই উঠবো দুপুরে।
মানতে হবে। না হলে কোলে করে নিয়ে যাবো।
ইসস দেখা যাবে।
চ্যালেন্জ করছো?
চুপ আর একটাও কথা না। ফ্রেশ হয়ে আসুন একটু পরেই খেতে ডাকবে।
আচ্ছা শেষ একটা কথা?
কী?
তুমি এতো সুন্দর কেন?
কারন আপনার দেখার চোখটা সুন্দর তাই।
সর্বনাশ করে দিলে চন্দ্রাবতী। এর প্রতিশোধ যে নিবো। তৈরি থেকো।
চন্দ্রা হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রাশেদের মন খুব হালকা লাগছে। সে জানতে প্রেমে পড়েছে তবে এতো কঠিন প্রেমে পড়েছে বুঝতে পারে নি। এই মেয়েকে ছাড়া চারদিন চার বছর মনে হচ্ছে। দূরে থেকেও কী সাংঘাতিক মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে আমাকে! ওই বাড়িতে ডুকলেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাঝরাতে হাসপাতাল থেকে আসলে কেউ হাতে হাতে জিনিস এগিয়ে দেয় না। বকার পরও না খেয়ে বসে থাকে না। রাতে খাবারের পর চা নিয়ে আসে না। বিছানায় যাওয়ার পর খালি খালি লাগে। কী যেন একটা প্রচন্ড মিস করে? হ্যাঁ চন্দ্রার গায়ের গন্ধ। চারপাশে চন্দ্রা চন্দ্রা গন্ধ সে প্রচন্ড মিস করে।
চলবে………