অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৫২

0
1025

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৫২

বিয়ের তিনদিন আগে রাফিনের বড় আপু ও ছোট আপু এলো আমায় দেখতে। ওরা আগেরদিন আসতে পারেনি তাই। আমার রুমে একা বসে আছি। বাইরে সবাই ব্যস্ত নিজেদের কাজে। আমার বিয়ে, অথচ আমার-ই কোনো মূল্য নেই। রুমে আমাকে সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সাদা আঁচলের আকাশী রংয়ের একটা শাড়ি পরেছি আমি। শাড়িটার ডিজাইন পুরোপুরি আকাশের। পুরো শাড়ি জুড়ে মেঘেদের উড়াউড়ি। আঁচলেও মেঘ, তবে বৃষ্টি নেমেছে। শাড়িটা দেখামাত্রই এত পছন্দ হলো আমার। এটা এসেছে পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকে। বড়আপু নিজে শাড়িটা পরিয়ে দিলেন আমায়। শাড়ি পরার পর সাদা রংয়ের হিজাবও পরিয়ে দিলেন। বড়আপুকে যতবার দেখছি ততবার আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। উনি কেন আমার এত যত্ন করছেন? একদম মায়ের মতো! শাড়ি পরানোর পর হালকা সাজিয়েও দিলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন ওনার ছোট্ট তিন বছর বয়সী বাচ্চাটাকে। আপু যাওয়ার পর আমি ওকে কাছে ডাকলাম।
“তোমার নাম কি বাবু?”
“আয়েশা!”
“মা শা আল্লাহ! কত সুন্দর নাম তোমার।”
“তোমাল নাম কি?”

আমি হেসে বললাম, “আমাল নাম আরোহী।”
“তুমি আমাল মামী?”
বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে মুহুর্তেই গা শিরশির করা অনুভূতি বয়ে গেল শরীরজুড়ে। ওর দিকে তাকিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম,
“হু, তোমার মামী।”
“মামা বলেতে তোমাতে মাম্মাম দাকতে।”
“তাই? আচ্ছা তুমি একটু বসো, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”

আয়েশাকে রেখেই ওয়াশরুমে চলে গেলাম। কেমন যেন অস্থির লাগছে আমার৷ এমন কেন হচ্ছে? আমি তো এতদিন রাফিনকে ছাড়া দিব্যি ভালো ছিলাম। ওর কথা আমার মনেও পড়তো না। এখন প্রায়ওর কথা মনে পড়ছে। আল্লাহু! বুকটা তো যন্ত্রণায় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণা রাফিনের জন্য না, দোটানায় পড়ে হচ্ছে। রাফিনকে সামনে দেখে অজান্তেই আল্লাহর অবাধ্যতা হয়ে যাচ্ছে আমার দ্বারা তাই ভেতরটা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আয়েশাকে একা রেখে এসেছি মনে পড়তেই দরজা খুলে বের হলাম। বের হতেই চোখাচোখি হয়ে গেল রাফিনের সাথে। ও আয়েশাকে নিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে আছে। আয়েশা ওর পেটের ওপর বসে ওকে চিপস খাইয়ে দিচ্ছে। আমি আবার ওয়াশরুমে ঢুকতে পা বাড়ালাম। রাফিন বললো,
“স্যরি! আমি চলে যাচ্ছি। আয়েশা আটকে রেখেছে, আমাকে যেতে দিচ্ছে না। চলো আয়েশা।”
“মামা, আমলা এথানে থাব্বো।”

রাফিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যলকনিতে গিয়ে দরজা আটকে বসে রইলাম। ঢুকরে কান্না আসছে আমার। রাফিন কি কিছুই বুঝতে পারছে না? ও কেন বারবার আমার সামনে আসছে? আমি তো নিজেকে সামলাতেই পারছি না। ও কেন আমার সাথে মিলিয়ে পোশাক পরলো? সাদা রংয়ের শার্ট পরে দিব্যি হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য ও প্রায়সময়ই সাদা অথবা কালো পোশাক পরে। গলার ভেতর আটকে আসা কান্নাটা চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নামাজ পড়তে পারলে কিছুটা হালকা হওয়া যেত।

রুমে বড় আপুর গলা শোনা গেল।
“কিরে, তুমি এখানে কি করছো?”
“উফ! আপ্পি তোমার মেয়েটা আমার মান-ইজ্জত সব ডোবাবে। ও আমাকে বেরুতেই দিচ্ছে না।” ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো রাফিন।
“যাও, ওকে আমি দেখছি। হৃদিতা কোথায়?”

রাফিন কি বললো শুনলাম না। দরজা লাগানোর শব্দ পেলাম। হয়তো চলে গেছে। ব্যালকনি থেকে বেরুতে যাবো তখনই ফ্লোরে একটা কাগজ পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিলাম। স্পষ্ট বাংলায় লেখা,
“সত্যি করে বলতো, তুমি আমায় ভালোবাসো না?”

চোখমুখ খিঁচে কাগজটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরলাম। এতদিন পর ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে? এমনিতেই নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি আমি তারওপর আবার চিরকুট দেওয়া হচ্ছে। বাসি না কাউকে ভালো। কাউকে ভালোবাসি না। কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বাইরে ফেলে দিলাম। কাগজের টুকরোগুলো হাত থেকে ছাড়তেই নিচে তাকিয়ে দেখি রাফিন ঠিক আমার বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক! জবাব নিশ্চয়ই পেয়েছে। আমি চোখের পানি মুছে চলে আসলাম ওখান থেকে। আর কিছুতেই কষ্ট পাওয়া যাবে না ওর জন্য৷ একজন পরপুরুষের জন্য। একজন পরপুরুষের জন্য কষ্ট পাচ্ছি ভাবতেই নিজের প্রতি ঘেন্না হচ্ছে আমার।

দুপুরের দিকে শাওন এলো, সাথে সোহাকেও নিয়ে এলো। শাওনকে দেখে আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। সোহার সাথে নয় মাস বয়সী বাচ্চা ছেলে। রিয়াদের বাচ্চা! আমি চমকে শুধু এটুকু বলেছি,
“এতকিছু কবে হয়ে গেল?”
“তুই থেমে আছিস বলে কি পুরো দুনিয়া থেমে যাবে নাকি?”
“আমি থেমে আছি?”
“থেমে নেই? আমরা সবাই সে-ই কবে বিয়ে করেছি। অথচ সবচেয়ে বেশি ইসলাম মানিস তুই। তুই-ই বিয়ে করলি না?”
“পাত্র পাইনি ভালো।”
“এবার পেয়েছিস?”
“হু।” মাথানিচু করে মৃদুস্বরে বললাম।
“তুই খুশি তো এই বিয়েতে?”
“খুশি না হলে তো বিয়ে করছি না।”
“তুই ফাইয়াজকে সামনে রেখে আরেকজনের হয়ে যেতে পারবি?”
“না পারার কি আছে? আমি তো ওকে সেই কবেই ছেড়ে এসেছি। নতুন করে ওর হওয়ার তো কারণ নেই। আর তোদের সবার কথায় বারবার ফাইয়াজ চলে আসে কেন? আমি তো ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারবো না, মনে না করতে চাইলেও মনে করিয়ে দিচ্ছিস।” আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে চলে গেলাম। সোহা এসে বলল,
“তুমি ফাইয়াজ ভাইয়ার কথা বলতেই মুখ লুকাচ্ছো কেন? তুমি যদি কনফিডেন্ট থাকতে তাহলে নিশ্চয়ই মুখ লুকাতে না।”
“তোমরা সবাই কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাইয়াজ ভাইয়া সম্পর্কে জানাবে বলে এখানে এসেছো? সেরকম ভাবনা নিয়ে আসলে তোমাদের আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না।”
“হৃদি, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”
“শোন, আমার সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে না চাইলে আমার বিয়ের আগপর্যন্ত কেউ একটাবারও রাফিনের নাম উচ্চারণ করবি না আমার সামনে।”
”আমরা তো ফাইয়াজের নাম উচ্চারণ করছি। তুই একাই তো রাফিন রাফিন করে পাগল হয়ে যাচ্ছিস।”
আমি কটমট করে তাকালাম শাওনের দিকে। ও ঝটপট বললো, “আচ্ছা রে বাবা, করবো না।”

বড়আপু যাওয়ার আগে আমার রুমে এলেন। আমাকে পাশে বসিয়ে বললেন,
“তুমি এই বিয়েতে মন থেকে রাজি তো?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “শতভাগ রাজি আপু।”
“মা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ফাইয়াজ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। মা যখন মারা যাচ্ছিলেন, তখন আমার হাত ধরে বলেছিলেন ফাইয়াজকে দেখে রাখতে। এই একটামাত্র ছেলেকে আমরা খুব বেশি ভালোবাসি। যে-ই ওর সান্নিধ্য পেয়েছে সে-ই ওকে ভালোবেসেছে। আর ও ভালোবেসেছে তোমাকে। তুমি চলে যাওয়ার পর প্রায় প্রতিটা রাত ওকে বিমর্ষ অবস্থায় পেতাম আমি। আমাদের ঘর লাগোয়া ছিল। রুমের মাঝখানে শুধু একটা পর্দা ছিল। আমার ভাইটা ঘুমিয়েছে কিনা দেখতে গিয়ে প্রতিরাতে দেখতাম ওর চোখ জলে টইটম্বুর। মা মারা যাওয়ার পর ও কতরাত ঘুমায়নি আল্লাহ ভালো জানেন। এরপর সবকিছু ছেড়ে মাদরাসায় চলে যায়। ওখান থেকে ফেরার পর ওকে স্বাভাবিক পাই আমরা। অনেক কষ্ট পেয়েছে ও, অনেক। তুমি ছাড়া কারো জন্য কখনো কেঁদেছে বলে আমার জানা নেই। ওর চোখের জলের কারণ হয়েছো একমাত্র তুমি। ছেলেরা ভালোবাসা, রাগ, অভিমান মেয়েদের মতো প্রকাশ করতে পারে না। ছেলেরা সহজে কারো জন্য কাঁদে না। যার জন্য কাঁদে সে বড় ভাগ্যবান। যে ছেলে কোনো মেয়ের জন্য সরাসরি চোখের জল ফেলতে পারে সে নির্দ্ধিধায় ঐ মেয়েটাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। তুমি বড় ভাগ্যবতী, জীবনে এমন কারো সান্নিধ্য পেয়েছো।”

গলায় বিঁধে আসা কান্নাটা কোনোরকমে ঢোক গিলে আটকালাম। বড়আপু চলে যাক একবার। এই ঘরে আমি আর থাকবো না। পালাতে হবে এখান থেকে। সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে।

বড়আপু বললেন, “তুমি ওকে আল্লাহর জন্য ছেড়েছো জানি। আল্লাহ চাইলে সব ভালো হবে। আচ্ছা, ভালো থেকো তাহলে। আজ আসি।” বড়আপু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন।

বড়আপু বেরুতেই রাফিনের হাসির শব্দ শোনা গেল। ও তো খুশি, বাকীদের ওর জন্য এত দরদ উতলে পড়ছে কেন? কই, ও তো একবারও এসে বললো না, আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই। বাকীসব ফেলে চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। ধুৎ! কিসব ভাবছি। টেবিলে ফুলদানিটা দেখে বহুদিনের পুরোনো ভাঙ্গাভাঙ্গির রোগটা আমার ভেতর ফিরে আসতে চাইলো। ইচ্ছেটাকে দমিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রাফিনরা চলে যাচ্ছে। রাফিন হাসতে হাসতে বড়আপুকে কি যেন বলছে আর বড়আপু ওর পিঠ চাপড়ে আস্তে কথা বলতে বলছেন। সব খুশি যেন উপচে পড়ছে ওর। এদিকে বাকীদের যন্ত্রণায় আমিই টিকতে পারছি না। রাফিনরা চলে যেতেই আমি ব্যাগ নিয়ে সবার অলক্ষ্যে নিচে চলে এলাম। পালাতে হবে এখান থেকে। ততক্ষণে জগতে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ব্যাগ নিয়ে প্রাণপনে ছুটতে থাকলাম। আর একমুহূর্তও এখানে না। চারদিকে রাফিন, রাফিন, রাফিন আর রাফিন। অসহ্য! বিয়েটাও শান্তিতে করতে দিবে না আমায়। এতই রাফিনকে নিয়ে মেতে থাকলে ওর সাথেই বিয়ে ঠিক করতো। কই, সে-কথা তো কেউ বলছে না একবারও। আর ঠিক করলেও বা কি? আমি কখনোই ওকে বিয়ে করবো না, কক্ষনো না। হুহ!

#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here