তোর অপেক্ষায় পর্ব-৮

0
454

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৮

ডাইনিং টেবিলে বসে আজকের তাজা খবরটা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি।আমার জন্মদিন উপলক্ষে সন্ধ্যায় বাড়িতে হৈচৈ করে কেক কাটা হবে।সাথে মা এবং বড়মা’র হাতের মজাদার ডিশ তো আছেই।জন্মদিনের সেলিব্রেশন মানেই হলো সবার থেকে রঙিন কাগজে মুড়ানো গিফট পাওয়া।আহ্ ভাবতেই কি সুখ সুখ লাগছে।
খুশি ধরে রাখতে না পেরে হাসতে হাসতে ডাইনিং টেবিলের চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে মা বড়মা,আপু ভাইয়া সবাই অবাক হয়ে রইল।ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আব্বুর সামনে পড়ে গেলাম।লজ্জা বুঝি একেই বলে।আব্বু নিশ্চয়ই ভাববে তাঁর এত বড় মেয়ে কেমন বাচ্চাদের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আব্বু স্নেহময় কন্ঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ এভাবেই সবসময় হাসিখুশি থাক মা।’

নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ এত ভালেবাসে আমায় ভাবলেই ভাগ্যবতী মনে হয়।আমার প্রত্যেকটা খারাপ সময়ে সবাই পাশে থেকে সাপোর্ট করেছে আমায়।সেই দুর্ঘটনার পর বেশকিছু দিন আমি ডিপ্রেশড ছিলাম।কারো সাথে কথা বলতাম না,খাওয়াদাওয়া থেকেও মন উঠে গেছিল।ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে।তখন বাড়ির সকলে সর্বদা আমাকে চোখে চোখে রাখত।প্রতিটা মুহূর্ত চেষ্টা করে গেছে আমি যেন হতাশা থেকে বেরিয়ে এসে আবার নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারি।তাঁদের বহু পরিশ্রম এবং আমার ইচ্ছাশক্তির বদৌলতে আমি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।কিন্তু সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমি এদেরকে দিতে চাই।এরাই আমার সব।তাদের নিঃস্বার্থ আদরের সংস্পর্শ না পেলে আজ আমি এত খুশি থাকতাম না।জানি না তাদের ঋণ কিভাবে শোধ করব আমি।

.

সেলিব্রেশন নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে ভার্সিটি যেতে মন সায় দিল না।ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম এই বুঝি ভ্রু কুঁচকে ধমক দেবে।কিন্তু মা তো আজ পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা হয়ে গেছে তাই শেষমেষ আর ভার্সিটি যাইনি।আমার দেখাদেখি আপুও ক্লাসে যাওয়া বাদ দিলেন।এদিকে ফারাজও বেঁকে বসেছে ওর বোনেরা কেউ যাচ্ছে না তাহলে সে ছোট হয়ে কেনো যাবে স্কুলে।ব্যস্ আমরা তিনজনই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা পাকা করে নিলাম।একমাত্র ইমন ভাইয়া রাগে গজরাতে গজরাতে অফিস গেলেন।ফাঁকিবাজ,পড়াচোর ইত্যাদি উপাধি দিতেও ছাড়েন নি আমাদের।আমি ভালো করেই জানি আমাদের দেখে ভাইয়ারও অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু কিছু করার নেই।

সারাদিন কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আমি আর আপু মিলে ড্রয়িংরুম সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।ফারাজও বাদ যায়নি কিন্তু সে বেলুনে হাওয়া দিতে গিয়ে চার পাঁচটা নিমিষেই ফাটিয়ে দিল।তাই আপু তাকে ধমকিয়ে সরিয়ে দিল এখান থেকে।
পুরো ড্রয়িংরুম সাজাতে প্রায় একঘন্টার মত সময় নিল।ততক্ষণে বাইরে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে।ইমন ভাইয়া বলেছে আজ জলদি চলে আসবে অফিস থেকে।সকালে আমাকে আর আপুকে বলে গেছিল আমরা নাকি ডেকোরেশন করতে পারব না ভালোভাবে। ভাইয়া ফিরে আসা পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করি।কিন্তু আমরা দুবোন তো সব সাজিয়ে গুছিয়ে কামাল করে ফেলেছি।

আপু আর আমি চটজলদি ড্রেস পাল্টে আজকের জন্য ঠিক করে রাখা জামা পড়ে নিলাম।আপু অবশ্য থ্রিপিস পড়েছে।আর আমারটা সাদা এবং গোলাপির কম্বিনেশনের অত্যন্ত ঝকমকে একটা গাউন।আয়নায় নিজেকে দেখে খারাপ লাগল না।সাজগোজের বাকি যা প্রয়োজন সব লাগিয়ে পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়ে নিলাম।আপু আমাকে দেখতেই চিল্লিয়ে বলে উঠল,

‘ ওহ্ মাই বিউটিফুল লেডি!তুম তো মুঝে দিওয়ানা বানা দোগি।’

আপুর মুখে হিন্দি শুনলে বরাবরই আমার হাসি পায়।আমিও তাল মিলিয়ে বললাম,
‘ অর তুম তো মুঝে মার ডালোগি।আজাও গালে লাগ যাও।’

ড্রয়িংরুমে আমাদের দুজনের অপরিপক্ক হিন্দি শুনে এবং কাজকারবার দেখে মা আর বড়মা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।কিন্তু এসব পাত্তা দেয় কে।আমাদের মাস্তি আরো একধাপ বাড়িয়ে দিতে ফারাজ এসে মিউজিক বক্সে একটা হিট গান চালিয়ে দিল-হায় গরমি!
আমাদের তিনজনকে আর পায় কে।হাত ধরাধরি করে উড়াধুরা নাচতে আরম্ভ করলাম।কেউ কারো থেকে কম নয়।গানের আওয়াজে অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পেলাম মা কিচেন থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বকাবকি করছে।করুক গে।আব্বুরা চলে আসলে তো এসব করা যাবে না তাই এখনই আশ মিটিয়ে লাফালাফি করে নেই।
নাচের একপর্যায়ে আপু হঠাৎ সটান দাঁড়িয়ে গেলেন।কাঁদকাঁদ চেহারা তাকাচ্ছেন ফারাজ এবং আমার দিকে।এইমাত্র তো ঠিক ছিল এখন কি হলো আবার।
নাচ থামিয়ে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কি সমস্যা? আসো নাচি। এখন বাড়ি ফাঁকা আছে।পরে কিন্তু সবাই চলে আসবে।’

আপু আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আগের ভঙ্গিতেই বোকার মত চেয়ে আছে আমার পানে।বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ এভাবেই থাকো তুমি।চল ফারাজ আমরা আমাদের উরাধুরা নাচ চালিয়ে যাই।’

ফারাজ আমার কথায় সায় দিয়ে পা মেলাল। আমি ওর হাত ধরে স্টেপ নেওয়ার জন্য পেছনে মুড়তেই হাজার ভোল্ট কারেন্টের শক খেলাম।আমার চশমা কি আমার সাথে বেইমানি করছে নাকি সামনের দৃশ্যটা সত্যি!
খোলা মেইনডোরের সামনে দুর্জয় ভাইয়া চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছেন।উনি আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হাসলেন সামান্য।সুহানা আপু তাহলে উনাকে দেখেই এমন রোবট হয়ে গেছে।কিন্তু আমি তো অপ্রস্তুত হতে হতে মাটিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছি।
ফারাজ দুর্জয় ভাইয়া বলে লাফিয়ে উনার কোলে উঠতে গেল।কিন্তু উনার কৌতুকময় দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ।
আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে গাউন উঁচু করে ধরে দৌড়ে চলে এলাম নিজের ঘরে।লজ্জায় নাকি ভয়ে এভাবে চলে এসেছি জানি না।মন বলছে এখনি পালাতে তাই পালিয়ে এলাম।উনি আমার ঐতিহাসিক নাচ দেখে নিয়েছে ভাবতেই মাথা ঘুরে উঠছে।জন্মদিনে এমন এক লজ্জাকর অবস্থায় পড়ব তা ভাবিনি।ইস দরজাটা বন্ধ রাখলেই তো হত।কিন্তু লাফালাফির চক্করে একদম মনে ছিল না।এখন কিভাবে উনার সামনে যাব আমি।উনি নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে হাসিতে ফেটে পড়ছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচতলা থেকে ইমন ভাইয়ার হম্বিতম্বি করার আওয়াজ পেলাম।ভাইয়াই বোধ হয় ওই লোকটাকে নিয়ে এসেছে।এই ভাইয়াটাও যে কি!উফ।
রুমের মধ্যে এদিক সেদিক পায়চারি করছি এমন সময় দরজায় টোকা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।কারণ দুর্জয় ভাইয়া রুমের খোলা দরজার সামনে। উনার ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা।দরজায় টোকা দেওয়ার অর্থ উনি অনুমতি চাইছেন ভেতরে আসার।
উনাকে দেখতে পেয়ে একটু আগের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।মন চাইছে বলে দেই আপনার আসার দরকার নেই এই রুমে।চলে যান।আপনি অতি দীর্ঘকায় অদ্ভুত এক প্রাণী।
কিন্তু মনের কথা চেপে রেখে কোনোরকমে বললাম,
‘ আসুন! ‘

দুর্জয় ভাইয়াকে ভেতরে ঢুকতে দেখে আমি এককোনায় সটান দাঁড়িয়ে গেলাম।উনি দুহাত পকেটে গুঁজে আমার ছোটখাটো রুমটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।পড়ার টেবিলে এসে দুয়েকটা বই উল্টেপাল্টে দেখলেন।দেয়ালে লাগানো আমার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন একনজরে।উনার এমন জাসুসি করা দেখে নিজেকে আসামী মনে হচ্ছে। আর এটা যেন কোনো আসামীর ঘর যেখানে বিভিন্ন ভয়ানক অস্ত্র লুকিয়ে রাখা আছে আর সেই অস্ত্র উদ্ধার করার দায়িত্ব এনার উপর।
উনি পুনরায় আমার সামনে এসে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘ মেইন দরজা খোলা রেখে সেজেগুজে এভাবে লাফানোর কি মানে?আমার জায়গায় যদি বাইরের কেউ থাকত?’

এতক্ষণ এই প্রশ্নটার ভয় পাচ্ছিলাম আর সেই ভয় সত্যি হয়ে গেল।শেষমেষ উনি টেনে টেনে ওই ঘটনাটা সামনে নিয়ে এলেন।অসহ্য!
মাথা নিচু করে বিরবির করে বলে ফেললাম,
‘ আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ভালোই হত।এত লজ্জা পেতাম না।’

দুর্জয় ভাইয়া এবার দেয়ালে ঠেস দিয়ে দুহাত বুকের উপর ভাঁজ করে দাঁড়ালেন।উনার থেকে আমার দূরত্ব বেশখানিকটা।

‘ তাই?আমাকে দেখে এত লজ্জা কেনো?আমার জানামতে তো আমি বাইরের কেউ নই। আমাকে দেখামাত্রই তুই আড়ষ্ট হয়ে থাকিস,পালিয়ে বেড়াস কারণটা কি জানতে পারি?’

উনার প্রশ্নে আমার আড়ষ্টভাব আরো বেড়ে গেল।উনি বুঝি এরকম জেরা করার জন্যই আমার রুমে হাজির হয়েছে? উনার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারব না আমি।কারণ উত্তর তো আমার নিজেরও জানা নেই।

আমার চুপচাপ থাকাটা বোধ হয় উনার পছন্দ হলো না।মৃদু হেসে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে।উনি কি আজ আমার হার্ট অ্যাটাকের কারণ হবেন?বুক ধড়ফড় বাজেভাবে । এক্ষুনি হার্ট ছিটকে বেরিয়ে আসবে।
আমার কাছে এসে ঝুঁকতেই হঠাৎ,

‘ পূর্ণতা!কোথায় তুই?’

কারো চিৎকারে চমকে উঠলাম আমি। দুর্জয় ভাইয়া ঝটপট কয়েক কদম পেছনে চলে গেলেন দ্রুত পায়ে। ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকালেন।
জেরিন আপু দাঁড়িয়ে আছে।তাঁর হাতে বড় একটা গিফটের বাক্স।আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম আপুকে।

‘ অনেকদিন পর দেখা হলো আপু।সুহানা আপু থেকে শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ ছিলে।এখন ঠিক আছো তো?’

আপু কোনো উত্তর দিচ্ছে না।এর আবার কি হলো।এক্ষুনি তো আমার নাম ধরে চিল্লিয়ে কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল।
আপুকে ছেড়ে সামনে এসে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম।আপু গোলগাল চোখে সরাসরি তাকিয়ে আছে দুর্জয় ভাইয়ার দিকে যেন দুর্জয় ভাইয়া কোনো মানুষ নয়।
এদিকে দুর্জয় ভাইয়ার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।উনার চোখের চাহনি কঠিন।একটু আগে উনার ঠোঁটে যেমন মিষ্টি হাসি খেলা করছিল সেটা আর নেই।তার বদলে স্থান করে নিয়েছে চাপা এক রাগ।যেন এক্ষুণি সামনের মানুষটাকে ছিলে খাবেন।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এরা এভাবে একে অপরকে দেখে যাচ্ছে কেনো?

আপু আমতাআমতা করে বলল,
‘ ক..কেমন আছো দুর্জয় ভাইয়া?’

স্পষ্ট দেখলাম দুর্জয় ভাইয়ার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল।চোখে এখনো অজস্র রাগ।উনারা কি একে অপরকে আগে থেকে চেনে?দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।

‘ ভালো।’

এটা বলেই দুর্জয় ভাইয়া হনহনিয়ে বের হয়ে গেলেন।আমি স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।জেরিন আপু উনার সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলতে চাইল আর উনি কেমন অভদ্রের মত চলে গেলেন!কিভাবে পারলেন এটা করতে?
জেরিন আপুর দিকে তাকিয়ে বেশ মায়া লাগল আমার।মেয়েটা সুহানা আপুর সাথে একই ক্লাসে পড়ে।ওর নাকি ছোটবেলায় বাবা-মা দুজন কোনো এক এক্সিডেন্টে মারা যায়।এরপর থেকেই নিজের চাচীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করে।একদিক দিয়ে ভালো যে জেরিন আপুর চাচী তাঁকে মেয়ের মত ভালোবাসে।
সুহানা আপুর ফ্রেন্ড হওয়ার দরুণ এ বাড়িতে তাঁর আসা-যাওয়া লেগেই থাকে।আমাদের বাড়ির সবাই আপুকে খুব আদর করে।বাবা-মা মরা মেয়ে।
দুর্জয় ভাইয়ার ব্যবহার দেখে খুব রাগ হলো আমার।আপুকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললাম,
‘ তুমি দুর্জয় ভাইয়াকে চিনো?’

আপু জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,
‘ চিনি।খুব ভালো করেই চিনি ওকে। ‘

‘ আর বলো না উনার মত এমন রগচটা মানুষ কখনো দেখিনি আমি।খালামণিদের পরিবারে সবাই ভালো একমাত্র উনি বাদে।বদমেজাজি লোক একটা।’

আমার কথায় আপুর কোনো হেলদুল হলো না।উদাসভাবে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। ইস না জানি কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here