তোর অপেক্ষায় পর্ব-১৮

0
442

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৮

চোখ খুলতেই ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম মাথার উপর সিলিং ফ্যান অল্প গতিতে ঘুরছে।উজ্জ্বল লাইটের আলো চোখে লাগতে চোখ কুঁচকে উঠল।কিছুসময় পর আলোটা সয়ে আসলে ধীরে ধীরে তাকালাম।ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে মনে হচ্ছে আমার মাথাই ঘুরে উঠছে।এতক্ষণে টের পেলাম আমি শুয়ে আছি বিছানার উপর।কিন্তু এটা কার ঘর?
চটজলদি উঠে বসলাম।মাথার ভেতর কেমন যেন দুমদুম শব্দ হচ্ছে। একহাতে মাথা চেপে ধরে পুরো রুমে নজর দিলাম।বেড থেকে কিছু দূরে একটা সোফার উপর একজন পুরুষকে বসে থাকতে দেখে হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠলাম।মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে।লোকটির চেহারা না দেখেও আমি নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারছি এটা দুর্জয় ভাইয়া।মাথা নিচু করে থাকার কারণে এখনো খেয়াল করেনি আমায়।রুমের আশেপাশের আসবাবপত্র এবং সরঞ্জাম জানান দিচ্ছে আমি বর্তমানে কোনো এক হসপিটালের কক্ষে।আমার কি হয়েছিল?
চোখ বন্ধ করে সবটা মনে করার চেষ্টা করলাম।আজ সকালে খালামণির বাসা থেকে সোজা ভার্সিটি গিয়েছি।দুটো ক্লাস শেষে তৃতীয় ক্লাস করার সময় হঠাৎই মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়।এই ব্যথা মাঝেমধ্যেই দেখা দেয় কিন্তু আজকের মত জোরালো অনুভূত হয়নি কখনো।মাথা ব্যথার ধাক্কা সামলাতে না পেরে পাশে বসে থাকা মেয়েটার হাত বাজেভাবে খামচে ধরেছিলাম।শুধু এটুকুই মনে করতে পারছি।তাহলে কি আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম?অবস্থা কি এতই খারাপ ছিল যে আমাকে হাসপাতালের দরজা পর্যন্ত আসতে হয়েছে?বেডের পাশের আধখোলা জানালা দিয়ে অন্ধকার আকাশ দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম।ক’টা বাজে কে জানে!আমি সারাদিন সেন্সলেস ছিলাম নাকি!

গায়ের উড়না ঠিকঠাক করে দুর্জয় ভাইয়াকে ডাকার চেষ্টা করলাম।উনার সাড়া নেই।বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছেন বোধহয়।আবার এতক্ষণ কথা না বলার কারণে আমার গলার স্বরও ক্ষীণ শোনা যাচ্ছে।তাই কিছুক্ষণ থেমে কিছুটা চেঁচিয়ে ডেকে উঠলাম,

‘ দুর্জয় ভাইয়া..!’

দুর্জয় ভাইয়া ঝট করে মাথা তুললেন।উনার চোখ প্রচন্ড লাল হয়ে আছে।উসখুসকো চুলগুলো কপালের উপর পড়ে আছে।মুখখানা শুকিয়ে বিবর্ণ প্রায়।উনার আপাদমস্তক দেখে নিমিষেই বুঝে গেলাম বিগত কয়েকঘন্টা উনি স্থির হয়ে দুদণ্ড বসতে পারেননি।
দুর্জয় ভাইয়া ঝড়ের মত ছুটে আসলেন আমার কাছে।পাশে বসে কপালে চিন্তার ভাজ তুলে বলতে লাগলেন,

‘ স্যরি চোখটা হঠাৎ লেগে গেছিল।এখন কেমন লাগছে।আর ব্যথা নেই তো!তোর কখন জ্ঞান ফিরেছে?’

‘ আরে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করুন না!এমন তীরের মত প্রশ্ন ছুড়লে কি করে উত্তর দেব?’

দুর্জয় ভাইয়ার শুকনো ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল।
‘ ঠিক আছে।তুই একে একে সব উত্তর দে।’

‘ প্রথমত আমার হসপিটালের এই রুমে দম বন্ধ লাগছে যেমনটা আগে লাগত।দ্বিতীয়ত এখন আর ব্যথা নেই।তৃতীয়ত আমার মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে।এবার আপনি বলুন সত্যি করে আমার কি হয়েছিল! ক্লাস করতে করতে হঠাৎ মাথা ব্যথা শুরু হলো এরপর আর কিছু মনে করতে পারছি না।’

দুর্জয় ভাইয়া সযত্নে আমার ডানহাতটা নিজের হাতে টেনে নিলেন।কিছু বুঝে উঠার আগেই হাতের উল্টো পিঠে ইচ্ছেমতো অগুনিত চুমু খেয়ে ফেললেন।এমন অসুস্থতার মধ্যেও উনার ছোঁয়ায় আমার শরীর শিউরে উঠল।হাত ছাড়াতে নিলেই আরো শক্ত করে ধরে বললেন,

‘ তীব্র মাথাব্যথার কারনেই মূলত সেন্স হারিয়েছিস।ডক্টর বলেছে এখন ভয়ের কিছু নেই।ঘুমের ওষুধ দেওয়ার কারণে এতক্ষণ ঘুমিয়েছিস।চিন্তা করিস না কাল সকালে রিলিজ করে দেবে।’

‘ কিন্তু মা কোথায়?বাড়ির লোকজন কোথায় সব?’

‘ এখন রাত কয়টা বাজে জানিস?দশটার কাছাকাছি।সবাই-ই ছিল হসপিটালে একটু আগে বলে কয়ে বিদায় করেছি।খালামণি টেনশনে অসুস্থ হয়ে গেছিল প্রায়।’

‘ হসপিটালে আপনি ছাড়া কেউ নেই?’

‘ বাইরে ইমন আর আম্মু আছে।ইমন গেছে খাবার আনতে।তুই বোস আমি ডক্টরকে ডেকে আনি।’

দুর্জয় ভাইয়া উঠে দরজার কাছে যেতেই আমি কোমল গলায় ডেকে উঠলাম,

‘ শুনুন! ‘

দুর্জয় ভাইয়া ফিরে তাকালেন।আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার আগের জায়গায় এসে বসলেন।উনার শুকনো চেহারা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললাম,
‘ আপনি কেনো বাসায় যাননি?আপনাকে দেখতে খুব ক্লান্ত লাগছে।’

দুর্জয় ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
‘ ক্লান্ত দেখালেও আমি একদম ফিট আছি।আর তোকে এখানে ফেলে আমি বাসায় যাব ভাবলি কি করে?’

‘ দেখুন আমিও এখন ফিট আছি।আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে অফিস থেকে চলে এসেছেন।গায়ে এখনো ফরমাল ড্রেস।আপনি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন কাল সকালে না হয় আসবেন।’

‘ চুপ থাক! আমাকে তুই কেনো অর্ডার দিবি?অর্ডার দেওয়ার কাজ আমার।কাল তোকে রিলিজ না দেয়া পর্যন্ত আমি হসপিটালেই থাকব।বুঝলি?’

এমন ধমক শুনে আমার মুখ কালো হয়ে গেল।আমি উনাকে কোথায় অর্ডার দিলাম আজব।ভালোর জন্য বলতে গেছি উল্টো আমাকেই কথা শোনাচ্ছে।এজন্যই বলে দুনিয়াতে কারো ভালো চাইতে নেই। হাড়ে বজ্জাত লোক একটা।
উনার দিকে একঝলক কড়া চাহনি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম।যা ইচ্ছা করুক।
হঠাৎ উনি হ্যাঁচকা টানে আমাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন।এমন কান্ডে আমি পুরো থ।অটোমেটিক চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেল।বামপাশের হৃদপিণ্ডটা যেন বলের মত লাফাতে আরম্ভ করল।শরীরের রক্তচলাচল স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুন হয়ে উঠছে।আমি একটু নড়েচড়ে উঠতে উনার হাতের বাঁধন আগের চেয়ে শক্ত হয়ে গেল।একি জ্বালা!
আমার ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টি বারবার বন্ধ দরজার দিকে চলে যাচ্ছে এই বুঝি কেউ এসে গেল।

‘ আমি তোর সাথে থাকতে চাই প্রতিটা সেকেন্ড,প্রতিটা মিনিট! তোর ভালো সময় খারাপ সময় দুটোরই আমি সঙ্গী হতে চাই।প্লিজ থাকতে দে আমায় পূর্ণতা!তোকে ছাড়া আমি কিচ্ছু বুঝি না।আমার জীবনে যত সমস্যাই আসুক না কেনো আমি তা তোয়াক্কা না করে মেনে নেব কিন্তু তোর ব্যপারে আমি দুর্বল হয়ে যাই। তোকে হারানোর ভয় আমাকে প্রত্যেক মুহূর্তে ঘিরে রাখে।প্রতিদিন তোকে একটা বার সুস্থভাবে হাসিখুশি দেখা আমার নিত্যদিনের কাজ।আজ তোকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে কতটা ভয় পেয়েছিলাম জানিস?’

দুর্জয় ভাইয়ার কথাগুলো সম্মোহনের মত শুনে যাচ্ছি আমি।আমাকে নিয়ে উনার মনে যে ভয় আছে তা উনার কন্ঠ জানান দিচ্ছে স্পষ্টভাবে।কিন্তু ভয়টা আসলে কি নিয়ে?আমি এখনো উনার দুই হাতের মাঝে বন্দী।এমনভাবে আগলে রেখেছেন যেন এই দুনিয়া থেকে লুকিয়ে আমাকে উনার বুকের ভেতর আবদ্ধ করে রাখতে চাইছেন।

‘ আমি একজনকেও ছাড়বো না।যাদের জন্য তোর আজ এত কষ্ট পেতে হচ্ছে তাঁদের চরম শাস্তি দেব আমি।শুধু একটু সুযোগের অপেক্ষা! ‘

উনার কন্ঠে এবার কাঠিন্য প্রকাশ পেল।একটু আগে কথায় যেমন মুগ্ধতা ছিল সেটা এখন আর নেই।কিন্তু উনার কথাগুলো একটাও আমার মনপুত হয়নি।আস্তে করে বললাম,

‘ আপনি বিনাকারণে এমন রাগ দেখাচ্ছেন।আমার এক্সিডেন্টের জন্য আপনি কাদেরকে দায়ী করতে চাইছেন জানি না তবে এটা বলতে পারি আপনার সন্দেহ ভুল।আমার কষ্ট পাওয়ার পেছন করো হাত নেই।আপনি কি কিছু জানেন না! সেদিন ভার্সিটি যাওয়ার পথে একটা ট্রাক ধাক্কা মেরেছিল আমায়।পরে জানা গেছে ওটা ব্রেকফেল ছিল।ট্রাকের ড্রাইভারও আহত হয়েছে।এখানে কারো হাত নেই।যেটা হওয়ার ছিল সেটা হয়েছে।’

দুর্জয় ভাইয়া কিছুক্ষণ নীরব রইলেন।এরপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে চুমু খেয়ে বললেন,
‘ ঠিক আছে মেনে নিলাম তোর কথা।এখন তুই চুপচাপ রেস্ট নে আমি এক্ষুনি আসছি।বাইরে গিয়ে আম্মুকে পাঠিয়ে দেব।’

দুর্জয় ভাইয়া চলে গেলেন।আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলাম।আমার মনে হলো উনি আমার কথাগুলো একপ্রকার এড়িয়ে গেলেন।অথবা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করেছেন।উফ্ এই লোকটার মনে যে কি চলে কিচ্ছু বুঝতে পারি না।ভেতরে ভেতরে কি খিচুড়ি পাকাচ্ছে কে জানে!

দুর্জয় ভাইয়া বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই খালামণি চলে আসলেন।খালামণির চেহারায়ও অবসাদের ছাপ।আমার জন্য চিন্তা করতে করতে সবার এই হাল হয়েছে বুঝি!
খালামণি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ শরীর এখন কেমন রে?আর কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো!’

‘ আমি একদম সুস্থ খালামণি।তুমি আগে বলো মায়ের কি অবস্থা? দুর্জয় ভাইয়া বলল মা নাকি অসুস্থ হয়ে গেছিল!’

‘ আমি তোদের বাসায় ফোন দিয়েছি।তোর আব্বু বলে কয়ে তোর মাকে ঘুম পাড়িয়েছে।আসলে তোকে নিয়ে তোর মায়ের চিন্তাটা বরাবরই একটু বেশি তাই সামান্য কিছুতেও ঘাবড়ে যায়।’

‘ জানো খালামণি আমাকে নিয়ে তাঁদের ভয় দেখলে ভীষণ খারাপ লাগে।মাঝেমাঝে কান্না পায়।তাঁদের মন থেকে ভয়ের রেশ কাটছে না কোনোভাবেই।’

খালামণি আমাকে বুকে জড়িয়ে বললেন,
‘ কান্নার কি আছে হুম?অসুখবিসুখ হয় না মানুষের?তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি দেখিস।আর বাবা-মা হিসেবে তাঁদের ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক তাই না!সময়ের সাথে সাথে কেটে যাবে ভয়টা দেখিস।’

তখনই ইমন ভাইয়া ঢুকলেন রুমে।পেছন পেছন দুর্জয় ভাইয়া এবং সাদা এপ্রোন পরিহিত ডক্টর।
ডক্টর এসে চেকআপ করে বললেন,
‘ এখন বিপদমুক্ত। তবে ব্যথাটা হতে পারে যখনতখন। আশা করি আজকের মত এমন তীব্র হবে না।যে মেডিসিন গুলো দেওয়া হয়েছে নিয়মিত খেতে হবে কিন্তু। ‘

ডক্টরের কথায় মাথা দুলিয়ে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম।এরপর মেডিসিন।এই মেডিসিন বোধ হয় সারাজীবনেও পিছু ছাড়বে না আমার।দিনের পর দিন এগুলো খেতে খেতে তিতা ত্যক্ত হয়ে গেছি আর এখন তো আরো কতগুলো যোগ হয়েছে।ঠেলা সামলাও পূর্ণী।

.

মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে সকালে ঘুম ভাঙলো।চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসলাম।রিংটোনের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি সোফায় খালামণি ঘুমিয়ে আছে।টেবিলে রাখা খালামণির ফোন বেজে চলেছে নিজের মত কিন্তু খালামণির হুঁশ নেই।আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলাম।নিশ্চয়ই কালরাতে খালামণি ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি যারজন্য ফোনের শব্দেও উঠছে না।
বিছানা ছেড়ে নামতে যাব এমন সময় দুর্জয় ভাইয়া ঢুকলেন।অবাক হয়ে গেলাম পুরো। উনাকে রাতে যে পোশাকে দেখেছি এখনো সেইভাবেই আছেন।আশ্চর্য উনি সারারাত কোথায় ঘুমিয়েছেন?চোখদুটোও লাল লাল।

‘ আপনি সত্যি সত্যি কাল রাতে বাসায় যাননি?’

দুর্জয় ভাইয়া ওষুধপত্র ঘাটতে ঘাটতে নির্বিকারভাবে বললেন,
‘ দেখতেই তো পাচ্ছিস। সত্যি সত্যিও যাইনি নকলে নকলেও যাইনি।’

উনার কথায় হতাশ হলাম।কি দরকার ছিল রাতে থাকার?যাই হোক আমি কিছু বলব না বললে উল্টো আমাকেই কথা শুনতে হবে।বসে বসে নিঃশব্দে উনার কাজকর্ম দেখছি।যন্ত্রের মত সব মেডিসিন একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে চলেছেন।
কাজ শেষে আমার সামনে এসে হুট করে গালে একটা চুমো খেয়ে বললেন,
‘ ফ্রেশ হয়ে আয় বাসায় যেতে হবে।আমি একটা জরুরি কল করে আসছি।’

উনি চলে যেতেই আমি সর্বপ্রথম খালামণির দিকে তাকালাম।এখনো গভীরভাবে শ্বাস উঠানামা করছে।এদিকে ভয়ের কারণে আমার বুকও ধরফড় করছে।ভাগ্যিস খালামণি গাঢ় ঘুমে আছে।ভয়ানক লোক একটা কখন কি করে বসে আগে থেকে টের পাওয়া যায় না।

চলবে…

[ কিছুদিন গল্প দিতে পারব না।আমাকে অন্য একটা কাজে মনযোগ দিতে হবে তাই।😐]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here