তোর অপেক্ষায় পর্ব-২০

0
408

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২০

দুর্জয় ভাইয়া ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন।আমি অবাক হয়ে দেখছি উনাকে।মনের সমস্ত রাগ হঠাৎ কোথায় উবে গেল।এতক্ষণ রাগের বশে উনাকে কতগুলো জঘন্য শুনিয়েছি তার বদলে এত শান্ত থাকছেন কিভাবে?
উনি হাসির রেখা আরো চওড়া করে বললেন,
‘ সকল প্রেমিকদের মতো আমিও বলব রাগলে তোকে সুন্দর দেখায়।’

বলেই আমার নাক টেনে দিলেন।আমি ভড়কে গেলাম।উনি হাসিহাসি মুখ করেই বের হয়ে গেলেন।অথচ আমি স্পষ্ট টের পেয়েছি উনার হাসির আড়ালেও একটা বিষাদের ছাপ। আমার কথাগুলো বোধ হয় উনাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।আমিই বা কি করতাম!অতিরিক্ত রাগের বশে পুরো ধুয়ে দিয়েছি উনাকে।তবে রাগটা তো স্বাভাবিক ছিল।

কিছুক্ষণ পর সুহানা আপু হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে এসে ঢুকল।আমাকে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘ স্যরি বোন।দুর্জয় ভাইয়া তখন বলেছিল তোকে যেন আমার রুমে নিয়ে আসি।ভাইয়ার কথার পিঠে না করার কোনো চান্স ছিল না।বুঝতেই পারছিস ভাইয়াকে দেখলেই আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।কারণটা নিজেও জানি না।’

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ কিন্তু মা কেনো ভাইয়াকে ডাকতে গেল?অযথা একটু আগে এখানে একটা সিনক্রিয়েট হয়েছে।ধ্যাত।’

‘ চাচী কেনো ভাইয়াকে ডাকবে?দুর্জয় ভাইয়া তো এসেছিল ইমন ভাইয়ার কাছে।কি যেন দরকার ছিল।দুর্জয় ভাইয়াকে দেখতে পেয়েই চাচী তোর কর্মকান্ড সম্পর্কে ডিটেইলস বলে দিয়েছে।চাচী তখন অনেক রেগেছিল তো তাই।’

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।তারমানে মা উনাকে ডাকেনি।হায় আল্লাহ আমি শুধু শুধু উনাকে এতগুলো কথা শুনালাম।না জানি কত কষ্ট পেয়েছে লোকটা।একটা বারের জন্যও আমার ভুলটা ভেঙে দিল না!নিজের কাছে নিজেই খুব ছোট হয়ে গেলাম।

‘ তুই কথা বলছিস না কেনো রে?’

সুহানা আপু দিকে করুণ চোখে তাকালাম।একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা ধীরে ধীরে খুলে বললাম।সব শুনে আপু গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ এটা খুবই অন্যায় হয়ে গেল।না জেনে বুঝে কাউকে অপমান করা ঠিক না।দেখ বাড়ির সবাই তোকে প্রচন্ড ভালেবাসে বলেই তোর প্রতি তাঁদের ভয়ের মাত্রাটা বেশি।দুর্জয় ভাইয়াও তেমনি তোকে ভালোবাসে।হয়তোবা নিজের চেয়েও বেশি।তাই তোকে নিয়ে যথেষ্ট ভয়ে থাকে।ভয়ের কারণটাও অজানা নয়।আচ্ছা বুঝলাম ভাইয়া তোর উপর নিজের আদেশ চাপাতে চেয়েছে কিন্তু তুই তো জানিস উনি কতটা ভালোবাসে তোকে।আরে বোকা এর দ্বারাই তো তুই উনাকে সহজে মানাতে পারতিস।তা না করে রেগেমেগে অস্থির।ভাইয়ার জায়গায় আমি থাকলে তোকে মাথায় তুলে আছাড় মারতাম।ভাইয়া কিন্তু কিছুই করেনি।’

আপুর কথা শুনে অনুতাপের মাত্রাটা আরো বেড়ে গেল।একধরনের অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে শরীরে।মানুষটাকে সত্যিই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।কি হবে এখন?কিভাবে উনার সামনে যাব?

‘ আপু কি হবে এখন?আমার তো সারারাত ঘুম আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না উনাকে স্যরি বলতে পারি।’

সুহানা আপু হাত নেড়ে বলে উঠল,
‘ শান্ত হ শান্ত হ।সমস্যার সমাধান আছে আমার কাছে।’

আমার অশান্ত চেহারায় শান্তির ছায়া নেমে আসলো।উৎসুক হয়ে আপুর দিকে তাকাতেই বলে উঠল,

‘ ভালোবাসার মধ্যে রাগ-অভিমান,ভুল বুঝাবুঝি ভালোবাসা দিয়েই মিটাবি।’

‘ মানে?’

‘ অদ্ভুত মেয়ে তো তুই!এত সহজ এবং সুন্দর একটা কথা তোর মাথাতে ঢুকছে না?এদিকে আয় তোর মাথায় দুটো টুকা মেরে দেই।’

আপুর ঠোঁটে মুচকি হাসি।আমার কুঞ্চিত ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে গেল।হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে আপুও নিশ্চিত হলো আমি কথাটার মানে ধরতে পেরেছি।
মনের খুশিতে আপুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘ হিমু ঠিকই বলে আমার এই জঞ্জাল মাথাকে কেটে ফেলে দিতে হবে।’

______________________________

খুশির বার্তা আসলো রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে।মা বাবা দুজনই রাজি আমার পিকনিকে যাওয়ার ব্যাপারে।আমি খুশির চোটে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইলাম।কিন্তু পরক্ষনেই গপাগপ ভাত গিলতে লাগলাম।হিমুসহ বাকিরা উৎসুক হয়ে বসে আছে আমার খবরটা শোনার জন্য। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে।
তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে ভাত গলায় আটকে কাশি উঠে গেল।বিনিময়ে মায়ের কাছ থেকে সুমিষ্ট এক ধমক খেয়ে ফেলেছি।তাতে কি।আমার অবস্থা তো এখন বিনা পরিশ্রমে সোনার হরিণ দেখা পাওয়ার মত।

খাওয়া শেষে রুমে যাওয়ার আগে সুহানা আপু আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল সবকিছুই দুর্জয় ভাইয়ার জন্য সম্ভব হয়েছে।কথাটা সত্যি।উনি কি বলে বুঝিয়েছেন যে এত সহজে মা মেনে নিল?যাই হোক এটা বড় বিষয় নয়।বড় বিষয় হলো অবশেষে আমি পিকনিকে যাচ্ছি। ইয়াহু!

আনন্দের খবরটা বন্ধুমহলের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।আবছা অন্ধকারে চিনি মিনি বেশ আয়োজন করে ঘুমোচ্ছে।ওদের আর ঘাটাতে মন চাইল না।আশেপাশের রাস্তাঘাট এখন নিস্তব্ধ। মাঝেমাঝে দু চারজন পথচারী হেঁটে যাচ্ছে। আকাশে চাঁদের আলো না থাকলেও বেশ পরিষ্কার।সেখানে অসংখ্য ছোট ছোট তারা মিটমিট করে জ্বলছে।চমৎকার একটা পরিবেশ!

ফোনে দুর্জয় ভাইয়ার নাম্বার বের করে ডায়াল করলাম।সময় এখন বারোটার কাছাকাছি। বারোটা বাজার আগেই উনি ঘুমিয়ে যাবেন এটা মোটেও আশা করছি না।দুবার রিং বাজতেই দুর্জয় ভাইয়া রিসিভ করলেন।আমি অত্যন্ত মিষ্টি কন্ঠে বলতে চেষ্টা করলাম,

‘ ঘুমিয়ে গেছেন নাকি?’

ফোনের ওপাশ থেকে খাতাপত্র উল্টানোর আওয়াজ পেলাম।তাহলে ঘুমাননি এখনো।যাক ভালোই হলো।তখনের ব্যবহারের জন্য সুন্দরভাবে স্যরি বলা যাবে।দুর্জয় ভাইয়া হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ ঘুমাইনি।কেনো তুই আসবি নাকি?’

আমি প্রশ্নের ধরণ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ আমি কেনো আসবো?’

‘ ঘুমাতে।আমার সাথে ঘুমাতে আসবি।’

‘ আশ্চর্য আমি একথা কখন বললাম?আপনি ক বলতেই কলকাতা বুঝে নিচ্ছেন কেনো?’

‘ তাই বুঝি?এত রাতে ফোন দেওয়ার কারণ কি জানতে পারি?ক আর কলকাতার পার্থক্য বুঝাতে নিশ্চয়ই ফোন দিস নি!’

দুর্জয় ভাইয়ার কথার ধাঁচ আমার মোটেও ভালো লাগল।উনি মনে এখনো কষ্ট পুষে রেখেছেন।ইস্ তখন এতটা কঠিন ব্যবহার না করলেও চলতো।কিন্তু উনার কথার উত্তরে কি বলবো সহসা খুঁজে পেলাম না।ভয় ভয় লাগছে।যদি আবার রেগে যায়?

‘ কথা বলছিস না কেনো? সিম কোম্পানি তোকে আনলিমিটেড অফার দিয়েছে নাকি আজ?’

আমি আবারো চুপ।কি করে উনার রাগ ভাঙানো যায় সেটা ভাবতে ভাবতেই সময় কেটে যাচ্ছে। সুহানা আপু বলেছে ভালোবাসায় রাগ অভিমান ভালোবাসা দিয়েই মিটাতে হবে।ভালেবাসার কোন উপায়টা অবলম্বন করলে উনার অভিমান চুরমার হবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।

‘ পূর্ণতা আমি ফোন রাখছি।আরো চার-পাঁচটা ফাইল চেক করার বাকি আছে।তুই…’

‘ আপনাকে খুব মিস করছি।এতটাই যে বলতে ইচ্ছে করছে আপনি কি আসবেন? এখন এই মুহূর্তে?আমি বারান্দায় অপেক্ষা করছি।’

দুর্জয় ভাইয়ার মধ্যে পিনপতন নীরবতা।খাতাপত্র উল্টানোর আওয়াজও আর পাচ্ছি না।আমার মিনি সাইজের হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করছে।একটু আগের কথাগুলো কিভাবে যেন মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না।আমি তো এগুলো বলতে চাইনি।বিকেলে উনাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছি আর এখন বলছি মিস করছি।এ যেন জুতা মেরে গরু দান।নিশ্চয়ই আমাকে এখন ধমকে ধমকে আধমরা করে ফেলবে এই লোক।

দুর্জয় ভাইয়া অতি স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলেন,
‘ রাত ক’টা বাজে খেয়াল আছে?আমাকে কি ক্লাস নাইন টেনে পড়ুয়া আবেগী প্রেমিক মনে হয় যে প্রেমিকা ডাকবে আর আমি সব ছেড়েছুড়ে দৌড়ে যাব?কালকে ক্লাস আছে না তোর?ফোনটা রেখে ঘুমাতে যা।’

অপর পাশ থেকে আবারো নীরবতা টের পেতে ফোনটা সামনে এনে দেখলাম দুর্জয় ভাইয়া সত্যি সত্যি কল কেটে দিয়েছেন।তাজ্জব ব্যপার!উনার রাগ ভাঙানোর জন্য আমি মনের সাথে যুদ্ধ করে এত আবেগ নিয়ে সুন্দর একটা রোমান্টিক কথা বললাম আর উনি পাত্তাই দিল না।আমিই একটু বেশি ভালোমানুষী দেখাতে গেছি।আসলে উনি তো প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে।তখনকার কথাগুলোর জন্য আমার উপর প্রতিশোধ নিল আর কি।থাক তুই তোর প্রতিশোধের আগুন নিয়ে।জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যা।আমি ঢু মারতেও যাব না।

বারান্দার গ্লাস আটকে পর্দা ফেলে দিলাম।একটা উজবুকের সাথে কথা বলে বৃথা সময় নষ্ট করাতে বড্ড আফসোস হচ্ছে।মেজাজও খারাপ হচ্ছে ধীরে ধীরে।ঝটপট বিছানা গুছিয়ে এসে শুয়ে টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলাম।পুরো রুম ছেঁয়ে গেল অন্ধকারে।মাথার পাশের খোলা জানালা দিয়ে হালকা বাতাস প্রবেশ করছে।জানালার পর্দাগুলো কাঁপছে মৃদুভাবে।সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ লেগে আসলো।এমন সময় বারান্দা থেকে চিনি মিনির কর্কশ আওয়াজ শুনে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।ওরা এভাবে ডাকছে কেনো?কান খাড়া করতেই পাখা ঝাপটানির আওয়াজও শুনতে পেলাম।আশ্চর্য ওরা কি কোনোকারণে ভয় পেয়েছে নাকি।এখনি দেখতে হবে আমাকে।
তড়িঘড়ি করে বারান্দার থাই গ্লাস সরাতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here