তুমি তাই পর্বঃ১০

0
3390

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১০

নিলির বিষয়ে সব তথ্য বের করার দায়িত্ব জাহিদের ওপর দিয়েছ ছিলো রেজোয়ান। আশানুরূপ অনেক কিছুই বের করেছে জাহিদ। এই যেমন, নিলির স্বামী মুবিন মারা যাওয়ার পর তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন সম্পত্তি বিক্রি করে দেশের বাইরে সেটেল হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে এখন আর নিলির কোন যোগাযোগ নেই, তিনবছর আগে পুলিশের গুলিতে নিলির ভাই নিহত হয়েছে ইত্যাদি নানারকম খোঁজখবর।

তাঁর মুখ থেকে সব শুনে গম্ভীর মুখে বসে রইলো রেজোয়ান। নিলি যে আর্থিক সংকটে আছে সেটা ও আগেই বুঝতে পেরেছিলো। এমনি এমনি তো আর তাঁর অফিসে চাকরী করতে আসে নি? তাও আবার সামান্য একটা ক্লার্কের চাকরী।
কিন্তু একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজামউদ্দিন সাহেবের এমন দুরবস্থা হলো কি করে? তিনি তো বেশ ভালোই অবিস্থাসম্পন্ন লোক ছিলেন।

নিলির কথা জিজ্ঞেস করলো ,’তার খোঁজ পেয়েছো? কোথায় এখন সে?’

-‘এখনো সেরকমভাবে কিছু জানা যায় নি স্যার। তবে শুনেছি রেজা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক মি.রেজা নাকি উনাকে তাঁর পি.এস এর পোস্টে যোগ দেওয়ার জন্য অফার করেছেন।’

অবাক হলো রেজোয়ান। কিছু দিন আগেই তাঁদের কম্পানীর সঙ্গে রেজা গ্রুপের একটা স্ক্যান্ডাল হয়েছে। এরই মধ্যে মি.রেজা কি করে নিলিকে এমন অফার দিতে পারে? এর মানে কি? ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ? হতেও পারে। ইনরফরমেশন চুরি করার অভিযোগে ব্যবিসায়িক সমিতি থেকে সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে রেজার। কিন্তু তার সঙ্গে নিলির কি সম্পর্ক?

চিন্তিত মুখে জাহিদের দিকে একঝলক চাইলো সে। জাহিদ ইতস্তত করে বললো,’মিসেস নিলি বোধহয় অফারটা এক্সেপ্ট করবেন স্যার। স্যালারি ভালোই দেবে শুনেছি। কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না এতে করে রেজা গ্রুপের লাভটা কি হলো? মিসেস নিলি মাত্র অল্প কিছুদিন আমাদের এখানে কাজ করেছেন। উনার পক্ষে এই অল্প সময়ে কম্পানীর সমস্ত প্রটোকল ঠিকমত বোঝাও সম্ভব নয়! তাহলে ওরা মিসেস নিলিকে কেন হায়ার করছেন?’

-‘আমিও তো সেটাই ভাবছি। কোন একটা কারণ তো অবশ্যই আছে। এমনি এমনি তো আর রেজা গ্রুপ সিদ্ধান্তটা নেয় নি?’

বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলো জাহিদ এবং রেজোয়ান। কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারলো না। জাহিদকে নিলির ওপর নজর রাখতে বলে দিলো রেজোয়ান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাপারটা জানা চাই। বল যায় না কখন কোন ঝামেলা এসে আবার উপস্থিত হয়ে যায়।

জাহিদের সঙ্গে আলোচনা শেষে নিজের রুমে বসে একা একা নিলির কথা ভাবছিলো রেজোয়ান। নিলির সঙ্গে মি.রেজার কোন পূর্বপরিচয় থাকার কথা নয়। তাহলে ঠিক কোন সূত্র ধরে নিলিকে তিনি চাকরীটা অফার করেছেন? আসল উদ্দেশ্যটা কি? রেজোয়ান? কিন্তু নিলির মাধ্যমে?…সেটা কীভাবে সম্ভব?
ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো মাথায়। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠতে চমকে গেলো। অপরিচিত নাম্বার! রিসিভ করলো রেজোয়ান।

ফোন রিসিভ করতেই মি.রেজা প্রথমে তাঁর পরিচয় জানালেন। রেজোয়ান ভেতরে ভেতরে চমকে গেলেও ভদ্রতাসূচক হেসে বললো,’কি খবর মি.রেজা? হঠাৎ আমার কথা মনে পড়লো যে?’

অপরপাশ থেকে রেজাও হাসিমুখে জবাব দিলো,’এখন তো আপনার কথাই বেশি মনে পড়বে ভাই। শেষ সম্বল যে আপনার হাতেই তুলে দিয়েছি।’

মি.রেজা স্পষ্টত ক্ষতিপূরণের টাকার দিকেই ইঙ্গিত করছেন। রেজোয়ান সেটা বুঝতে পেরে অট্টহাসি দিয়ে বললো,’বড় বড় কম্পানীর মালিকেরা এসব বললে আমার মত অভাগাদের উপায় কি? আমরা তো আপনাদের ওপরেই নির্ভরশীল।’

-‘এসব আপনার বিনয়!’

-‘সত্যি বলছি। আপনার সঙ্গে কি আর আমার তুলনা হয়?’

-‘তা জানি না। কিন্তু টাকাটা যে এবার ফেরত দিতে হয় ভাই?’

-‘মানে?’

-‘মানে টাকাটা আপনাকে ফেরত দিতে হবে। সেই সঙ্গে আরো হাফ বিলিয়ন আমার অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে।’

রেজোয়ান তাঁর কথার আগাগোড়া কিছু বুঝতে না পেরে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললো,’আপনি তো দেখছি বেশ ভালোই ঠাট্টা করেন।

ক্রুর হাসলো রেজা। অত্যাধিক মোলায়েম কন্ঠে বললো,’আপনাদের দুজনকে কিন্তু বেশ ভালোই মানায় মি.মুরসালীন। আমি তো চোখই ফেরাতে পারছিলাম না। দারুণ প্রেম ছিলো বোধহয় আপনাদের তাই না? আমি কার কথা বলছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই? আমি আপনার আর আমার সুন্দরী পিএস মিসেস নিলির কথা বলছি।’

বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো রেজোয়ান। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। কি থেকে কি ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে ন। এদিকে রেজা চুপ করে নেই। ক্রমাগত বলে যাচ্ছে,’মিসেস নিলি বোধহয় ছাত্রজীবনে খুব সুন্দরী ছিলেন? দারুণ ফিগার, একেবারে আগুন! আমিও একটা সুযোগ নেবো ভাবছি।’

চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রেজোয়ানের। বদমাশটার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে মন চাইলো। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় ঢুকছিলো না। ছবিগুলো তাঁর নিজস্ব ল্যাপটপের খুবই গোপন ফোল্ডারে সেইভ করা ছিলো। সেগুলো রেজার হাতে গেলো কী করে?

রেজা তাঁর মনের কথা বুঝতে পেরে বললো,’সেদিন মিটিংয়ে আপনি ভুল করে ল্যাপটপ রেখে প্রায় দশ মিনিটের মতন বাইরে গিয়েছিলেন? অ্যাম আই রাইট?’

-‘আপনি আমার ল্যাপটপ হ্যাক করেছেন?’

-‘করে খুব একটা লাভ হয় নি। ভেবেছিলাম কম্পানীর কিছু গোপন তথ্য পাবো কিন্তু শেষমেশ দেখলাম পুরো ল্যাপটপই আপনার প্রেমের স্মৃতি দিয়ে ভরা।’

-‘হাউ ক্যান ইউ বি সো চিপ মি.রেজা? আই ডিডন্ট এক্সপেক্ট দিজ ফ্রম ইউ! আপনি তো মেন্টালি সিক!’

রেজোয়ানের কথা গুলো গায়েই মাখলো না রেজা। উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। একশো কোটি টাকার জন্য একটু আধটু কথা শোনাই যায়। হাসি থামিয়ে বললো,’আপনি টাকাটা কবে পাঠাবেন মি.মুরসালীন?’

-‘এক পয়সাও দেবো না।’

-‘আপনি পাঠাবেন মি.মুরসালীন।’

-‘যদি না পাঠাই?’

-‘সেটা অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু আমি আপনাকে পাঠানোর জন্য সাজেস্ট করবো। আফটার অল ব্যবসায়িক মহলে আপনার একটা রেপুটেশন আছে। হঠাৎ করে পুরাতন প্রেমিকার সঙ্গে এসব ছবি ভাইরাল হলে বুঝতেই তো পারছেন….এই দেশে মানুষ তিলকে তাল বানায়। এমনও তো হতে পারে সবাই ভাবলো আপনার সঙ্গে মিসেস নিলির অবৈধ কোন সম্পর্ক আছে। আই মিন পরকীয়া, তাই আপনারা দুজন মিলে মুবিন তালুকদারকে খুন করেছেন। নানারকম পুলিশি ঝামেলা….সেটা কি ভালো হবে?’

এমন নোংরা কথাবার্তা শুনে কপালের শিরা দপদপ করে উঠলো রেজোয়ানের। সে ভাবতেই পারে নি রেজার মত একজন শিক্ষিত মানুষের মনমানসিকতা এত জঘন্য হতে পারে। খুন করতে মন চাইলো কুলাঙ্গারটাকে। তথাপি দাঁতেদাঁত চেপে সহ্য করে নিলো।

রেজে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে মি.মুরসালীন, মিসেস নিলির বিষয়টা থাক। উনার সঙ্গে যেহেতু এখন আর আপনার কোন সম্পর্ক নেই তাই উনাকে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। আপনি বরং ক্ষতিপূরণের টাকাটা পাঠিয়ে দিন। আমি ছবি ব্লার করে দেবো। আপনাকে কেউ চিনবে না।’

আন্দাজেই ঢিলটা ছুঁড়লো রেজা। তাঁর ধারণা রেজোয়ান এই প্রস্তাবে রাজি হবে না। নিলির প্রতি এখনো যথেষ্ট ফিলিংস আছে তাঁর। নতুবা এতদিন পর্যন্ত ল্যাপটপে ছবিগুলো রাখার কোন মানেই ছিলো না। নিলির বিয়ের পরই ডিলিট করে দিতে পারতো। কিন্তু খুব যত্ন করে ছবিগুলো গোপনে লুকিয়ে রেখেছে রেজোয়ান। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে নিলির কথা ভেবেই রেজোয়ান এখন পর্যন্ত কোন রিয়েক্ট করছে না। নইলে আরো আগেই চিৎকার চেঁচামেচি করে এক অবস্থা হতো।

তাঁর চিন্তাভাবনা ছেদ ঘটালো রেজোয়ানের শান্ত, গম্ভীর কন্ঠস্বর, ‘তাঁকে এক্সপোজ করে আপনার লাভ?’

-‘কিছু না। জাস্ট একটু মজা নেবো!’

দাঁতেদাঁত দাঁত ঘষলো রেজোয়ান। মেজাজ শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,’ঠিক আছে কালকে সন্ধ্যা আগেই টাকা পেয়ে যাবেন। কিন্তু ছবিগুলো ডিলিট করতে হবে।’

-‘হয়ে যাবে।’

-‘হাউ ক্যান আই আই ট্রাস্ট ইউ?’

-‘ইট’স আ ডিল। সো ইউ হ্যাভ টু!…বস্তুত আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আপনার হাতে আর কোন উপায় নেই। ইউ হ্যাভ নো চয়েস।’


রেজার ফোন রাখতেই জাহিদকে নিজের রুমে ডাকলো রেজোয়ান। জাহিদ ভেতরে ঢুকে সামনে চেয়ার টেনে বসলো। নিলির সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা তাঁকে খুলে বললো রেজোয়ান।

সব শুনে খুব বেশি চমকালো না জাহিদ। নিলির সঙ্গে যে রেজোয়ানের আগে থেকেই একটা সম্পর্ক আছে সেটা প্রথম দিন দেখেই বুঝে গিয়েছিলো সে। কিন্তু এতদিন ভয়ে জিজ্ঞেস করার সাহস পায় নি। সব শেষে রেজোয়ান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তাঁর দিকে,

-‘তোমার কি মনে হয় জাহিদ? ও সত্যি সত্যি চাপের মুখে পড়ে মুবিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো?’

-‘বুঝতে পারছিনা স্যার। তবে আমার মনে উনি সত্যি বলছেন।’

তাঁর জবাবটা রেজোয়ানকে ঠিক আনন্দ দিলো না কি দুঃখ দিলো বোঝা গেলো না। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে। বেশকিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর পুনরায় সোজা হয়ে বসলো। এইবার রেজার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সময়।

রেজার হুমকির কথা শুনে টাকা না দেওয়ারই পরামর্শ দিলো জাহিদ। কারণ টাকাটা দিলে হিউজ লসের মুখে পড়ে যাবে রেজোয়ান। সবে মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে কম্পানী। এরই মধ্যে এতগুলো টাকার ধকল কম্পানীর জন্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

রেজোয়ানকে নির্লিপ্ত দেখে উদ্বিগ্নস্বরে বললো,’ওয়ান বিলিয়ন ইজ নট আ স্মল অ্যামাউন্ট স্যার! কম্পানীর জন্য এই লস ক্যারি করা টাফ হয়ে যাবে।’

সম্মতি সূচক মাথা দোলালো রেজোয়ান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’তোমার চিন্তাটা আমি বুঝতে পারছি জাহিদ। কিন্তু সম্মানের দিকটাও তো দেখতে হবে?’

-‘কিন্তু স্যার…’

-‘ছবিগুলো খুব বেশি যে ইন্টিমেট তেমন না। আবার একেবারেই যে ইন্টিমেট নয় তেমনও নয়। ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির এবং সিচুয়েশনের ওপর নির্ভর করেছে। কে কীভাবে নেবে সেটা তাঁর চয়েস। কিন্তু সমস্যা একটাই, ধরো কোনভাবে ছবিগুলো এক্সপোজ হয়ে গেলো, মানে রেজাই এক্সপোজ করলো তখন কিন্তু সবাই জাজমেন্টাল হয়ে যাবে। ব্যাপারটা তখন আর পজিটিভ থাকবে না। নেগেটিভলিই নেবে সবাই। সত্যিটা খতিয়ে দেখবে না। কারণ একবার যদি কোনকিছু নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যায় তখন মানুষ সেটাকেই সত্যি মনে করে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here