আমার পুতুল বর পর্ব: ৭+৮
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
চারপাশে সবুজ ঘাসের বিস্তৃতি। মাটিতে সবুজের সমারোহ আর আকাশে নীল রঙের মেলা। এর মাঝে একদল যুবক যুবতী বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। মেহে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চুপচাপ বসে আছে, আরশি ও চুপ করে আছে। সুজানা ওদেরকে চুপ থাকতে দেখে আলতো করে ধাক্কা দিলো।
~ কিরে কি ভাবছিস এতো?? বেড়াতে এসে এমন চুপচাপ থাকলে হয় নাকী?? কিছু কি হয়েছে?
আরশি আর মিহি দুজনেই মুচকি হেসে মাথা নাড়লো।
~ না আপু কোনো সমস্যা নেই আসলে পরিবেশ টা এতটা স্নিগ্ধ আর শান্ত যে চুপ করে অনুভব করতে বেশ ভালো লাগছে।( আরশি)
~ হ্যাঁ আপু একদম ই তাই।( মিহি)
~ আচ্ছা!! হয়েছে আর একা একা উপভোগ করতে হবে না আমাদের সাথে গল্প কর l
~আচ্ছা। ( মিহি )
মিহি আড়চোখে রেহানের দিকে তাকালো চোখে চোখ পড়তেই চোরের মত চোখ সরিয়ে নিলো। আজ ওরা সবাই মিলে বেড়াতে এসেছে। রেহান, অভ্র ,নাহিদ সাথে সূর্যর বন্ধুবান্ধব। মিহির কালরাতে রেহানের সাথে কথা বলার পর থেকেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে রেহানের সামনে এখন এভাবে বসে থাকতে আর রেহান ও বারবার ওর দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসছে । আরশি মন খারাপ করে সূর্য আর ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে আছে। ন্যান্সি বারবার এটা ওটা বলে সূর্যের গায়ে ঢলে পড়ছে আবার জড়িয়ে ধরে ছবি ও তুলছে।
~ এই রোজ??
~ কি?
~ ন্যান্সিকে দেখ আজ ওর ভাব একটু বেরেছে মনে হচ্ছে। সূর্যর সাথে একটু বেশিই ঘেসছে।
~ ও কোনদিন এমন করে না বলবি?? এখানে আসার আগে সূর্য্য তো ওকে বলেছিলো এই দেশে এইসব মানায় না তাও ওর কোনো হেলদোল নেই। আর সূর্য্য কেনো যে কিছু বলছে না বুঝতে পারছিনা। আগে তো এমন করলে কড়া কথা শুনাতো।।।
~ ও কখন কি করে ও নিজেই জানে না।।। আমি না একটা জিনিস খেয়াল করেছি জানিস?
~আরশির ব্যাপারটা??
~ (চমকে) তার মানে তুই ও ওসব খেয়াল করেছিস!!
~হ্যাঁ মেয়েটাকে আসার পর থেকে দেখছি সূর্যকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। তার উপর ন্যান্সি যখন যখন সূর্যের কাছে যায় ওর মুখটা শুকিয়ে যায়, কালকে যখন সূর্য ওকে বকা দিয়েছিল মেয়েটার পুরো কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছিল। আজকেও দেখ!! সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে মন খারাপ করে।
~ হ্যাঁ আমার মনে হয় আরশি সূর্য্য কে পছন্দ করে!!
~ আমার তো মনে হয় ভালোবাসে।।
রিক আর রোজ দুজনেই চমকে সুজানার দিকে তাকালো।।।
~ মানে??
~আসলে আরশি ছোটবেলা থেকেই সূর্যের প্রতি দুর্বল আমি যতটুকু জানি ও সূর্যকে ওর পুতুল বর ভাবে।।
~হোয়াট কি?? পুতুল বর? ইউ মিন ডল হাসব্যান্ড?? এটা আবার কি??
~ এটা আরশির ছোট্ট মনের প্রথম অনুভূতির নাম। ও যখন ৩ বছরের ছিলো তখন সূর্য্য কে প্রথম দেখে। আমি তখন প্রায় খুব অসুস্থ থাকতাম বলে আমাদের বাড়িতে এসছিলো ওর মা বাবার সাথে আমাকে দেখতে। আমার সাথে ওর বেশ ভাব হয়ে গেছিলো। কারণ আমি ওকে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে পুতুল দিয়েছিলাম আর দুষ্টুমি করে বলেছিলাম জাদুর মাধ্যমে এনেছি তোর জন্য।। ও খুব খুশি হয়ে গেছিলো। এরপর থেকে আমাকে জাদু আপ্পি বলে ডাকতে লাগলো। সূর্যের সাথে যখন দেখা হয় তখন ওর বেশি একটা কথা বলেনি। ও বরাবরই এমন! খুব কম কথা বলে আর ওর এই কম কথা বলার জন্যই আরশি ওর কাছে যেতো না।। দূরে দূরে থাকতো।। ঐদিনের পর আরশি প্রায় ই পুতুল গুলো নিয়ে খেলতো । আমাদের জিজ্ঞেস করতো আপ্পি, খালামণি এই পুতুল গুলোর নাম কি?? আমরা বলতাম এইটা আরশি আর এটা আরশির বর। ও কিছু না বুঝে তাকিয়ে থাকতো। আর আমরা হাসতাম। একবার ওকে নিয়ে আমার ফ্রেন্ড এর ভাই এর বিয়েতে গেছিলাম তখন ওই বর বউ দের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করেছিল – এরা কারা? আর এভাবে বসে কি করছে??
~ এরা হচ্ছে বর বউ আর আজ এদের বিয়ে হচ্ছে।
~বিয়ে?? এটার মানে কি?
~উমমম এর মানে হচ্ছে মেয়েটা মানে বউ যে সে এখন থেকে সবসময় তার বরের সাথে থাকবে। যেমন তোমার আব্বু আম্মু এক সাথে থাকে। বুঝেছো??
~ এর মানে এক সাথে থাকলেই বর বউ হয়ে যায়??
~ না তার জন্যে আগে বিয়ে দিতে হবে ঠিক এদের মতো।।
~ ওহ আচ্ছা।।। আপ্পি আমার আরশি পুতুল আর ওর বর ও কি বিয়ে করতে পারবে??
~ (হেসে দিয়ে) হ্যাঁ খুব পারবে।
~ (খুশি হয়ে) তাহলেআমি ওদের বিয়ে দিবো।।।
~ আচ্ছা।।
তারপর ওর পুতুল বর বউ এর বিয়ে হয়ে গেলো। ও নিজে দিলো।
~ কিন্তু আপু আরশি সূর্যকে পুতুল বর ভাবে ! মানে কেনো??( রোজ )
~ কারণ সূর্য আরশির বর তাই।।
~ হোয়াট!!!!
~ কি বললে??
~কি হয়েছে রিক , রোজ তোরা এভাবে চিৎকার করছিস কেনো??( সূর্য )
রিক আর রোজ এখনো হতভম্ব হয়ে সুজানার দিকে তাকিয়ে আছে। ।
~ কিরে কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দে??
~ আসলে হয়েছে কি বলতো সূর্য আমি ওদের একটা পুতুল বউ আর বরের বিয়ের কাহিনী বলছিলাম।। ওরা আগে কখনো এমন কিছু শুনে নি তাই অবাক হয়ে গেছে। সূর্যের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। সুজানার দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।। এসব আজাইরা কাহিনী কই থেকে পাস??
~ সত্যিই আজাইরা সূর্য??
~বাজে বকা বন্ধ কর ঘুরতে এসেছিস ঐটাই কর।( হনহন করে চলে গেল )।।। রিক , রোজ আর সুজানা তিনজনই ওর যাবার পানে তাকিয়ে আছে। রিক আর রোজ এখনো সুজানার বলা কথাটা নিয়ে শকড হয়ে আছে। কি বললো আর কেনই বললো বুঝতে পারছে না।
~ আরশি??
~ হ.. হ্যাঁ??
~ কি হয়েছে তোমার এতো চুপচাপ?
~ না ভাইয়া তেমন কিচ্ছু না।
~ কিছুতো হয়েছে। বলতে না চাইলে জোর করবোনা। নাও বাদাম খাও। ( আরশির পাশে বসে )
~ আপনি খান।
~ উহুম খাও বলছি। ওয়েট আমি খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি। অভ্র বাদামের খোসা ছাড়িয়ে আরশি কে দিলো। আরশি আর কিছু না বলে খেয়ে নিলো। খাওয়ার মাঝে মাঝে অভ্রর কিছু কথা শুনে হাসছে। কিন্তু ও তো বুঝলই না ওর এই হাসি এক সাথে দুটি হৃদয়ের কম্পন বাড়িয়ে দিলো। একজনের মনে ভালোবাসা নামক সুখ খেলা করছে তো অন্যজনের মনে কিছু চাপা অনুভূতির যন্ত্রনা।
~ মিস লালামরিচ!! কি হাল চাল?
~ আব- আপনি? আপনি এখানে কেনো??
~ তুমি এখানে যে কারনে আমিও সেই কারনে।
~ মানে??
~ মানে তুমিও বেড়াতে এসেছ আর আমিও বেড়াতে এসেছি।।
~আমি তা বুঝাইনি । আমি জিজ্ঞেস করছি আমার এখানে কি??
~ তোমার বোধ হয় আমাকে কিছু বলার ছিলো? সেটাই জানতে এসেছি।
~ আম্.. আমার আবার কি বলার থাকতে পারে? তাও আপনাকে??
~ (মিহির আরেকটু কাছে গিয়ে) কেন মনে নেই মিশকার ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছিলে?
~ আমিতো..
~উহুম উহুম ( শুকনো কাশি দিয়ে) ।। আজ সিঙ্গেল বলে কারো মতো জোড়ায় জোড়ায় চিপকে দাঁড়িয়ে গল্প করতে পারি না আবার কাউকে যত্ন সহকারে বাদাম ছিলে খাওয়াতেও পারি না ( অভ্র- আরশি রেহান আর মিহির দিকে ইশারা করে আফসোসের সুরে বলল নাহিদ )
রেহান- মিহি একে অপরের থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো। অভ্র আরশিও কথাটা শুনতে পেয়ে কিছুটা নড়েচড়ে বসল । বাকিদের মনোযোগ এখন নাহিদের দিকে।
~ কিচ্ছে এমনে তাকাস কা?? মামা তোমাদের মহাভারত এখন রামলীলায় রূপ নিয়েছে??( দুষ্টু হেসে)
আর অভ্র?? তোর কেয়ারিং স্বভাবটা একটু বেরেছে বলে মনে হচ্ছে।।
~( নাহিদের মাথায় গাট্টা মেরে) চুপ কর শালা এত বাজে বকিস কেন?( রেহান)
~আমার তরফ থেকে আর দুটো দে!!!( অভ্র )
~ যা বাবা!!! চোখের সামনে যা দেখছি তাই তো বলছি।। এখন সত্যি কথা বললেও দোষ।।
~ রাখ তোর সত্যের প্রবচন আর চুপ কর!!
মিহি আর আরশি জড়োসড়ো হয়ে আছে।
~ আই থিঙ্ক অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন আমাদের ফেরা উচিত। ( বেশ গম্ভীর ভাবে কথাটা বলল সূর্য )
~ কেন সূর্য!! এত জলদি কেন? একটু আগেই না এলাম ? আমার এখনো অনেক ছবি তোলা বাকি!
~ন্যান্সি আমি কি বলেছি নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছিস! এখন বাড়ি ফিরতে হবে মানে ফিরতে হবে। আবার পরে যখন ঘুরতে আসবো তখন তুলে নিস ।।
~সূর্য হঠাৎ কি হলো তোর? (সুজানা)
~ (কোনো জবাব না দিয়ে )আমি গাড়ি বের করছি সবাই চলে আয়। (আরশি আর অভ্রর দিকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল।।)
সবাই অবাক হলেও কেউ কিছু বলল না কারণ এখানে কমবেশি সবাই সূর্যের সম্পর্কে জানে ও যা বলবে তাই করবে।
অভ্র , রেহান আর নাহিদ ওদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আর্ মিহি আরশিদের সাথে গেল। মিহি কে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওরা আরশিদের বাসায় ফিরে এলো। পুরো রাস্তায় সূর্য মুখটাকে গম্ভীর করে রেখেছিল। একটা কথা ও বলেনি। বাকিরাও সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। সূর্য বাড়িতে ফিরে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।।
বাকিরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আর ভাবছে ওর হঠাৎ হলো টা কি?
#চলবে
আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব : ৮
আম্মা আপনি এখানে আসতে গেলেন কেনো??( আফিফ )
~ তুমি যে কি বলোনা? আরিয়া , অহনা দুজনেই আমার মেয়ের মতো। আর আজ আরিয়ার জীবনে এতো বড় একটা দিন আর আমি আসবনা!! তা কি হয় ?
~ কিন্তু আম্মা আপনি তো অসুস্থ পরে তো হিতে বিপরীত হতে পারে।( অহনা )
~ উফফ বৌমা চুপ করোতো তুমি। কি হয়েছে আমার শুনি? কিছুই না আমিই একদম ঠিক আছি। এই তোমরাই আমাকে অসুস্থ বানিয়ে রাখো। ( সাজেদা বেগম অহনার শাশুড়ি মা )
~ আচ্ছা আম্মা আমরা আপনাকে কেউ কিচ্ছু বলবোনা কিন্তু আপনি এখানে বসুন।( সুরাজ )
~ হ্যাঁ আম্মা বসুন আপনি।( আফিফ;)
আধা ঘণ্টা পর ওটির দরজা খুলে গেল। সাদা তোয়ালে তে মোড়ানো একটা ফুটফুটে বাচ্চা কোলে নিয়ে একজন নার্স এগিয়ে এলেন। কংগ্রাচুলেশনস আপনাদের ঘরে একটা ফুটফুটে রাজকন্যা এসেছে।
সবাই তার দিকে দৌড়ে গেলো। আফিফ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ভাল করে দেখল তারপর অতি যত্নে কপালে চুমু খেলো।
~আমার মা টা!! সত্যিই একদম রাজকন্যার মতো দেখতে হয়েছে। আবার কপালে চুমু খেলো। নার্স আমার ওয়াইফ ঠিক আছে তো??
~হ্যাঁ উনি সুস্থ আছেন কিন্তু জ্ঞান ফেরেনি ওনাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে জ্ঞান ফিরলে কেবিনে শিফট করা হবে। (নার্সকি মুচকি হেসে চলে গেল )
~ কৈ গো দেখি! নাতনিকে দেখি আমি! বাচ্চাটার দিকে তাঁকিয়ে থমকে গেলেন। কিছুক্ষন পর হুশ আসতেই বললেন–ওমা মাশাল্লাহ! বেশ দেখতে হয়েছে তো! কারো নজর না লাগে যেনো।।
~হ্যাঁ আম্মা সত্যি দেখতে অনেক মিষ্টি হয়েছে। ( অহনা আর সুরাজ ও বাচ্চাটাকে আদর করলো )
~ আপা আমি আরিয়া কে দেখে আসছি।
~ আচ্ছা।
~আম্মা কি হয়েছে আপনার চোখে পানি কেনো? ( বিচলিত হয়ে অহনা প্রশ্ন করলো )
~ (চোখের পানি মুছতে মুছতে) ওকে দেখতে কার মতো লাগছে জানো বৌমা? অহনা আর সুরাজ কিছু না বুঝে তাকিয়ে আছে।
~ (হালকা হেসে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে) আমার জান্নাতের মতো। ( আবার কেঁদে দিলেন )
অহনা আর সুরাজ অবাক হলেন সাজেদা বেগম এর কথা শুনে। এবার তারা ভালো করে খেয়াল করে
দেখলেন হ্যাঁ একদম ওর মতো দেখতে কিন্তু এ কি করে সম্ভব? জান্নাত অহনার একমাত্র ননদের নাম। কার অ্যাকসিডেন্ট এ খুব ছোটবেলায় মারা গেছে। অহনা যদিও তাকে সামনাসামনি দেখিনি কিন্তু ছবিতে দেখেছে আর সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাটার সাথে তার দীর্ঘ বছর পূর্বে গত হওয়া ননদের চেহারার এত মিল দেখে সে সত্যিই হতবাক হয়ে গিয়েছে। সুরাজ জামান পাথরের ন্যায় হয়ে গেছেন।
~ আম্মা কিন্তু এটা মানে এটা কি করে? ( সুরাজ )
~ হয়তো এই বাচ্চাটার মাধ্যমেই আমাদের জান্নাত আমাদের কাছে ফিরে আসতে চাইছে।
~ আম্মা এসব কি বলছেন আর এটা কি করে সম্ভব?
~ আল্লাহ চাইলে সব ই সম্ভব বৌমা। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
~কিন্তু আমি…
~ বাচ্চাটাকে দিন ওকে খাওয়াতে হবে ওর মায়ের জ্ঞান ফিরেছে।।( নার্স )
~বাচ্চাটাকে নার্সের কোলে দিয়ে দিলো। আমরা কি এখন ওর সাথে দেখা করতে পারব? (অহনা)
~ বাচ্চাকে খাওয়ানো হলেই দেখা করতে পারবেন।( নার্স)।। এরপর নার্সটি চলে গেলো।
~ আরিয়া মা এখন কেমন লাগছে তোর??
~ আমি এখন ঠিক আছি আম্মা। আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেনো? আপনার শরীর এমনিতেই ভালো নেই। ( দুর্বল কণ্ঠে আরিয়া কথা গুলো বললো)
~ আরিয়া তুই আমাকে তোর মা মনে করিস না তাই না!! আজ যদি তোর মা আসতো তাকেও কি তুই একই কথা বলতি? (অভিমানের সুরে বললেন সাজেদা বেগম)
সবাই সাজেদা বেগমের কথায় মুখ টিপে হাসলো। আরিয়া ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই বললো–হাজার বার বলতাম আর আমি তো আমার মাকেই বলছি। আমার কাছে আমার মায়ের স্বাস্থ্য সবার আগে। বুঝেছেন?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি বাপু। এবার তুই চুপ কর তো! তুই এখনো বেশ দুর্বল বেশি কথা বলিস না।
~আম্মু!!!
~ একি সুজানা তুই এখানে তোকে কে আনলো আর ভাই কোথায় তোর?
~ আমাকে ময়না খালা নিয়ে এসেছে। আর ভাই তো পড়ছে। তার নাকি হসপিটালের গন্ধ সহ্য হয় না বমি পায়। ( মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল সুজানা ) ওমা! ও বুঝি আমার নতুন বোন?? দেখি দেখি! কি সুন্দর দেখতে হয়েছে গো মা। মাশাআল্লাহ! আচ্ছা ওর নাম কি?
~ওর তো এখনো কোনো নাম রাখা হয়নি কারণ ও কিছুক্ষণ আগেই পৃথিবীতে এলো। হ্যা রে আরিয়া, আফিফ তোরা কোনো নাম ভেবেছিস?
~ আপা আমি চাই আমার মেয়ের নাম আম্মা রাখুক। দেখুন আমার ও গুরুজন বলতে শুধু আম্মাই আর আরিয়ার ও তাই আমি চাই নামটা আম্মাই রাখুক।( আফিফ )
~সাজেদা বেগম মুচকি হেসে আফিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অবশ্যই রাখবো বাবা। ” আরশি ওর নাম হবে আরশি জান্নাত।”
~ বাহ খুব সুন্দর নাম দিয়েছো তো দিম্মা।( সুজানা হাতে তালি দিয়ে খুশী হয়ে বললো )।
আফিফ হেসে বলল – হ্যাঁ নামটা সত্যিই ভালো হয়েছে তারপর বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল আরশি আমাদের ছোট্ট রাজকুমারী। কথাটা বলতেই আরশি হেসে উঠলো। এটা দেখে সবার মুখে ও তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।
আফিফ তখন একটা টেক্সটাইল কোম্পানির আন্ডারে কাজ করে । আরশির জন্মের ছয় মাসের মাথায় আফিফের পোস্টিং খুলনায় হলো। অগত্যা ছোট্ট আরশি আর আরিয়া কে নিয়ে খুলনায় পারি জমাতে হোলো তার। সবাই আরশির যাবার কথা শুনে অনেক দুঃখ পেলো।এতে সাজেদা বেগম সব থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারেন নি।
সাজেদা বেগম হার্টের রোগী ছিলেন। নিজের স্বামীর ও আদরের মেয়ে মেয়ের অকাল মৃত্যুতে তিনি দু-দুবার হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন যার ফলে দীর্ঘ এক বছর বিছানায় পড়ে ছিলেন। তারপর কিছুটা সুস্থ হলে হাঁটাচলা করতে শুরু করলেন। কিন্তু তবুও তাকে যথা সম্ভব রেস্ট নিতে বলা হয়েছিল। তার কোনো মেয়ে না থাকায় এবং অহনা ও আরিয়ার কোনো মা না থাকায় তিনি ওদেরকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসতেন। সুজানা আর সূর্যকে তো আগে থেকেই ভালোবাসতেন আরশি হওয়ার পর ওকেও ভালোবাসা শুরু করলেন ।
আরশি চলে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই ওনার শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখা দেয়। উনি আরশির মাঝে নিজের হারানো মেয়েকে দেখতে পেতেন। তাই আরশির চলে যাওয়া মানে আবার তিনি উনার মেয়েকে হারিয়ে ফেললেন। এসব ভাবনার কারণেই তার এই শারীরিক অবস্থার অবনতি।।
দীর্ঘ আড়াই বছর পার আরশিরা আবার ফিরে এলো। আর প্রথম বারের মতো আরশি সুজানাদের বাড়ি এলো। এতে সব থেকে বেশি খুশি সাজেদা বেগম হয়েছিলেন। তিনি বেশ কিছুক্ষণ আরশিকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন।।।
~ আমার সোনাটা এসে গেছিস এবার তোকে কোথাও যেতে দেবো না।। কিরে এই বুড়িটা কে বুঝি ছেড়ে চলে যাবি?
ছোট্ট আরশি ফ্যাল ফ্যাল করে সাজেদা বেগম এর দিকে তাকিয়ে আছে।।
~ ওরা চাইলেও আর কোত্থাও যেতে দিচ্ছিনা ওদের আমি আম্মা।( সুরাজ )
~ মানে!
~ মানে হচ্ছে মিস্টার আফিফ হাসান এখন থেকে আমার অফিস জয়েন করবেন।
অহনা, আরিয়া, আর সাজেদ বেগম বেশ খুশি হয়ে গেলেন।
~ কিন্তু ভাইজান আমিতো একটা চাকরি করছি।
~ তো সমস্যা কোথায় ওটা ছেড়ে দাও। তাহলে আমরা সবাই এক সাথে থাকতে পারবো।
~ হ্যাঁ আফিফ বাবা তুমি তাই করো। আমিও আমার আরশি সোনা কে ছাড়া থাকতে পারবোনা। ( সাজেদা বেগম )
~ বাবাই আমিও আরশি রানিকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। ( সুজানা )
আফিফ সকলের জোরাজুরিতে রাজি হয়ে গেল। সবাই আনন্দে মেতে উঠলো।
~ দাদুভাই ? কি করছো? পড়ছো?
~ হ্যাঁ দিম্মা।। তুমি এসোনা।
~ আমি কি আমার ভাই টাকে ডিস্টার্ব করলাম?
~( হালকা হেসে ) একদম না।।। বসো।
সোফায় বসে সূর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
~দাদা ভাই? তুমি এতো চুপচাপ থাকো কেনো সব সময়?তোমার বয়সি সবাই কতো শোরগোল করে বেড়ায় আর তুমি!! সারাক্ষণ বই নিয়ে থাকো। এটা কিন্তু ঠিক না। সবার সাথে তোমাকে মিশতে শিখতে হবে। কাল নাকি তুমি আরশি মনিকে তোমার বই ধরার জন্য বকেছো?
~ (মাথা নিচু করে) ও আমার বই সব এলোমেলো করে ফেলেছিলো। তাই বকে ছিলাম।
~ না দাদুভাই ও তো ছোট। বুঝতে পারেনি। তুমি এর পরের বার থেকে ওকে না বকে বুঝিয়ে বলবে কেমন?
~ সূর্য্য মাথা দুলালো। তার দিম্মার কথা সে ফেলতে পারবেনা। কারণ তার দিম্মা কে যে সে বড্ড ভালোবাসে। সূর্য সাজেদা বেগমের কোলে মাথা রাখলো। সাজেদা বেগম ও পরম আবেশে সূর্যের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
~একটা কথা জিজ্ঞেস করবো দাদা ভাই?
~হ্যাঁ করো না দিম্মা।
~ আরশি মনি কে তোমার কেমন লাগে?
~কেমন লাগে বলতে?
~ পছন্দ করো নাকি অপছন্দ?
~ দিম্মা আমি ও কে অপছন্দ করি না কিন্তু ওর করা দুষ্টুমিগুলো কে অপছন্দ করি।। আমার ঘরে ঢুকলেই ঘরটাকে পুরো এলোমেলো করে ফেলবে আর সারাক্ষণ পুতুল নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করবে। আর ও প্রচুর চেঁচামেচি করে আর তুমি তো জানো আমার এসব চেঁচামেচি–ছোটাছুটি পছন্দ না। পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গবে। এমনিই তো হাত-পা ওর ঐ ডল দুটোর মতোই তুলতুলে পড়লে আর আস্ত থাকবে না।। তারপর ভ্যা ভ্যা করে কাদবে।
সাজেদা বেগম শব্দ করে হেসে দিলেন।
সূর্য তার কোল থেকে মাথা তুলে মুখের দিকে তাকালো।
~কি হয়েছে দিম্মা হাসছো কেন? আমি হাসির কি বলেছি?
~ আমার নাতিটা দেখছি আরশি মনির জন্যে বেশ চিন্তা ও করে। আর তুমি ঠিক বলেছো ও সত্যিই পুরো ডলের মতো।( হাসতে হাসতে বললেন )
~আমিতো কথার কথা বললাম। তুমি কেনো হাসছো বুঝছিনা।
~ বুঝতে হবেনা তুমি পড়ো। আর চিন্তা করো না তোমার ডলের কিচ্ছু হবে না আমরা আছিতো। ( সূর্যকে চোখ টিপ দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন)
সূর্য্য আহাম্মকের মতো তার দিম্মার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করে বলল আমার ডল!!
ধুর আমার পড়তে হবে সামনে জেএসসি।। সূর্য্য আগের ন্যায় পড়তে বসে গেলো। কিন্তু তার কানে না চাইতেও একটা কথাই বাজছে “তোমার ডল”।
#চলবে