তুমি তাই পর্বঃ১৪

0
648

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৪

অফিসিয়াল মিটিংয়ে জাহিদের সঙ্গে জরুরি আলাপে ব্যস্ত ছিলো রেজোয়ান। আচমকা টেলিফোনের রিং
বেজে উঠতেই মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো। রিসিভার তুলে কথা না বলে ফের রেখে দিলো রেজোয়ান। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। কল কেটে যাওয়ার পরেও বিরতিহীন ভাবে কল করা জারি রাখলো অপরপাশের ব্যক্তিটি। রেজোয়ান বিরক্ত হয়ে রিসিভার কানে তুলে নিলো,
-‘হ্যালো। রেজোয়ান স্পিকিং!’

-‘হ্যালো মি.মুরসালীন। রেজা হিয়ার,’

রেজার নামটা শুনে চোখ জ্বলে উঠলো রেজোয়ানের। হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো। জাহিদকে উদ্বিগ্ন দেখালো। ইদানীং রেজোয়ানের শরীর ভালো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় যথেষ্ট চেঁচামেচি তাঁর শরীরের পক্ষে ভালো হবে না। সে জানে না রেজোয়ান কার সঙ্গে কথা বলছে তথাপি ইশারায় শান্ত থাকতে অনুরোধ করলো ।

রেজোয়ান কাট কাট গলায় প্রশ্ন করলো,’কি চাই?’

-‘আপনাকে আমাদের বিয়েতে ইনভাইট করার জন্য ফোন করেছি মি.মুরসালীন। আগামী এগারোই ফেব্রুয়ারি আমার এবং নিলির বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়েছে।’

রেজোয়ান চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও উঠলো না। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বললো,’

-‘কংগ্রাচুলেশনস মি.রেজা। উইশ আ ভেরি ব্যাড লাক।’

-‘সরি?’

-‘ভুল হয়ে গেছে। গুডলাক হবে।

-‘থ্যাংক ইউ।

-‘ভালোই হলো আপনি ফোন করেছেন। একসঙ্গে আমার বিয়ের দাওয়াতটা পৌঁছে দেওয়া যাবে।’

-‘আপনার বিয়ে?’

-হ্যাঁ। আমারও বিয়ে। এগারোই ফেব্রুয়ারি আমারও বিয়ে।’

রেজা যেন আকাশ থেকে পড়লো! রেজোয়ানের কথা সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। রেজোয়ান কি তাঁর সঙ্গে মজা করছে তাও বুঝতে পারছে না। তবে অবাক হোক আর যাই হোক ব্যাপারটা জোরপূর্বক হজম করে গেলো সে। কৃত্রিম আন্তরিকতার সুরে বললো,

-‘তাই নাকি? হোয়াট আ কো ইন্সিডেন্স! এনিওয়ে কংগ্রাচুলেশনস মি.মুরসালীন।’

-‘কোইন্সিডেন্স তো বটেই আমার হবু স্ত্রীর নামও নিলি রহমান। ভেন্যুটাও সেইম।’

রেজোয়ান ইচ্ছে করে রেজার মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিলো। এতক্ষনে জাহিদের বোঝা হয়ে গেছে রেজোয়ান কার সঙ্গে কথা বলছে। মুখটিপে হাসলো সে। রেজোয়ান মুরসালীন একবার যার ওপর থাবা বসায় তাঁর আর মুক্তি নেই। রেজা আবার সেই থাবার শিকার হতে যাচ্ছে।

রেজোয়ান গলাটা আরেকটু খাদে নামিয়ে বললো,
-‘একটু সাবধানে থাকবেন ভাই। বিয়ের দিন কিডন্যাপ-টিডন্যাপ হয়ে গেলে তো সমস্যা। তখন তো আপনার বউ নিয়ে অন্যলোকে ভাগবে।’

শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও রেজার পেটের কেমন করছে। রেজোয়ান সরাসরি তাঁকে থ্রেট দিচ্ছে। হাড়বজ্জাত ছেলে এই রেজোয়ান! একে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই নিলিকে টোপ হিসেবে বেছে নিয়েছে রেজা এখন উল্টে তাঁকেই টোপ বানানোর প্ল্যান করছে রেজোয়ান। ভাবছে বিয়ের আসর থেকে রেজাকে কিডন্যাপ করে সে নিজে বিয়ে করবে? আচ্ছা? এত সহজ। গতবার নাহয় রেজা কিডন্যাপের কথা জানতো না। কিন্তু এবার আর তো সে জেনে গেছে। এবার আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখবে। দরকার পড়লে বিয়ের দিন পুলিশ পাহারা বসাবে।

-‘আপনি ব্যবসা ছেড়ে মানুষ কিডন্যাপিং কবে থেকে শুরু করেছেন?’

-‘ধুর। মানুষ কিডন্যাপ শুরু করতে যাবো কেন? আমি তো কিডন্যাপ করবো একটা নেড়ি কুত্তাকে। চিড়িয়াখানায় যাওয়ার বহুত শখ হয়েছে কুত্তাটার।’

ইনডাইরেক্টলি রেজোয়ান তাঁকে কুকুর বলছে ভেবে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো রেজা। ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’মুখ সামলে কথা বলুন মি.মুরসালীন।’

জবাবে রেজোয়ান অত্যাধিক নমনীয়, কোমল কন্ঠে বললো,’আপনি কেন উত্তেজিত হচ্ছেন? আমি তো আপনাকে কুকুর বলি নি।’

রেজা বুঝলো কথার মারপ্যাঁচে তাঁকে অপমান করার ফন্দি এঁটেছে রেজোয়ান। আচমকা যেমনি রেগে গেছিলো তেমনি আবার শান্ত হয়ে গেলো। ফিচেল হেসে বললো,
-‘আপনি আমাকে যাই বলুন না কেন আপনার প্রিয়তমা কিন্তু আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভক্তিতে একেবারে গদগদ। আমি চাইলেই তাঁকে দিয়ে যেকোনো কাজ করাতে পারি। এমনকি নিজের শয্যাসঙ্গীও বানাতে পারি। কিন্তু আপনার কথা ভেবে মায়া হয়। শত হলেও আপনার পুরাতন প্রেমিকা, বিয়ের আগে এমন কিছু করেছে জানলে আপনি নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবেন। তাই ছেড়ে দিয়েছি। তবে বিয়ের পর কিন্তু আর ছাড়বো না। ‘

রেজোয়ান হাসলো। বললো,
-‘সেই চেষ্টা যে আপনি করেন নি এ আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে বাগে আনতে না পারেন নি। তাই এসব ভুজুংভাজুং শুনিয়ে আমাকে রাগাতে চাইছেন। কি তাইতো?’

ধরা খেয়ে রেজার অঙ্গ জ্বলে উঠলো। মাথায় রক্ত উঠে গেলো। একথা সত্যি যে, রেজোয়ানকে অপদস্থ করার জন্যই নিলিকে বেছে নিয়েছিলো সে। কিন্তু এর বাইরেও যে নিলির প্রতি তাঁর আলাদা লোভ নেই সেকথা মিথ্যে। ভেবেছিলো ফুঁসলে ফাঁসলে কোনমতে একবার বিছানায় নিয়ে যেতে পারলেই কাহিনী খতম। বিয়ে-টিয়ে করার দরকার পড়বে না। কিন্তু নিলি তাঁকে সেই সুযোগই দেয় নি। ঐ হাত ধরাধরি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো সবকিছু।

রেজার নিরবতা রেজোয়ানের হাসিকে প্রশস্ত করে দিলো। শীতল বাতাস বসে গেলো সমস্ত শরীরে। আবেগ মিশ্রিত গলায় বললো,

-‘সি ইজ মাই গার্ল!…আই নো মাই গার্ল, সি উইল নেভার লেট ইউ গেট দ্যা চান্স।’

রেজা রাগে ক্রুদ্ধ হয়ে ফোন রেখে গেলো। যেই উদ্দেশ্যে সে রেজোয়ানকে ফোন করেছিলো সেই উদ্দেশ্য বিফল। উল্টে তাঁর নিজের মাথায় আগুন জ্বলছে। গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে রেজোয়ান আর তাঁর ঐ সতী সাবিত্রী প্রেমিকা।
নিজেকে শান্ত করা চেষ্টা করলো রেজা। প্রবোদ দিলো, আর তো মাত্র কয়টা দিন। বিয়েটা হয়ে গেলেই আসল খেলাটা শুরু করবে সে। নিজের অর্ধশত কোটি টাকা যদি রেজোয়ানের কাছ থেকে আদায় না করে ছেড়েছে তবে তাঁর নামও রেজা নয়।

রেজোয়ান ফোন রেখে জাহিদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। জাহিদ হাসছে। বললো,

-‘আপনি কিন্তু ভীষণ ঝগড়া করতে পারেন স্যার। রেজা সাহেব নিশ্চয়ই এখন রাগে ফুঁসছে।’

ঝগড়ার প্রসঙ্গ উঠতেই চট করে তিন্নির কথা মনে পড়লো রেজোয়ানের। ছাদে সেদিন কথাগুলো বলার পর থেকে তিন্নির সঙ্গে আর দেখা হয় নি। মেয়েটা ভীষণ অভিমানী। কি করে নিজেকে সামলাচ্ছে কে জানে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রেজোয়ান। এখন তিন্নির সঙ্গে দেখা না হওয়াই ভালো। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার জন্যে হলেও কিছুটা সময় দরকার।


পাঁচসাত দিন পরের কথা
তিন্নির রেজাল্ট বেরিয়েছে। অনেকদিন বাদে দেখা করতে এসেছে রেজোয়ান। তিন্নি তখন দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমাচ্ছিলো। রেজোয়ান এসেছে শুনে তড়িঘড়ি করে উঠে গেলো। তবে কোন অস্থিরতা দেখালো না। ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হয়ে রেজোয়ানের সামনে গেলো। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে রেজোয়ান। তাঁর চেহারার অবস্থা দেখে তিন্নির চোখে পানি চলে এলো। চোখ মুখ বসে খুবই করুণ অবস্থা রেজোয়ানের। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি, মুখভর্তি দাড়ি। কেমন একটা বিষন্ন চেহারা।

গত দুরাত ঠিকমত ঘুমাতে পারে নি রেজোয়ান। দুদিন আগেই নিলির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো। কিন্তু ফিরে এলো তিক্ত মন নিয়ে। নিলি তাঁর সামনে দিয়েই রেজাকে নিয়ে বিয়ের শপিং করার জন্য বেরিয়ে গেছে। নিলিকে সে কোনভাবেই বোঝাতে পারছে না রেজোয়ান একটা মুখোশধারী শয়তান। নিলি তাঁর কোন কথাই কানে তুলছে না। এসব ভেবে অস্থির হয়ে আছে মান।

তিন্নি নিজেকে সামলে নিলো। গলা পরিষ্কার করে বললো,’কেমন আছেন রেজোয়ান ভাই?’

রেজোয়ান চোখ খুললো। অদ্ভুত বিষন্ন এক হাসি দিলো তিন্নির দিকে তাকিয়ে। তারপরই অভিমানের সুরে বললো,

-‘তুই আমাকে বদদোয়া দিয়েছিস তাই নারে তিন্নি?’

-‘আমি? আমি আপনাকে বদদোয়া কেন দেবো?’

-‘দিয়েছিস। আলবাত দিয়েছিস। নইলে নিলির অন্য জায়গায় বিয়ে করতে যাচ্ছে কেন?’

তিন্নির চোখে মুখে সীমাহীন বিস্ময় ফুটে উঠলো। বললো,

-‘অন্য জায়গায় বিয়ে করতে যাচ্ছে?’

-‘হ্যাঁ। অন্য জায়গায় বিয়ে করতে যাচ্ছে। তারওপর যাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে সে আস্ত একটা বদমাইশ। আমি কোনভাবেই ওকে আটকাতে পারছি না। ওর ধারণা আমি ইচ্ছে করে রেজার নামে খারাপ খারাপ কথা বলছি।’

-‘তাঁর এমন ধারণার কারণ?’

-‘বদমাইশটা আমাকে জব্দ করার জন্য নিলির দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছ্র। নিলির বাবা অসুস্থ থাকাকালীর টাকা পয়সা দিয়ে ওকে সাহায্য করছে। আমার অফিস থেকে চাকরী ছেড়ে দেওয়ার পর নিলিকে নিজের পি.এস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। আর সেইজন্যই নিলি ভাবছে ওর মত বুঝি মানুষ হয় না।’

-‘ভাবারই তো কথা। দুঃসময়ে যেই মানুষটা পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁকে আপনি খারাপ মানুষ বলছেন কি করে? হতেও তো পারে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে?’

-‘ধুর। কোন ভুল হয় নি আমার। ও যে একটা বদমাইশ তাঁর প্রমাণ আমি নিজে। বদমাইশটা আমার আর নিলির পুরোনো ছবি ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে একশো কোটি টাকা দাবি করেছিলো আমার কাছ থেকে।’

তিন্নির চোখ কপালে উঠে গেলো। গোল গোল চোখে চেয়ে থেকে বললো,’একশো কোটি টাকা?’

-‘হ্যাঁ। একশো কোটি টাকা। তাহলেই বুঝ কেমন শয়তান?’

-‘আপনি টাকা দিয়েছিলেন?’

-‘পাগল নাকি। একশো কোটি টাকা কি মগেরমুল্লুক? যে চাইলো আর আমি দিয়ে দেবো? আমার ব্যবসা লাটে উঠতো তাহলে। অন্যভাবে শায়েস্তা করেছি। এবারও ছাড়বো না। সে যাই হোক তোর কি খবর? ভর্তি পরীক্ষা দিবি তো নাকি?’

-‘দেবো।’

-‘ঠিক আছে। পড়াশুনা করিস ঠিক মতো। আমি তাহলে আসি।’

রেজোয়ান বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো। তিন্নি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো,

-‘একটা প্রশ্ন ছিলো রেজোয়ান ভাই?

-‘কি প্রশ্ন?’

-আপনার রাজকন্যা কি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসে? না মানে সে তো অন্য একজনকে বিয়ে করছে। হতে পারে রাগ করে করছে, তবুও বিয়ে তো।’

-‘তোর মনে হয় আমি সত্যি সত্যি বিয়েটা হতে দেবো? নিলি আমার ওপর অভিমান করে এসব করছে। আমিও তো কম কষ্ট দিই নি। তাই রাগ করেছে। জানিস তো, যেখানে ভালোবাসা বেশি সেখানে রাগ, অভিমান এগুলো বেশি। এসব কোন ব্যাপার না।আমি ওকে ঠিক আমার করে নেবো।’

কথা শেষ করে রেজোয়ান বেরিয়ে গেলো। যদিও নিলির ব্যাপারে সে ভীষণ টেনশনে আছে, নিলি আদৌ তাঁকে ক্ষমা করবে কিনা, আবার তাঁরা নতুন করে শুরু করতে পারবে কিনা এসব ভেবে অস্থির লাগছে। আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা না বুঝে নিজের সর্বনাশ করতে চলেছে কিন্তু তিন্নিকে এসব কিছুই বুঝতে দিলো না। উপরন্তু কথাবার্তা বলার সময় এমন সাবধানে বলেছে যেন তিন্নির মনে তাঁকে নিয়ে বিন্দুমাত্রেও আশার সঞ্চার না হয়। রেজোয়ান চায় না তিন্নি মিথ্যে কোন আশা দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখুক। নিজের জীবনটা সে নতুন করে গড়ে তুলুক।

রেজোয়ান বেরিয়ে গেলে তিন্নির অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,’আমি আপনাকে অনেক বেশি ভালোবেসেছিলাম রেজোয়ান ভাই। আপনার ঐ রাজকন্যার চাইতেও বেশি। কিন্তু আফসোস আপনি আমার ত্যাগটুকু দেখতে পেলেন না।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here