তুমি তাই পর্বঃ২৫

0
1111

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৫

রেজোয়ান বিদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে শুরু করেছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা শায়লা মুরসালীনের নেই। ছেলের বিয়ে দিয়ে তবেই দেশ ছাড়বেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে রেজোয়ান বিয়ের কথা শুনতেই নারাজ। সে আছে তাঁর ব্যবসা আর দত্তক নেওয়া কন্যাসন্তান দুটিকে নিয়ে। এসব নিয়েই ব্যস্ত সারাদিন। শায়লা মুরসালীন চুপিচুপি জাহিদকে ডেকে পাঠালেন। উদ্দেশ্য নিলির খোঁজ জানা। জাহিদ ডেকে ফিসফিস করে বললেন,’ঐ মেয়েটার সঙ্গে কি রেজোয়ানের আবার দেখা হয়েছে? তুমি জানো কিছু?’

জাহিদ প্রথমে ইতস্তত করলেও সত্যিটা বলে দিলো। নিলির সঙ্গে রেজোয়ানের দেখা হয়েছে শুনে শায়লা মুরসালীন চুপ করে গেলেন। মিনিট খানেক সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’ঠিকানা আছে?দেখা করা যাবে ওর সঙ্গে?’

জাহিদ বেশ অবাক হলো। নিলির সঙ্গে শায়েলা মুরসালীনের হঠাৎ করার কি কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারলো না। বললো,’আমার কাছে ঠিকানা নেই ম্যাম। জোগাড় করতে হবে।’

-‘তাহলে তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো আমাকে ঠিকানাটা জোগাড় করে দাও। আমি ফিরে যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’

-‘ঠিক আছে ম্যাম।’

-‘আর শোনো, রেজোয়ানকে কিছু জানানোর দরকার নেই। প্রয়োজন হলে আমিই পরে জানাবো ওকে।

ড্রয়িংরুমে বসে আছে ফুয়াদ এবং রেজোয়ান। রেজোয়ানের দুই কন্যাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তাঁরা।

রান্নাঘরে সবার জন্য নাশতা রেডি করছিলো তিন্নি, আর ভাবছিলো বিয়ের পর এই প্রথম রেজোয়ানের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। আসার পর থেকেই রেজোয়ান তিন্নিকে ভাবি বলে সম্বোধন করছে। শুধু ভাবি নয়, আপনি বলেও সম্বোধন করছে। যদিও শুনতে খানিকটা ঠাট্টাসূচক লাগছে তথাপি রেজোয়ান যে তিন্নির কাছ থেকে পরিমিত দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছে সেটা তিন্নি বেশ ভালো করেই বুঝে গেলো।

কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো রেজোয়ানের ভাবি ডাকা নিয়ে কোনরকম খারাপ লাগা কাজ করছে না তিন্নির। বরং ভালো লাগছে তাঁর। ভীষণ ভালো লাগছে। তবে কি সত্যিই ফুয়াদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে? হেসে ফেললো তিন্নি। ফুয়াদের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। তিন্নিকে সে এত ভালোবাসবে বলেছিলো যে দিন রাত চব্বিশঘণ্টা তিন্নি নাকি শুধু তাঁর নামই জপ করবে। অদ্ভুত লোক একটা! তিন্নি তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেও বলবে তিন্নি নাকি তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! তাঁকে ছাড়া নাকি তিন্নি একমুহূর্তও থাকতে পারবে না।

ফের হেসে ফেললো তিন্নি। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো ড্রয়িংরুমের দিকে। বাচ্চাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে তাঁর সুদর্শন, সুপুরুষ বরটা। কি মায়া লাগছে দেখতে! চোখেচোখে চোখ পড়ে গেলো দুজনের। ফুয়াদ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,’কি?’

তিন্নি হাত ইশারায় কাছে ডাকলো তাঁকে। এগিয়ে এলো ফুয়াদ। বললো,’কিছু লাগবে?’

-‘লাগবে তো।’

-‘কি?’

-‘আপনাকে!’, বলেই লজ্জায় উল্টো দিকে ঘুরে গেলো তিন্নি। কারণ সে জানে এক্ষুনি তাঁকে কতগুলো নির্লজ্জ কথা শুনিয়ে দেবে ফুয়াদ, কিংবা কাছে আসার বাহানায় জ্বালাতন শুরু করে দেবে। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ফুয়াদ মিষ্টি করে হাসলো। বললো,’আমাকে দিয়ে কি কাজ?’

-‘অনেক কাজ। আসুন আমার সঙ্গে আটা মাখাবেন।’ বলেই মুখটিপে হাসলো তিন্নি।

ফুয়াদও পালটা জবাব দিয়ে বললো,’আটার সঙ্গে আমাদের দুজনার মাখামাখি হলে আপত্তি নেই।’

-‘আচ্ছা? তবে তো মাখামাখি শেষে তাওয়ায় সেঁকতে ও হয়? কি বলেন সেঁকবো আপনাকে?’

ফুয়াদ হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা তিন্নির আঁচল টেনে ধরলো। বললো,’লজ্জাবতীর মুখে খই ফুটেছে দেখছি!’

তিন্নি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। আঁচল ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’ছাড়ুন আমাকে। বউয়ের আঁচল ধরে কারা ঘুরে বেড়ায় জানেন?’

-‘কারা?’

-‘ভেড়ারা। আপনি তো পুরুষ। আপনি কেন আঁচল ধরে টানাটানি করবেন?’

আঁচল ছেড়ে দিলো ফুয়াদ। এবারে সোজা কোমর চেপে ধরলো তিন্নির। ফিসফিস করে বললো,’খুব কথা শিখে গেছো না? দেই মুখটা বন্ধ করে? দেবো?’ বলতে বলতেই সে ঠোঁটজোড়া তিন্নির মুখের কাছে নিয়ে গেলো। তিন্নি সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিলো। হার স্বীকার করে নিয়ে বললো,’ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর বলবো না। ছাড়ুন আমাকে। রান্নাঘরে কেউ দেখলে কি ভাববে?’

-‘তাহলে এবার বলো ফুয়াদ আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

-‘পারবো না।’

-‘না পারলে আমিও ছাড়বো না।’

-‘আমার লজ্জা লাগে।’

-‘এসব বলে কোন লাভ নেই। আজকে তোমার মুক্তি নেই। হয় আমাকে তুমি করে বলবে নইলে আমি জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো।’

-‘ছাড়ুন বলছি। অসভ্য লোক!’

-‘অসভ্য বলেছো আমাকে। এবার ‘তুমি’র সাথে গালে চুমুও খেতে হবে। নইলে কিছুতেই ছাড়বো না।’

-‘আমি কিন্তু মাকে ডাক দেবো?’

-‘দাও। মা এসে দুজনকেই দেখুক।’

তিন্নি ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ফুয়াদ এর সঙ্গে জোরাজুরি করতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে সে। বেশ ভালো করে বোঝা হয়ে গেলো এই লোক আজকে তাঁকে ছাড়বে না। তাই বাধ্য হয়ে তুমি বলার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু সেখানেও যন্ত্রণা। লজ্জায় মুখ দিয়ে কিছুতেই বেরোচ্ছে না। অবশেষে চোখ বন্ধ করে মৃদু কোমল কন্ঠে তড়িঘড়ি করেবললো,’ছাড়ো আমাকে। সবাইকে নাশতা দিতে হবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে।’

ফুয়াদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তাঁর লাজুক লাজুক মুখখানার দিকে। কোমরের বাঁধন হালকা করে দিলো। আলতো করে হাত রাখলো তিন্নির দুই গালে। সস্নেহে চুমু খেলো তিন্নির কপালে। মোলায়েম কন্ঠে বললো,’লজ্জা পেলে আমার বউটাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়।’.

তিন্নি হাসলো। ফুয়াদ হাতের ওপরের নিজের একটা হাত রেখে বললো,’আর আমার এই দুষ্টু বরটাকে সবসময়ই সুন্দর দেখায়। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর পুরুষ সে।’

নিলি কাঁদছে। শায়লা মুরসালীন মৌনমুখে তাঁর সামনে বসে আছেন। রেজোয়ানের বৃত্তান্ত সব খুলে বলেছেন তাঁকে। সব শুনে নিলি বুঝতে পারছে না তাঁর কি করা উচিৎ। সে চেয়েছিলো রেজোয়ান সুখি হোক, ভালো থাকুক।
নিজের অপরাধের দায়ভার মাথায় নিয়ে একা বেঁচে থাকবে সে। কিন্তু রেজোয়ান যে তাঁকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে খেলা শুরু করে দেবে একথা নিলি স্বপ্নেও ভাবে নি।

শায়লা মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফসোসের সুরে বললেন,’ভেবেছিলাম জীবনে কোনদিন মুখ দেখবো না তোমার। কিন্তু কি করবো, আল্লাহ আমাকে ঠেকিয়েছেন। আমার ছেলে তোমার মধ্যে কি পেয়েছে তা কেবল সেই জানে। এত মেয়ের ছবি দেখালাম কাউকে মনে ধরলো না। তাঁর একই কথা, মেয়ের আমার পছন্দ নয়। তুমি বিয়ের চিন্তা বাদ দাও মা।

নিলির টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে। কি করলে সে রেজোয়ানকে তাঁর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবে! নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে।

-‘এতিমখানা থেকে বিদেশি বাচ্চা দত্তক নিয়েছে। মেয়ের বাবা সেজেছে। মা হয়ে ছেলের এমন দুর্দশা আমি দেখতে পারছি না। তাই তোমার কাছে এসেছি। তুমি তো জানো আমার ছেলে তোমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই এবার সেই ভালোবাসার প্রতিদান চাইতে এসেছি আমি। আমার ছেলের ভালোবাসার মূল্য পরিশোধ করে আমাকে উদ্ধার করো।’

-‘আমি কি করবো? কি করলে রেজোয়ান কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে? আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। মরতে বললেও রাজি আছি।’

-‘তোমাকে মরতে বলার মতন অমানুষ আমি নই। আমি তোমার সঙ্গে রেজোয়ানের বিয়ে দেবো বলে ঠিক করেছি। একটাই পথ আমাকে ছেলেকে ঘরমুখি করার। আমার একটা মাত্র ছেলে। ওর জন্য আমি সব করতে পারি।’

নিলি পুনরায় ডুঁকরে উঠলো। এত অপরাধ নিয়ে রেজোয়ানের মুখোমুখি কি করে দাঁড়াবে সে? শায়লা মুরসালীনের হাত চেপে ধরে বললো,’আপনি আমাকে শাস্তি দিন মা। মেরে ফেলুন। কিন্তু ফিরে যেতে বলবেন না প্লিজ। দোহাই আপনার। রেজোয়ানের কাছে ফিরে যাওয়ার মতন মুখ আমার নেই।’

শায়লা মুরসালীন হাত ছাড়িয়ে নিলেন। এই মেয়েটার জন্যই তাঁর ছেলের এমন করুণ অবস্থা। একে তিনি এত সহজে ক্ষমা করবেন না। শুধু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই তাঁকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে এসেছেন। তবুও যদি রেজোয়ান সংসারী হয়!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here