হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:৬

0
1069

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:০৬

তুমি যামিনী আমি শশী হে,

ভাতিছো গগনো মাঝে

মম সরসীতে তব উজ্বলো প্রভাত

বিম্বিত যেন লাজে,,,

গভীর নিশি। বাড়িতে সবাই হয়তো ঘুমিয়ে কাঁদা।বিরূপাক্ষের ঘড় থেকে মৃদু ভলিউমে শ্রীকান্ত আচার্যের গাওয়া এই গানটি ভেসে আসছে। কিচেনে গ্যাসের চুলোয় কফির জন্য জল ফুটতে দিয়ে আনমনে গানটা শুনছিলো রিতি,,গানটা তার অত্যধিক পছন্দের। আর যদি রাতের এই নিঃশব্দ নির্জন পরিবেশে হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিচেনের দরজায় মৃদু শব্দ শুনে ঘুরে তাকায় রিতি।কালো শর্টস আর অফহোয়াইট ঢোলা টিশার্ট পরে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপ।চোখে তাহার রাজ্যের কৌতুহল। বিকালে রাস্তায় দেখা ভদ্র মহিলা এই রাতদুপুরে তাদের বাড়ির কিচেনে কি করছে?
রিতির মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। গায়ের রং টা একটু চাপা হলেও নিঃসন্দেহে সুদর্শন সুপুরুষ সে। দেহের মধ্যে শীতল শিহরণ বইছে রিতির। ফুটন্ত গরম জলে চামচ মেপে কফির গুঁড়ো দিতেই প্রশ্ন ভেসে আসে,আপনি এতরাতে এখানে ক্যানো?
ক্যানো কেউ কারো বাড়িতে আসতে পারে না?কফি নাড়তে নাড়তে উত্তর দেয় রিতি
পারবে না ক্যানো?তবে অনাত্মীয় কেউ তো আর কারো বাড়িতে রাত দুপুরে কফি করবে না তাইনা?আমি চিনি না তাই বললাম।

আত্মীয়তা থাকলেই কি সবাই সবখানে স্থান পায় ?নাকি সম্পর্ক থাকলেই সবজায়গায় অধিকার খাটানো যায়?এই পাশের স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা আমি।বড়মা অনেক স্নেহ করেন তাই পূজার কদিন এখানে থাকবো।আশা করি বুঝতে পেরেছেন?মগে কফি ঢালতে ঢালতে বললো রিতি।
রূপ মুগ্ধ নয়নে দেখছিলো সামনের রূপবতী নারীর হাত পা নেড়ে কাজ করা। চুলগুলো হাত পেঁচিয়ে খোপা করে রাখা।সাধারন একটা সুতির শাড়ি পড়নে , গলার ফাঁকা জায়গাটুকুতে চিকন স্বর্ণের চেইনটা জলজল করছে উজ্জ্বল আলোতে।একজন স্বয়ংসম্পূর্ন সুন্দরীর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা কিছু আছে তার কোনোটাই কমতি নেই মেয়েটার মধ্যে ,তবে একটু বেশীই আছে সেটা হলো ঐ মধুর কন্ঠ ঝংকার।নিচু স্বরে আস্তে আস্তে কথা বলে মেয়েটা,এসব যখন ভাবছিলো তখনই অতি নিকটে শোনা যায়,এই যে আপনার কফি উইদাউট মিল্ক এন্ড সুগার।
রূপ একটু অবাক হয়ে কফির মগটা হাতে তুলে নিয়ে বলে, আপনার টা কোথায়?

আমি চা,কফি তেমন পছন্দ করিনা।

বিরূপাক্ষ একটু বেশিই অবাক হলো,
আপনি এই রাতে আমার জন্য কফি করছিলেন? বুঝলেন কিভাবে আমার এখন এক মগ কফির ভীষণ প্রয়োজন ছিলো?

আমি কিভাবে বুঝলাম সেটা মুখ্য নাকি আপনার কফি পানে মন দেওয়াটা এখন মুখ্য বিষয়?

রূপ মনে মনে বিরক্ত হয়ে বিরবির করে,কথা সাতটা বলবে কিন্তু সোজা ভাবে একটা উত্তর দেবেনা। এখন তার কফি পান করাটাই জরুরী তাই বিরক্তিকে ঝেড়ে গরম কফিতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বললো,আমি যে দুধ চিনি ছাড়া কফি খাই এটা কিভাবে জানলেন সেটুকু তো বলুন।তবে হ্যা দারুন হয়েছে কিন্তু।
হ্যা নেকামি যতসব,,দুধ চিনি ছাড়া কফি গেলা যায়? আবার বলে দারুন হয়েছে।
মুখ ফুটে আর বলা হয়ে উঠলো না কথাগুলো।

বড়োমা বলেছেন।আর বৌদিদির শরীরটা একটু খারাপ তাই দায়িত্বটা আমাকে দেওয়া হয়েছে।আসছি আমি।
ড্রইং রুম পেরিয়ে সবে সিঁড়িতে উঠবে পেছন থেকে ডেকে ওঠে রূপ,এই যে শুনছেন,,
রিতির পা থেমে যায়,এমন ভাবে ডাকে ক্যানো মানুষটা।ওকি বোঝে এইটুকু স্বরে আমার সমস্ত শরীরের রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য?
আপনার হাঁটুর চোটটা কি বেশী ছিলো?না মানে খুড়িয়ে হাঁটছেন তাই বলছি, আমার কাছে ঔষধ আছে।একটু লাগিয়ে নিন ঠিক হয়ে যাবে চলুন আমি দিচ্ছি।

তেমন কিছু না।ঠিক হয়ে যাবে।ঔষধ লাগবেনা আমার। আচ্ছা শুভ রাত্রি।

এত একরোখা ক্যানো আপনি।ব্যাথায় হাঁটতে পারছেন না আবার বলছেন ঠিক হয়ে যাবে? একটু জোড়ে বললো রূপ।

রিতির মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে, শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলে,একজন অজানা অচেনা মেয়ের জন্য এত উতলা হচ্ছেন ক্যানো আপনি? বাইরের এইটুকু চোট দেখলেন আর ভেতরে ভেতরে যে প্রতিনিয়ত ভাঙচুরের খেলা চলে তার বেলায়?

খুড়িয়ে খুড়িয়ে দ্রুতবেগে উপরে উঠে যায় রিতি। বিরূপাক্ষ আহম্মক বনে সেদিক পানে চেয়ে থাকে।
আজব তো,,কি ভাঙচুরের খেলা ?কি বলে গেলো মেয়েটা? শুনেছি রিটায়ার্ডকৃত
টিচার্সদের মানসিক সমস্যা দেখা দেয় ,এর তো অবসর নিতে এখনো অনেক বাকী তার আগেই কি গেলো মাথাটা?
নিজের মনে কথা গুলো আওড়ে কফি সমেত মগটা অত্যন্ত বিরক্তির সাথে পাশের সেন্টার টেবিলে রাখে।ওটা আর খাওয়ার উপযুক্ত নেই।

বালিশে মুখ গুঁজে পরে আছে রিতি।ও ঘড়ের গানটা বন্ধ হলো। তারমানে সে এসেছে ঘড়ে। কতটুকুই বা দূরত্ব দুজনের মাঝে?ইট পাথরের তৈরি ইঞ্চি কয়েক পুরু দেওয়ালইতো। কিন্তু মনের দূরত্ব যে যোজন যোজন ক্রোশ।রিতি শঙ্কিত , এতদিন ধরে মনে মনে যে কঠিন বলয় গড়ে তুলেছিল সেটা বুঝি ভেঙে যাবে,ঐ তো ওঘড়ে মানুষ টা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ এভাবে কেঁদে নয় ,ঐ প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে একটা মধুময় রাত সে পার করতে পারতো। চোখের একফোঁটা জলও হয়তো নিচে পতিত হতে দিতো না সে।আর এই যে এখন বালিশ ভিজছে তাকে ভেবে সে কথাটা কি কোনদিন ঐ পাষান হৃদয় মানুষটা জানতে পারবে?

গত দিনের মতো আজো কুয়াশা ভেজা ঘাস মাড়িয়ে শিউলি তলায় এসেছে রিতি।আজ মন্দির থেকে ফুলের সাজিটা আনতে ভোলেনি।রাতটা নির্ঘুম থেকে কান্নাকাটির ফলে মাথাটা ভার হয়েছিলো তাই ভোরের আলো ফোটার আগেই স্নান সেরে নিয়ে তবে বেরিয়েছে ঘড় থেকে।ভেজা চুলগুলো পৃষ্ঠদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। চুলের মাঝখানে সিঁথিতে এক চিলতে সিঁদুর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।আর যাই করুক না কেন সিঁথিতে সিঁদুর দিতে কখনোই ভোলে না রিতি।একপাশে সিঁথি করলে সেটা ঢাকা ই থাকে বেশ লক্ষ্য না করলে হয়তো বুঝা যায় না।
বিরূপাক্ষের সকালে জিম করার অভ্যাস কিন্তু এখানে তার কিছুই নেই। যতদিন সেগুলোর ব্যাবস্থা না হচ্ছে গ্রামের ফ্রেশ খোলা হাওয়ায় দৌড়ে সন্তুষ্ট রাখতে হবে দেহকে।সাদা পাতলা টিশার্ট,সাদা ট্রাউজার এবং পায়ে কেডস্ গলিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ আটকে যায় শিউলি তলায়।সাদা লাল পেড়ে তাঁতের শাড়ি পরিহিতা রমনীর পিঠময় ছড়িয়ে আছে একঢাল দীঘল কালো কেশ রাশি। সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশে কোন স্বর্গের দেবী ভাবতে ভুল হবে কারো। বিরূপাক্ষ চোখ দুটো কচলে নেয় ।তার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো। ভুল দেখছে নাকি এই সাত সকালে কোন ভূতনী নেমে দুহাতের আজঁলাতে ফুল নিয়ে সাজি ভরছে?তখনো পর্যন্ত ভূতনীর পৃষ্টদেশ ছাড়া সম্মুখভাগ দৃষ্টিগোচর হয় নি বিরূপাক্ষের।
রিতি যখন ফুল কুড়ানো শেষে সাজি তুলে হাটা ধরলো মন্দিরাভিমুখে তখন বিরূপাক্ষের মুখটা আপনা আপনি হা হয়ে গেল,এ মেয়ে কি ঘুমায় না নাকি?একই অঙ্গে কতরুপ?

সকালের জল খাবার টা নিজের ঘড়ে বসেই করছিলো রিতি।বৌদিদিকে বলেছে সবার সাথে ডাইনিং টেবিলে বসে খাবেনা ও। বড়মার কানেও কথাটা গিয়েছে তিনি কোন প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেননি। রূপের সাথে তিতলি নামক ওর যে বান্ধবীটা এসেছে তাকে মন থেকে কেউই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু সেটা তিতলিকে বুঝতে দেবে এমন মানবিকতা হীন নয় এবাড়ির কেউ। রূপের সাথে মেয়েটির গলায় গলায় ভাব বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের চোখে কাঁটার মতো বিঁধছে।
রিতি খাচ্ছে আর জয়া বসে আছে।দোনা মোনা করে বললো সে,একটা কথা বলবো রিতি?রাগ করবি না বল?

আগে সব নিয়ম মেনে একটা দরখাস্ত জমা দাও আমি ভেবে দেখবো তোমার সাথে কথা বলা যায় কিনা?

ফাজলামি করবি না মোটেও।এমন গোমড়া মুখে থাকিস কথা বলতে ই ভয় করে।

খিলখিল করে হেসে উঠলো রিতি, এবার হলোতো ?আর গোমড়া মুখে নেই আমি এবার বলো কি বলবে?আর একটা কথা, আমার সাথে কথা বলতে যদি ফের কখনো এইসব ফর্মালিটিজ দেখাও তাহলে সত্যিই তোমাকে দিয়ে দরখাস্ত লেখিয়ে ছাড়বো বলে দিলাম।

কথা তেমন কিছুই না শুধু একটা অনুরোধ করি তোকে,তিতলি মেয়েটা ভাইয়ের সাথে ক্যামন আঠার মতো সেঁটে থাকে দেখেছিস? আমার কিন্তু মোটেও ভালো ঠেকছে না ব্যাপার টা। অভিমান পুষে রেখে এভাবে ছেড়ে দিসনে দিদি,ওকে একটু সময় দে। তাহলে মনটা আর এদিক ওদিক ঘুরবে না।ঠিক সাত পাকের মধ্যেই ফিরবে দেখিস ‌।
রিতি এ কথার কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। নিজেকে অতটাও সস্তা মেয়েদের কাতারে দাঁড় করানো সম্ভব নয় তার পক্ষে।সে স্বামী হোক বা অন্য কেউ তার মনকে বশে আনতে নিজেকে, নিজের আত্ম সন্মান বোধকে বিকিয়ে দিতে পারবে না ,কোনো দিনও না।

বৌদিদি তোমার ভাইয়ের মন যদি অন্য কোথাও বাঁধা পরে থাকে তো এতদিনে পরে গেছে।সে তিতলি হতে পারে বা অন্য কেউ।আর যদি এখনো মনে কাউকে না ধরে তাহলে চিন্তা করোনা।যে যতই লেপ্টে থাকুক বা চিপকে থাকুক তাঁর মনে দাগ কাটা তো দূরে থাক ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবেনা।ধীরে সুস্থে কথাগুলো বললো রিতি।
ত্রাসিত নয়নে তাকিয়ে থাকে জয়া রিতির সহজ স্বাভাবিক মুখপানে।
******
সুমিতা দেবী ঝকঝকে কাঁসার থালায় অন্ন ব্যঞ্জন সাজিয়ে আসন পেতে খেতে ডাকলেন শশীশেখর বাবুকে। তিনি সামনের বারান্দায় পেতে রাখা চৌকিতে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন।আজ দুদিন হলো রিতি বাড়িতে নেই।বাড়ি ঘড় ক্যামন খাঁ খাঁ করছে। কোনো দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি।একটা মানুষের অভাব সবখানে।এমনতো কখনো হয়না তাঁর।রিতি এর আগেও বহুবার পরীক্ষা বা কাজের জন্য পনেরো বিশ দিন বাইরে থেকেছে কিন্তু তখন মনটা এত বিক্ষিপ্ত হয়নি শশিশেখর বাবুর।সুমিতা দেবীর আহ্বান শুনেই উঠে বসেন তিনি।সকালে খাওয়ার সময় হলো।

খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখনি উঠোনে কারো কথা শুনে রান্না ঘরের বাইরে উঁকি দেন শশীশেখর বাবু।

দাদু,,,ওদাদু,,,আরে পিসি কোথায় গেলে সব?দ্যাখো কে এসেছে?
প্রদীপের স্বর শুনে বাইরে বেরোতেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেন সুমিতা দেবী।দ্রুত মাথায় কাপড় টেনে দেন। ততক্ষনে পায়ে কারো হাতের স্পর্শে থতমত খেয়ে বলেন ,ভালো থাকো বাবা,বাইচ্চা থাকো। এমনিতেই ছেলেটা দেখতে সোন্দর আছিলো । গায়ের রং টা বাপের লাহান হইলেও মুখটা হইছে মায়ের মতন ছাঁচে গড়া। একবার দেখলে পরাণডা জুড়ায় যায়।এসব ভাবছিলেন সুমিতা দেবী।
ক্যামন আছেন পিসিমা? রূপের কন্ঠে ঘোড় কাটে তাঁর।

এইতো বাপ,যেমন রাখছে গোপাল ঠাকুর, তেমনই আছি। তুমি তো ভালো আছো ?

ও পিসি দাদুকে দেখছিনা যে? বাড়িতে নেই না কি?

হ হ আছে‌।খাইতেছেন ।তোমরা ঘড়ে গিয়া বসো।জ্যাঠার খাওয়া প্রায় শেষ।
অ প্রদীপ যা না বাবা ওনারে নিয়া ঘড়ে যা।দ্রুত রান্নাঘড়ে পা বাড়ান সুমিতা দেবী।প্রদীপ ঘড়ে দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,পিসি এত তাড়াহুড়া করিও না।স্পেশাল গেস্ট নিয়া আসছি। পাঁঠার মাথাটা , মুরগীর ঠ্যাং দুটো , পুঁটি মাছের পেটি টা না খেয়ে নরছি না কিন্তু।

চলবে,,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here