উপন্যাস:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব:৩৫
চারিদিকে সুনসান নীরবতা। পূর্ণ চাঁদের ভরা জ্যোছনার প্লাবনে ভেসে চলেছেন ধরনী।আমির শেখের ইটভাটার গোপন কক্ষের একটা ছোট্ট কুঠুরি থেকে অসুস্থ কুকুরের গোঙানির মতো আওয়াজ ভেসে আসছে।তবে ভালো করে কান পেতে শুনলেই যে কেউ বুঝতে পারবে সেটা আসলে কোনো কুকুর বা জন্তু জানোয়ারের মুখনিঃসৃত শব্দ নয় বরং মুখ বাঁধা অবস্থায় পরে থাকা কোনো অসহায় মানুষের মুক্তির দাবিতে আকুল ছটফটানি।ভাঙা ইটের গুঁড়ো ছিটিয়ে রাখা লালচে মাটিতে কাত হয়ে পরে আছে এক ব্যাক্তি।হাত দুটো তার পেছন মুড়ে বাঁধা।কন্ঠের স্বর রোধের উপায় হিসেবে পুরোনো গামছা দিয়ে মুখখানি আঁটোসাঁটো করে বেঁধে রাখা হয়েছে তার।চোখ দুটো স্বাভাবিক এর চেয়ে বড়ো।সেটা মরণ ভয়ে নাকি,চরম ক্রোধে তা বোঝার অবকাশ নেই ঐ আবছা আলোয়।কালো কেডস পরিহিত একটা পা ভীষণ ভাবে আঘাত করলো লোকটির বুক বরাবর।ককিয়ে উঠলো ব্যাথায়,,
হারামির বাচ্চা,নেমকহারাম,,তোরে কত্তবার সাবধান করছি না??কথা শুনিসনাই,কাইল তরে ইটের পাঁজার আগুনে পোড়ানো হবে,বুঝিস ঠ্যালা।
কাঠের নড়বড়ে দরজা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে লিকু সরদার। ভূলুণ্ঠিত ব্যাক্তি
করুণ চোখে তাকায় সেদিকে।
বৃদ্ধ লিকুর ঘোলাটে চোখে প্রতিহিংসার প্রতিফলন,,
লিকু ভাই এখন কিন্তু বলবা না তোমার পোলারে মাফ করে দিতে। হুমকির মতো শুনায় আসলাম এর বাক্য গুলো।
লিকু নিজের ছোট পুত্র ইকরামের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ডান হাতে তার সোয়েটার এর কলার চেপে ধরে,,খা**র পোলা তরে কইছিলাম না ভালা হইতে,,কথা হুনোস নাই আমার।একটু দম নিয়ে আবার বলে,,
বে***ন্মা কোহানকার মর এইবার জ্বইলা,পুইড়া।
ইকরামের চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।এটা হয়তো নিজেরই জন্মদাতার প্রতি প্রবল ঘৃনায়।
আসলাম তুমি লিকু সরদার রে চেনো নাই।আমি নিজের কাম হাসিল করতে সব পারি।এই নালায়েক নেমকহারামি ডারে এমনেই ধরতে পারছো মনে করছো??হা হা হাহা,,,
উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে লিকু সরদার এর বিদঘুটে হাসি দেখছে। আসলাম তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে,, পূণরায় বলে লিকু,,
আমি যহন আমির ভাইর লগে ফোনে কথা কইতে ছিলাম এই হারামির বাচ্চা আড়ি পাতছিলো।ভাবছে আমি ট্যার পাইনাই।
এই কুত্তার***তরে কইছি না,আমার লগে আড়ি দেস না।বাপের আগে হাঁটোস??দালালি করোস চৌধুরীগো?আজ দেখুম কোন বাজানে বাঁচায় তরে।
লিকু সরদার নিচু হয়ে ইকরামের টুঁটি চেপে ধরে দাঁত কিড়মির করে বলে কথা গুলো।
কি ভাবছোস,,তুই আমার পিছে পিছে ধাওয়া করছোস??হা হা হা,হায়রে বোকা ছ্যারা,আমিই তরে লইয়া আইলাম বাঘের গুহায়।অহন তুই বন্দী।
ইকরাম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দু-পেয়ে জানোয়ারটার দিকে।চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামছে তার। নিজের প্রতি ঘৃণা হয় এটা ভেবে যে,আল্লাহ তাকে ক্যানো এই নৃশংস পশুটার মাধ্যমে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন?? অভিযোগ করতে ইচ্ছে হয় উপর ওয়ালার প্রতি,,ক্যানো তিনি এইসব পাষন্ডদের পিতৃত্বের সুখ দেন মুঠো ভরে??
আসলামের কুঞ্চিত ভ্রু-দ্বয় মসৃন হয়। ইকরাম বন্দী হওয়ায় হয়তো লিকুকে বাহবা দেওয়ার দরকার ছিলো কিন্তু হিতে বিপরীত হলো,,এই বৃদ্ধ লোকটির প্রতি একরাশ ঘৃণা পর্যবশিত না করে পারে না আসলাম।তার মধ্যকার ভালোমানুষী সত্ত্বাটা এখনো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় নি।
********
চারিদিকে ভারী হিম কুয়াশার প্রলেপ। খেসারি, মটরশুটি আর সরষে ক্ষেতের আইলে নরম ঘাসের ডগায় ঠান্ডা ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে অনুভূতির আলোড়ন।সে ঘাসের আদ্রতায় নগ্ন পায়ের পাতা সিক্ত করিয়ে ছুটে চলেছে বিরূপাক্ষ।অনতিদূরে রায় চৌধুরী মহলের সর্বোচ্চ চূড়াটা আবছা দৃষ্টিতে দেখে মরনপণে ছুটছে সে। স্নিগ্ধ চাঁদের চাঁদোয়া ঝলমল করছে শিশিরের ধোঁয়ার মতোকুন্ডলী ছাপিয়ে। বুকের মাঝে হালকা শিহরণ।বনলতা এই রাত্রি দ্বি-প্রহরে তার অপেক্ষায় আছে তাদেরই চৌধুরী মহলের সামনে। কিন্তু এই অসময়ে, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন ক্যানো বুঝতে পারছে না বিরূপাক্ষ।। ভেতরের দ্বি-সত্ত্বার তর্কে বিতর্কের উত্তেজনা বাইরের হাড় কাঁপানো জাড় অতিক্রম করেছে তার দেহ, শুধুমাত্র একটা পাতলা শার্টে আচ্ছাদিত শরীরে অবলীলায় দৌড়ে চলেছে উত্তরের হিমেল হাওয়া এবং কুয়াশার ঠান্ডা কাটিয়ে।
একমুহুর্ত হেলায় নষ্ট করতে চায়না বিরূপাক্ষ।ধরা দিতে দিতে যদি আবার নাগালের বাইরে চলে যায় বনলতা?পা দুখানি চলছে রেসের ঘোড়ার মতো কিন্তু মনের কোনে ভাবনা গুলো গতি বিধি পাল্টাচ্ছে তার চেয়েও চতুর্মাত্রিক বেগে।কত কিছুই না ভেবে চলেছে তার অন্তরাত্মা। একবার ভাবছে,এই রাতে বনলতা তাকে নির্ঘাত ঠকাচ্ছে মিথ্যে বলে। পরমুহূর্তেই আবার উৎকন্ঠায় ভাবছে,, বনলতার উদ্বেগপূর্ন গলাতে মিথ্যার কোন আভাস তো ছিলোই না। যদিও ফোনে বনলতার আহ্বান খুব তেজের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে বিরূপাক্ষ কিন্তু মনকে প্রবোধ দিয়ে লাইনটা কেটে ঠিকই ছুটছে সেদিকে। অস্থিরতার কারণে ফোনটাও ফেলে এসেছে বিছানাতেই।
কিছুক্ষণ আগে,,
আচমকা রিতির ফোন থেকে কল আসে বিরূপাক্ষের হ্যান্ডসেটে।দুবার কেটে যাওয়ার পর পুনরায় রিং হতেই রিসিভ করে বিরূপাক্ষ।গলায় তার জোর করে টেনে আনা রুক্ষতা।সে রুক্ষতা আমলে না নিয়ে অবিরত উৎকন্ঠার ফোয়ারা ছুটিয়ে বললো রিতি,,রূপ দা তুমি খামার বাড়ি থেকে বাড়িতে ফিরে যাও এখনি।আর একমূহুর্ত ওখানে থেকো না তুমি প্লিজ।
আমার ফোনে কল দিয়েছিস কোন সাহসে?আর তুই কে আমাকে হুকুম করার?গনগনে আগুনের আঁচ ঝরে বিরূপাক্ষের স্বরে।
প্লিজ রূপদা কথা শোনো আমার। এক্ষুনি বেরিয়ে পরো ওখান থেকে। খামার বাড়িতে এখন তুমি সেইভ না।পায়ে পরি,কথাটা শোনো আমার।জীবনে আর কিচ্ছুটি বলবো না।কোনো অনুরোধ করবো না।
এক পা ও নড়বো না আমি দেখি তুই কি করতে পারিস?তুই না আমার বিপদ খন্ডনকারীনী?তো আমার বিপদ, মৃত্যু যোগ রোধ কর,,এক বিকৃত হাসি ফোঁটে বিরূপাক্ষের ঠোঁটে।রিতিকে একটু হলেও জব্দ করতে পারছে সে।টের পেয়েছে রিতির অধীর ছটফটানি। কিন্তু রিতি যদি তাকে না চাইবে,তাহলে এই ছটফটানির তাৎপর্য কি?? নিজের মনে ভাবে বিরূপাক্ষ।
আরো কিছুক্ষণ বিভিন্ন ভাবে অনুরোধ করে রিতি কোনো কাজ হয়নি তাতে অবশেষে শেষাস্ত্র ছেড়ে নিরাশ হয়,,
রূপদা তুমি যদি এখনি ওখান থেকে না যাও তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে বলে দিলাম।যাওনা প্লিজ,,একটি বার আমার কথাটা শোনো,,গলা ধরে আসে রিতির।
বিরূপাক্ষ মনে মনে বিচলিত হলেও রুক্ষতা বজায় রেখে নিজের মুখে সবচেয়ে কঠিন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কথাটা উচ্চারণ করে বসে,,
তোর মরা মুখ দেখলে আমার কি হবে রে??
মর তুই,,যন্ত্রণা পেয়ে পেয়ে সবচেয়ে করুণ মৃত্যু হোক তোর।তাতেও আমার মতো যন্ত্রণা হবে না তোর।যে যন্ত্রণা তোর জন্য আমি পাচ্ছি।আর কখনো আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি তো আমিই তোকে খুন করবো অসভ্য, ধান্দাবাজ মেয়ে কোথাকার।। খালি ভালো সাজার নাটক তাই না??ওতে আমি ভুলবো না রে,,
আচ্ছা তাহলে থাকো তুমি ওখানে,আমি আসছি,, অসহায়ের মতো বললো রিতি।দৃঢ় গলায় বললো রিতি।
বিরূপাক্ষের এমন কথায় বুকটা ভেঙে আসে তার।প্রাণের রূপদা তার মৃত্যু কামনা করে??এ ও সম্ভব??কান্নারা বাঁধন হারা,অশ্রুর সমুদ্র ঢেউয়ে নিমজ্জিত। কিন্তু বসে শুয়ে কেঁদে কুটে দুঃখ প্রকাশ করলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে।পুরু শালটি গাঁয়ে জরিয়ে অসুস্থ দুর্বল শরীরে ছুটে চলে মথুরাপুরের উদ্দেশ্যে। শর্টকাট পথ ধরে।ঝোপ ঝাড় ভেঙে দ্রুত পৌঁছে যাবে গন্তব্যে।পায়ে স্যান্ডেল পরার সময়টুকুও নেই, নদীর পাড়ের জংলি কাঁটাতে পা ছড়ে রক্ত ঝরছে। সেদিকে হুঁশ নেই মেয়েটার।হাতে ছোট বাটন ফোনটা। এবার হবে শেষ চেষ্টা।কাজ নিশ্চয়ই হবে,,রিতি হারবে গো হারান। কিন্তু বনলতা তো জিতবে। পরিশেষে, বেঁচে তো থাকবে রিতির রূপদা।
***
ফার্মের মুরগিগুলোর খাবার দিয়ে বেশ রাতেই ঘুমিয়ে ছিল প্রদীপ, অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে ফোনে চোখ রাখতেই দেখলো পনেরোটা ব্যার্থকল। ঘুম ছুটে যায় তার।ফোন সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি।এতরাতে রিতির নম্বর থেকে এতগুলো কল?? ভাববার সময় নেই কল ব্যাক করে প্রদীপ,, কিন্তু বারকয়েক দিয়েও ওপাশ থেকে রিসিভ হয়না।
অস্থির হয়ে সুমিকে কল করে প্রদীপ।মনটা কু গাইছে তার।সুমি হয়তো গভীর ঘুমে। বিরক্ত হয়ে,নিরাশ হয়ে শীতের পোশাক পরে মটরবাইক্ নিয়ে বেরিয়ে পরে সে।এত রাতে নিশ্চয়ই কোন জরুরী কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলো রিতি।উথাল পাথাল চিন্তা ভাবনা আসছে মস্তিষ্কে। পাশের গ্রামে পৌষের মেলা বসেছে। তিন দিন যাবত হবে।সেখান থেকে ভেসে আসছে হালকা পাতলা গম গম আওয়াজ। গ্রামের অধিকাংশ যুকব ছেলেরা হয়তো মেলার মাঠে আছে, তারমানে মথুরাপুর, চন্ডীনগর গ্রাম তো প্রায় ফাঁকা আজ,, প্রদীপের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় লাফিয়ে উঠে।সে দ্রুত বাইকের গতি কমিয়ে বিরূপাক্ষের ফোন নম্বর এ ডায়াল করে।নাহ রিসিভ হয়না। প্রদীপের হাত কাঁপছে,,তবে কি কোনো বিপদ সত্যিই হলো?? রঘুনাথ এর ফোন নম্বরটা বের করে ডায়াল করে প্রদীপ,,
*******
রিতির কলটা কেটে দেওয়ার সাথে সাথেই নিজের বলা কটু বাক্য গুলো স্মরণ করে মরমে মরছিলো বিরূপাক্ষ।রিতির মৃত্যু তো দূরের কথা, সামান্য অসুস্থতার কথা শুনলেও যে তার বুকে তুফান আসে, কষ্টের ঢেউ গুলো আছড়ে পড়ে মনের দু-কূল বরাবর ।বার বার নিজের বাক্য খন্ডন করে চলেছে বিরূপাক্ষ। কিন্তু ধনুক থেকে তীর,আর মুখ থেকে যে কথা একবার মুক্ত হয় তা কি আর বন্দী করা যায়??
দশ মিনিট গত হয়েছে কি হয়নি,, পুনরায় ফোনটা বেজে উঠতেই রিসিভ করে বিরূপাক্ষ,,ভেবছিলো রিতি কিন্তু না, ওপাশ থেকে ভেসে আসে বনলতার কন্ঠস্বর,,
বনলতা ফোনে কথা বলেছে বিরূপাক্ষের সাথে। কিন্তু বিরূপাক্ষ কোনো কথা শুনতে নারাজ। গভীর অভিমানে কোনঠাসা হয়েছে হৃদয় তার।বনলতার আকুতি মেশানো কন্ঠস্বর তার বুকে বিঁধলো ভীষণ ভাবে।
বনলতা অপেক্ষা করছে তাদের বাড়ির সামনে। ভীষণ বিপদে পরেছে সে।এখনি যদি বিরূপাক্ষ সেখানে না যায় তাহলে আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না। কিন্তু বিরূপাক্ষ বিশ্বাস করতে চায় না বনলতার কথা। একবার ঠকিয়েছে,, পুনরায় যদি ঠকায়??
ফোনে যতই না না করুক ঠিকই ছুটেছে সেদিক পানে, যেদিকে তার মনের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
****
ভেজা ক্ষেতের আইল পেরিয়ে সবে পিচঢালা পথে উঠেছে বিরূপাক্ষ,, মনের মধ্যে জানা, অজানা হাজারো অনুভূতির মেলা।আর কয়েক মিনিটের ব্যাবধান মাত্র। ভাগ্য প্রসন্ন হলে বনলতার দর্শন পাবে সে।সামনেই রাস্তার পাশে বিশাল পুরোনো কাঠবাদামের গাছটির অসংখ্য ডাল পালা সুবিশাল আকাশের মতো ছড়িয়ে আছে পথের উপরে।এ যেনো এক প্রশস্ত ছাদ। পায়ের গতি খানিকটা শিথিল হয়ে এসেছে তার।আর একটু,,, তারপর,,,
আর ভাববার অবকাশ পায় না,বাদাম গাছটি ক্রস করেছে কি করেনি,,কানে আসে এক বজ্র কঠিন শব্দ।বিরূপাক্ষের মাথার উপর বাদাম গাছে বসবাসরত হাজারো পাখির নিদ্রা ভঙ্গ হয় সে উদ্ভট শব্দে।পতপত শব্দে ডানা ঝাপটে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে তারা।
বিরূপাক্ষ থমকে দাঁড়ায়,,হুট করেই হৃদপিন্ডটা প্রচন্ড বেগে বিট করছে তার,ক্যামন যেনো হাঁসফাঁস করে উঠেছে ভেতরটা।মনে পরে,,এমন অনুভূতি আরো একবার হয়েছিলো, যেদিন দাদুভাই মারা যান। দেহের সকল ইন্দ্রীয় যেনো ক্রিয়া কর্ম বন্ধ করে অবসর নিয়েছে তার,, পুনরায় গুলির শব্দ হতেই সেগুলো আবার সজাগ হয়ে ওঠে।
শ্রবণ ইন্দ্রীয় জানান দেয় তৎক্ষণাৎ, খামার বাড়ি থেকেই গুলির শব্দ দুটো এলো।
বিরূপাক্ষ উদ্ভ্রান্তের মতো উল্টো দিকে ছুটতে শুরু করেছে,, মনের মধ্যে,মাথার মধ্যে, সমস্ত দেহে শুধু রিতির বলা একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,,”থাকো তুমি ওখানে ,আমি আসছি”
আর ভাবার কিছু নেই। খামার বাড়িতে গিয়েই ভাববে সে।অকারনেই চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে বিরূপাক্ষের।কি দেখবে সেখানে গিয়ে?সইতে পারবে তো?
******
খামার বাড়ির বাঁশের বেড়া ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে বিরূপাক্ষ।কোনো সাড়া শব্দ নেই। এখানে কিছু হয়েছে বলেও মনে হচ্ছে না।তবে কি তার আন্দাজ ভুল হলো। গ্রামের দিকে অনেক মানুষের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ গুলির শব্দে মানুষ জন হতবিহ্বল হয়ে পরেছে হয়তো।সে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় নিজের বসবাসরত ঘড়খানার দিকে,রিতি আসেনি ভেবেই শান্তি পেলো।ফোনটা নেবে এবার।
হঠাৎ করেই লাউ মাচার আড়াল থেকে কেউ এসে জাপটে ধরে প্রাণপনে।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরূপাক্ষ। খামারের মূল দরজায় কোলাহল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিছু লোক খামারের ভেতরেই আসছে। আবার গুলির শব্দ। এবারে কানে তালা লাগে বিরূপাক্ষের। শুধু বুঝতে পারে বুকের উপরের বোঝাটা প্রবল বেগে যেনো ধাক্কা দিলো তাকে। সেটাকে আঁকড়ে ধরে বিরূপাক্ষ। পিঠের কাছটা আঠালো স্যাঁতসেঁতে কিন্তু উষ্ণতায় ভরপুর।দূর থেকে ভেসে আসছে প্রদীপ এবং দাদাভাইয়ের কান্নাজড়িত গলার স্বর,,রূউউউপ,
সব কিছু ছাপিয়ে কানের একদম চুল পরিমান দূরত্বে আরেকটা নিথর মলিনকন্ঠ,,,
রূ–প–দা,,,,
মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে বিরূপাক্ষের, দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো,, দাদাভাই,,,,,
সে আর্তনাদের সুর ছড়িয়ে পড়লো জনহীন প্রান্ত পেড়িয়ে জনবহুল লোকালয়ে। শিশিরে, জোছনায় মিলে মিশে রাতের আঁধারে সে সুর ছড়িয়ে পড়লো দিগন্তের সীমান্তে।রিতিকে বুকে জড়িয়ে হাত পা ভেঙ্গে সেখানেই বসে পরলো সে।
উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোতে নিজের হাতের তালুতে দেখলো কালচে আবরণ।রিতির পিঠ থেকে রক্ত ছুটছে।
ক্যানো করলি এটা বুড়ি??এত পাকনামো করতে কে বলেছে তোকে?এই তুই কি করলি রে? এভাবে প্রতিশোধ নিতে আছে বল??আর কত জ্বালাবি আমায়??আর কত,,আর কত,,, চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে বিরূপাক্ষ,রিতির রক্ত ভেজা গালে নিজের গালটা মিলিয়ে কাঁদছে সে,,
রিতি এখনো সজ্ঞানে, নিজের প্রায় অবশ হয়ে আসা ডান হাতটা বিরূপাক্ষের বাম গালে মেলে ধরে বলে মৃদু স্বরে,, তোমার বিপদ কেটেছে রূপদা,,, আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। কিন্তু আফসোস যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু আমার হবে না গো,, তোমার বুকে মৃত্যু,,সেতো আমার স্বর্গসম সুখ হবে,,
তোর কিচ্ছু হতে দেবো না রে আমি,,রূপ দা আছি তো।আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নেয় রিতিকে,যেনো ছেড়ে দিলেই পালাবে দুষ্টু মেয়েটা,,
তোমার বনলতা যে অপেক্ষা করছে,,ভাঙা ভাঙা শব্দের উচ্চারণ রিতির। সবকিছু যেনো অকেজো হয়ে আসছে। চোখ জুড়ে অন্ধকার।মনের মধ্যে একটাই কষ্ট,, চিরচেনা রিতি হারলো আর অজানা, অচেনা বনলতাকেই জিতিয়ে দিলো বিরূপাক্ষ।কষ্টে যন্ত্রণায় সর্বাঙ্গ নীল হয়ে যাচ্ছে রিতির।
কাউকে চাইনা,কিচ্ছু চাই না আমার,,শুধু তুই থাক না বুড়ি,, কে থাকবে না থাকবে জানি না,তবে তোকে যে থাকতেই হবে,, থাকতেই হবে কিন্তু,,কারো হাতের টর্চ লাইটের এক চিলতে আলো পড়লো রিতির মুখে,দেখলো বিরূপাক্ষ,, ধীরে ধীরে আঁখি মুদে যাচ্ছে রিতির কিন্তু মুখে কোনো ব্যাথা বেদনার চিহ্ন পর্যন্ত নেই,,
হ্যা রিতির ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসি,,সে জিতেছে,রূপদা তাকেই জিতিয়ে দিয়েছে।এমনি এমনি কি আর এত ভালো বেসেছে মানুষটাকে। চোখের পাতা রুদ্ধ হলো।
কানে শো শো কিছু উদ্বিগ্নতা মেশানো শব্দের মিছিল,,
*****
পুষ্প রথের মনিমুক্তা খচিত সিংহাসনে রাজ-রাজেষ্যরীর বেশে বসে আছে রিতি। সম্মুখে স্বর্গরাজ্যের সিংহদ্বার,,, কিন্তু রথ তো চলছে না।মুখে ভুবন মোহিনী হাসি নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে রিতি,,
কি হলো রূপদা,, এবার তো ছাড়ো তোমার সোনার শিকল। আমাকে যে যেতে হবে। কঠিন মুখে তাকিয়ে বিরূপাক্ষ সেই আগের মতো শাসনের সাথে বললো,,
কি বোকা হয়েছিস তুই রিতি!একা একা কোথায় ছাড়বো তোকে?পথের মাঝেই পথ হারিয়ে কাঁদবি শেষে। নেমে আয় বলছি,সাথে করে নিয়ে যাবো আমি, সময় আসুক আগে।
রথের সাথে বেঁধে রাখা শিকল বিরূপাক্ষের দুহাতে। কোনোকিছুর বিনিময়ে তা ছাড়বে না।রিতি একবার তাকালো স্বর্গাভিমুখে আর একবার রূপ দার কাঠিন্য মেশানো করুন চোখের দিকে।কি করবে সে ,নেমে যাবে নাকি ছুটে যাবে অফুরন্ত সুখ,সমৃদ্ধি ও শান্তির দেশে????
চলবে,,,,
পর্বটি দেরীতে দেওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আগামী পর্বে উপন্যাসটির সমাপ্তি হবে আশা করি।
ভালো থাকবেন সবাই।
ভালো লাগলে একটা লাইক, কমেন্ট করতে ভুলবেন না যেন।