প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১
আজ জহির রায়হান অডিটোরিয়ামের কাছে প্রজাপতি উৎসব আরম্ভ হয়েছে।
আড়ং থেকে কেনা কাঠের ফ্রেমের আয়নায় তাকিয়ে আমি ঠোঁটে হাল্কা করে ক্রিমসন রেড লিপস্টিক মাখলাম, চোখে চিকন করে কাজল দিলাম, কপালে একটা কালো টিপ পরলাম। আমার মতে মেয়েরা প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর। তাই খুব রংঢং করে সাজাটাকে আমি বাহুল্য মনে করি। কিন্তু মিতির বাড়াবাড়িতে আজ আমাকে সাজতেই হলো। মিতি আর আমি প্রীতিলতা হলের ২১১ নম্বর রুম শেয়ার করছি তিন বছর ধরে। আমি জানি মিতি আমাকে কতটা ভালোবাসে। এ কারণে মিতির কোন আবদার আমি ফেলতে পারি না। মিতি আমার দিকে তাকিয়ে খুশীতে ঝলমল করে বললো,
-উফ, তোকে কেমন যে লাগছে রূপা।
আমি একটা টিস্যু দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিকের লাইনিং ঠিক করতে করতে বললাম,
-কেমন লাগছে? শাকচুন্নির মত?
-আমি যদি ছেলে হতাম, মাথা আওলায় যেতো। অচিন প্রেমিকের যে কী কাহিল অবস্থা হবে একমাত্র আল্লাহই জানে।
আজ প্রজাপতি উৎসবে অচিন প্রেমিকের সঙ্গে আমার দেখা হবে। আমি সেই ধরণের মেয়ে যে বাবামা’র পছন্দ করা ছেলেদের থেকে একজনকে বেছে নেবে। তারপর ভালো মানুষের মত বিয়ে থা করে নির্বিবাদে সংসার চালিয়ে যাবে। শরৎ চন্দ্রের নায়িকার মত সেই সবেধন নীলমণি হাজবেন্ডকে মেয়েটা গভীরভাবে ভালোবাসবে, যখন তখন প্রবল মান অভিমানের তোড়ে ভেসে যাবে।
কিন্তু আজ আমি কী করছি? অচেনা, অজানা একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হবে বলে নিজেকে সযত্নে সাজিয়েছি। সিরিয়াসলি? আমি? ভাবা যায়?
সব দোষ আসলে এই জাহাঙ্গিরনগর ইউনিভার্সিটির আলো হাওয়ার । এই যে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে হাল্কা সবুজ, ঘন সবুজ, ফিকে নীল সজীব সতেজ গাছপালা, কাঠগোলাপ আর কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে পাখীর কিচিরমিচির, একটু পরপর টলোমলো জলের সরোবর, আর এদের ফাঁকে ফাঁকে ফাঁকে লেগোর মত লাল ইট দিয়ে বুনন করা রম্য ভবন, এৎ আনন্দের মাঝে কত দিন মাথা ঠিক থাকে? প্রাণটা হায় হায় করে ওঠে না?
জাহাঙ্গীর নগরে পড়তে এসে আমার মত শক্ত মনের মানুষের মনও শেষমেশ টলে যাচ্ছে। কীসের একটা হাহাকার থেকে থেকে জেগে উঠছে মনে। শূন্যতাও যে বরফের মত জমাট বাঁধতে পারে আর পাথরের মত ভারী হতে পারে তা ইদানীং টের পাচ্ছি। হ্যাঁ, এর জন্য আমি বাংলাদেশের ষড়ঋতু আর জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসকেই দায়ী করবো। এটা যদি তেজগাঁ বিজ্ঞান কলেজ কিংবা মিপুর বিআরটিএ কিংবা সাভার ইপিজেড হতো, তাহলে আমি হলফ করে বলতে মনটা আমার এমন হাওয়াই মিঠাই হয়ে যেতো না।
আর হ্যাঁ, ওই অচেনা ছেলেটারও দোষ আছে। সে এক নাছোড়বান্দা। দিনের পর দিন আমার পেছনে জোঁকের মত লেগে আছে। এতদিন আমি কোন সাড়া দিইনি। আমার অবহেলা তাকে মোটেই দমিত করেনি। বিদেশে হলে এমন নাছোড়বান্দা ছেলেকে বলতো স্টকার, আর আমার জাহাঙ্গীরনগরের বান্ধবীরা বলে ও হলো একটা প্রথম শ্রেণীর মজনু।
ছেলেটা এমন কেন, চিঠির পর চিঠি লিখেই যাচ্ছে। কোন টেক্সট মেসেজ না, ফেইসবুক, ভাইবার, টুইটার, ইন্সট্রা না,আবোলতাবোল ইমোজি না। একেবারে ফাউন্টেন পেনে নীল কালিতে গোঁটা গোঁটা অক্ষরে হাতে লেখা প্রেমপত্র। নীল খামে ডাকটিকেট লাগানো চিঠি, হারানো দিনের মত। এমন উড়োচিঠি ভয়ঙ্কর হৃদয়ঘাতী। প্রতিটা বর্নের মোচড় আর কলমের নিবের নিবিড় চা্পে যে প্রেমের আকুলতা লুপ্ত থাকে তা কাগজে মেখে যায়। একটা চিঠি অনেকবার খুলে পড়তে ইচ্ছে করে, কাগজে হাত বুলালে কোন শব্দে কতটা আবেগ বোঝা যায়।
হ্যাঁ, একান্ত বাধ্য হয়ে স্বীকার করে নিচ্ছি ছেলেটার এই ডাকবিভাগীয় দৌরাত্ম্য আমার ভালো লেগেছে। এভাবে যত্ন করে দিনের পর দিন খামভরা উষ্ণতা পাঠালে পাথরও গলে যায়। আর আমি তো জাস্ট ফিলোসোফির রূপা। কিন্তু আমি যে একদম গলে গেছি তা না। ছেলেটা বারবার অনাথের মত দেখা করবার আবদার করায় আমি ব্যাপারটা বিবেচনায় এনেছিলাম। কিন্তু মিতির চাপাচাপির চাপল্যে দেখা করতেই হচ্ছে। মিতি বলছে, দেখা করতে তো কোন ক্ষতি কী? ভালো লাগলে লাগলো, না লাগলে নাই। মিতি বারবার শাড়ি পরতে বলছিল কিন্তু আমি মেরুন রঙের সালোইয়ার কামিজ পরলাম। শাড়ি পরলে বেশী বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, ছেলেটা অযাচিত পাত্তা পেয়ে যাবে।
আমি আর মিতি প্রীতিলতা হল থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নিলাম। জহির রায়হান অডিটোরিয়ামে সামনে প্রজাপতি উৎসব। ছেলেটা জানিয়েছে যে নীল পাঞ্জাবী পরে ওখানে অপেক্ষা করবে। প্রীতিলতা হল থেকে অডিটোরিয়ামে হেঁটে যেতে দশ বারো মিনিট লাগতো কিন্তু মিতি পোস্ট অফিসে একটা পার্সেল ড্রপ করবে। সে কারণে রিক্সা নিয়ে আমরা একটু ঘুর পথে যাচ্ছি।
আনন্দ দীঘির কাছে আসতেই দেখলাম টিটু ভাই হাতে কতগুলো প্ল্যাকার্ড নিয়ে হন হন করে হাঁটছেন। ছাত্রদের বেতন বাড়ানোর বিরুদ্ধে উনি কাল ছাত্র সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। টিটু ভাই একজন আশ্চর্য মানুষ। একদিকে সিরিয়াস রাজনীতি করছেন অন্যদিকে ইকনমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস পাচ্ছেন। কিন্তু আমু শুনেছি ভার্সিটির পলিটিক্সের কারণে ওনাকে টিচার করা হবে না। টিটু ভাই কোন অজানা কারণে আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। আমাদের দেখে রিক্সা থামিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন,
-রূপা এত সেজেটেজে কোথায় যাচ্ছো?
-প্রজাপতি উৎসবে।
-তোমাকেই তো প্রজাপতির মত লাগছে।
টিটু ভাইয়ের কথায় আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। মিতি বললো,
-টিটু ভাই, যান যান, আপনি আপনার ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করেন। আমার বান্ধবীর দিকে কুনজর দিতে হবে না। আমরা গেলাম, তাড়া আছে। এই রিক্সা চলো।
টিটু ভাইয়ের মুখ সামান্য লাল হলো। উনি মিতির কথায় চুপসে গেলেন? কে জানে। টিটু ভাই প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাঁটা দিলেন। পোস্ট অফিসের কাছে এসে মিতি আমাকে রিক্সায় অপেক্ষা করতে বলে পার্সেল হাতে ভেতরে ঢুকে গেলো। এখান থেকে অতিথি পাখী সরোবরের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। শীতকাল চলে গেলেও অতিথি পাখীদের কয়েকটি মায়ার টানে এখনো রয়ে গেছে। দূর থেকে ওদের ডানার ঝিকিমিক দেখতে দেখতে ভাবলাম মিতি আমার দেখা সবচেয়ে সুখী এবং বোকা মানুষদের একজন। তিন বছর ধরে মেয়েটা ক্লাসমেট রায়হানের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। দুজনেই ইংরেজি সাহিত্য পড়ছে। একটাই পার্থক্য, মিতি কোন রকমে টেনেটুনে পাশ করছে, ওদিকে সবাই জানে রায়হান বের হলেই লেকচারারের পোস্টটা পেয়ে যাবে। এই বিষমতা নিয়ে মিতির মনে বিন্দুমাত্র বিকার নেই। সে জনে জনে ঘোষণা করেছে পাশ করবার পরই রায়হানকে বিয়ে করবে। তারপর নাকি কোন চাকুরী করতে বললেও মিতি করবে না, তিন চারটা বাচ্চা নিয়ে মহা আনন্দে সংসার সামলাবে। মিতি ফিরে এসে রিক্সায় উঠে বললো,
-রূপা, চল্ এবার প্রজাপতি উৎসবে। তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।
-ফাজলামো করিস না, কীসের শুরু, আর কীসের সারা?
-এই যে আমি প্রেমট্রেম শেষে বিয়ের দিকে ধাইছি আর তুই মাত্র সরোবরে ডুব দিতে যাচ্ছিস।
-মোটেও না। আমি এসব প্রেমট্রেমে বিশ্বাসী না। তুই বারবার চাপ দিচ্ছিস, তাই যাচ্ছি।
-তোর কোন আগ্রহ নাই?
-বেনামে চিঠি লেখা ছেলেটা কে সেটা একটু জানতে ইচ্ছে করছে। দ্যাটস অল। বড় জোর বন্ধু হওয়া যেতে পারে।
দু মিনিটের ভেতর আমরা জহির রায়হান অডিটোরিয়ামের কাছে চলে এলাম। প্রজাপতি উৎসব বললেও এখানে এলাহি কান্ডকারখানা চলছে। হস্তশিল্প, কুটিরশিল্পের স্টল বসেছে, বাচ্চারা পিঠে প্রজাপতির ডানা লাগিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে, মেঝেতে মাদুর পেতে প্রজাপতি আঁকার আর্ট কম্পিটশন হচ্ছে। আমি মিতির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-প্রজাপতি উৎসবে প্রচুর প্রজা আর দু একজন পতি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রজাপতি খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে।
আমার কথা শুনে মিতি হেসে ফেললো। আমরা অডিটোরিয়ামের ডানপাশে একটা সবুজ নেটঘেরা যায়গায় এলাম। সামান্য দূরেই ভার্সিটির বাটারফ্লাই গার্ডেন। ওখান থেকে নানা রঙের প্রজাপতি এনে এখানে প্রদর্শন করছে। আমি কাছে এসে নেটে হাত দিতেই তিনটা সিল্ভার লাইন প্রজাপতি গোলাপ ফুলের ঝার থেকে ঝিলমিল ঝিলমিল করে উড়াল দিয়ে উল্টো পাশের নেটের উপর বসলো।
ওদিকে তাকাতেই সামান্য কেঁপে উঠলাম। ঝাঁকড়া চুলের একটা ছেলে নেটের উল্টো দিক থেকে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
(চলবে)
#এশরারলতিফ
পর্ব ২
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1340245509823806/