প্রজাপতি উৎসব পর্ব-১৩

0
481

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১৩

মিতিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও না।
দুটোর সময় আমার একটা জুম লেকচার ছিল। লেকচারের মাঝেই রায়হান ভাই ফোন দিলেন। ।আমি জুম মিউট করে ফোন ধরতেই রায়হান ভাই জিগেস করলেন,
-রূপা, মিতিকে দেখেছো? আমার সঙ্গে একটা ইম্পরট্যান্ট কাজে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ওর কোন খবরই নেই।
আমি জানি রায়হান ভাইয়ের ইম্পরট্যান্ট কাজ কী। মিতি বলেছিল আজ এগারোটায় রায়হান ভাই ওকে অ্যাবরশনের জন্য গ্রীন রোডের রাজমনি ক্লিনিকে নিয়ে যাবেন। মিতি সাড়ে দশটার দিকে একটা কালো সালোয়ার কামিজ পড়ে বেরোচ্ছিল। মিতিকে দেখে মনে হচ্ছিল আজ কোন শোক দিবস। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,
-আমি দোয়া করছি সব যেন ঠিকমত হয় মিতি।
মিতি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলেছিল,
-বাচ্চা রাখলে এক রকমের পাপ, না রাখলে আরেক রকমের। রায়হান আমাকে হাতে ধরে একটা নরকে ঢোকালো।
আমি মিতিকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললাম,
-জীবনে অনেক সময় না চাইলেও পাপ হয়ে যায় মিতি। কুদ্দুস স্যার কী বলেছিলেন মনে আছে? পাপ পুণ্যের ধারণা সমাজের বানানো। সোশ্যাল কন্সট্রাক্ট। এক সমাজে যেটা পাপ, আরেক সমাজ সেটাই সেলেব্রেট করে।
মিতি কোন উত্তর না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর মিতির সঙ্গে আমার কোন কথা হয়নি। আমি রায়হান ভাইকে বললাম,
-কেন মিতির তো আপনার সঙ্গেই থাকার কথা, ও বললো আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে।
-আমার সঙ্গে থাকলে কি আর তোমাকে ফোন করতাম? মিতির টিএসসি আসার কথা ছিল, আমি এক ঘন্টা বসেছিলাম আসেনি। তার উপর আবার মোবাইল অফ করে রেখেছে। এভাবে আমার সময় নষ্ট করার কোন মানে আছে?
আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,
-মিতি তো নরমালি এ রকম করে না। আচ্ছা,আমি খোঁজ করে আপনাকে জানাবো।
রায়হান ভাই বিরক্ত কন্ঠে আচ্ছা রাখি বলে ফোন রেখে দিলেন। আমি জুম লেকচার শুনতে শুনতে দিলশাদ আর অতন্দ্রিলাকে ভাইবারে টেক্সট করে মিতির খোঁজ করলাম। ওরাও আজ মিতিকে দেখেনি। আমার মনে হলো মিতি হয়তো শেষ মুহূর্তে দ্বিধায় পড়ে গেছে, কিংবা হয়তো আবরশনের ব্যাপারে ভয় পেয়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসে আছে। রায়হান ভাইকে এড়ানোর জন্যই মিতি ফোন অফ করে রেখেছে। আমার ধারণা ও সন্ধ্যার পর ঠিকই রুমে ফিরে এসে বলবে, আমি পারলাম না রূপা, আমার ভয় করছিল।
একবার ভাবলাম রঞ্জনকে ব্যাপারটা জানাই। সে বাইক নিয়ে এদিকওদিক ছোটাছুটি করে খোঁজ খবর নিতে পারবে। রঞ্জন এসব উড়নচণ্ডী কাজের কাজী। কিন্তু রঞ্জনের সঙ্গে এখন যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করছে না। পরশু দিনের ঘটনার পর মনের ভেতরে একটা কাঁটা খচখচ করছে। এটা বিরক্তির নাকি বিভ্রান্তির, ঠিক বুঝতে পারছি না। সেদিন বিকেলে সপ্তর্ষি ছাদ থেকে নেমে যাবার পর রঞ্জনের হঠাৎ মাথাব্যথা করছিল। ও তখুনি কেন্দ্র থেকে ঢাকায় ওদের নিজেদের বাড়িতে যেতে চাইছিল কিন্তু একা যেতে ভয় পাচ্ছিল। আমি ওকে উবার করে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিলাম। গাড়িতে বসে রঞ্জন বললো, সপ্তর্ষির কোন কথা বিশ্বাস করো না রূপা। সপ্তর্ষির বাইপোলার ডিজঅর্ডার আছে। সপ্তর্ষি কখনো খুব খুশী থাকে, তখন এক ধরণের কথা বলে। কখনো রেগে আবার আবোলতাবোল কথা বলে। শুধু তাই না, অন্য কাউকে সুখী দেখলে সপ্তর্ষি সহ্য করতে পারে না, ওর মাথায় আগুন ধরে যায়, উল্টাপাল্টা মিথ্যা বলে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে চায়। এ রকম সপ্তর্ষি আগেও অনেকের সঙ্গে করেছে। এ কারণেই ওর বাবামা ওকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়েছে।
মুহূর্তের জন্য আমার মনে হচ্ছিল রঞ্জন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে। আবার ও যা বলেছে সেটাও সত্য হতে পারে, একশভাগ উড়িয়ে দেবার মত না। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তাই রঞ্জঙ্কে পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বাড়িতে নামিয়ে দেয়ার সময় রঞ্জন বললো ওর বাবা মা নেপাল গেছে, আমি চাইলে ভেতরে গিয়ে ওর সঙ্গে মুভি দেখতে পারি। আমি রাজি হইনি। একটা ছেলের সঙ্গে একা বাসায় মুভি দেখা আমার কাছে অরুচিকর লাগে। ওকে নামিয়ে দিয়ে আমি খালার বাসায় চলে গেছি। পরশুদিন থেকে রঞ্জনকে নিয়ে মনের ভেতর একটা কাঁটা ঢুকে গেছে আর সেই কাঁটাটা এখন খচখচ করছে। নাহ, মিতির কথা ওকে এখন আর জানাবো না।
আজ সারা সকাল ব্যস্ত ছিলাম দেখে টিটু ভাইয়ের ইমেইল খুলে পড়ার সময় হয়নি। জুম লেকচার শেষে এক কাপ চা আর টোস্ট বিস্কুট নিয়ে টিটু ভাইয়ের ইমেইল খুলে বসলাম। টিটু ভাই লিখেছেন,
প্রিয় রূপা,
রাশিয়ার বসন্ত এক অদ্ভুত সময়। কোথাও কোথাও এখনো বরফ গলছে, কোথাও আবার হরিৎ লাবন্যের মাঝে প্রাণের আনন্দে লাল কমলা ফুল ফুটছে। বসন্তের আকাশ মহাসমুদ্রের মত উজ্জ্বল নীল। রূপা,এই বসন্তে একটা লোভী এবং খরচসাপেক্ষ কাজ করে ফেললাম। মস্কো থেকে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলে চড়ে বসলাম। বারো দিনের ভ্রমণে আমাদের ট্রেন সাতটা সময়রেখা অতিক্রম করলো। মস্কো থেকে তৃতীয় দিনে ট্রেন এলো ইয়েক্যাতেরিনবার্গ। যাবার পথে উরাল পর্বত কেটে টানেল বানানো হয়েছে। সেই টানেল থেকে ট্রেন বেরোতেই হঠাৎ সুবিশাল ইসেত নদীকে দেখে চমকে উঠতে হয়। ধ্যানগম্ভীর উরাল পর্বতমালার পাদদেশের এই শহর ভীষণ চঞ্চল আর কর্মব্যস্ত। আরেকাট কারণে এ শহর বিখ্যাত। রাশিয়ার শেষ জার মানে রোমানভ পরিবারকে এখানেই হত্যা করা হয়েছিল। ইয়েক্যাতেরিনবার্গ থেকে ষষ্ঠদিনে আমরা ইরকুতস্ক শহরে এলাম। এ শহরে রংবেরঙের অর্থডক্স ক্যাথেড্রাল আছে, এ কারণে শহরটাকে কোন আর্টিস্টের আঁকা ক্যানভাসের মত লাগে।। এর পরের দিন সাইবেরিয়ার লিতভিয়াঙ্কা গ্রামে ট্রেন থামলো। লিতভিয়াঙ্কা গ্রাম ঘেঁষে তুঁতরঙের বৈকাল হ্রদ। ছোটবেলায় ভূগোলে অনেকবার পড়েছি এই বৈকাল হ্রদের কথা। বৈকাল হ্রদে টিকেট কেটে হাইড্রফয়েলে ঘোরা যায় কিন্তু আমি এবার আর ঘুরিনি। ওখান থেকে তিনদিন পর এলাম প্রশান্ত মহাসাগরের পারে ভ্লাদিভস্তক শহরে। এখানে আগে নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল, এ কারণে সিভিলিয়ানদের ঢুকতে দিতো না। এখন অনেক জাহাজকেই ওরা যাদুঘর বানিয়ে ফেলেছে। ভ্লাদিভস্তকে দুদিন কাটিয়ে প্লেনে মস্কো ফিরে এলাম। তোমাকে ভোলার ব্যাপক ব্যর্থ প্রয়াসের সমাপ্তি ঘটলো।
কী আশ্চর্য, মস্কো ফিরে এসেই তোমার চিঠ পেলাম। রূপা, আমি কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করিনি তুমি আমায় চিঠি লিখবে। বিবশ হৃদয়ে, কম্পিত হাতে খাম খুললাম। ধানক্ষেতে যেমন বসন্তের হাওয়া বয়ে যায় ঠিক তেমনি আমার চোখের চাওয়ার হাওয়া বয়ে গেলো তোমার চিঠির শব্দ চন্দনের বনে। কী সুন্দর করে তুমি নিজেকে ব্যাখ্যা করেছো। আমার প্রেমকে গ্রহণ করোনি কিন্তু স্বীকার করেছো। সেই-ই ঢের। রূপা, জানো, আগে কখনো বাংলা বর্ণমালাকে এত অলৌকিক লাগেনি। কাল গভীর রাতে তোমার চিঠি পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হচ্ছিল এ ফোর সাইজের কাগজটা যেন হঠাৎ রাতের আকাশ হয়ে গেছে আর তার মাঝে হীরের কুচির মত জ্বলজ্বল করছে তোমার আঙ্গুলের ঘূর্ণিমাখা প্রতিটি বর্ণ। চিঠি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কোন কোন শব্দ গ্রহের মত, ওদের গায়ে লেপ্টে আছে মন্দ্র আলোর আভা। আবার কোন কোন শব্দ নক্ষত্রে মত অস্থিরভাবে একবার জ্বলছিল, একবার নিভছিল। এক সময় সেই আলোর বন্যায় আমার হৃদয়পাত্র উপচে পড়লো। সেই অনন্ত নক্ষত্র বীথি ভাঁজ করে আবার খামে ভরে রাখলাম। অনেকদিন পর পরম প্রশান্তিতে ঘুমলাম।
এই ভোরের আলোয় ঘুম ভেঙ্গে মনে হচ্ছে রাতের সকল তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।
ইতি
টিটু
পুনশ্চঃ তুমি কি বুঝতে পেরেছ তোমার প্রত্যাখ্যান পত্রই তোমার প্রেমপত্র? আমি তো ওই চিঠিতে শুধু প্রেমই পেলাম, এক পংক্তির প্রত্যাখানটুকু যেন নিজের উপর জোরজবরদস্তি করা ফরমায়েশি লেখা।
টিটু ভাইয়ের চিঠি পড়লেই কেন যে বুকটা হু হু করে ওঠে আর কান্না আসে বুঝতে পারি না। আমি ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতেই টুং করে দিলশাদের টেক্সট এলো,
-রূপা, মিতিকে পাওয়া গেছে, খুব খারাপ খবর ।
(চলবে)

পর্ব ১২
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1354178775097146/
পর্ব ১৪ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1356707304844293/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here