প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১৯
এত সকালে আব্বু হলে এসেছে শুনে অবাক হয়ে গেলাম।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে গেস্ট ওয়েটিংরুমে গেলাম। দেখলাম আব্বুর হাতে একটা ভাঁজকরা পত্রিকা, কিন্তু আব্বু পত্রিকা পড়ছে না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আব্বু গাজীপুরে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নিশ্চয় নিয়মিত ক্লাস নিতে হচ্ছে। কিন্তু আব্বুকে দেখে কেমন জুবুথুবু লাগছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, মুখে বলিরেখা বেড়েছে, চুল ঠিকমত আঁচড়ায়নি। আব্বুর বয়স এখন মাত্র সাতান্ন। অথচআব্বু নিজের কোন যত্ন নিচ্ছে না। এগুলো অবশ্য আম্মুই দেখভাল করে। আমি আব্বুর পাশের সোফায় বসে বললাম,
-আব্বু, কী হয়েছে? আমাকে খবর দিলে আমিই চলে আসতাম।
-না, তেমন কিছু না, হঠাৎ তোকে দেখতে ইচ্ছে হলো।
-আমি তো ভালোই আছি। ফাইনাল ইয়ারটা শেষ হয়ে গেলে চাকুরীর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বো।
আব্বু একটু ইতস্তত করে বললো,
-একবার এসে তোমার আম্মুকে দেখে যেও।
আম্মুর সাথে ফোনে প্রায়ই কথা হয় কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধ আম্মু ফোন ধরছে না। আম্মু যখন ফোন করে আমি ব্যস্ত, আমি যখন ফোনকরি আম্মু ব্যস্ত। আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,
-কেন, কী হয়েছে আম্মুর?
-কিছু না, অনেক দিন আসো না, তাই বললাম।
-ঠিক আছে আব্বু, সামনের শুক্রবার দিনে চলে আসবো।
-তোর ছোট মামা শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করেছিল না?
ছোট মামা আম্মুকে দিয়ে বলিয়ে আমাদের জমি বিক্রি করে শেয়ার বাজারে বিশ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছিল। কম করে হলেো নাকি দ্বিগুণ লাভ হবে। আমি বললাম,
-লাভ এসেছ কোন?
-উল্টো লস হয়েছে। তোর ছোটমামা বলছে শেয়ার মার্কেট নাকি ফল করেছে।
-তার মানে কী?
-আমাদের শেয়ারের কোন ভ্যালু নাই, শেয়ার সার্টিফিকেট কাগজের মত হয়ে গেছে।
আমি আঁতকে উঠে বললাম,
-তার মানে আমাদের সব টাকা লস। এখন কী হবে?
-জানি না।
-আম্মু কী বলে?
-কিছু বলে না, তোর মা তো সব কিছু ভুলে যায়।
-ভুলে যায় মানে?
-আগেও ভুলে যেতো। কিন্তু এখন একটু পরপর সবকিছু ভুলে যায়। শেয়ারের কথা বললাম, মন খারাপ করলো, কিন্তু একটু পর আবার ভুলে গিয়ে দুধের সেমাই বানাতে বসে গেলো।
আব্বুর কথা শুনে মনে হচ্ছে আম্মুর স্মৃতির সমস্যা হতে পারে। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম,
-আম্মুকে ঢাকায় নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। বেশী দেরী করা যাবে না। দেখি আমি তোমাদের ওখানে গিয়ে কিছুদিন থাকবো।
-ক্লাস মিস হবে না? তার চেয়ে মাঝে মাঝে এসে দেখে যা।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। সব পরিবারেই হঠাৎ বিপদ নেমে আসে, বিপদ আসলে একা আসে না, সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে আসে । আমাদের পরিবারেও সেই পর্ব আসি আসি করছে মনে হয়।
আম্মুর আগেও কিছু সমস্যা ছিল, আম্মু আব্বুকে সব সময় অযথা সন্দেহ করতো। সেটা তবু সামলানো যেত। এবার কী হবে জানি না। আব্বু এবার আমার একটি কাছে সরে এসে বললো,
-জানি না কী হবে সামনে। তোর আম্মুর সব মনে থাকতে থাকতে তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো।
আব্বুর কথায় আমি চমকে উঠলাম। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে নিয়ে ভাবতে চাইনি। বললাম,
-আমার বিয়ে?
-তোর হীরা মামার এক বন্ধুর ছেলে আছে। ফাইন্যান্স থেকে পাস করেছে।
-তো?
-তোকে দেখেছে।
-কোথায়?
-এখানেই।
-এখানে পড়ে?
-না, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, কিন্তু এখানে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে আসে, তোকে দেখেছে।
-তো?
-ছেলেটারে ফ্যামিলির হাতিরপুলে বাড়ি আছে। ছেলেটার বাবা প্যারালাইজড।
-আমাকে বলছো কেন?
-ওরা প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম,
-বাবা এসব বাদ দাও, আমি এখন বিয়ে করবো না।
– তোর মা’র শরীর যদি আরও খারাপ হয়ে যায়? জমিজমাও সব রসাতলে গেলো।
আব্বুর চোখ হঠাৎ ভিজে গেছে, সংসার নদীর পাড় ভাঙছে, আব্বু অসহায় বোধ করছে। আমি মন খারাপ করে বললাম,
-তাহলে আমাকে কী করতে বলছো?
-ছেলেটার সঙ্গে দেখা কর, ভালো লাগলে লাগলো, না লাগলে নাই।
-আচ্ছা আমি দেখা করবো, আগে মাকে ডাক্তারের কাছে নিই, তারপর।
আব্বু যেন স্বস্তি পেলো, আমি মত পাল্টাবার আগেই চলে যাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি বললাম,
-চলো ক্যাফতে গিয়ে নাস্তা করে আসি।
-আজ না, তোর মা বাড়িতে একা, তুই আয়, তখন কথা হবে।
বাবা চলে যেতেই আমি সোফার উপর গা ছড়িয়ে দিলাম। রঞ্জন আর টিটু ভাইকে নিয়েই আমি দ্বৈরথ বানিয়ে ফেলেছি। তার উপর আব্বু আবার এ কী ঝামেলা চাপিয়ে দিলো? আব্বুকে কি এখুনি জানিয়ে দেবো রঞ্জনের কথা? কিন্তু আমি তো এখুনি রঞ্জনের কথা বাবাকে বলতে চাই না। কোথায় যেন একটা জড়তা বোধ করছি। কীসের জড়তা এটা? আজ পরীক্ষা আছে বলে এই নিয়ে খুব বেশে ভাবতে পারলাম না।
পরদিন সকালে বাস ধরে বাড়ি চলে এলাম। আমাকে দেখে আম্মু বললো,
-কাকে চাই?
-আম্মু কী বলছো? আমি রূপা।
-হ্যাঁ, জানি তো, ইস কতদিন পর এলি। ভেতরে আয়।
ড্রইং রুমে গিয়ে দেখি শো কেসে, সোফার হাতলে ধূলা জমে আছে, সবগুলো কুশন একটা সোফায় স্তুপ করে রাখা, ফ্যানে মাকড়শার ঝুল। আমি আম্মুকে বললাম,
-বুয়া আসে নাআ আম্মু?
আম্মু বললো,
-অনুফা আজ আসলো না, আবার কাল আসবে। এত ফাঁকি দিলে হয়?
অনুফা পাঁচ বছর আগে আমাদের বাসায় কাজ করতো। মা সেটা ভুলে গেছে। নতুন বুয়ার নাম মালেকা। আব্বুর ঘরে গিয়ে দেখলাম আব্বু নেই। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। তার মানে মালেকা বুয়া এসেছে। রান্না ঘরে গিয়ে দেখলাম আব্বু ডাল বাগাড় দিচ্ছে। আমাকে দেখে বললো,
-এসেছিস?
-হ্যাঁ, বুয়া কোথায়?
-আসে নাই, ছেলের শরীর খারাপ।
আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-তুমি সরো, আমি বাকিটা করি।
-না, না, তুই তোর মার কাছে গিয়ে বোস, আমি চা নিয়ে আসি।
বুঝলাম বাবা এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, অথচ আমি এসবের কিছুই জানি না। নিজের উপর রাগ লাগলো। পড়ালেখা আর মানসিক টানাপড়েনে নিজের বাবামা’র খেয়াল রাখতে পারিনি।
সেদিন সারাক্ষণ মাকে লক্ষ্য করলাম। বেশীরভাগ সময় মা আমাকে চিনছে কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ ভুলে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে। আমার বান্ধবী তানিয়ার বড় বোন সুমাইয়া আপু নিউরলজির স্পেশালিস্ট। আমি তানিয়াকে ফোন করে সুমাইয়া আপুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট যোগাড় করে দিতে বললাম। তানিয়া বললো চিন্তা না করতে। দু একদিনের ভেতর আপয়েন্টমেন্ট ম্যানেজ হয়ে যাবে।
ফেরার সময় আব্বু বললো,
-তোর মা’র অবস্থা তো দেখলি, আমার ভালো লাগছে না। তোর বিয়েটা হয়ে গেলে শান্তি পেতাম।
-আমি বলেছি তো ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলবো, তুমি দিন ক্ষণ ঠিক করে জানাও। ওকে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে আসতে হবে।
ক্যাম্পাসে ফেরার সময় মনে হলো, এই জীবন আর আগের মত ফড়িঙের পাখায় ভাসবে না। এখন প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আম্মুর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আর আব্বুর শেয়ার বাজারে লসের কথা মাথায় রেখে। আম্মু নিজেই অনেক কষ্ট পাচ্ছে, আমি ওদের কোন বাড়তি কষ্ট দিতে পারবো না। আসার পথে মোবাইলে ইমেইল চেক করে দেখলাম টিটু ভাই আরেকটা মেইল দিয়েছেন,
প্রিয় রূপা,
আমি আজ জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসি থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে গোরি শহরে এসেছি। এখানেই জুগেসভিলি জন্মেছিলেন, পৃথিবী যাকে লৌহমানব জোসেফ স্টালিন নামে চেনে। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার যে বিদ্যুৎবেগে উন্নতি হয়েছে তার খেসারত দিতে হয়েছে ভিন্নমতালম্বীদের। যারাই স্টালিনের বিরুদ্ধাচরণ করেছে স্টালিন তাদেরকে নির্মমভাবে মেরেছে। এমনকি চিরশত্রু ট্রৎস্কি মেক্সিকোতে বসেও স্টালিনের রক্তের হোলিখেলা থেকে রক্ষা পায়নি।
আমি সব সময় ভাবি এ রকম একজন সাইকো কীভাবে এত বছর ক্ষমতায় টিকে থাকলো? পরে বুঝলাম, যখনই ওনার বিরুদ্ধে কোন অভ্যুত্থান হয়েছে বা গোয়েন্দারা অভ্যুত্থান হবার সম্ভাবনা আঁচ করেছে, তখুনি স্টালিন নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। স্টালিন যদি সবার কথা শুনে এগোতেন তাহলে কি নানা মতের চাপে আদৌ রাশিয়ার উন্নতি সম্ভব হতো? আমি জানি না।
জীবনে কোন কোন মুহূর্তে আসে যখন স্টালিনের মত চোখ বন্ধ করে একদিকে চলতে হয়। আজ গোরিতে এসে একটা উপলব্ধি হলো আমার জীবনে সেই মুহূর্তটি এসেছে।
রূপা, কাল সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তোমার কথা ভেবেছি। মন বলছে সত্যিকার ভালোবাসাকে চব্বিশ ঘন্টার হিসেব নিকেশ আর চাহিদার চাপে পিষে ফেলা কতটা সঙ্গত? এদেশে দেখি প্রচুর বিয়ে ভেঙ্গে যায় অথচ একদিন এরা ভালবেসেই একত্র হয়েছিল। তাহলে কোথায় কখন কীভাবে এদের সম্পর্কের আত্মাটা মরে ভুত হয়ে গেলো?
তাই ভয় হয় আজ যাকে আদরে মায়ায় যতনে কাছে টেনে নেবো তাকে যদি দশ বছর পর ঠিকমত মূল্য দিতে না পারি? এমন দৃশ্য আমি ভাবতেও চাই না যে, তুমি ক্লান্ত দেহে কিছু একটা কাজ করছো, তোমার সারা শরীর বেঁয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে, অথচ আমার কোন বিকার হচ্ছে না। অথবা এমন বিষাদকাল চাই না যখন সম্পর্কের একঘেয়েমী এড়ানোর জন্য আমরা সকাল সকাল অফিস চলে যাচ্ছি আর অফিস শেষে দেরী করে বাড়ি ফিরছি।
রূপা, আমি খুব বেশী ভালোবাসি তোমাকে। এখন সেই অতি আদরের চাঁদের আলো হাতের মুঠোয় ধরতে ভয় পাই।
রূপা, তোমার আমার দূরে দূরে থাকাই ভালো। প্রতিদিনের দেনাপাওনা মেটানো ব্যবসার জন্য আদর্শ, কিন্তু মনের জন্য ক্ষতিকর।
ইতি
টিটু
আজ আম্মুকে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছি, মনে হচ্ছিল আমার চারপাশ সবকিছু ভেঙ্গে পড়ছে। তবু নিজেকে শক্ত রেখেছি। কিন্তু টিটু ভাইয়ের চিঠি পড়েআর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাদেত ইমেইলের উত্তর লিখলাম,
টিটু ভাই,
তুমি তোমার স্টালিন লেনিন নিয়ে যত ইচ্ছে ডুবে থাকো। আমি সামান্য মেয়ে, আমি সামান্য ভালোবাসা চাই। প্রতিদিন, প্রতিঘন্টা, প্রতি মিনিট আমি শুধু ভালোবাসা চাই। প্লিজ, আমাকে আর এসব থিয়োরি শোনাবে না।
রূপা
ইমেইলটা পাঠানোর পর বুঝলাম টিটু ভাইকে হঠাৎ তুমি বলে ফেলেছি।
(চলবে)
পর্ব ২০
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1365520520629638/