প্রজাপতি উৎসব পর্ব-২০

0
474

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব 20

আমি ফিলোসফি পড়ছি। কিন্তু ভেবে দেখলাম আমার জীবনে বড় কোন দর্শন নেই। এমনকি মানুষ হিসেবে আমি ভীষণ আটপৌরে। শিমুল তুলোর মত হাল্কা পল্কা শুভ্র আমার চাওয়া। আমি চাই কেউ আমাকে খুব ভালোবাসুক, আমার বিরহে কেউ ভীষণ কষ্ট পাক। আমি একদিন বাড়ি না থাকলে কেউ যত্ন করা টবের গাছগুলোয় পানি ঢেলে দিক, আমাকে খুশী করবার জন্য কোন রকমে আনাড়ি হাতে ঘরটা গুছিয়ে রাখুক, বাহাদুরি করে ডাল বাগাড় দিতে গিয়ে কড়াইয়ের কোণা লেগে হাত পুড়াক, আমি কষ্ট পাবো দেখে সেই পোড়া দাগ শার্টের হাতা দিয়ে ঢেকে রাখুক।

এমন কেউ এলে তার বিনিময়ে আমি সমস্ত জীবন দিতে রাজি আছি। টিটু ভাই কি সেই মানুষ? আমার তো এখন তাই মনে হচ্ছে। আবার কখনো মনে হয় যতই আবেগ দেখাক, সংসারের মন্দ্রসপ্তকে বিহবল হবার মানুষ টিটু ভাই না। টিটু ভাইয়ের যে কোন কাজে উদ্দেশ্যই হলো সমাজ বিপ্লবের সৈন্য নিয়োগ। সংসারের লোভ দেখিয়ে কাছে টেনে প্রিয়তমাকেও উনি শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির সৈনিকে রূপান্তর করবেন। তবু টিটু ভাইয়ের মনের ছায়া আমার মনকে শান্ত করে।

আজ ভেবে দেখলাম রঞ্জনের কাছে আমি কখনো শান্তি চাইনি, চেয়েছি মোহময় উত্তেজনার উদ্বেল স্রোত। রঞ্জনের ঈশান কোন থেকে মত্ত বাসনার মোহমেঘ এসে আঁধারে ঢেকে দিয়েছে আমার সব বাছবিচার। কী এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ আমাকে টেনে নিতে চাচ্ছে রঞ্জনের বলিষ্ঠ বাহুর দিকে। টিটু ভাইকে ভালোবেসেও রঞ্জনকে আমি না বলতে পারছি না। রঞ্জনের ধোঁয়াশার চুম্বকে আমার মন লোহার গুঁড়োর মত লেপটে যাচ্ছে। নিজেকে নিজেই বুঝ দিচ্ছি, রঞ্জনকে কথা দিয়ে কীভাবে এখন সরে দাঁড়াই?

কিন্তু সত্য হলো মোহ এমন এক সর্বনাশা জল, ডুব না দিলে ও থেকে মুক্তি মেলে না। আগুন ভয়ংকর জেনেও পতঙ্গ তাই নিষ্ঠুর আগুনের দিকেই ধায়। কিন্তু বিয়ে না করে রঞ্জনের স্রোতে আমি কোনভাবেই গা ভাসবো না।

আমার মনে যে এত ঝড় বইছে তা একমাত্র অতন্দ্রিলা জানে। গাঁজায় টান দিতে দিতে অতন্দ্রিলা বললো,
-আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, তোর এই রঞ্জনটা একটা খেলারাম, প্লেবয়। এদের আমার ভালোমত চেনা আছে। এরা হলো হাড্ডচেড়া শয়তান। তোকে বিয়ে করার কদিন পর দেখবি এত মেয়ে নিয়ে লোফালুফি করছে, তোর জীবনটাই ছারখার হয়ে যাবে।

-তাহলে তুই বলছিস টিটু ভাইকে হ্যাঁ বলতে?

-সে তোর ইচ্ছে, কিন্তু টিটু ভাইয়ের অন্য সমস্যা।

-কী সমস্যা?

-টিটু ভাই একটু টিচারমার্কা।

-মানে?

-মানে বিয়ের পর ওনার ভালো ভালো উপদেশের ঠ্যালায় বাঁচবি না। দেবতার সাথে কি ঘর করা যায়?

-তাহলে কী বলছিস?

-একদম সাধারণ মানুষ খুঁজে বের কর, যার সঙ্গে দিন আনবি আর দিন খাবি।

-কী বলছিস?

-সংসারের তেল ভরবি আর চালাবি।

আমি হেসে বললাম,
-সংসার একটা মোটর সাইকেল নাকি যে তেল ভরবো আর চালাবো?

অতন্দ্রিলা গাঁজার ঘোরে মেঝেতে শুয়ে পড়ে বললো,
-হ্যাঁ সোনামণি, সংসার একটা মোটর সাইকেল, যন্ত্রণার দ্বিচক্রযান। আমি সেই মোটর সাইকেলে জীবনেও চড়বো না। আই হেইট মেন।

পরদিন দুপুরে বাবার ঠিক করা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় এলাম। ছাত্রদের ভিড়ের মাঝে কর্পোরেটের মত দামী ফর্মাল পোশাক পরা একটা ছেলেই বসে আছে। তাই চিনতে অসুবিধা হলো না। ছেলেটার নাম মোহন, একটা বড় মোবাইল ফোন কোম্পানির অ্যাকাউনট্যান্ট। আমি কাছে যেতেই মোহন উঠে দাঁড়িয়ে আমার চেয়ারটা টেনে ধরলো। আমি বসতেই সেও চেয়ারে বসে বললো,
-আপনার বাবা বললেন আপনি এখানে ছাড়া আর কোথাও দেখা করবেন না।
-জি আব্বু ঠিকই বলেছেন।
-তা না হলে আপনাকে ভালো কোন রেস্টুরেন্টে ইনভাইট করতাম।
-আমি এখানেই বেশী আরাম পাই, অন্য কোথাও গেলে আমার নার্ভাস লাগে।
-আমার সম্পর্কে আপনার কিছু জানবার আছে?
-জি।
-বলুন।
-আমাকে আপনি কোথায় দেখেছেন?
-এখানেই, আমি ছুটির দিনে প্রায়ই আসি। আপনাকে বেশ কবার দেখেছি।
-আর দেখেই ভালো লেগে গেছে।
-ভালো লাগলে এক দেখাতেই লাগে, না লাগলে একশ বার দেখলেও লাগে না।
-আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করি। না, একটা না, দুটো ছেলেকে পছন্দ করি।
-একটা শুনে ভয় পেয়েছিলাম, দুটো শুনে আশ্বস্ত হলাম।
-মানে?
-মানে আপনি টানাপড়েনে আছেন আর আমি সময় মতই প্রস্তাব পাঠিয়েছি।

মোহন সাহেবের কথায় আমার হাসি চলে এলো। উনিও হেসে ফেললেন, হাসলে ওনাকে মিষ্টি লাগে। কিন্তু তাতে আমার কী? আমি বললাম,
-আপনি ভুল বলেননি, আমি টানপড়েনে আছি, এর মাঝে তৃতীয় আরেকটা ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না।
-আমি তো এখুনি কোন সিদ্ধান্ত চাচ্ছি না। আপনি ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। শুধু এটুকু জানিয়ে রাখছি, আমি আপনাদের পাশে আছি।
-পাশে আছেন মানে?
-আপনার আম্মুর শরীর ভালো যাচ্ছে না, ওনাকে শুধু ডাক্তার দেখালেই হবে না, নার্সিং প্রয়োজন। আমি সেটার ব্যবস্থা করছি। আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হোক না হোক, এটা আমি করবো।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
-কী বলছেন? আপনি কেন করবেন?

-আসলে আপনাদের বাসায় দু তিবার গিয়েছি। আমার মা নেই, মানে সৎ মা আছেন। আর আমার বাবা প্যারালাইজড। আপনার মা দেখতে অনেকটা আমার আসল মায়ের মত। একটা মায়ার টানে পড়ে গেছি।

আমি সামান্য আবেগাক্রান্ত হয়ে বললাম,
-আসলে সেটা আপনার ব্যাপার। এখন বলুন আমাকে কেন আপনার ভালো লেগেছে।

-ওই যে বললাম প্রথম দেখায় ভালো লেগে গেছে কারণ ছাড়াই। তারপর খোঁজখবর করলাম, সবাই আপনার প্রশংসা করলো, বললো আপনি খুব শক্ত চরিত্রের মানুষ।

-দেখুন আব্বু চাপ দিচ্ছেন আম্মুর স্মৃতি হারিয়ে ফেলবার আগেই যেন বিয়ে করি। আব্বুকে খুশী করবার জন্যই আপনার সঙ্গে দেখা করলাম। এটাকে অনুগ্রহ করে পজিটিভলি নেবেন না।

-আমি আপনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকবো।

মোহন সাহেব চলে যাবার পর ভাবলাম, এই লোকটা অন্যরকম। এর চেহেরায় রঞ্জনের মত একটা ক্যারিশমা আছে, অন্যদিকে কথাবার্তায় মনে হলো টিটুর মত মানবিক উদারতাও এর চরিত্রের অংশ।

আমাদের পরিবারে হঠাৎ একটা বিপর্যয় নেমে এসেছে। আব্বু যেভাবে চাপ দিচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত আমাকে কী করতে হয় কে জানে।

(চলবে, ছোট পর্বের জন্য দুঃখিত)

পর্ব ১৯
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1364075447440812/
পর্ব ২১ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1366817967166560/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here