প্রজাপতি উৎসব পর্ব-২২

0
490

প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৩

আজ সন্ধ্যায় আমার বিয়ে। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না।

সোমবার দিন আম্মুকে চেক আপের জন্য ডক্টর রুহুল আমিনের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডক্টর রুহুল আমি বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট। ঢাকা শহরে ওনার ব্যাপক পসার। তিন মাসের আগে ওনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু মোহন কাকে কাকে ধরে দুদিনের ভেতর অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে ফেললো। বাইরে থেকে ওনাকে যত ব্যস্ত লাগে, সামনা সামনা উনি তার উল্টো পরিমান শান্ত । ডাক্তার সাহেব আম্মুর সাথে প্রায় বিশ মিনিট ধরে গল্প করলেন আর কাগজে কী সব টুকে রাখলেন। পরীক্ষা শেষ আমার কাছে এসে বললেন,
-দেখুন আমি কতগুলো কুইক টেস্ট নিলাম। শর্ট এবং লং টার্ম মেমোরি, অ্যাটেনশন স্প্যান, কথা বলার ক্ষমতা এসব পরীক্ষা করলাম। তাছাড়া উনি স্থানকাল এবং সময় আন্দাজ করতে পারেন কিনা তাও দেখলাম।

-কী বুঝলেন?

-আপনারা বললেন আর্লি স্টেজ। কোন ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?

আমাকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখে উনি বললেন,
-যাকেই দেখিয়ে থাকেন, আমার মনে হয়েছে রোগ অনেক প্রগ্রেস করে গেছে। তবে কয়েকটা টেস্ট করালে কনফার্ম হয়ে বলতে পারবো।

ওনার পরামর্শমত লিভার ফাংশন, কিডনি ফাংশন, থাইরয়েড ফাংশন, হিমোগ্লোবিন এ১সি, ভিটামিন বি ১২ লেভেল পরীক্ষার জন্য ব্লাড টেস্ট করালাম, ব্রেইন এম আর আই আর পিইটি স্ক্যান করালাম।

সাতদিন পর সব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার সাহেব বললেন,
-রোগের ক্ষেত্রে খারাপ খবর না দেয়াটাও অন্যায়, আপনার মা’র আরপিডি হয়েছে।

-আরপিডি মানে?

-র‍্যাপিডলি প্রগ্রেসিং ডিমেনশিয়া। রোগটা খুব তাড়াতাড়ি খারাপের দিকে যাবে।

-কত তাড়াতাড়ি?

-এক বছর ধরে যে ক্ষতি হতে পারতো তা এক সপ্তাহ থেকে এক মাসের ভেতর হয়ে যেতে পারে।

-আপনি কী ক্ষতি বোঝাচ্ছেন? কপ্লিট মেমোরি লস? মানে এপ্রিল মাস থেকে আর কাউকেই চিনবে না?

-না, তার থেকেও খারাপ।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
-তাহলে কী বলতে চাইছেন?

-আমি মিন করেছি এপ্রিল মাসের শুরুতেই আপনার মা মারা যেতে পারেন, আবার ভাগ্য ভালো হলে আরও কিছুদিন বাঁচতেও পারেন।

আমি কান্না চেপে বললাম,
-আর আমাদেরকে মনে রাখা? আর কদিন আম্মু আমাদেকে মনে রাখতে পারবে?

-এক দু সপ্তাহ পর আপনাদেরকে আর চিনবে বলে মনে হয় না। কিন্তু ওনাকে বাঁচিয়ে রাখাই যখন কঠিন, মনে রাখা না রাখা ভেবে কী হবে? এখন মোস্ট ইম্পট্যান্ট হলো প্যালিয়েটিভ কেয়ার, উনি যেন ডিগনিটি নিয়ে গন্তব্যে যেতে পারেন।

আম্মু পাশের ঘরে অপেক্ষা করছিল, সঙ্গে কেয়ার গিভার সুরাইয়া। আমি আম্মুর কাছে যেতেই আম্মু বললো,
-ডাক্তার সাহেব খুব সুন্দর সুন্দর কথা বললেন। ওনার কাছে না এলে ভাবতাম আমার আবার অসুখ বাঁধলো কিনা।

আমি এবার আর চোখের পানি সামলাতে পারলাম না। মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললাম। মা বললো,
-কী হয়েছে? আবার পরীক্ষায় ফেল করেছিস? ঠিক মত পড়ালেখা না করলে কলেজে উঠবি কী করে?

এই কদিন মোহন ওর গাড়িটা আমাদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে রেখেছে। তা না হলে কী যে একটা অবস্থা হতো। গাড়িতে উঠতেই মোহনের ফোন এলো,

-ডাক্তার কী বললেন?

-ভালো না, খুব খারাপ খবর। পড়ে বলবো। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

বিকেলে বাবার সঙ্গে কথা সেরে অতন্দ্রিলাকে সবকিছু জানালাম। অতন্দ্রিলা শুনে বললো,
-তার মানে তোর বিয়েটা ডিসেম্বরে না, বরং এখুনি সেরে ফেলতে হবে।

-হ্যাঁ, আমার খুব নার্ভাস লাগছে।

-কিন্তু কিছুই করার নেই। মোহনকে জানিয়েছিস?

-মোহনকে জানাবো একটু পর। কিন্তু বিয়ে নিয়ে আমি নিজে থেকে কিছু বলবো না। ও বলুক আগে।

-ঠিক আছে। আমি একটা কথা বলবো?

-বল।

-বিয়ের সময় অনেক কাজের চাপ পড়ে। কত রকমের আয়োজন। কিন্তু ওসব নিয়ে একদম টেনশন করবি না। কেনাকাটা থেকে শুরু করে তোকে সাজিয়েগুজিয়ে বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিলশাদ আর আমার। তবে খবরদার, রঞ্জন যেন কিছু জানতে না পারে।

অতন্দ্রিলার কথায় শান্তি পেলাম। আম্মুর স্বাস্থ্যের আকস্মিক অবনতির কথা শুনে আমার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আম্মু আব্বুকে বলেছিল, রূপার বিয়ে না দেখে আমি মরবো না। ছোট একটা শখ। কিন্তু আব্বুর মনে সেই কথাই গেঁথে আছে। বিকেলে মোহন ফোন করে বললো,
-রূপা, তোমার আব্বুর সঙ্গে কথা হয়েছে। তোমার আম্মুর জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। এত তাড়াতাড়ি এমন অবস্থা হবে ভাবতেও পারিনি। আমি সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করেছি। আগামী বুঝবার রাতে একটা স্লট পেয়েছি। এখন তুমি ভেবে দ্যাখো কী চাও। তোমার মাকে খুশি করার জন্য আমরা জাস্ট বিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলতে পারি , কিংবা বিয়ে বৌভাত মিলিয়ে একটা অনুষ্ঠান করতে পারি।

-মা নিশ্চয় জরির শাড়ি, আলোর রোশনাই, আত্মীয়দের হৈচৈ আর ক্যামেরার ঝলকানি দেখতে চেয়েছিলেন। বিয়ে হলে ধুমধাম করে ঠিকমত হোক।
তারপরের সাতদিন আম্মুর অসুস্থতার ভয়াবহতা ভুলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো বিয়ের আয়োজনে। আমার ছোট ভাইটা খড়গপুর থেকে পরীক্ষার পড়া ফেলে চলে এলো। অবশ্য আম্মুর এই অবস্থায় ওর না এসে উপায় ছিল না। মিলি প্রেগ্নন্যান্ট বলে তেমন সাহায্য করতে পারলো না। কিন্তু ঢাকা জাহাঙ্গীরনগর করে করে দিলশাদ আর অতন্দ্রিলার নাভিশ্বাস উঠে গেলো। রঞ্জনের কাছে থেকে লুকোতে চাইলেও শেষমেশ ওর কানে আমার বিয়ের খবর পৌছুলো। শেষ চেষ্টা হিসেবে রঞ্জন এখানে ওখানে বলে বেড়াচ্ছে আমি নাকি ওর সঙ্গে বেডে গেছি। ভাগ্যিস ইন্সপেক্টর লাবণি ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবার উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। ওর কোন কথাই এখন কেউ বিশ্বাস করে না।

বিয়ের দিন বিকেলে দিলশাদ আর অতন্দ্রিলা আমাকে সাজাবার জন্য পার্লারে নিয়ে গেলো। শীতের সিজন না বলে পার্লার মোটামুটি ফাঁকা। ওরা আমার মুখে প্রাইমার স্প্রে করে গভীর মনোযোগে একটার পর একটা রঙের পরত চড়াতে লাগলো, শেষে ব্লাশন দিয়ে গোলাপি আভা আনলো। ভ্রু প্লাক করলো, ভ্রু আঁকলো, চোখে আইল্যাশ লাগাল, মাসকারা দিলো, কাজল দিলো। ঠোঁটে লিপালাইনার দিয়ে সীমানা টেনে, টকটকে লাল লিপস্টিক মাখালো। শেষে চুলে ফুল দিয়ে খোঁপা করলো। আয়নায় তাকিয়ে নিজেরই লজ্জা পেলাম। দিলশাদ বললো, তোকে দেখে মনে হচ্ছে সাত সাগরের তের নদীর পার থেকে আসা কোন রাজকন্যা।

আম্মু তার বিয়ের লাল কাতান শাড়িটা অনেক বছর ধরে নেফথলিন দিয়ে উঠিয়ে রেখেছিল। আমি আম্মুকে বলেছিলাম আমার বিয়ের সময় আমি আম্মুর বিয়ের শাড়ি পরবো। আজ সেই সুযোগ এলো। বাড়ি ফিরে আসার পর আমার বউয়ের সাজ দেখে মা পাশের ঘরের দরোজার দিকে তাকিয়ে হাঁক দিলেন,
-এই রূপা এদিকে এসে দেখে যা, ঘরে একটা নতুন বউ এসেছে।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তুমি কোন বাড়ির বউ গো মা?

আমার ভাই ছুটে এসে বললো,
-মা, এটা রূপাপু, আজ বিয়ে না? একটু পর আমরা বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, তুমিও তো রেডি হয়েছো।

মা, আবার স্মৃতি ফিরে পেয়ে বললেন,
-হ্যাঁ হ্যাঁ, রূপাই তো। না হলে কে হবে? সবাইকে এখুনি রেডি হতে হবে, আমরা একটু পর বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। তোর বাবা কোথায়?

(চলবে)

পর্ব ২২ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1368286817019675/
পর্ব ২৪ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1371016080080082/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here