প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ২৬
আমাদের ভার্সিটি আপাতত বন্ধ। মোহন চাচ্ছে না আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাই। অথচ আমার শুধু ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা বাকি। মোহন বেরিয়ে যাবার পর মা ঘরে এসে আমার কাছে বসলেন। আমার হাত ধরে বললেন,
-শোন বউ মা, তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে রাখি।
আমি সাবধান হয়ে বললাম,
-জি মা, বলুন।
-মোহন সাত বছর থাকতে ওর মা মারা যায়। তার এক বছর পর আমি এই সংসারে আসি। মোহন, মিনু আর প্লাবনকে বলতে গেলে আমি এক হাতে মানুষ করেছি। কেবল মিনু আমার নিজের পেটের মেয়ে। তুমি তো প্লাবনকে দেখেছ বিয়েতে?
-জি।
-প্লাবন বাড়ির বড় ছেলে। সে ডাক্তার, চট্টগ্রাম থাকে, সরকারী চাকুরী করে। এ কারণে বিয়েতে এসেই আবার চট্টগ্রাম ফিরে গেছে। যা হোক, যেটা বলছিলাম, তুমি মোহনকে দেখেশুনে বিয়ে করেছো। আমি শুধু একটা কথাই জানিয়ে রাখি।
-কী কথা মা?
-মোহনের ভেতর একটু মহব্বতের অভাব আছে। এই যে এত বছর ধরে ছেলেটাকে বড় করলাম, কখনো আমাকে জিগেস করে না আমার ভালোমন্দ কোন শখ আছে কিনা, আমি কোথাও বেড়াতে যেতে চাই কিনা। তাই কখনো যদি মনে হয় ও একটু হার্টলেস, সেটা কিন্তু ও সবার সঙ্গেই। এটাই ওর স্বভাব।
জানি না কী বলবো। ছেলে আর সৎ মার কোন দ্বন্দ্ব আছে কিনা সেটাও এখনো জানি না। আমার ভাবনায় বাঁধা দিয়ে মা বললেন,
—বউমা, আশা করছি তোমার সঙ্গে থেকে ও একটু নরম হবে। কিন্তু যে কথা আমি তোমাকে বলতে এলাম তা হলো, তুমি কখনো ভুলেও রান্নাঘরে যাবে না।
-কেন মা?
-এ বাড়ির রান্নাবান্না সোমা করে, তাকে খুব হাই স্যালারি দেয়া হয়। আমার মিনু ঘরে যেমন থাকে, তুমিও তেমন থাকবে। কোন সময় যেন না ভাবো সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছো।
শাশুড়ির মার কথায় মন ভরে গেলো। মোহন যেমনই হোক, আমার শ্বশুর শাশুড়ি মনে হচ্ছে অনেক ভালো মানুষ। শাশুড়ি মা বেরিয়ে যেতেই আমার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। অতন্দ্রিলা ফোন করেছে। আমি ফোন ধরতেই অতন্দ্রিলা বললো,
-জাহাঙ্গীরনগরে বসে তোর জন্য মন খারাপ লাগছে রে। প্লিজ চলে আয়। এখুনি।
-কী বলছিস, হুট করে আমি কীভাবে আসবো? তুই চলে আয়।
-ঠিক আছে, তাহলে দরজা খোল।
-মানে?
-আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, তোদের নীচের কেঁচি গেটে তালা লাগানো, উপরে আসতে পারছি না।
হঠাৎ খুশীতে আমার মন ভরে গেলো। বুয়াকে বলতেই বুয়া গিয়ে অতন্দ্রিলা আর দিলশাদকে উপরে নিয়ে এলো। অতন্দ্রিলা যথারীতি কালো শড়ি, কালো লিপস্টিক দিয়ে এসেছে। অতন্দ্রিলা ঘরে ঢুকেই বললো,
-আমাদের দুলাভাই কোথায়?
-একটা কাজে বেরিয়েছে, চলে আসবে ঘন্টাখানেক পর।
-ইস, দুলাভাইকে মিস করলাম। খবর শুনেছিস?
-কী খবর?
-রঞ্জন আর ওর রুমমেট দুজনেই নাকি রেপের সঙ্গে জড়িত। ওই যে ট্রাংক পাওয়া গেলো, ওটা ওদের দুজনেরই। ভেতরের আন্ডারগার্মেন্টে রঞ্জনের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
আমার গা গুলিয়ে এলো, মনে হলো বমি করে দিই। রঞ্জন এত নীচে নামতে পারে ভাবিনি। নিজেকে কোন রকমে সামলে নিয়ে বললাম,
-পুলিশ কীভাবে জানলো?
-মনে আছে ইন্সপেক্টর লাবণি চন্দ্রিমা আর ক্রমেলা নামের দুজন মেয়েকে আন্ডারকভার হিসেবে আমদের হোস্টেলে রেখেছিল?
-হ্যাঁ।
-ওরা ক্যাম্পাসে কিসব নাইটভিসন ক্যামেরাট্যামেরা বসিয়েছিল?
-হ্যাঁ
এবার দিলশাদ বললো,
-একটা ক্যামেরায় ধরা পড়েছে রঞ্জন খসরুকে স্ট্যাব করছে। ইন্সপেক্টর লাবণি এটা ক’দিন আগেই জেনেছিলেন কিন্তু প্রকাশ করেননি। রঞ্জনকে অনুসরণ করে পুরো গ্রুপটাকে ধরার চেষ্টায় ছিলেন।
-সবাই ধরা পড়েছে?
-হ্যাঁ, বেশীরভাগই আউটসাইডার। এমনকি রঞ্জন নিজেও আউটসাইডার। শুধু একজন জার্মানি পালিয়ে গেছে। উনিভার্সিটি আডমিন ব্যাপারটাকে আপাতত কনফিডেনশিয়াল রাখতে অনুরোধ করেছে।
রঞ্জন আউটসাইডার শুনে অবাক হয়ে বললাম,
-কী বলছো? রঞ্জন ফিজিক্সের ছাত্র না?
-মোটেও না। ও একটা পলিটিকাল পার্টির শেল্টারে ছিল।
-ইন্সপেক্টর লাবণি জানতেন এসব?
-বললাম না উনি আস্তে ধীরে জাল গুটাচ্ছিলেন। এখন সব রুইকাতলা জালে আটকা পড়ে গেছে, এভিডেন্সসহ। তবে পলিটিকাল প্রেসারে আবার কী হয় কে জানে। তুই বড় বাঁচা বেঁচে গেছিস। রঞ্জন নির্ঘাত তোর কোন ক্ষতি করতো।
রঞ্জনের খবর আজ হোক কাল হোক পত্রিকায় আসবে। পত্রিকায় এলে মোহন আমাকে জড়িয়ে কী বলবে কে জানে। আমরা কথা বলার সময় মিনু ট্রেতে চা নিয়ে এলো। আমি মিনুকে অতন্দ্রিলা আর দিলশাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মিনু মোহনের মত না, এখন পযন্ত ওকে দেখে সহজ সরল হাসিখুশী মেয়ে বলেই মনে হয়েছে। ও হোম ইকনমিক্স কলেজে পড়ছে। মিনু অতন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনার গেট আপ কিন্তু আমার দারুণ লেগেছে, অল ব্ল্যাক। মনে হচ্ছে মহিলা ব্যাটম্যান।
অতন্দ্রিলা হেসে ফেললো। আমাকে বাদ দিয়ে ওরা দুজনই গল্পে মেতে উঠলো আমার ভারী মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। ওরা চলে যেতেই মোবাইলে টুং ওরা আওয়াজ হলো। টিটু ভাই ইমেইল করেছেন।
প্রিয় রূপা,
তুমি আমাকে জানাওনি কিন্তু অন্যদের কাছে খালাম্মার অসুস্থতার খবর শুনে খুব কষ্ট পেলাম। তোমার স্বামী বিয়ের আগেই খালাম্মার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শুনে ভালো লাগলো। উনি নিশ্চয় একজন উদার মনের মহৎ প্রাণ মানুষ। একজন মহৎ মানুষ তোমার জীবনসঙ্গী হবে জেনে স্বস্তি পাচ্ছি। আজ বলতে বাঁধা নেই রঞ্জন ছেলেটিকে আমার কখনোই বিশেষ ভালো লাগেনি। নিজে যেমন দেখেছি আর অন্যদের কাছে যেমন শুনেছি, ছেলেটাকে ধুরন্ধর প্রকৃতির মনে হয়েছে,
রূপা, তুমি বলেছো বিয়ের পর আর যোগাযোগ রাখতে পারবে না। তুমি একাগ্র চিত্তের মেয়ে। নিজেকে যেখানে দাও, পরিপূর্ণভাবে ঢেলে দাও। জানতাম তুমি ও কথাই বলবে । না বললেই বরং অবাক হতাম। আমিও চাই তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও না কেন, সেই সিদ্ধান্তের কারণে সুখী কিংবা দুঃখী যাই হওনা কেন, সত্য এবং নিষ্ঠা নিয়ে যেন জীবনটাকে বহন এবং যাপন করতে পারো।
ভালোবাসার উপর কারো হাত থাকে না। এই যে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেলাম, আনন্দে রঞ্জিত আর বেদনায় বিবর্ণ হলাম, এটা কিন্তু ভেবেচিন্তে হিসেব করে হয়নি। আমার চেতনা যখন যুক্তি দিয়ে বলেছে আমার জীবন জনগণের মুক্তির জন্য নিবেদিত, আমার অবচেতন তখন আমাকেই ফাঁকি দিয়ে হৃদয়ের সিঁধ কেটে তোমার দিকে ঝুঁকেছে। বসন্তের মৃদু কিন্তু মদির হাওয়া এসে আমার ঔচিত্যবোধে বন্দী জীবনকে সৌরভে মন্থিত করেছে।
রূপা, যতদূর বুঝি নানা পার্থিব কারণ বিবেচনা করে তুমি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আমার চেতনা এবং যুক্তি বলছে তুমি ঠিক কাজটিই করেছো। অথচ আমার অবচেতন মন বিষাদ আর যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে। অকারনে অশ্রু গ্রন্থীর উপর নিদারুণ চাপ সৃষ্টি হয়েছে, কি একটা বিড়ম্বনার ব্যাপার বলো তো।
রূপা, ভার্সিটি থাকতে অনেকদিন তুমি আমার সাথে কাজ করেছো, আমাদের লিফ্লেটগুলো হলে হলে তুমিই বিলি করেছো। তবু তুমি অধরাই ছিলে, মনে পড়ে না কখনো কোন ছুতায় তোমার আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়েছি। কিন্তু তুমি যে এখন অধরারও অধিক দূরের হবে, তোমাকে শব্দ সাজিয়ে পাঠাতে পারবো না, সে কথা ভাবতে মন ভেঙ্গে যাচ্ছে।
রূপা, আমি বিশ্বাস করি কেউ যদি সত্যি সত্যি কাউকে ভালোবাসে, তাহলে সে সর্বান্তকরণে তার আনন্দে দেখতে চায়। বাগানের হাল্কা রোদে পাপড়ি মেলে দেয়া ফুল দেখে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেটাই ভালোবাসা। সেই ফুল ছিঁড়ে এনে ফুলদানিতে সাজানোটা লোভ। তুমি আমার মনের বাগানে ফুল হয়ে থাকবে।
রূপা, আমি সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে সব সময় তোমার পাশেই আছি। অনেক সুখী হও রূপা, অনেক আনন্দে থাকো।
ইতি
রূপামুখী টিটু
টিটু ভাইয়ের ইমেইল পেয়ে আমি বাথরুম গিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিলাম। সেই শব্দের আড়ালে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। ভাবলাম, মানুষের জীবনটা এমন কেন।
(চলবে)
পর্ব ২৫ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1372051429976547/
পর্ব ২৭ https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1374211096427247/