মম চিত্তে পর্ব-১৩

0
4706

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৩
#সাহেদা_আক্তার

– এসব ব্যাপারে পরে ডিসকাস করা যাবে। খাবেন তো? আদ্রিতার কাছে শুনলাম আপনি কিছুই খান নি। রাত তো অনেক হলো।

– ক’টা বাজে?

– প্রায় সাড়ে বারোটা।

– এতক্ষণে তো জ্ঞান ফেরার কথা। আব্বু…

মম কেবিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এক নজর বুকের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রায়হান সাহেবের শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। রিয়ান উঠে এসে ওর কাছে দাঁড়িয়ে বলল, খুব ভালো বাসেন বাবাকে?

– হুম।

– আপনার বাবা যদি দেখে আপনি না খেয়ে আছেন তাহলে খুশি হবেন?

মম ইতস্তত করতে লাগল। রায়হান সাহেবকে ফেলে ওর এক পা কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। রিয়ান আস্বস্ত করে বলল, নিক্বণাপু আছে, চিন্তা করো না। সে স্পেশালভাবে বলে রেখেছে। জ্ঞান আসতে সময় নেবে। অ্যানেস্থেশিয়ার প্রভাব কাটতে সময় নেবে। জ্ঞান ফিরলেই আপনি জানতে পারবেন। এখন চলুন খাবেন। মম অনিচ্ছার সত্ত্বেও ওর সাথে হাসপাতালের ক্যান্টিনে গেল। চেয়ারে বসতে বসতে রিয়ান জিজ্ঞেস করল, কি খাবেন?

– আপনার যা খুশি অর্ডার দিতে পারেন।

রিয়ান নরমাল একটা খাবার সেট অর্ডার দিল। মম এক নজরে গ্লাসে রাখা টিস্যুর দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন অন্য জগতে হারিয়ে গেছে। খাবারটা সামনে আসতেও ওর খেয়াল হলো না। রিয়ান ডাকতে চামুচ হাতে নিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগল। দেখে বোঝাই যাচ্ছে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। রিয়ান কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি নিজে খাবেন না আমি খাইয়ে দেবো? ওর কথায় মম একটু লজ্জাবোধ করল। খাচ্ছে না দেখে এমন কথা বলা লাগে? ও কি বাচ্চা নাকি? ভাবতে ভাবতে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। অর্ধেক খাওয়া শেষ হতেই মমর ফোনে কল আসল। রায়হান সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে। শুনে অর্ধেক খাবার ফেলে রেখে দৌঁড়ে চলে এল কেবিনের সামনে। ভেতরে তাঁকে হাত নাড়াতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শরীরে যেন জোর নেই। কথা বলতে পারছেন না। ঠোঁট নাড়াছেন। এখনো ঘোর কাটে নি। মমর ইচ্ছে হলো ভেতরে যেতে। কিন্তু ঢুকতে দেবে না। নিক্বণ ভেতরে তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। বাইরে এসে ওকে দেখে বলল, সব ঠিক আছে। তবে শরীর খারাপ লাগতে পারে অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য। একজন নার্স থাকবে। তুমি চিন্তা করো না। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও। রিয়ানকে আসতে দেখে বলল, তুই ওকে বাড়িতে দিয়ে আয়। আর…

– আমি যাবো না। আমি আব্বুর কাছে থাকবো নার্সের বদলে।

– মম, অবুঝের মতো এমন বোলো না। ব্যাথার ইনজেকশন দিতে হবে, ওষুধ দিতে হবে, ক্লিন করতে হবে। অনেক কাজ যা তুমি পারবে না। নার্সকেই করতে হবে। খাওয়া হয়েছে?

– অর্ধেক খেয়ে চলে এসেছে।

– এটা তো ঠিক করোনি। খাওয়া দাওয়া করো ঠিকমতো। তুমিও যদি অসুস্থ হয়ে যাও তাহলে কে দেখে রাখবে?

মম চুপচাপ রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। এগিয়ে গিয়ে কেবিনের কাচে হাত রেখে বলল, সব আমার দোষ আব্বু। আমি কাছে থাকার সত্ত্বেও তোমাকে দেখে রাখতে পারিনি।

সকালে মানুষের আনাগোনায় ঘুম ভাঙল মমর। চোখ খুলে প্রথমে যা আবিষ্কার করল তাতে ভয়ে দশ হাত দূরে সরে গেল। ও রিয়ানের কোলে সারারাত ঘুমিয়েছে! কিভাবে হলো! যতদূর মনে পড়ে ও এমনিই শুয়েছিল চেয়ারগুলোয়। কখন ক্লান্তিতে চোখ লেগে গিয়েছিল মনে নেই৷ মম সাবধানে সরে গিয়ে কেবিনের সামনে দাঁড়াল। রায়হান সাহেবও ঘুমাচ্ছেন। পা হুট করে হালকা হয়ে যাওয়ায় রিয়ানের ঘুম ভেঙে গেল। মমর পেছন থেকে বলল, ঘুম কেমন হলো মিস মম? মম মনে মনে বলল, আর ঘুম! পিঠটা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। কিভাবে যে বেহুঁশের মতো চেয়ারে পড়ে পড়ে ঘুমালাম কে জানে। বাইরে বলল, ভালো।

– হুম তা তো হবে। সারারাত আমার পায়ের উপর কয়েক কেজি ওজনের ভারি মাথাটা রাখলে ভালো তো হবেই। ফাঁকে দিয়ে আমার পা দুটো অবশ হয়ে গেছে। নড়তে পারছি না। বাই দ্যা ওয়ে নিনিটা কে?

– কেন বলুন তো।

– রাতে আমার হাতটাকে জড়িয়ে ধরে যেভাবে নিনি নিনি করছিলেন আর নাক মুখ ঘষছিলেন!

– আ…আ… আমি!? মজা করছেন?

– আপনার মনে হচ্ছে আমি মজা করছি? আমার পা দুটো তো নেই মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় আমি মজা করব?

– ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওয়াশরুম থেকে আসি।

মম কোনমতে পালালো ওখান থেকে। এ ক’দিন নিনিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিনিটা এত ফ্লাফি আর তুলতুলে যে ঘুম চোখে না থাকলেও ঘুম চলে আসে। নিনির কথা হঠাৎ মনে হল, কালকে বাসায় অনেকক্ষণ একা ছিল বেচারি। কি করেছে কে জানে। ফ্রেশ হয়ে হাত মুখ ধুতে ধুতে নিজেকে আরেক দফা জ্ঞান দিল। রিয়ানকে এমন আচরণের জন্য সরি বলতে হবে। গিয়ে দেখল কেউ নেই। একজন নার্স এসে বলল, আপনি মিস মম?

– জ্বি।

– এই কাগজটি একজন ভদ্রলোক দিয়ে গেছেন।

মম কাগজটা খুলে দেখল রিয়ান দিয়ে গেছে। সে বাড়ি চলে গেছে ফ্রেশ হয়ে অফিস যাবে৷ আজকের জন্য ওকে ছুটি দিয়েছে। তবে নিচে একটা ওয়ার্নিং দিয়ে বলেছে, পা দুটো তো ভর্তা করে দিয়েছেন৷ পরের বার এর পরিবর্তে কি পুরষ্কার দিবেন তা ঠিক করে নিন।

মম কাগজটা ভাঁজ করে ব্যাগে রেখে দিল। এমন বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে হেসে ফেলল। কেবিনের দিকে তাকিয়ে রায়হান সাহেবকে দেখে নিল একবার। তিনি ঘুমাচ্ছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিচে নাস্তা করতে চলে গেল। কালকে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া হয়নি। তাই প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। ক্যান্টিনে দুটো পরোটা, ডিমভাজি আর ডাল অর্ডার দিল৷ খেতে খেতে রিয়ানের কথা আবার মনে পড়ল। খাওয়ার মাঝেই হাসি চলে এল।

– কি দেখে এমন হাসছো?

নিক্বণ এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ওর সামনে এসে বসল। মম খাওয়ায় মনোযোগ দিয়ে বলল, তেমন কিছু না। আব্বুর সারতে কতদিন সময় লাগবে? নিক্বণ আলতো করে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আপাতত তিনদিন পর জেনারেল ওয়ার্ডে নেওয়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যে আশা করি বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। মম মাথা নাড়ল। তারপর দুজনে চুপ করে রইল। নিক্বণ কফি খেতে খেতে বলল, অফিস কেমন চলছে?

– ভালোই।

– কোনো সমস্যা হলে ভাইকে বোলো। ও সমাধান করে দেবে।

মম আবার মাথা নাড়ল। কি করে যেন রিয়ানের পরিবারের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে। এতটা কাকতালীয় ঘটনা কি করে হচ্ছে তা মাথায় আসছে না ওর। বিলের প্রসঙ্গ ওঠানোর আগে নিক্বণের ফোন চলে এল। ও ধরে বলল, হ্যাঁ, আমি এখুনি আসছি। ফোন কেটে রেখে বলল, আচ্ছা তাহলে পরে কথা হচ্ছে। তুমি খেয়ে নাও। আমি আসি। নিক্বণ উঠে চলে গেল। মম কিছু বলার সুযোগ পেল না। ও ধীরে সুস্থে খেয়ে বিল দিতে গেলে জানতে পারল ওর বিল পে করা হয়ে গেছে। এটা যে নিক্বণের কাজ খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। এভাবে ঋণী করতে থাকলে শোধ করবে কিভাবে ভাবতে ভাবতে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এল৷
.
.
.
.
তিনদিন পর জেনারেল ওয়ার্ডে রায়হান সাহেবকে স্থানান্তর করল। এই দুই তিন দিন মমকে হাফ আওয়ার কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে অফিস থেকে। যদিও ও এত সুযোগ সুবিধা নিতে চাইছিল না। কিন্তু কেউ ওর কোনো কথা শুনল না। রিয়ানের সাথে দেখা হয়নি এই ক’দিন। নিক্বণও ব্যস্ত থাকে বলে কথা হয় না। তাও নিয়মিত দেখে যায় রায়হান সাহেবকে। মমর অনুপস্থিতিতে মাধুরী খালা দেখাশোনা করতে লাগল।

আজকে কাজ শেষ করে মম সোজা হসপিটাল চলে গেল। সব মিলিয়ে তিন চার দিন পর কথা হবে রায়হান সাহেবের সাথে। মম কেবিনে ঢুকে দেখল তিনি অপর পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন খোলা জানালার দিকে। মৃদু বাতাস আসছে। বেশ ভালো লাগছে বাতাসটা। মম আস্তে আস্তে তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল বিছানার পাশের ছোট টুলটায়। কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থেকে ডান হাতটা নিজের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিল। ছোঁয়া পেতেই তিনি ফিরে তাকালেন মমর দিকে। তাঁর শুকনো চেহারা দেখে ওর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। রায়হান সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, কেমন আছিস মা?

– ভালো। আমাকে কেন বললে না তোমার শরীর খারাপ করছিল। এমন কেউ করে?

তিনি চুপ করে রইলেন। মম আবার বলল, তোমার কিছু হলে আমার কি হতো বলো তো!? এবার তিনি মুখ খুললেন। বললেন, এজন্যই তো তোর বিয়েটা দিতে চেয়েছিলাম৷ তোর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তোর বিয়েতে মত নেই। তোকে বিয়ে দিয়ে কোনো ভালো পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারলে আমি মরেও শান্তি পেতাম। মম আস্তে করে বলল, তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না আব্বু। এখন তো আরো চাই না। আর তুমিও আমাকে ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি যাবে না। আম্মুটাও তাড়াতাড়ি চলে গেল। রায়হান সাহেব কাঁপা হাতে ওর হাত দুটো ধরে বলল, তোর কাছে আর কিছু চাইবো না৷ এই শেষবার তুই এই বিয়েতে রাজি হয়ে যা৷ যতটুকু জেনেছি ছেলে পরিবার দুটোই ভালো।

– জানি আব্বু।

– তাহলে রাজি হতে চাইছিস না কেন?

– আমার যে মন ওঠে গেছে ছেলে শব্দটার উপর। ভালো লাগে না। তাছাড়া তোমার শরীরও ভালো নেই।

– তুই বিয়ে করলে দেখবি আমি ভালো হয়ে গেছি।

– থামো না আব্বু। তোমার শরীর অনেক দুর্বল। মাত্র সব কিছু খুলে এখানে শিফট করেছে। একটু রেস্ট নাও। তুমি ভালো হলে পরেও বিয়ের আলোচনা করা যাবে।

– না। আগে তুই কথা দে তুই বিয়েটা করবি।

মেশিন হঠাৎ জোরে জোরে শব্দ করতে লাগল। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। প্রেশারও বাড়ছে। মম ভয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। কথা দিলাম। এখন একটু শান্ত হয়ে ঘুমাও। রায়হান সাহেব আস্তে করে শান্ত হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করতে মম মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, আব্বু, কেন দূরে পাঠিয়ে দিতে চাইছো তোমার থেকে!?

পরদিন সকালে বাসা থেকে তৈরি হয়ে এসে দেখল কেবিনের ভেতরে কারা যেন কথা বলছে। হাসির শব্দও ভেসে আসছে। মম দরজা খুলে দেখল রাকিব হাসান আর ফেরদৌসী এসেছেন। সাথে রাশেদ হাসানও আছেন। রায়হান সাহেবকে দেখতে এসেছেন। তিনি আজকে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। ওকে ডেকে বললেন, মা, দেখতো এই শাড়ি গয়নাগুলো পছন্দ হয় কি না। ওনারা নিয়ে এসেছেন।

– এগুলো কার? আমাকে দিচ্ছো কেন?

– তোর জন্য। তোর বিয়ের। কালকে আমি তাদের তোর রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছি। তাই তারা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন।

মম একবার তাদের দিকে তাকালো। ও কি বলবে তার অপেক্ষায় সবাই উৎসুক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সবার মুখে হাসি। মম ফেরদৌসীকে ডেকে বললেন, আমি আপনার সাথে আলাদা করে কিছু কথা বলতে চাই। তিনি সবার দিকে একবার একবার করে তাকালেন৷ রায়হান সাহেবের মুখ আবার শুকনো হয়ে গেল এই ভেবে যে মম আবার না করে না দেয়। ফেরদৌসী রাজি হয়ে ওকে নিয়ে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলেন। মম কোনো প্রকার ভণিতা না করেই বলল, বিয়েতে আমার কিছু শর্ত আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here