শিউলিবেলা পর্বঃ১৩

0
622

শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ১৩

হঠাৎই একটা পার্টিতে যেতে হয়েছে অতসীকে, সেট থেকে ফেরার সময়ই তাকে জানানো হয়েছে পার্টির কথা। তাড়াহুড়ায় সেভাবে জুতা নির্বাচন করা হয় নি। এখন হাঁটতে গেলেই গাউনে জুতার পাথর আটকে যাচ্ছে, যখন তখন পড়ে যাবার আশঙ্কা আছে ভেবে চুপচাপ এককোনায় বসে আছে সে। মনে মনে নিজেকে বকে দিচ্ছে বারংবার… এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে “জোকার” নামটা ভেসে উঠতে দেখে মুচকি হাসলো সে। গতদিন ঈশানের অদ্ভুত সাজপোশাক দেখে এ নামটাই দিয়েছে তাকে অতসী। তার নাম্বারটা খুব কম মানুষের কাছেই আছে, ঈশান সে নাম্বারটা জোগাড় করেছে ব্যাপারটা তার জন্য বেশ অবাক করা। প্রথম যেদিন কল দিয়েছিলো সেদিন কল রিসিভ করার পরই এক নিঃশ্বাসে ছড়ার মতো করে বলেছিলো,

ভাবী, ভাবী, ভাবী-
চাই আমার ভাবী,
ওগো সুন্দরী,
হবে নাকি আমার প্রিয় ভাবী”

অতসী রাগ করতে গিয়েও রাগ করতে পারে নি, ফিক করে হেসে দিয়েছিলো। তারপর থেকে প্রায়ই ঈশান কল করে তাকে, কখনো রিসিভ করে তো কখনো করে না। এ মুহূর্তে একা বসে বিরক্ত হবার চেয়ে ঈশানের মজার মজার কথা শোনা উত্তম ভেবে ফোন রিসিভ করলো অতসী। ওপাশ থেকে ইশানের উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে কিছুটা অবাক হলো অতসী, চটজলদি প্রশ্ন করলো,

-“আপনার গলার স্বর এমন শোনাচ্ছে কেনো? কাঁদছেন নাকি?”

ঈশান ধমকে বলে,

-“কাঁদবো কেনো মিস আতসবাজি, আপনার চোটপাটে কাঁদার সুযোগ আছে? সামনে গেলে কাঁমড়াতে আসেন, দূরে গেলে মাথা নষ্ট করে দেন। সমস্যা কি আপনার? কোথায় আপনি?”

অতসী মুচকি হেসে প্রশ্ন করে,

-“যাকে ভাবী বানানোর পণ করলেন তার প্রেমে পড়ে গেলেন বুঝি ঈশান বাবু?”
-“মোটেই না।”
-“তবে আমি কোথায় তা দিয়ে আপনার কাজ কি? আপনার ভাই কি নিজের হবু বধূর খোঁজ খবর রাখতে ব্যর্থ?”
-“মোটেই না।”
-“মোটেই হ্যাঁ, তাই তো আপনি কাজকর্ম ফেলে আমার পেছনে ছুটছেন। কোনো লাভ নেই, আমি না আপনার, না আপনার ভাইয়ের। আমি আমার… আর এ মুহূর্তে আমি আমাকে সময় দেবো, বিদায় মি. জোকার।”

ঈশান হতবম্বের মতো কিছুক্ষণ কানে ফোন চেপে দাঁড়িয়ে থাকলো। একজন মানুষ তাকে এভাবে মুখের উপর জোকার বলে কল কেটে দিবে ভাবতে পারে নি সে। নেহাত পিথিউশা অতসীকে পছন্দ করে, নতুবা ঈশান কখনোই অতসীর কাছে যেতো না, মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দেয় ঈশান। ক্ষণিক বাদে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, আসলেই কি সে অতসীর কাছে যেতো না! কোথায় যেনো একটা কিন্তু লেগেই থাকে…

১৮
অরিত্রীদের বাড়িতে পিথিউশার আগমন যেনো অতি সামান্য ব্যাপার। আতিকুর রহমান ও মিনতি রহমান খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকে বাড়িতে স্বাগতম জানিয়েছে। এছাড়া অমিতও অল্প সময়ে পিথিউশার সঙ্গে মিশে গেছে। যে পিথিউশা সর্বদা চুপচাপ থাকতো আজ তার নতুন রূপ দেখলো অরিত্রী। সবার সঙ্গে বসে বেশ উৎসাহ নিয়ে গল্প করছে এবং শুনছে। অরিত্রীর ছোটবেলার গল্প। যতো দেখছে ততোই মুগ্ধ হচ্ছে অরিত্রী, বাবা-মা যদি অরিত্রীর ছোটবেলার গল্প করতে করতে অতসী প্রসঙ্গে চলে আসে! বাড়িতে এসে অতসীকে পাবে ভেবেছিলো, সকল মিথ্যের অবসান ঘটবে ভেবেছিলো, কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনা বোঝা দায়। এ মুহূর্তে অরিত্রী ভেতর ভেতর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, আর যা’ই হোক পিথিউশার চোখে ছোট হতে চায় না সে। এ যাত্রায় বেঁচে গেল অরিত্রী, ডিনারের পর পিথিউশাকে বিদায় জানালো। যেতে যেতে পিথিউশা একদিন তার বাড়িতে যাবার প্রস্তাব জানাতে ভুলেন নি। অরিত্রী মুচকি হেসে পরে জানাবে বলে প্রসঙ্গ পাল্টালো। পিথিউশাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই মিনতি রহমানের প্রশ্নের মুখে পড়লো অরিত্রী। পিথিউশা কে, তার পরিবার কেমন, বিস্তারিত জানতে চাইলো। পিথিউশার অতীত গোপন করে বাকিসব ঠিকঠাকভাবেই মাকে জানালো অরিত্রী। সঙ্গে এটাও বললো, পিথিউশা চায় তার পরিবারের সঙ্গে অরিত্রী দেখা করুক। এছাড়া অতসী এবং অরিত্রীকে নিয়ে পিথিউশার যে কনফিউশন তা’ও জানালো মাকে। সব শুনে মিনতি রহমানের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো, অরিত্রীকে নিয়ে তার বরাবরই চিন্তা। তার এই মেয়েটা এমনিতেই আবেগী, এ আবার নতুন কোন ঝামেলায় জড়ালো! অনেক ভেবে তিনি অরিত্রীকে পিথিউশার পরিবারের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিলেন, বললেন,

-“ওদের বাড়ি যা, কথা বল বাড়ির সবার সঙ্গে। যদি মনে হয় ওদের পরিবারের সবাই তোর জন্য পারফেক্ট তবে ছেলেটাকে সবটা খুলে বলিস নতু্বা নিরবে সরে আসিস।”

এখন অবধি পিথিউশার পরিবার সম্পর্কে যা শুনেছে তাতে পরিবারটার প্রতি অরিত্রীর আগ্রহ কম না। প্রথমবারের মতো মায়ের পরামর্শ পছন্দ হলো তার, অতি আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরলে মা ঝারি দিয়ে বললো,

-“এসব ঢং বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়…”

অরিত্রীর পরবর্তী দিনগুলো কাটলো নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে। কিভাবে পিথিউশার পরিবারের সামনে যাবে, সবার সঙ্গে কথা বলবে, কিভাবে পিথিউশার কনফিউশন দূর করবে আরো কতো কি। অবশেষে বহু প্রতিক্ষীত দিনটি এলো। পিথিউশার বাড়ির সদস্যদের অমায়িক ব্যবহারে অরিত্রীর পিথিউশাকে পাবার লোভ এবং ওকে এতো কাছ থেকে জানার পর হারাবার আশঙ্কা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। অরিত্রী এসেছে বলে আরজু হক যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। নিজ হাতে যত্ন করে নানা পদের সুস্বাধু খাবার রান্না করে খাইয়েছেন। মঈনুল হক অরিত্রীকে ঈশানের জন্য পছন্দ করলেও পিথিউশার পাশে ওকে দেখে খুব একটা নারাজ হলেন না, বরং ছেলের পছন্দকে সাদরে গ্রহণ করলেন। মহসীনুল হক অবশ্য বরাবরই পিথিউশাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তাই প্রথম প্রথম তিনি অরিত্রীকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। পরবর্তীতে অরিত্রীর ব্যবহারে তিনিও মুগ্ধ হয়েছেন। তবে অদ্ভুতভাবে আজকের এই আয়োজনে ঈশান অনুপস্থিত। অরিত্রীর আগমনের কথা শুনেই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে সে। দুপুরে খাবার পর পিথিউশা অরিত্রীকে নিজের সঙ্গে ছাদে নিয়ে যায়। বেশ আগ্রহ নিয়ে নিজের ছাদ বাগান দেখায়, পিথিউশার উচ্ছসিত চেহারা দেখে অরিত্রী বুঝে নেয় মানুষটা গাছ ভালোবাসে, সে প্রকৃতিপ্রেমী। অরিত্রীর মনে হয়, এটাই সুযোগ পিথিউশাকে সত্যটা খুলে বলার… ছাদের এক কোনে ঝুলানো দোলনায় গিয়ে বসে অরিত্রী, তার থেকে কিছুটা দুরত্বে বসে পিথিউশা। অরিত্রী আকাশের পানে চক্ষু স্থির করে বলে,

-“একটা গল্প বলবো, শুনবেন?”
-“জ্বী শুনবো, আপনার প্রতিটি কথাই আমার কাছে জরুরি।”
-“আমরা দুই বোন এক ভাই। আপনি সেদিন আমার বড় বোনকে দেখেন নি, আপু বাহিরে ছিলো। আপুর আর আমার অনেক মিল, বিশেষ করে পছন্দে। আপুর যা পছন্দ কিভাবে যেনো আমারও তা’ই পছন্দ হয়ে যায়। কিংবা আপুকে যারা পছন্দ করে তারা আমায় পছন্দ করলো না বলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। হিংসে হয়, তা’ও বলতে পারেন। সেই আপুর প্রথম প্রেম ছিলো আয়ান। অদ্ভুতভাবে আমার প্রথম প্রেমও আয়ান। হুম, আমি আয়ান নামের একজনকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আয়ানের চোখে আমি ছিলাম আপুর কাছে পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম! ওদের সম্পর্ক হলো, আবার ভেঙেও গেলো। ওদের সম্পর্ক ভাঙায় আমার খুশি হবার কথা ছিলো, অদ্ভুতভাবে আমি খুশি হতে পারলাম না। আয়ানের কষ্টে আমার কষ্ট হলো, আপুর উপর রাগ হলো। সেই রাগ এতোদূর গড়ালো যে, আপুর আর আমার সম্পর্কে দূরত্ব বেড়ে গেলো। কিন্তু যার জন্য এ দূরত্বের সৃষ্টি সে এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, এইতো কিছুদিন পর তার বিয়ে। তার এক খালাতো বোনের সঙ্গে, দাওয়াত করেছে আমাকে…”

পিথিউশা কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো, ও কিছু বলার আগেই অরিত্রী ওকে ইশারায় থামিয়ে দিলো। মুচকি হেসে বললো,

-“সান্তনা দেবার কিছু নেই, আয়ান বিয়ে করছে, ব্যাপারটা আমার জন্য আনন্দের। আমি চাই ও ভালো থাকুক। তারপর শুনুন…”
-“বলুন…”
-“এই এতোগুলো বছরে আমার জীবনে দ্বিতীয় প্রেম আসে নি, একদিন হুট করে চলে এলো। তাও কিভাবে জানেন? আপুর মাধ্যমে… আমি আবারও এমন একজনের প্রেমে পড়লাম যে কি না আমার বড়বোনকে ভালোবাসে। এবারের প্রেমটা আগেরবারের মতো না, এটা গভীর প্রেম। আমি তাকে ছাড়া নিজের ভবিষ্যত কল্পনা করতে পারি না, তাকে ছাড়া সবকিছু এলোমেলো লাগে। কি করি বলুন তো? তাকে বলে দেব মনের কথা? নাকি সে আপুকে ভালোবাসে বলে সরে আসবো? কিন্তু কি করে সরে আসবো? তাকে ভালো না বেসে যে আমি থাকতে পারবো না…”

চলবে…

(কিছু ব্যক্তিগত কারনে লেখার গতি হারিয়ে যাচ্ছে বারংবার, তাই নিয়মিত পোস্ট করা হচ্ছে না। যারা ধৈর্য্য ধরে উপন্যাসটির জন্য অপেক্ষা করছেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আর যাদের অপেক্ষা করতে কষ্ট হয় তাদের প্রতি উপন্যাসটি শেষ হবার পর একত্রে পড়বার অনুরোধ রইলো। শেষ হবার পর সব পর্বের লিংক একত্রে পেইজে পোস্ট করে দেয়া হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here