মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর। পর্ব-০৫

0
3871

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [০৫]

জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। তাই, মা হওয়ার পর যদি বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা বৈধব্যের অঘটন ঘটে, তাহলেও বিরহে অশ্রুবিসর্জন নয়, একলা মায়ের মানে Single Mother হয়েও দায়িত্ব নিয়ে পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করা যায়। এমন উত্তরণের কাহিনি বহু ছবিতেই তুলে ধরা হয়েছে।আমাদের সমাজ আজও সিংগল মাদার-এর বিষয়টিকে খুব সহজে মেনে নিতে পারেনি। সন্তানকে বড়ো করার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে, পুরুষের সাহায্য ছাড়া মহিলারা অক্ষম বলে মনে করে আমাদের সমাজ। হাজারো প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয় একলা মায়েদের। অবশ্য, সিংগল মাদার হওয়া কঠিন জেনেও, শুধু মনের জোরে লড়াই জারি রেখেছেন অনেকে। তার অন্যতম উদাহরণ হলো সৈয়দা মাহবুবা। সৈয়দা মাহবুবা যেদিন প্রথম মেহেরকে স্কুলে ভর্তি করাতে যান তখন সেখানেও তাকে অপমানিত হতে হয়। স্কুলের এক শিক্ষিত তার চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলে। মেহের সৈয়দা মাহবুবার পাপের ফল এটা বলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। স্কুলের শিক্ষকদের অনেক বুঝিয়েও সৈয়দা মাহবুবা সেদিন মেহেরের বাবার পরিচয় আড়াল করতে পারেন নি। বাধ্যহয়েই তাকে মেহেরের বাবার নাম বলতে হয়। হ্যঁ মেহেরের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক এটাই। একটা সার্টিফিকেট। এর বাইরে কিছুনা। সার্টিফিকেটে বাবার নামের জায়গায় গুনে গুনে এগারো অক্ষরের একটা নাম লেখে মেহের এটাই ওর সাথে ওর বাবার সম্পর্ক। মেহের যখন ক্লাস সেভেন এ উঠলো তখন প্রথমবার তার বাবাকে দেখতে পায় সে। সৈয়দ নওশাদ সেদিন তার প্রথম সন্তানকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে মেহেরের কাছে ক্ষমা চায়। আর বাংলা সিনেমার মতোই বলে,

– আমাকে একবার বাবা বলে ডাক মা।

মেহের সেদিন তার বাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। আজ অব্ধি সে তার বাবাকে মেনে নিতে পারে নি মেহের। ক্ষমা করেনি সে তার বাবাকে। তার কাছে তো তার মা আছেই। তার মা-ই তার বাবা -মা। যেখানে তার মা সমাজের মানুষের কটু কথা শুনে তাকে একলা বড় করে তুলেছে সেখানে এই লোকটাকে বাবা বলে ডাকার কি দরকার। তাকে বাবা বলে ডাকার জন্যে তো তার একটা মেয়ে আছে। মেহের না হয় তার মাকে আঁকড়ে ধরেই সারাটা জিবন কাটিয়ে দিবে। চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু গাল গড়িয়ে পড়লো।

– আপনি কাঁদছেন কেন লেখিকা সাহেবা?

পরিচিত এক কণ্ঠস্বর শুনে হচকচিয়ে উঠে মেহের। হাতের আলতো স্পর্শে চোখের পানি মুছে সামনে তাকিয়ে বলে,

– আপনি?

– হ্যাঁ। মাঠে যাচ্ছিলাম। আপনি কাঁদছেন কেন?

– কাঁদছিনা তো। আপনি যান না যেখানে যাচ্ছিলেন।

– লেখিকা সাহেবা, আপনার চোখ বলছে আপনি কাঁদছেন আর মুখে মিথ্যে বলছেন?

– আমি লেখিকা নই। শক্তগলায় বলল মেহের।

মেহেরের কথা শুনে স্মিত হাসলো রাহনাফ। ওষ্ঠদ্বয় চেপে মনে মনে বলল,

– আমি তো আপনাকে লেখিকা বলেই ডাকবো ম্যাডাম। যার লেখা প্রতিবেদন, গল্প প্রতিমাসে খবরের কাগজে ছাপা হয় সে কি লেখিকা নয়। যার লেখা ডিবেটের কারনে একটা স্কুল প্রতিবছর স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছে সে কি লেখিকা নয়।নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকায় রাহনাফ। এতে বেশ বিরক্ত হয় মেহের। রাহনাফের হঠাৎ করে মেহেরের সামনে চলে আসা ওর সাথে কথা বলা এগুলো খুব বিরক্ত লাগে মেহেরের। মেহের রাহনাফের দিকে বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই পিছন থেকে রাহনাফ বলে উঠে,

– আমার বলটা?

– ওটা আমি কেটে রোদে শুকাতে দিয়েছি। ভালো করে শুকানোর পর সেটা জ্বালানি হিসাবে ব্যাবহার করবো। আপনি আমার পিঁয়াজু খেয়েছেন না। আমি আপনার বল জ্বালিয়ে পিঁয়াজু ভাঁজবো আর সেটা গপাগপ খেয়ে নিবো। মেহেরের কথা শুনে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকে রাহনাফ। মাঝে মাঝে মেহের এমনসব কথা বলে না, অবাক না হয়ে পারা যায়না। রাহনাফ তার ভ্রূদ্বয়ে কিৎচিত ভাজ ফেলে বলে উঠে,

– আপনি এমন শুকনো শুকনো কথা বলেন কেন?

– ভেজা কথা কিভাবে বল! তাহলে কি এখন মুখে পানি দিয়ে কথা বলতে হবে।

মেহেরের কথাশুনে ফিক করে হেসে দেয় রাহনাফ। এই মেহেরটাও না রাগের সময় এমন একেকটা কথা বলে না হেসে পারা যায় না। রাহনাফ পকেটে দুহাত গুজে হাসি মুখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাহনাফের হাসি দেখে মেহের প্রচন্ড বিরক্ত। সে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। বিনিময়ে রাহনাফ অধরোষ্ঠ চেপে হাসে।

মেহেরের চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রাহনাফের মোবাইলে একটা কল আসে। বুকপকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মোবাইলের স্কিনে নাম্বার দেখে খুশির ঝলক ফুটে উঠে রাহনাফের মুখে। মৃদু হেসে কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে মাঠের দিকে এগিয়ে যায়।

৯,
সৈয়দা মাহবুবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহের। সৈয়দা মাহবুবা তার মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কতদিন পর এভাবে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মেহের। মায়ের কোলে মাথা রাখলে নিমিষেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে হয়। মেহের সৈয়দা মাহবুবার কোলে মুখ গুজেদিয়ে দু-হাতে ওনার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,

– জানো মা আজও রাস্তায় ওই লোকটার সাথে দেখা হয়েছিলো। সে তার মেয়ে আর বউকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। মেহেরের কথার প্রতিউত্তরে কোন জবাব দেয়না তার মা। অতঃপর মেহের বলে,

– আমি আজও কোন কথা বলিনি তার সাথে। তুমিই বলো মা আমি কেন তার সাথে কথা বলবো। মেহের কথা শুনে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে সৈয়দা মাহবুবা। মেহের যতই তার বাবাকে অস্বীকার করুকনা কেন? বাবা বলে ডাকতে না পারার আক্ষেপ যে তারও আছে। সৈয়দা মাহবুবা মেহেরের মাথায় উষ্ণ ভালোবাসার স্পর্শ একে দিলেন। মেহের আরো শক্তকরে তার মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরলো।

আয়নার দিকে অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিছানায় বসে আছে মেহের। কপালে তার কদাচিৎ ভাজ। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে আয়নাতে মৌয়ের প্রতিবিম্ব দেখছে। মৌ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। কখনো সে মাথা আছড়াচ্ছে কখনো হাতে চুড়ি পরছে আবার কখনো কানের দুল পরছে। আর এগুলো পরে আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আবার খুলে ফেলছে। আজ মৌকে একটু অন্যরকম লাগছে। চোখমুখ উজ্জল যেন এক আকাশ পরিমান সুখ এসে ভীড় জমিয়েছে তার মনে। ঠোঁটের কোনে তো আলতো হাসি লেগেই আছে।

– এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের কাজ কর। অনেক বড় দায়িত্ব মাথায় নিয়েছিস। সেগুলো ঠিকঠাক মতো পালন করতে হবে তো নাকি? হাতের চুড়ি খুলতে খুলতে বলল মৌ।

– আজ তোকে একটু বেশীই খুশি খুশি লাগছে কাহিনী কি??

মেহের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের কোন জবাবই দেয়না মৌ। নেইলপালিশের কৌটা নিয়ে মেহেরের পাশে বসে। নোখে নেইলপালিশ লাগিয়ে তাতে ফুঁ দিয়ে বলে,

– আজ আমি অনেক খুশি মেহু।

-সেটাই তো জানতে চাইছি। এত খুশির কারন কি।

মৌ হাসে কোন জবাব দেয়না। নেইলপালিশ লাগানো শেষে পুরো রুম ঘুরে ঘুরে ডান্স করতে থাকে। অতঃপর বলে,

– আমি কাল আমার ড্রিম বয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি তাকে আমার মনের কথা বলবো। আমার ড্রিম বয় আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছে মিহু।

– এতে নাচার কি হলো। সে এমনকি যে দেখা করতে চাইছে বলে তোকে খুশিতে নাচতে হবে। পাগল টাগল হলি নাকি।

মেহেরের কথা শুনে মৌ থেমে যায়। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে কোমড়ে হাত রেখে মেহেরের দিকে তাকায় মৌ। মেহের মৌয়ের চাহনি উপেক্ষা করে নিজের কাজে মন দেয় আর বিরবির করে বলে,আমার সময়টুকুই নষ্ট। এদিকে মৌ বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে পুরো ঘর ঘুরে ঘুরে ডান্স করতে থাকে।

১০,
তিনদিন পর আজ কলেজে এসেছে মেহের। এই তিনদিনে ডিবেট প্রতিযোগীতার সব বক্তব্য লেখা শেষ করে স্কুলে জমা দিয়ে এসেছে। আজ কলেজে পা রাখতেই রাহির মুখোমুখি হতে হয় মেহেরকে। রাহিকে দেখে অন্যদিককে চলে যেতে চাইলে রাহি গিয়ে মেহেরের সামনে দাঁড়ায়। মেহের রাহিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করে নিয়ে চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে।তারপর বলে,

– প্রবলেম কি তোমার? বারবার আমার পথ আটকিয়ে দাঁড়াচ্ছ কেন?

– আজ তোমার গলার স্বর এত নিচু যে। কোথায় গেল তোমার দম।

– আমি তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাইছি না। সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায় মেহের। রাহি এবার গিয়ে মেহেরের হাত ধরে সাথে সাথে মেহের তার হাত মুঠি করে ফেলে। তার হাতদুটি বারবার করে মেহেরকে বলছে,

– তুই এখনো কিছু বলবি না মেহু। মেয়েটা তোর হাত ধরেছে মেহু। ওর হাতটা ধুমড়েমুচরে দে তুই।

দু-চোখ বন্ধকরে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নেয় মেহের। তারপর সে রাহির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেই অংশটাকে ঝাড়া দিতে থাকে সে। আর বলে,

– নেক্সট টাইম এরকম কিছু করার দুঃসাহস করোনা। নাহলে এর ফল খুব খারাপ হবে। মনে রেখো।

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

[গল্প সম্পর্কে সবার মতামত জানতে চাচ্ছি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here