মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-২৪

0
2299

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৪]

– আমার চোখ দেখেও বুঝতে পারছেন না আমি কি বলতে চাচ্ছি। রাহনাফের চোখে চোখ রেখে বলল মেহের। রাহনাফ কান থেকে মোবাইল নামিয়ে একবার মোবাইলের দিকে তাকালো তারপর আবার মেহেরের চোখের দিকে নিজের দৃষ্টি স্থীর রেখে মোবাইল কানের কাছে ধরে মৃদু সূরে বলে উঠলো,

– কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?

– আপনি বুঝে নিন।

– না বললে কি করে বুঝবো!

– আচ্ছা বেশ, আপনি আপনার চোখ দুটি বন্ধ করুন আমি বলছি। অতঃপর রাহনাফ তার চক্ষুদ্বয় বন্ধকরে নিলো। মেহের তার চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস নিয়ে আবার রাহনাফের দিকে তাকিয়ে চট করে বলে উঠে,

– আই লাভ ইউ।

চোখ খুলে রাহনাফ, অবাক চোখে সে মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কান থেকে মোবাইল সড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আবার মোবাইলটা কানের কাছে ধরে বলে,

– কি- কি বললেন আপনি? আবার বলুন।

– আপনি যা শুনেছেন ঠিক শুনেছেন। হাসি মুখে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে মেহের। রাহনাফ মৃদু হেসে কল করে মোবাইলটা তার প্যান্টের পকেটে পুরে মেহেরের দিকে এগোতে থাকে।তখনি মেহেরের সামনে দিয়ে একদল লোক যায়, যাদের পরনে ছিলো লাল কাপর। ভীড়ের মধ্যে পরে যায় মেহের যার ফলে সে রাহনাফের চক্ষুর অগোচরে চলে যায়। লোকগুলো চলে যাওয়ার পর মেহেরের হাত থেকে মোবাইলটা মাটিতে পরে যায়। মেহের চোখ বড় বড় করে রাহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড, তারপর সে মাটিতে লুটে পরে। রাহনাফের পা সেখানেই থেমে যায় দূর থেকে সৈয়দ নওশাদ দৌড়ে মেহেরের কাছে আসতে থাকে।

রাহনাফ দ্রুত পায়ে মেহেরের কাছে গিয়ে হাটু গেরে পরে থাকে। জ্ঞানহীন অবস্থায় রাস্তায় পরে আছে মেহের। পেট থেকে অঝড়ে রক্ত পরছে তার। কেউ মেহেরের পেটে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে। ভীড়ের মধ্যে থাকায় বুঝতে পারেনি কে মেহেরকে আঘাত করেছে। সৈদয় নওশাদ বসে আছে মেহেরের মাথার কাছে। চোখের সামনে মেয়ের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছে না সে। মেহের যতই তাকে অস্বীকার করুক না কেন! মেহের তো তার মেয়ে। এটা সে মনে প্রানে মানে। সৈয়দ নওশাদ আজ একেবারে ভেঙে পরেছে। মেহের অপমানেও তিনি এত কষ্ট পাননি। চোখের সামনে সন্তানের এমন অবস্থা দেখলে কোন বাবা-মাই ঠিক তাকতে পারেন না। মেহেরকে ঘিরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা সকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে শুধু সাহায্য করার জন্যে কেউই এগিয়ে আসছে না। এদিকে মেহেরের এমন অবস্থা দেখে রাহনাফও জ্ঞান শূন্য হয়ে পরেছে। হঠাৎ কারো কঠিন গলার স্বর শুনে চমকে উঠে রাহনাফ। কথাটা এখনো রাহনাফের কানের কাছে বেজে চলেছে। মেয়েটারে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাও, মরে যাবে তো। কাপাকাপা চোখে মেহেরের মুখের দিকে তাকায় রাহনাফ, দেখে মেহের তার চোখ বন্ধকরে নিয়েছে, সে তার উষ্ণ হাত রাখে মেহেরের গালে।কান্নামিশ্রত গলায় বলতে থাকে,

– আপনার কিছু হবে না, লেখিকা সাহেবা। আমি আপনার কিছু হতে দিবো না।

– আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। উঠে দাঁড়ায় সৈয়দ নওশাদ। সৈয়দ নওশাদের কথার কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে মেহেরকে পাজা কোলে তুলে নেয় রাহনাফ তারপর সে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সৈয়দ নওশাদ গাড়ি নিয়ে রাহনাফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যখন বলে,

– গাড়িতে উঠে বসো রাহনাফ।

রাহনাফ কয়েক সেকেন্ড ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মেহেরের মুখ পানে একপলক তাকিয়ে সৈয়দ নওশাদের চোখে চোখ রেখে নিজের গলারস্বর একটু মোটা করে বলে উঠে,

– আমাকে মাফ করবেন স্যার, আমি আমার লেখিকা সাহেবাকে আপনার গাড়িতে তুলে দিতে পারবো না।আমি লেখিকা সাহেবার আত্নসম্মানে এত বড় আঘাত করতে পারবো না।

– মানে, কি বলতে চাও তুমি রাহনাফ?

– ভেরী সিম্পল, আপনি সামনে থেকে সরে যান স্যার, আমাকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। লেখিকা সাহেবাকে বাঁচাতে হবে।

– আমার গাড়িতে নিয়ে এসে আমরা তাড়াতাড়ি হসপিটালে পৌঁছে যাবো। আমিও চাই মেহের তাড়াতাড়ি সুস্থ হোক। রাহনাফ তুমি ওকে আমার গাড়িতে বসিয়ে দাও। ও আমার মেয়ে। রাহির মতো মেহেরকেও ভালোবাসি আমি।

– মেয়ে, কে আপনার মেয়ে স্যার। দ্বিতীয় বিয়ে করার আগে মনে ছিলো না আপনার, আপনার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।কদিন পর আপনার সন্তান পৃথীবির আলো দেখবে। তখন কোথায় ছিলো আপনার পৃত্বীত্ব। একবারও আপনার মনে হয়নি, আপনার সন্তান আপনার পরিচয়ে বড় হবে। কি দিয়েছেন আপনি লেখিকা সাহেবাকে, আদর স্নেহ ভালোবাসা নাকি পরিচয় কোনটা? আর এখন এসেছেন পিতার অধীকার নিয়ে। আমি কিছুতেই আপনার গাড়িতে আমার লেখিকা কে তুলে দিবো না। আন্টির এত দিনের পরিশ্রম, তার আত্নত্যাগ আমি বৃথা হতে দিবো না। বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায় রাহনাফ। পিছনে থাকা সৈয়দ নওশাদের চোখ থেকে অঝরে পানি ঝড়তে থাকে। অধোর চেপে হাতদুটি শক্ত মুঠি করে নেয় সে। রাহনাফের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখদুটি বন্ধকরে নেয় সে। আর কত! আর কত অপমানিত হতে হবে তাকে। আর কত পুড়িয়ে তাকে মেনে নিবে মেহের। মেহের আধো তাকে মেনে নিবে তো।

রাস্তার মধ্যে একটা মাইক্রোবাস পেয়ে যায় রাহনাফ তারপর সেই মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে অনুরোধ করে মেহেরকে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছায় রাহনাফ। হসপিটালে আসার পর মেহেরকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্লান্ত শরীর আর চিন্তিত মন নিয়ে করিডোর বসে যায় রাহনাফ। রাহনাফের দুই হাত আপনাআপনি তার মাথায় চলে যায়। দু-হাতে মাথা চেপে সে বসে থাকে কিছুসময়। মাথা থেকে হাত সড়িয়ে সামনে তাকাতেই তার চোখ আটকে যায় টিশার্টে। আকাশী রংয়ের টিশার্টে রক্ত লেগে কেমন মেরুন মেরুন বর্ণ ধারন করেছে। কাপাকাপা হাতে টিশার্ট স্পর্শ করে রাহনাফ। মুহূর্তেই তার শরীর কেপে উঠে। চোখ দিয়ে দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।

নার্সের ডাকে সামনে তাকায় রাহনাফ। তড়িৎগতিতে দাঁড়িয়ে যায় সে।তারপর বলে,

– মে-মেহু,,,

– ইমার্জেন্সি রক্ত লাগবে। পেসেন্টের শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝড়ছে। তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করে দিন নাহলে পেসেন্টকে বাঁচানো সম্ভব না।

নার্সের কথা শুনে পুরো দুনিয়া থমকে যায় রাহনাফ। হাতদুটি আলগা হয়ে আসে তার। গড়ানো গলায় বলে,

– আপনারা রক্তের ব্যবস্থা করে দিন। আমি কোথায় পাবো রক্ত।

– আমাদের কাছে যেটুকু ছিলো সেটা দেওয়া হয়েছে। আপনি রক্তের ব্যবস্থা করুন আমরাও চেষ্টা করছি। কথাগুলো বলেই চলে যায় নার্স। নার্স চলে যেতেই ঠাস করে বসে পরে রাহনাফ। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ওকে শক্ত থাকতে হবে। ধর্য ধরতে হবে। আল্লাহ ধৈর্যধারণলারীকে কখনো নিরাশ করেন না।

অর্থাৎ “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন।” (সূরা বাকারাহ ১৫৩ আয়াত)

পরক্ষনেই মনে রাহির কথা। রাহি আর মেহেরের রক্তের গ্রুপ এক। সেদিন মেহের নিজের অজান্তেই রাহিকে রক্ত দিয়েছিলো। রাহি তো এখন মেহেরকে পছন্দ করে। সে মেহেরকে রক্তদিতে কিছুতেই অমত করবে না। উহঃ মেহেরের বাড়িতেও কাউকে ঘটনাটা জানানো হয়নি। কাকে জানানো আন্টি! না, আন্টি এমনিতেই অসুস্থ। মেহেরের এই অবস্থার কথা জানলে সে আরো ভেঙে পরবে। তার থেকে বরং আলিহানকে জানানো হোক। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। রাহনাফ আলিহান আর রাহিকে কল করে মেহেরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা জানায় আর ওদের তাড়াতাড়ি হসপিটালে আসতে বলে।

৩৫,
গায়ের কোটটা কাঁধে ঝুলিয়ে হেলতে দুলতে বাসায় ফিরে যায় সৈদয় নওশাদ। কেঁদেকেঁদে চক্ষুদ্বয় লাল করে ফেলেছেন তিনি। মেহেরের এই অবস্থাতেও মেহেরের পাশে থাকতে পারছেন না তিনি। তা মতো অভাগা পিতা দুনিয়াতে আর কে আছে। মেয়ের বিপদেও পাশে দাঁড়াতে পারছে না। অবশ্য এর জন্যে সে নিজেই দায়ী। আজ তার মনে হচ্ছে সেদিন বিয়েটা না করে মাহবুবার পাশে দাঁড়ালেই হয়তো ভালো করতেন। আজ অন্ততপক্ষে তার সুখের একটা সংসার হতো। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে নিজের রুমের দিকেই যাচ্ছে সে। উৎফুল্ল কন্ঠে স্ত্রীর কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায় সে।

চলবে,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here