একদিন তুমিও ভালোবাসবে ❤️পর্ব-১৩

0
11797

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৩||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

এরপর থেকেই কদিনের মধ্যে অঙ্কিতের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ও আদিত্যের বয়সই। দুজনেই MBA করছে। বাট ওকে আপনি বলা বারণ আর দাদা বলাও। যাই, এইবার জানতে হবে শত্রুতা টা ঠিক কি কারণে। আমি ফ্রেশ হয়ে হলে এলাম দেখলাম অঙ্কিত বসে আছে একা হলরুমের সিটে, সবাই চলে গেছে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসতেই ও তাকালো আমার দিকে হেসে….আমার হাতটা ধরলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপসেট?’

‘নাহ। আমরা মানে আমি আর আদিত্য ইউনিভার্সিটিতে আসার শুরুতেই ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম কিন্তু যে যার মতো। আদিত্য আর আমার আগে থেকে কোনো পরিচয় ছিলো না কিন্তু ইউনিয়নে ঢোকার পর আলাপ ভালোই হয়েছিলো। সব ঠিক ছিলো কিন্তু তারপরেই জিয়া আসে ভার্সিটিতে। তোর কিছুদিন আগেই ভর্তি হয়েছিল জিয়া, বলতে পারিস সবার প্রথম তখনও আদিত্যের সাথে রিলেশনটা আমার ভালোই ছিলো কিন্তু তারপর…

‘তারপর? তারপর কি এমন হলো যে তোমরা একে অপরের শত্রু হয়ে গেলে?’

‘শত্রু ঠিক নয়। আসলে জিয়া আসতে না আসতেই একপ্রকার উৎপাত শুরু করে। ওর যাকে ইচ্ছা তাকেই বিরক্ত করতে থাকে, অপমান করতে থাকে। এটা আমার ঠিক লাগে না কারণ জিয়া নিজে ফ্রেশার হয়ে অন্য একটা ফ্রেশারের সাথে এমন ব্যবহার করতে পারে না। ফ্রেশার কি বলছি? ও তো ওর থেকে যারা সিনিয়র তাদের সাথেও এরকম বিহেভ করতো শুধুমাত্র…

‘শুধুমাত্র আদিত্য ওনার বয়ফ্রেন্ড এই জন্য। তাই তো?’

অঙ্কিত আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো আর বললো,

‘একদিন আমি জিয়াকে কাজটা করতে বারণ করি বাট ও কথা শোনেনা। সে সময় আদিত্য এলে আমি মনে করি আদিত্য আমাকে সাপোর্ট করবে কিন্তু নাহ, ও বললো “তোর এ বিষয়ে কথা না বলাটাই বেটার অঙ্কিত।” সেদিন থেকেই আমি ওকে পরিষ্কার জানিয়ে দেই যে আমার গ্রূপ আলাদা আর ওর গ্রূপ আলাদা। ব্যাস, তারপর থেকেই আমাদের মধ্যে আর কথা হয় না।’

‘তুমি জানো জিয়ার পরিচয়?’

‘হ্যাঁ। বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে জিয়া। শুধু টাকা ভালোবাসে, যে ছেলের টাকা আছে সেই ছেলের সাথেই ও আটকে যায়। আজ যদি আদিত্যের থেকে কোনো বড়লোক ছেলেকে পায় তাহলে আদিত্যকে ভুলতে দু-মিনিট লাগবে না। আর ওর বাবা? ওর বাবা আর কদিনের মধ্যেই হয়তো ভার্সিটির ডিরেক্টর হয়ে যাবেন। তাই তো এতো বাড়াবাড়ি করে। কেউ ওর কথা না মানলেই ও ইচ্ছে মতো স্টেপ নিতে পারে মিথ্যে বলে।’

‘আদিত্যের কোনো দোষ নেই, উনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন।’

‘হোয়াট? তুই এটা বলছিস? আনবিলিভিবেল। কি করে এটাকে সাপোর্ট করছিস তুই?’

আমি অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,

‘তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই দিলে একটু আগে। ভেবে দেখো।’

অঙ্কিত আমার কথা শুনে চুপ করে গেলো। একটু ভাবার পরেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘কোয়েলের সাথে কি করে পরিচয় হলো? তোমরা কি একে অপরকে আগে থেকে চেনো?’

অঙ্কিত চুপ করে গেলো আমার প্রশ্নে। হয়তো বলতে চায় না তাই আমি উঠে চলে আসব ভাবলাম। কিন্তু যেই না উঠতে যাবো অঙ্কিত আমার হাতের উপর হাত রেখে বললো,

‘আসলে আমরা সবাই এক স্কুলে ছিলাম। আমরা মানে জিয়া, কোয়েল, আদিত্য, আমি আর…

‘সবাই হল থেকে তো কি ভার্সিটি থেকেও বেরিয়ে গেছে। আপনারা কখন বেড়াবেন সেটা কি বলা যাবে?’

অঙ্কিতের কথার মাঝখানে পিছন থেকে একটা গলার স্বর পেলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম আদিত্য আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। ওনার নজর আমাদের হাতের দিকে এটা দেখতেই আমি হাত সরিয়ে নিলাম অঙ্কিতের হাতের থেকে। আমরা উঠে দাঁড়ালাম যখন আদিত্য আমাদের সামনে এসে দু-হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়ালেন।

‘তুই যা আমরা ঠিক বেরিয়ে যাবো।’

‘হ্যাঁ আমি জানি তোরা ঠিক বেরিয়ে যাবি। এখানে রাত কাটাবি না।’

‘আদিত্য তুই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।’

আদিত্য অঙ্কিতের দিকে এক-পা এগিয়ে অঙ্কিতকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আচ্ছা? তো কি বাড়াবাড়ি করছি আমি?’

অঙ্কিত এগোতেই আমি ওদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে দু-হাত ওদের বুকে রেখে সরিয়ে দিলাম। আদিত্যের দিকে তাকাতেই উনি আমার হাতের দিকে তাকালেন তাই আমি হাত সরিয়ে অঙ্কিতের দিকে ঘুরে বললাম,

‘রাত হয়ে গেছে অনেক। চলো, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।’

আমি আর চোখে দেখলাম আদিত্যের চোখমুখ এখনও শক্ত। কি যে হয়েছে আজ ওনার বুঝতে পারছি না। কেন এরকম ব্যবহার করছেন উনি? আমি এগোতেই অঙ্কিত আমার হাত ধরে বললো,

‘আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো হস্টেল, চলো।’

কেন জানো বুকটা কেঁপে উঠলো আদিত্যের সামনে অঙ্কিতের হাত ধরায়। আমি আস্তে আস্তে আদিত্যর দিকে তাকালে দেখলাম উনি একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার আমাদের হাতের দিকে। আমি হাত ছাড়াবো তার আগেই অঙ্কিত আমাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো। আমি যাচ্ছিলাম ঠিকই কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে নয়, আদিত্যের দিকে তাকিয়ে। আলাদাই একটা ভয় কাজ করছে। মনে হচ্ছে বাজে কিছু একটা ঘটবে।

২৭.
‘কেন আদি কেন? কেন এতটা রিয়াক্ট করছিস তুই? তোর তো এতটা রিয়াক্ট করার কথাই নয়। তুই তো জীবনে কোনোদিনও কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবিসনি তাহলে আজ কেন? আজ কেন তোর এতটা অস্বস্তি হচ্ছে মৌমিতাকে অন্য একটা ছেলের সাথে দেখে। কেন মনে হচ্ছে মৌমিতাকে টেনে ওই ছেলেটার থেকে দূরে সরিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। হোয়াই আদি? হোয়াই?’

আদিত্য নিজের মনে মনে কথাটা ভেবেই সজোরে একটা ঘুষি মারলো ওর সামনে থাকা সিটের পিছনে। মৌমিতা আর অঙ্কিত বেরিয়ে যাওয়ার পর আদিত্য হলেই বসে পড়ে। আদিত্যের মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে এই মুহূর্তে। সে বুঝতে পারছে না তার সাথে কেন এমন হচ্ছে। হঠাৎ করে আদিত্য চোখ বুজতেই কিছুক্ষণ আগে অঙ্কিতের মৌমিতাকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আদিত্য ঝট করে চোখ খুলে ফেললো,

‘এই দৃশ্যটা দেখার পর আমার এমন কেন অনুভব হচ্ছে যেন কেউ আমার থেকে আমার অনেক মূল্যবান কিছু কেড়ে নিচ্ছে? কেন? ওই, ওই অঙ্কিতকে আমি দেখে নেবো। ওর সাহস কি করে হয় আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়ানোর। ড্যাম ইট!’

আদিত্য সিটে আবার একটা ঘুষি মেরে উঠে বেরিয়ে গেলো হল থেকে। রাগের মাথায় কি করছে, কি বলছে কিছুই জানে এখন সে। আদিত্যের সারা শরীরটা কেন জানো জ্বলে যাচ্ছে। এই কেনর উত্তরটাই সে খুঁজে পাচ্ছে না।

অন্যদিকে,

রাত ২টো,

কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সারা ঘরে পায়চারি করছি সমানে। ভীষণ ভাবে একটা অস্বস্তি কাজ করছে আমার মধ্যে। মনে হচ্ছে, কোনো একটা ভুল করে ফেলেছি কিন্তু কি ভুল? আমি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। পাশে তাকিয়ে দেখলাম কোয়েল ঘুমোচ্ছে, উঠে জানলার কাছে চলে গেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে আদিত্যের মুখটা ভেসে উঠলো যখন অঙ্কিত আমাকে টেনে নিয়ে আসছিলো। তার চোখে কোনো কিছু হারানোর কষ্ট, তার জিনিস কেড়ে নেওয়ার রাগ স্পষ্ট ছিলো। চোখ খুলে ফেললাম তাড়াতাড়ি।

‘হল থেকে আসার পর থেকেই এই দৃশ্যটা চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। কেন আমার এমন মনে হচ্ছে? উনি তো, উনি তো আমাকে স্ত্রী হিসেবেই মানেন না। তাহলে কেন এভাবে রাগ করছেন, অধিকার ফলাচ্ছেন? কেন ওনার চোখে মুখে কষ্টের ছাঁপ? উফ মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। আচ্ছা মনটা এতোটা অস্থির কেন করছে? কেন ওনাকে একটাবার দেখতে ইচ্ছে করছে?’

আমি আবার আমার বিছানায় গিয়ে বসলাম। চোখের জল আটকাতে পারছি না। আদিত্য! আপনি তো আমার সাথে ফুলশয্যার রাতে ওরকম ব্যবহারটা নাও করতে পারতেন? যদি ওমনটা না করতেন তাহলে আজ হয়তো আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। কেন আজ এমন ব্যবহার করছেন? যাতে আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন? কিন্তু এটা আর সম্ভব নয়। আপনার ধারণা নেই সেদিন রাতে আমি কতটা পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি তাও আপনাকে মেনে নিতাম যদি আপনি আমায় ওভাবে বিয়ের পরের দিন একা ফেলে না আসতেন, এখানে এসে আপনাকে জিয়ার সাথে না দেখতাম।

চোখের জল মুছে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ড্রয়ার থেকে ঘুমের ওষুধ বার করে একটা খেয়ে নিলাম। আর ভাবতে চাইনা আমি এসব নিয়ে, মুভ অন করতে চাই। বিছানায় শরীর এলাতেই চোখে ঘুম নেমে এলো।

সকালে,

আমি আর কোয়েল ভার্সিটিতে চলে এলাম। ভার্সিটিতে আসতেই সবাই আমাকে কংগ্রাচুলেট করতে থাকে কম্পিটিশন জেতার জন্য। আমি সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে, কোয়েলের সাথে ক্লাসে চলে যাই। ক্লাস শেষ করে বেরোতেই অঙ্কিত আসে, ওর সাথে আমরা গল্প করতে করতে এগোতে থাকি। গল্প করছি ঠিকই কিন্তু চোখ দুটো শুধু আদিত্যকে খুঁজছে।অন্যান্য দিন তো ঠিকই এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করেন, কোয়েলের সাথে কথা বলতে আসেন। তাহলে আজ কি হলো? কোথায় উনি?

‘কি রে? তুই হঠাৎ চুপ করে গেলি কেন?’

কোয়েল ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করতেই আমি হকচকিয়ে বললাম,

‘না, না। কিছু না। এমনি। আমি একটু আসছি।’

‘আরে কোথায় যাচ্ছিস? আজকে তো ম্যাডাম হোমওয়ার্কটা দেখে দেবেন। সবাইকে প্রেসেন্ট থাকতে বলেছেন।’

‘ওহ! হ্যাঁ। চল।’

ধুর, ভাবলাম একটু ওনাকে খুঁজবো। তা আর হলো না। ইশ আজ ক্লাস টা না থাকলে ভালো হতো। ক্লাসে এসেছি বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে, ম্যাম খাতা দেখছেন আর বকছেন ভুল হওয়ায়। আমার মন চাইছে বেরিয়ে যাই কিন্তু এখনও তো আমার খাতা দেখা শুরুই করেননি উনি। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে কোয়েল আমাকে ধাক্কা দিতেই টের পাই ম্যাম আমার নাম ডেকেছেন। আমি তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াই।

‘এসব কি মৌমিতা? এটা কিসের কপি তুমি সাবমিট করেছো? কম্পিটিশনে এতটাই মগ্ন ছিলে যে টেরই পাওনি কোন সাবজেক্ট এর কপি সাবমিট করেছো আমাকে? আবার ক্লাসেও তোমার মন নেই। বাহ! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার ক্লাস থেকে। আমি আজই কমপ্লেইন করবো প্রিন্সিপালের কাছে।’

‘ম্যাম আমি তো ঠিক কপিই…

‘শাট আপ! মুখে মুখে একদম তর্ক নয়। বেরিয়ে যাও বলছি।’

আমি অবাক হয়ে ভাবছি এসব কি করে হলো? আর চোখে দেখলাম জিয়া হাসছে। বুঝতে বাকি রইলো না কে কাজটা করেছে। আমি বেরোচ্ছি না দেখে ম্যাম আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরতে যাবেন এমন সময়……..

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]

আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here